গল্প:-♥ফুলশয্যা♥ পর্ব__ ০৪

0
4732

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥
পর্ব__ ০৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

আবিরের দু’চোখ গড়িয়ে যখন অশ্রু পরছে, নীলিমা তখন ওর বাবা-মাকে বকতে বকতে রুমে ঢুকছে। রুমে ঢুকে’ই নীলিমা আবির’কে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা চমকে যায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য যেই না পা বাড়ালো নীলিমা ওমনি আবির পেছন থেকে ডেকে উঠল_
“নী….লি..মা……”
নীলিমা থমকে দাঁড়ায়। আবির চোখের পানি মুছে নীলিমার সামনে যায়। তারপর__
“আমি চলে যাব। আজ এখনি চলে যাব। তার আগে তোমার কাছ থেকে আমার কিছু জানার আছে, বুঝার আছে…”
আবিরের কথা শুনে নীলিমা মাথা নিচু করে ফেলল। আবির আবারো বলা শুরু করল__
” বিশ্বাস করো নীলিমা! আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে গেলে আমি আর কখনো তোমার সামনে আসব না,কখনো না…”
নীলিমা চুপটি করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আবির আবারো বলছে__
” আমি তোমায় জোর করব না আমার সাথে যাওয়ার জন্য, আমি শুধু একটা কথায় জানতে চাই। আর সেটা হলো_
“আমি কি সত্যি’ই তোমার অযোগ্য?”
নীলিমা চুপ।
নীলিমা চুপ করে থেকো না।
তুমি যত তাড়াতাড়ি উত্তর দিবা, ততই তোমার ভালো। কারন, আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলে আমি চলে যাব তোমার বাড়ি থেকে। শুধু বাড়ি নয়, তোমার জীবন থেকেও। আর কখনো কোনো দাবি নিয়ে তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে না এই আবির।”

নীলিমা মুখ খুলে। কাঁপা কাঁপা স্বরে জবাব দেয়_
” জি, বলুন! কি জানতে চান?”
আবির আবারো বলে ঐ যে বললাম,
আমি কি সত্যি’ই তোমার অযোগ্য?
নীলিমা কাঁপা গলায় জবাব দেয়__
“আপনি অযোগ্য হতে যাবেন কেন?”
আবির:- নীলিমা! আমি প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন নয় উত্তর চাই….
নীলিমা:- বলছি….
বাইরে যাবেন???
আবির:- বাইরে? কোথায়???
নীলিমা:- আগে চলেন’ই না…
আবির:- তুমি বাইরে গিয়ে কথা বলতে চাচ্ছো???
ঠিক আছে, চলো….

নীলিমা আবিরকে নিয়ে যায় সবুজ মাঠের ভেতর দিয়ে দুরে কোথাও। আবিরও নীলিমার পিছু পিছু গ্রামের মেঠুপথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে।বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর নীলিমা থেমে যায়। একটা বিশালাকার আম গাছের নিচে গিয়ে নীলিমা দাঁড়ায়। আমগাছটা একটা বিরাট বড় পুকুরের সামনে গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে ওরা পুকুরের সামনে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে। কারো মুখে’ই যেন কোনো কথা নেই।শুধু ক্ষাণিক বাদে বাদে গাছের মগডাল থেকে ভেসে আসছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। দু’জনের মনেই এখন হাজারো কথারা এসে ভীড় করেছে, কিন্তু কেউ শুরু করতে পারছে না। মুখ খুলে প্রথম নীলিমা__
” জায়গা’টা বেশ দারুণ,তাই না?”
আবির:- হুম, ঠিক তোমার মতো….
নীলিমা:- মানে…..???
আবির:- সে কিছু না…
নীলিমা:- ওহ….
আবির:- তারপর…???
কেমন চলছে ডাক্তারি জীবন???
নীলিমা:- মন্দ না, ভালো’ই।
আচ্ছা, বাবা-মা, আদিবা আপু, দুলাভাই ওনারা কেমন আছেন???

আবির:- জানি না কেমন আছে। তবে বেঁচে আছে মনে হয়….
নীলিমা:- সে আবার কেমন কথা???
আবির:- মানে বাড়িতে যাওয়া হয় না ৮বছর ধরে। এই ৮বছরে ওদের খুঁজ নেওয়া হয়নি, শুধু সময় সময় আব্বুকেই কল দেওয়া হয়। যেহেতু ওদের সাথে কোনো কথা হয়না, তাই জানাও নেই ওরা কেমন আছে। বেঁচে আছে এই কারনে বললাম কারণ মরে গেলে এতদিনে ঠিক কারো না কারো মাধ্যমে খবর পেয়ে যেতাম। এবার বুঝেছ???
নীলিমা:- হুম….
,
আপনি না সত্যি’ই একটা রোবট।
আবির:- Sorry, কি বলছ???
নীলিমা:- এইভাবে এতটা বছর ধরে ওদের থেকে আলাদা আছেন, আপনার খারাপ লাগে না ওদের জন্য???
আবির:- না….
নীলিমা:- এই জন্য’ই আপনাকে রোবটের সাথে তুলনা করলাম…..
আবির:- হুম, রোবট’ই বটে।না হলে মানুষের দেওয়া এত আঘাত সয়ে যেতে পারতাম না…..

আবির একরকম খোঁচা দিয়ে’ই কথা’টা বলে। আবিরের কথা শুনে নীলিমা চুপ হয়ে যায়….

যায় হোক….
আমার প্রশ্নের উত্তর’টা কি আমি পাবো???
গম্ভীর ভাব নিয়ে আবির নীলিমার দিকে তাকালো…

নীলিমা আবিরের দিকে তাকিয়েও তাকাতে পারেনি অজানা কারনে। যার কারণে পুকুরের দিকে তাকিয়ে’ই জবাব দেই__
” আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। প্লিজ,এ ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন করে আমায় বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন না…”

নীলিমার কথা শুনে আবির নীলিমার দিকে চোখ তুলে তাকালো। তারপর__
” আমিও সেটাই চাই নীলি! আমি সব প্রশ্ন ভুলে যেতে চাই। তুমি শুধু প্লিজ আমার সাথে চলো। তুমি যদি এভাবে আমায় ফিরিয়ে দাও তাহলে আমি জীবনেও এ মুখ দেখাতে পারব না আমার বাবাকে। নীলি! আমি কখনো আমার বাবাকে এতটা খুশি দেখিনি, যতটা খুশি হতে দেখেছি বাবা যখন তোমার বাবাকে বলেছিল__
” আবির বিয়েটা করছে”।
নীলি! আমি আমার বাবার জন্য এই একটি কাজ ছাড়া কখনো কিছু করতে পারিনি, আর পারব কি না জানিও না। তাই বলছি__
নীলি! প্লিজ এমন করো না তুমি। চলো আমার সাথে…”

নীলিমা চুপ হয়ে আছে।
আবির নীলিমার কাছে গিয়ে হাত দুটো ধরল। তারপর__
“নীলি! প্লিজ একটা কিছু বলো। এভাবে চুপ করে থেকো না।”

নীলিমা হাত দুটো সারিয়ে নিয়ে বলল__
“তা কিছুতেই সম্ভব নয়..”

আবির:- নীলি! আমি বলছি না তোমায় আমার সাথে সংসার করতে হবে, তুমি শুধু মিছেমিছি আমার সাথে থাকবে। যাতে করে শেষ বয়সে এসে আমার বাবা না কষ্ট পেয়ে মরে। শুধু আমার নয় তোমার বাবা-মায়ের কথা’টাও একটু ভাবো….
,
নীলিমা:- ঠিক আছে।
আমি আপনাকে পরে জানাচ্ছি….আজকে রাতটা আমায় ভাবতে দিন।
আবির:- ঠিক আছে….

সেদিন সারা রাত ভেবে চিন্তে নীলিমা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে,
যায় হোক!
সে কখনো পারবে না ওর সিদ্ধান্ত থেকে লড়তে। নীলিমা আবিরকে জানিয়ে দেয় তার পক্ষে আবিরের ঘর করা সম্ভব নয়। আবির অনেক বুঝিয়ে শুনিয়েও নীলিমাকে ওর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারে নি। নীলিমা ওর সিদ্ধান্তে বড্ড পরিকর।

একবুক হাহাকার আর হতাশ মন নিয়ে আবির ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। ঢাকায় গিয়ে অনেক চেষ্টা করেছে নীলিমাকে ভুলার জন্য, কিন্তু পারে নি। যতবার’ই ভুলার চেষ্টা করেছে ততবার’ই নীলিমার মায়া মায়া মুখ’খানি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আবির না পারছে নীলিমাকে আপন করে কাছে পেতে, না পারছে নীলিমাকে ভুলে যেতে।
ভুলবে কি করে???
নীলিমা যে ওর প্রথম প্রেম,
প্রথম ভালোবাসা….
প্রথম ভালোবাসাকে কি কেউ কখনো ভুলতে পারে?
না…
কখনো না…
শত ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও আবির পারেনি একমুহূর্তের জন্য ওর নীলিমাকে ভুলে যেতে। এদিকে নিজেকে কন্ট্রোলও করতে পারছে না। আবিরকের ভেতরের প্রেমিক মন যেন সবসময় নীলি, নীলি করে চিৎকার করত। নীলিকে কাছে চাইত। বড্ড আপন করে কাছে পেতে চাইতো….
কিন্তু সেটা বোধ হয় উপরওয়ালা চাইনি। তাইতো এমন ভাবে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। মাঝে মাঝে’ই আবির ভাবে__
আচ্ছা আমি কি ওকে সত্যি’ই ভালোবাসতে পেরেছি??? নাকি কোথাও একটা কমতি আছে…?!!!
আচ্ছা, সত্যি’ই কি আমি ওর অযোগ্য নাকি কোথাও একটা ভুল হচ্ছে….
এমন হাজারো প্রশ্ন আবির নিজেকে নিজে’ই করে। কিন্তু কোনোটার সঠিক জবাব পায় না। এদিকে আবির ভার্সিটিতে ঠিক ভাবে স্টুডেন্টসদের পড়াতেও পারছে না। মানসিক শান্তির জন্য আবির চাকরীটা ছেড়ে দেওয়ার দরখাস্ত করে। আবিরের মত মেধাবী টিচার হাতছাড়া করতে চাইনি ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ।আবিরের দরখাস্ত মঞ্জুর না করে আবিরের সার্বিকদিক বিবেচনা করে আবিরকে ৬মাসের ছুটি দেয় ভার্সিটি থেকে। আবির দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা রুমে আবদ্ধ থাকায় কয়েকদিনের ভেতর আবির অসুস্থ্য হয়ে যায়। খবর পেয়ে ছুটে আসে নীলিমা….

দিন রাতে জেগে আবিরের সেবা এবং পরিচর্যা করে করে আবিরকে সুস্থ করে তুলে ডাক্তার নীলিমা। মাত্র ২মাসের ব্যবধানে আবির অনেকটা সুস্থ হয়ে যায়। আবির নীলিমাকে নরসিংদীতে চলে যেতে বলে, যেহেতু ওর হসপিটাল আছে। নীলিমার ভাষ্যমতে_
” আপনি এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হোন’নি। এই অবস্থায় আপনাকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর গেলেও বাবা-মা পাঠিয়ে দিবে এইখানে। আর হসপিটালের জন্য আমার সহকারী এবং দুইটা নার্স আছে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন…”

নীলিমার সাহচর্যে আবির আবার আগের মত হয়ে যায়। সুস্থ হয়ে উঠে। কিন্তু মনটা উত্তরোত্তর দুর্বল হতে থাকে নীলিমার প্রতি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব, আমাকে যে করে’ই হোক নীলিমার আড়ালে যেতে হবে। নিজের জন্য না হলেও নীলিমার সুখের জন্য ওর আড়ালে চলে যেতে হবে। দুরে চলে যেতে হবে, খুব দুরে….
যেখানে গেলে আমার ছায়াও নীলিমা দেখতে না পায়….

আবির নীলিমার থেকে দুরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আবির দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাওয়ার সব বন্দোবস্ত করে ফেলল। নীলিমার সামনে যাওয়ার সাহস আবিরের নেই, যদি দুর্বল হয়ে পরে সেই ভয়ে। আবির দুরে উড়াল দেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ওর পরিকে এসএমএস করবে। তার আগে আবিরের যেতে হবে মণির বাসায়। মণি নীলিমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ইন্টার এবং মেডিকেলে একই কলেজে ওরা একসাথে পড়ত। আবির যাচ্ছে তার’ই বাসায়। বিদেশে গিয়ে এই মণির মাধ্যমেই আবির ওর পরীর যাবতীয় খবরাখবর নিতে চায়।

দুপুর ২টার দিকে আবির গিয়ে পৌঁছায় মণিদের বাসায়…..

মণিদের বাসায় পৌঁছে’ই আবির প্রথমে নীলিমাকে বার্তা পাঠাই। বার্তা মারফত জানিয়ে দেয় সে দুরে কোথাও চলে যাচ্ছে। খুব দুরে। আর এও জানালো যে বাকি জীবনটা সে সেখানেই কাটিয়ে দিবে…

প্রিয় বান্ধবী নীলিমার হাজবেন্ড এসেছে, সেটা শুনে হসপিটাল থেকে ছুটে আসে ডাক্তার মণি। এসে সালাম ও কুশল বিনিময় করেই ব্যস্ত হয়ে পরে বান্ধবীর বরের জন্য কি রান্না করবে না করবে সেসবে। আবির মণিকে শত চেষ্টা করেও থামাতে পারেনি। বলতে পারেনি বোন! আমার হাতে সময় নেই। আমি আজ রাতের ফ্লাইটের বিদেশ চলে যাচ্ছি।
মণি যখন কাজের বুয়ার সাথে রান্না বান্নায় ব্যস্ত, মণির হাজবেন্ড তখন বাহির থেকে কলিংবেলে চাপ দেয়।
আবির গিয়ে দরজাটা খুলতে’ই চমকে যায়। আবিরের সাথে সাথে ইমনও চমকে যায়….
চমকে গিয়েও মুখে হাসি ফুটে উঠে ইমনের….
রুমে ঢুকতে ঢুকতে আবিরকে বলে_
” এতদিনে তবে আমি মামা হতে চলেছি??? তা কোথায় আমার বোন নীলিমা..???”

ইমনের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারেনি আবির। কি বলছে এসব? কিসের মামা? আর বোন?!!!
কোন নীলিমার কথা বলছেন ওনি? আর ওনি তো সেই ছেলে যে ছেলের সাথে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল নীলিমার। সেই ছেলে এখানে কেন?

এমন হাজারো প্রশ্ন আবিরের মনে এই মুহূর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।ইমন রুমে ঢুকেই সোফায় গা এলিয়ে দেয়। আবিরকেও বসতে বলে। আবির সোফায় বসলে ইমন বলা শুরু করে_
” আমি ইমন! ইঞ্জিনিয়ার ইমন। আমার আরেকটা পরিচয় আছে আর সেটা হলো আমি মণির হাজবেন্ড।”

আবির কিছু একটা বলতে যাবে তখনি ইমন বলে__
” নীলিমা মণির বান্ধবী। সেই হিসেবেই প্রথম ওর সাথে আমার পরিচয়। ওর বড় ভাই নেই। ও আমাকে তাই ভাইয়া বলেই ডাকত। আমিও ওকে বোনের মত স্নেহ করতাম। ও ওর যাবতীয় কিছু আমার আর মণির সাথে শেয়ার করত। একদিন ও ওর জীবনের গল্প আমায় শেয়ার করে। ওর গল্প শুনে আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। আমার ওয়াইফ তো সেদিন সারারাত প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর জন্য কেঁদেছে। যে কথাটি বলছিলাম….
সেদিন নীলিমার কষ্টের কথা শুনে ওকে বলেছিলাম,
কখনো যদি কোনো হেল্পের প্রয়োজন হয়, এই ভাইকে বলবি। এই ভাই জীবন দিয়ে হলেও তোর উপকার করার চেষ্টা করবে। একদিন নীলিমা আমায় কল দেয়। ওর নাকি খুব বিপদ তাই আমায় পার্কে যেতে বলে। আমি ছুটে যায় পার্কে। সেখানে গিয়ে যা শুনলাম তাতে আমি বাকরূদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। যাকে আমি নিজের বোনের মত স্নেহ করতাম সেই বোন আমায় বলেছিল__
” ওর প্রেমিক হয়ে অভিনয় করতে, ওর সাথে এমন ভাবে মিশতে যাতে ওর আবির ওকে ঘৃণা করে দুরে সরে যায়।”

আবির একথা শুনে লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে পরে। তারপর_
” অভিনয় মানে? কেন???
ও আমার সাথে কেন এমন করল? আর ওর থেকে দুরে সরাতেই বা কেন চাচ্ছিল?”

ইমন আবারো বলা শুরু করল__
ঢাকায় নিয়ে এসে ওর আবির নাকি ওকে একটা পার্টিতে নিয়ে গিয়েছিল। আবিরের বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে। সেখানে যাওয়ার পর ওর আবির সবার সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দেয়। আবির যখন ওকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কোথায় একটু গেছিল ঠিক তখনি আবিরের মানে আপনার কিছু বন্ধু বান্ধব নীলিমার পাশে এসে দাঁড়ায়।”

আবির:- তারপর???
ইমন:- তারপর ওদের মধ্যে একটা মেয়ে নীলিমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বলে, এই মেয়েকে আবির বিয়ে করেছে, যার হাসি দিলে দাত ছাড়া কিছুই দেখা যায় না??? কথাটা এমন ভাবে ব্যাঙ্গ করে বলে যে বাকি সবাই হু হু করে হেসে দেয়। হাসি থামিয়ে আরেকজন বলে__
আবির শেষ পর্যন্ত একটা কালিতারাকে বিয়ে করল???
আরেকজন বলল__
যে ছেলে একটা তুরি বাজালেই হাজারটা মেয়ে লাইন ধরত সে ছেলে কি না এমন গেয়োভূতকে বিয়ে করেছে?!!!!
জবাব আবির সাহেব, সেদিন আপনার একটা বন্ধ বলেছিল,
আরে বুঝিস না….
রাত্রে লাইট নিভালে তো সবই অন্ধকার। আবির কেবলমাত্র ওকে…….. (…….)…… করার জন্য’ই বিয়ে করেছে। আরেকজন বলেছিল_
ওর যদি এতই মেয়েদের নিয়ে রাত কাটানোর শখ ছিল তো আমাদের বলত। আমাদের কেন বলেনি??? আমার বললে তো হাইয়ার লেভেলের মেয়ে এনে দিতাম….
জনাব আবির সাহেব আপনি যার জন্মদিনের পার্টিতে গিয়েছিলেন তার জিএফ কি বলেছিল জানেন???
বলেছিল আপনি নাকি আপনার বাবার কথা রাখার জন্য বিয়েটা করেছেন। আপনি নাকি ওকে কখনো স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি, আর পারবেনও না। ঐ মেয়েটি এও বলেছিল স্ত্রী হিসেবে মেনে নেওয়া তো দুরের কথা আপনারা নাকি আজও অবধি আলাদা রুমে ঘুমান। আপনার আরেকটা বন্ধু খুব বাজে ভাষায় গালি দিয়ে বলেছিল__
” কিরে মেয়ে! তোর রেট কত?”

তারপর আপনি চলে আসাতে ওরা কথার টপিক চেঞ্জ করে ফেলে। আর আপনি ঐ সকল মানুষরূপি জানোয়ারদের সাথে হেসে কথা বলেছেন।

বোকা মেয়েটির সেদিন থেকে কান্নাই হলো নিত্যদিনের সঙ্গী। ও কেঁদে কেঁদেই এমবিবিএসটা শেষ করে। আর আপনার থেকে দুরে সরে যাওয়ার প্ল্যানটা সেদিন’ই করে।

আবির দাঁড়ানো থেকে বসে পরে। ইমনেরও গলাটা জমে আসে। মণি চায়ের ট্টে’টা সামনে এনে রেখে বলা শুরু করে__

” ভাইয়া জানেন?!!!
কালো’রাও মানুষ। ওদেরও মন আছে। আর সে মনে আছে ভালোবাসা। ওদেরও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে ভাইয়া। নীলিমা চাইত। খুব করে চাইত আপনাকে কাছে পেতে, ভালোবাসতে। জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। আপনি যখন রাত্রে ওকে ঘুমানোর কথা বলে শুয়ে পরতেন, তখন ও চোখ বোজে ঘুমানোর ভান করে থাকত। আপনি যখন ঘুমিয়ে পরতেন ঠিক তখনই ও চুপি চুপি ও আপনার রুমের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াতো। ও ঘুমাতো আপনার মুখ দেখে, আর ঘুম ভাঙলেও আপনার মুখটা দেখার জন্য জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াত। ভোরের আলোয় আপনাকে প্রথম দেখে ও ওর দিনটা শুরু করত। আর আপনার স্বপ্ন চোখে নিয়েই ও ঘুমিয়ে পরত। সেদিন আপনি যখন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ওর স্বপ্ন কি???
ও মনে মনে বলেছিল__
“আমার স্বপ্ন তো আপনি”
মুখে বলার সাহস পায়নি, কারণ ওর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ও কালো….”

আপনি যখন সেদিন ওর বাসায় গিয়েছিলেন ও খবর শুনে হসপিটাল থেকে ছুটে আসে খুশিতে আত্মহারা হয়ে। ইচ্ছে ছিল আপনাকে জড়িয়ে ধরতে, অভিমানী স্বরে বলতে__
এতদিন পরে এলে???”
কিন্তু পারেনি, কারণ ও কালো। সেদিন আপনি যখন বলেছিলেন ওকে ফিরে আসার জন্য ও যা খুশি হয়েছিল বলে বুঝানো যাবে না কিন্তু যখন বললেন আপনার বাবার জন্য আপনি ওকে এতবার রিকোয়েস্ট করতেছেন, তখন নিমিষেই ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল। আপনার সাথে আসবে না কথাটা ও সাথে সাথে বলে দিতে পারত, কিন্তু বলেনি। কারন_
ও চেয়েছিল আপনি একটা ওসিলায় ও বাড়িতে থাকুন। আর ও আপনাকে একটা রাতের জন্য কাছে পাক। একই রুমে হয়তো শুয়া হয়নি, কিন্তু ও মনকে শান্তনা দিয়েছিল একই ছাদের নিচেই তো আছি আমরা…”

আপনি চলে আসার সময় আপনার সামনে আসেনি, কারন সকাল থেকেই কেঁদে কেঁদে ওর চোখ লাল রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল। আপনার অসুস্থতার কথা ও ওর বাবা মা নয়, আপনার বাসার কাজের মেয়ের থেকে জেনেছিল। কারণ, ও কাজের মেয়ের সাথে প্রতিদিন মিনিমাম ঘন্টাখানেক কথা বলত শুধুমাত্র আপনার খুঁজ খবর নেওয়ার জন্য।
ভাইয়া! সাদা-কালো কোনো ফ্যাক্ট না। আসল কথা হলো মানুষের মনটা কেমন???

আমি এ ব্যপারে ১০০%গ্যারান্টি দিতে পারব, আমার বান্ধবী খাঁটি সোনা।
আর ওর মনটা ছোট শিশুদের মত নিষ্পাপ…..

ইমন:- এবার যখন ঢাকায় আসে তখন আমি বলছিলাম আপনাকে নিয়ে এখানে আসতে। ও বলল, আসলে সুখবর নিয়েই আসবে। আচ্ছা, সুখবর কি? আপনাদের মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে তো?!!!

আবির সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। পকেট থেকে পাসপোর্টের কাগজটা বের করে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে। মণি আর ইমনের দিকে তাকিয়ে বলে__
“বড় ভুল হয়ে গেছে। অনেক বড় ভুল…”
তারপর ব্যাগপত্র রেখে’ই একরকম দৌঁড়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। এদিকে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাসপোর্টের টুকরো দেখে মণির ভেতরটা আঁতকে উঠে। তবে কি নীলিমার কিছু হয়েছে???
ইমন- মণি একমুহূর্ত দেরী করল না। আবিরের রেখে যাওয়ার ব্যাগপত্র নিয়ে ওরাও রওয়ানা হয়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে।

এদিকে নীলিমা!!!!
ফোনে আবিরের বার্তা পেয়ে পাগলের মত হয়ে যায়। রুমের দরজা বন্ধ করে আবিরের রুমের দেয়ালে আবিরের যতগুলো ছবি আছে সবগুলো নামিয়ে ফেলে। সবগুলো ছবি একসাথে জড়ো করে সেগুলোকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল নীলিমা। একবার বুকে তো আরেকবার ফ্রেমে বন্দি আবিরের ছবি মুখের কাছে নিয়ে কাঁদতে থাকে নীলিমা।কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করে বলতে থাকে__
” আমি দুরে সরাতে চেয়েছি, এত দুরে তো যেতে বলিনি। আমি এখন কাকে নিয়ে থাকব? কার জন্য বাঁচব?”
কেঁদে কেঁদে একটা সময় নিস্তেজ হয়ে যায় সে।ফ্লোরেই ঐ অবস্থায় ঘুমিয়ে পরে নীলিমা।
এদিকে সে রাত্রেই বাসায় পৌঁছে আবির, মণি এবং ইমন।

রাত্রি ১২টা_
আবির ওর দরজায় এসে একের পর এক নক করতেছে। কিন্তু ওর নীলি আর দরজা খুলছে না। এদিকে মণি কল দিচ্ছে নীলির ফোনে। ফোনটাও রিসিভ করছে না। রীতিমত ভয় পেয়ে যায় সবাই। আবির তো কেঁদে অস্থির। নীলির কিছু হলো না তো???
এদিকে দরজা যে ভাঙবে তারও উপায় নেই। কারন দরজাটা স্টিলের, হাতের কাছে এমন কিছু নেই যা দিয়ে দরজা কাটবে। মণি বিরামহীন ভাবে একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে যায় নীলিমার। ফোনে আলো জ্বলে উঠতেই দেখে ৩০০মিসড কল। নীলিমা ঘুম চোখে কল বেক করে….
ওপাশ থেকে মণি উদ্ভীগ্ন কন্ঠে বলে__
” নীলিমা! দরজাটা খুল। কথা আছে। ইমন, আবির ভাইয়া সবাই দাঁড়িয়ে আছে।”

আবিরের নাম শুনে নীলিমার চোখ থেকে ঘুম লাফিয়ে দুরে সরে গেল।একমিনিট খুলছি বলে নীলিমা লাফিয়ে ফ্লোর থেকে উঠে। দরজা খুলতে গিয়েও খুলেনি। ফ্লোরে রাখা ছবিগুলো টানানোর জন্য উঠে পরে লেগে যায় নীলিমা। লাফিয়ে একবার ফ্লোরে আরেকবার ফ্লোর থেকে ছবি নিয়ে খাটে উঠে সেগুলো দেয়ালে টানাতে শুরু করে। এদিকে আবির দরজায় একের পর এক নক করতেই থাকে। ১০মিনিট পর দরজা খুলে নীলিমা। আবিরসহ সবাই রুমে প্রবেশ করে। রুমে প্রবেশ করে আবিরের চক্ষু চরকগাছ……..

সকালেও তো রুমটা সাজানো গোছানো ছিল, একদিনের ব্যবধানে কি করে হলো এসব???

মণি এবং ইমন দুজনেই নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলল__
” ইয়া ছি! তোর এই অবস্থা কেন? শাড়ি, চুল এমন এলোমেলো কেন? আর রুমে এত ধূলোবালি…..রুম কি গুছাস না???পঁচা মেয়ে….”

ইমন বিছানায় বসতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরল। ধুলোয় চাদর কচকচ করতেছে__
” নীলিমা! তুই না নোংরা পছন্দ করিস না বোন?!!! তো এসব কি??? বিছানায় বসা যাচ্ছে না কেন????”

আবির ইমন আর মণিকে সোফায় বসতে বলল।ওরা সোফায় বসতে গিয়ে লাফিয়ে উঠল। আবির কি হলো জিজ্ঞেস করতেই মণি জবাব দেয়__
” সোফায় জুতা কে রেখেছে?”

আবির বিছানা ঠিক করার জন্য বারান্দা থেকে বিছানা পরিষ্কার করার ঝাড়ু আনতে গিয়ে বারান্দায় ওর একটা ছবি আবিষ্কার করে। ছবিটা হাতে নিয়ে রুমে ঢুকে আবির বলে__
” আমাদের বিয়ের যে ছবি আলমারির ভেতর ছিল, সে ছবি বারান্দায় গেল কিভাবে? ছবিরও কি পা আছে নাকি?”

মণি:- ভাইয়া! ঐ যে খাটের নিচে দেখেন আপনার ল্যাপটপ। ল্যাপটপেরও কি পা আছে???

ইমন:- চায়ের কাপ পরে আছে টেবিলের নিচে। টেবিলও কি আজকাল চা খায়?????

আবির:- মণি! সিসিটিভির ফুটেজটা অন করে দেখো তো আজকে কয়টায় ভূমিকম্প হয়েছিল? আর ঠিক কয়মিনিটের জন্য….???

কথাটা বলে আবির নীলিমার দিকে তাকাই।নীলিমাও তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে……

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে