গল্প:-♥ফুলশয্যা♥ পর্ব_ ০৩

0
4924

গল্প:-♥ফুলশয্যা♥
পর্ব_ ০৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

নীলিমার কাজের মেয়ের দিকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কাজের মেয়ে বুঝে যায়। আর তাই কাজের মেয়ে বিনীত ভঙ্গিতে করুণ চাহনিতে চোখের ভাষায় নীলিমাকে বুঝিয়ে দেয়_
” স্যরি, ভাবি! আমায় মাফ করো… আমি পারলাম না প্রতিবারের মতো কথা লুকাতে, পারলাম না তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে…”
কাজের মেয়ের চোখের ভাষা বুঝে গিয়ে নীলিমা আমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো। আমি পূর্বের ন্যায় ওর দিকে জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। ও যেন বুঝে উঠতে পারছিল না কি করবে, এদিকে আমি একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছি। সবশেষে ও__
” চলে এলেন যে? কোনো সমস্যা? মা দেখেছেন? দাঁড়ান আমি বলে আসছি..”
একটানা কথাগুলো বলে নীলি আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছিল রুম থেকে, ঠিক তখন’ই আমি ওর হাত’টা ধরে ফেলি। কোথাও যাবে না তুমি। আমার কথার উত্তর না দিয়ে কোথাও যেতে পারবে না। নীলিকে টেনে আমার বুকের খুব কাছে এনে কথাগুলো বললাম।এদিকে এ দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না কাজের মেয়ে। লজ্জায় চোখ ঢেকে সেখান থেকে চলে যায় সে। আমি নীলিকে কাছে টেনে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছি আর নীলি আমার মুখের দিকের মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ যা বলছি তার একটাও ওর কানে ঢুকেনি। ওর চোখে চোখ পরতেই বন্ধ হয়ে যায় আমার কথা।
তাকিয়ে থাকি আমি আমার মায়াপরিটার দিকে। কি অদ্ভুত এক মায়াভরা মুখ, যে মুখে তাকালে রাজ্যের ক্লান্তি দুর হয়ে যায়।
বেশকিছু ক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার পর নীলি চোখ’টা ফিরিয়ে নেয় আমার থেকে। নিচের দিকে তাকিয়ে বলে__
” ছাড়েন…..”
আমি নীলির হাত’টা ছেড়ে দিলাম। নীলি দৌঁড়ে রুম থেকে চলে গেল। দুপুরে সবাই খাবার টেবিলে বসে আছি। কাজের মেয়ের সাথে নীলিও খাবার দিচ্ছে আমাদের সবাইকে। আপু সবার সাথে নীলিকেও খেতে বসতে বললে আম্মু নীলির আগে আগে জবাব দেয়__
” ও খেয়েছে একটু আগে। ওর মনে হয় খিদে নাই। ও না হয় পরে খাবে। তোরা খেয়ে নে…”
সকালের ঘটনায় মায়ের উপর ভিষণ রেগে ছিলাম আমি। কেন যেন মনে হচ্ছে নীলি খায়নি। আর কাজের মেয়ে যা বলছে তা যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে নীলি সত্যি’ই খায়নি। আর খেলেও সবার পরে খায়। ঐ যে সবার পরের যে উচ্ছিষ্ট’টুকু থাকে কুকুর বিড়ালের জন্য, সেটুকু খেতে দেওয়া হয় ওকে। আর তাই আমি বলে উঠি_
” নীলি খেয়েছে কিনা সেটা’তো নীলির থেকে বেশী তুমি’ই ভালো জানো, তাই না মা? আর জানবে’ই তো। কারন খাবার শেষের উচ্ছিষ্ট খাবার বেছে বেছে তুমি’ই তো জমা করো।কখন খাওয়া হবে সবার, আর কখন তোমার বৌমা আই মমিন এ বাড়ির কুকুরকে দিবে, তাই না???”

কথা শুনে মা আমার দিকে চমকে তাকালো। মায়ের সাথে উপস্থিত সকলে অবাক বিস্ময়ে তাকালো।
– আদিবা আপু আমায় ধমকের স্বরে বলে__
” এসব কি বলছিস আবির?”
আব্বু আমায় বলে__
“এসব কি বলছিস আবির? নীলিমা এ বাড়ির বউ, ওকে কেন উচ্ছিষ্ট খাবার দিবে তোর মা?”
আমার দুলাভাই বলে__
” আবির! ওনি তোমার মা হয়। মায়ের সাথে এভাবে কথা বলতে নেই..”

আপু! আমি ভুল কিছু বলিনি। আমার এই মা নীলিমার সাথে দিনকে দিন বাজে ব্যবহার করে আসছে। এমন বাজে ব্যবহার যা আমার মুখ দিয়ে এই মুহূর্তে আসবে না। এটুকু বলে আমি কেঁদে দিলাম।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি বলছিস কি তুই আবির? তোর মা…(……)…???
হ্যাঁ, বাবা! আমি সব ঠিক বলছি। আমার মা….(….)…
নীলি আমার থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলল, চুপ করেন।হাত জোর করছি আপনার কাছে, প্লিজ চুপ করুন। আব্বা!
আপু আপনারা ওকে চুপ করতে বলেন। ওনার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে, তাই মায়ের বিরুদ্ধে এসব বলতে একবারও বিবেকে বাধছে না ওনার। নীলির কথা শুনে মা কান্না করা শুরু করে, আর আমার রাগ চরমে উঠে যায়। আমি_
” চুপ! একদম কাঁদবে না তুমি মা। আর নীলি! মিথ্যে আমি নই, মিথ্যে তুমি/তোমরা আমাকে বলছ। দিনের পর না খেয়ে, মায়ের সব নির্যাতন মুখ বোজে হজম করে আমাকে বলে এসেছ, মা নাকি তোমাকে অনেক আদর করেন… এতটাই আদর করেন যার নমুনা না দেখালে’ই নয়। আমি চেয়ার থেকে উঠে নীলির কাছে গিয়ে আঁচল’টা টান দিয়ে সরিয়ে ফেলি।
তারপর নীলির পিঠটা ওদের দিকে দিয়ে সবাইকে বলি__
” এই হলো সেই আদরের চিহ্ন, তার নমুনা।”

সবাই চমকে উঠে নীলির পিঠের দিকে তাকালো। আমার মা লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে পরল। আমি মনে মনে__
” ক্ষমা করো মা! আজকে এসব কথা না বললেই নয়”
আমার আপ-দুুলাভাই-আব্বু বসা থেকে উঠে পরল। আপু আমার দিকে তাকিয়ে বলল__
” আবির! এসব কিভাবে হয়েছে ওর? কিভাবে এতটা পুড়ল???”
আব্বুও ঠিক এক’ই প্রশ্ন করল। আমি কাজের মেয়ের দিকে তাকালাম। কাজের মেয়ে পূর্ব থেকে’ই প্রস্তুত ছিল কথা বলার জন্য। কারন ওকে আশ্বাস দিয়েছিলাম চাকরী চলে গেলেও ওকে আপুর বাসায় কাজে দিয়ে দিব। কাজের মেয়ে অকপটে নীলির সাথে করে আসা দূর্ব্যবহারের বর্ননা দিয়ে গেল। সব শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে যায়।
বাবা একটা কথাও বলেনি। জলে ছলছল চোখ নিয়ে চলে যায় খাবার টেবিল ছেড়ে….
আপু:- ছি! মা তুমি?!!!
এতটা নিচে নেমে গেছ???
আমি জাস্ট বিশ্বাসও করতে পারছি না আমার মা…(…)…!!!
আদিবাও চলে গেল। আদিবার পিছু পিছু আমিও নীলিমাকে নিয়ে রুমে চলে গেলাম। আমাদের লক্ষ্য ক দুলাভাইও চলল। আমরা রুমে ঢুকার একটু পরেই দুলাভাই রুমে ঢুকল। নীলি তখন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদছে, একটু আগে’ই ওকে ধমক দিয়েছি, মার হয়ে ওকালতি করতে আসছিল, তাই ধমক দিয়ে দিয়েছি। ধমক দেওয়ার পর থেকে’ই কাঁদছে। অকস্মাৎ দুলাভাই রুমে আসে। এর একটু পর আদিবা আপুও। দুলাভাই রুমে প্রবেশ করেই আমার হাতে একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিয়ে বলে যেভাবেই হোক ঔষধগুলো আনতে, সবার আগে মলমটা আনতে। আমি প্রেসক্রিপশন হাতে পেয়ে ছুটে চললাম ফার্মেসির দিকে। কাছেই ফার্মেসিতে ঔষধগুলো পেয়ে যাওয়াতে বাইরে কোথাও যেতে হয়নি। ঔষধ নিয়ে রুমে ঢুকার সময় আব্বুও আমার সাথে রুমে ঢুকে। মলম’টা তখন’ই ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দেওয়া হয়। আব্বু আম্মুর কৃতকর্মের জন্য ভিষণ ভাবে লজ্জিত। আপু নিজেও আম্মুর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিল।

৩দিন পর সকাল বেলা__
আমি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছি নীলির বের হওয়ার অপেক্ষায়। আজ’ই নীলিকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাব। না, না! মামার বাসায় নয়। বাবা আমাদের জন্য একটা বড় এপার্টমেন্ট কিনে দিয়েছে। সেখানেই যাচ্ছি। সেখান থেকে’ই ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করব। আমি চাই না আর কোনো কালো ছায়া আমার নীলিকে স্পর্শ করুক, আর তাইতো ওকে নিয়ে যাচ্ছি সাথে করে। আমি যখন ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনছি ঠিক তখন’ই আম্মু এসে আমার পাশে বসল। আমি আমার মা’কে দেখে মুখ’টা বিপরীত পার্শ্বে ফিরিয়ে নিয়ে মায়ের থেকে একটু দুরে সরে বসলাম। আমার মা আমার আরো কাছে এসে বসল। তারপর আমার হাত দুটো ধরে বলল__
” বাবা! এভাবে রাগ করে যাসনে। আমি আর কখনো এমন করব না। প্লিজ ছুটির দিনটা এখানে কাটিয়ে যা, আর আমার ঘরের লক্ষ্মী’কে এখানে রেখে যায়। ও আজ থেকে আমার মেয়ে হয়ে থাকবে। ওকে আমি কলেজে ভর্তি করাবো। উচ্চ শিক্ষিত করব। মানুষ ওকে দেখে হিংসা করবে। ও সবার অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হবে। বাবা! প্লিজ তুই থেকে যা কয়টা দিন। আর বউমাকে রেখে যা।”
আমি মায়ের মুঠো থেকে হাতটা সরিয়ে নিলাম।তারপর__
” মা! তুমি ওকে পছন্দ করো না জানতাম, কিন্তু এত’টা ঘৃণা করো সেটা আমি বুঝতে পারিনি। আজ যখন বুঝতে পারলাম তখন কেন যেন মন সাই দিচ্ছে না ওকে এভাবে একা ফেলে যেতে এখানে। তাই আমি ওকে আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। Sorry, মা! আমাকে ক্ষমা করো। আমি পারলাম না তোমার এ কথা’টা রাখতে। আর একসেকেন্ডও সেখানে বসে থাকতে পারলাম না। দৌঁড়ে নীলির কাছে গিয়ে ওকে একরমক টেনে নিয়ে আসলাম। নিচে মা চাইবে ওর সাথে কথা বলতে তাই ওর হাত ধরে টেনেই ওকে বাইরে নিয়ে আসলাম। রওয়ানা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। রাত সাড়ে আট’টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বাবার দেওয়া ঠিকানায়। আমাদের নতুন বাসায়। কাজের লোক ৪টা সাথে করে’ই নিয়ে এসেছিলাম। একজন সার্বক্ষণিক নীলির দেখাশুনার জন্য আর ৩জন রান্না-বান্নাসহ বাসার যাবতীয় কাজকর্ম করার জন্য। সেরাত্রে বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে খেয়ে নিলাম। তারপর রুম গুছাতে গুছাতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেল। রাত ১২টার দিকে নীলিকে বললাম__
” সারাদিনে তো অনেক ধকল গিয়েছে। জার্নি করে এসেছ। তাই বলছিলাম কি আর বেশী রাত না জেগে ঘুমিয়ে পরাটাই ভালো হবে।তুমি ঘুমিয়ে পরো নীলি…”
_ নীলি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় ঘুমাবো আমি???
আমি হেসে বললাম, বোকা!
কোথায় ঘুমোবে সেটাও বলে দিতে হবে? ঘুমিয়ে পরো না সে রুম তোমার চয়েজ হয়…”
নীলি আবারো আমার দিকে তাকালো। তারপর__
” আপনি ঘুমাবেন না?”
আমি বললাম_
হুম, ঘুমাবো। তুমি শুয়ে পরলেই তোমার পাশের রুমে আমি ঘুমাবো….”
_ পাশের রুমে ঘুমাবেন মানে? আপনি আলাদা ঘুমোবেন?(নীলি)

আমি বললাম হ্যাঁ…
আমরা আলাদা রুমে’ই ঘুমাবো। তুমি-আমি সম্পূর্ণ আলাদা রুমে ঘুমাবো। আমার কথা শুনে নীলি আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মুখে না বললেও ওর মনে যে এই মুহূর্তে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটা আমি ওর মুখ দেখে’ই বুঝে গিয়েছিলাম।
যায় হোক।
ওকে সেসব কিছুই বুঝতে দিলাম না। দোতলার ছিমছাম গোছানো ছোট্ট একটা রুম পছন্দ করে ও। ও রুমে’ই ওকে শুইতে বলে সিড়ির অপর পাশের একটা রুমে আমি শুয়ে পরলাম।
পরদিন বিকেলে গল্প বলার চ্ছলেই জেনে নিলাম ও ছিল ভিষণ মেধাবী এবং স্বপ্নবিলাসী একটা মেয়ে।ওর ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওর বাবা-মায়ের মত অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে।তাদের দিকে সেবার হাত বাড়িয়ে দিতে। মানে নীলির ইচ্ছে ছিল ও একজন ডাক্তার হবে।
মনে মনে বললাম__
” তুমি শুধু তোমার স্বপ্ন পূরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকো নীলি! তোমার পাশে স্বয়ং আল্লাহ আছে।তুমি জয়ী হবে নিশ্চিত…”

সেদিন রাত্রে’ই আমি একটা কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে নীলির ভর্তির ব্যপারে কথা বলে রাখলাম। পরদিন ভোরে নীলিকে নিয়ে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। নরসিংদী নীলির বাসা থেকে নীলির স্কুলের সব কাগজপত্র নিয়ে একদিন থেকে তারপরের দিন ঢাকায় চলে আসলাম। ঢাকায় এসে একদিন পর ভর্তি করিয়ে দিলাম। ঢাকার একটা নামকরা কলেজে নীলিকে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিলাম। শুরু হলো নীলির কলেজ জীবন।
আমি প্রতিদিন নীলিকে বাবার গিফ্ট করা গাড়িতে করে কলেজে দিয়ে এবং নিয়ে আসতাম। আমার ভার্সিটির ছুটি শেষ হয়ে গেল। নীলিকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে আমি ভার্সিটিতে চলে যেতাম। ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে নীলির কলেজে গিয়ে নীলিকে নিয়ে আসতাম। কোনো কোনো সময় নীলি আমার জন্য কলেজ গেইটের সামনে অপেক্ষা করত। দিনে কলেজ আর রাত্রে পড়াশুনা। বেশ ভালো’ই চলছিল। নীলি বেশ মেধাবী ছাত্রি ছিল। পড়াশুনার ব্যাপারে ওর সাথে বেশী প্যাঁচাল পারতে হতো না ও নিজ দায়িত্বে ক্লাসের পড়াগুলো কমপ্লিট করত। ওকে আমি রুটিন তৈরি করে দিয়েছিলাম। ও সে রুটিন মাফিক পড়াশুনা করেও পার্টটাইম জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই পড়ত।দেখতে দেখতে নীলির এইচএসসি কমপ্লিট হয়ে যায়। এইচএসসিতে নীলি বিজ্ঞান শাখা থেকে গোল্ডেন জি.পি.এ পেয়ে উত্তীণ্ন হয়।

নীলি মেডিকেলে কলেজে ভর্তির জন্য পরিক্ষা দেয়। পুরো বাংলাদেশের মধ্যে আমার নীলি মেধাক্রমে ২য় স্থান অধিকার করে। নীলি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় চান্স পেয়ে যায় ঢাকা সরকারি মেডিকেল কলেজে। যে জায়গায় নীলির বান্ধবী ৫লক্ষ টাকা দিয়ে চান্স পায় ঠিক সে জায়গায় নীলি ভর্তি হয় ভর্তির ফি শুধু ১০হাজার টাকা দিয়ে। আমার শান্তশিষ্ট বউ’টা যে কিনা কারো সাথে মিশত না কিংবা কেউ যার সাথে মিশত না আজ তার অসংখ্য ফ্রেন্ডস। শুধু মেয়ে নয়, ওর রয়েছে অসংখ্য ছেলে ফ্রেন্ডও। নীলি পড়াশুনার পাশাপাশি ওদের সাথে আড্ডা দিত, কোনো কোনো সময় ওদের নিয়ে আমাদের বাসায়ও আসত। নীলি এখন আর আগের সেই গ্রাম্য মেয়েটি নেই। নীলি এখন ঢাকা শহরের একজন স্মার্ট মেয়ে। আজকাল নীলির সাথে কথায় পেরে উঠি না আমি। মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট বলে কথা…..

দেখতে দেখতে নীলির কোর্স প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যায়। ইন্টার্নি শেষ হলেই নীলি একজন সফল ডাক্তার। সেদিন রাত্রে খাবার টেবিলে নীলিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম__
” নীলি! পড়াশুনা তো প্রায় শেষের দিকে। তারপর? কি ভেবেছ???”

অকপটে নীলির জবাব__
আমার স্বপ্ন পূরণ করব।
আমি নীলিকে জিজ্ঞেস করলাম__
” তোমার স্বপ্ন? কি সেটা??”

নীলির জবাব__
“ছোট্ট থেকে দেখে আসা স্বপ্ন পূরণ করব। আমি গ্রামে একটা হসপিটাল খুলে সেখানে বসব গরিব ও অসহায়দের সেবা করার জন্য…. ”

– আর কিছু না???
~নীলি আমার দিকে তাকিয়ে বলে__
আর কি???
আমি বললাম__
” নাহ, মানে বুঝাচ্ছিলাম তোমার স্বপ্ন এটুকুই???”

নীলি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দিল__
” জি, আমার স্বপ্ন এটুকু’ই”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম- ওহ্!

দেখতে দেখতে ইন্টার্নিসহ নীলিমার কোর্স সম্পূর্ন হয়ে যায়। নীলিমা এখন একজন সফল ডাক্তার। নীলিমা ভোরে’ই ওর দেশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। রাত্রে খাওয়া শেষে নীলিমা যখন ওর জিনিসপত্র গোছাচ্ছে তখনি ওর রুমে প্রবেশ করলাম আমি__
” বাব্বাহ! জিনিসপত্র গোছানো শুরু করে দিয়েছ?”
নীলিমা ব্যাগে কাপড় ঢুকাতে ঢুকাতে বলল__
“হুম”….
-” গুড। সকালে কয়টাই রওয়ানা দিবা?”
আমার প্রশ্নের জবাবে নীলিমা জবাব দেয়_
” ৭টায়…”
আমি নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললাম__
” নীলিমা!সকাল ৭টায় যাওয়ার কি আছে? তুমি বরং একটু দেরিতে বের হও, এর ভিতর আমি ভার্সিটি থেকে একটা ক্লাস করে আসতে পারব।”
– জনাব আবির সাহেব! আপনাকে ধন্যবাদ এটুকু বলার জন্য। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আর নয়….”
– মানে? তুমি আমার সাথে যাবে না???
নীলিমা সিরিয়াস মুডে জবাব দেয়_
” না! আমি যাচ্ছি না….আমার একটা ফ্রেন্ড যাবে আমার সাথে আমার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে। আমি ওর সাথে’ই যাচ্ছি…”

তোমার ফ্রেন্ড মানে?কে সে?
আমার নীলি আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকালো। তারপর_
” আমার ফ্রেন্ড মানে ফ্রেন্ড। স্রেফ ফ্রেন্ড। আজব মানুষ তো আপনি! সবকিছুর কি জবাব আপনাকে দিতে হবে নাকি?”

নীলির এভাবে কথা বলা দেখে আমার বুকের ভেতর’টা হাহাকার করে উঠল। মুচড় দিয়ে উঠল। ৭বছরের বৈবাহিক জীবন আমাদের। এত বছরের বৈবাহিক জীবনে নীলির এমন ভাবে কথা বলা আগে কখনো শুনিনি। কিন্তু বিগত কয়েকটা মাস ধরে ও যেন কেমন হয়ে গেছে। আমার সাথে কথা বলে না। আমি কথা বলতে গেলে কেমন কেমন যেন করে। মুখ কালো করে উত্তর দেয়। তারউপর আজকে এমন ভাবে কথা বলার পর যেন নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারিনি। একরকম দৌঁড়ে চলে গেলাম রুম থেকে। পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙে হাসাহাসির আওয়াজে। ঘুম চোখে রুম থেকে বের হলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি ড্রয়িংরুমে নীলি আর ঐ ছেলেটি বসে আছে। যে ছেলেকে নিয়ে নীলি এর আগে একাধিকবার এই বাসায় এসেছে এমনকি ঘুরতেও গেছে।
আজও সেই ছেলে এই বাসায়। নীলি জোর করে ছেলেটির মুখে বিস্কুট তুলে দিচ্ছে, আর গল্প করছে। হাসাহাসিও হচ্ছে, হচ্ছে চোখাচোখি। আমি উপরে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য অবলোকন করছি। বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি এভাবে, নীলি আমায় দেখে ফেলে। আমি নিচে নামলাম। নীলি ওর ছেলে বন্ধুর সাথে আমায় পরিচয় করিয়ে দেয় এইভাবে_
” ইমন! এ আমার বন্ধু আবির। এখানকার একটা ছোট্ট ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন…আর আবির সাহেব! এ আমার বন্ধু ইমন।এবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া কমপ্লিট করে এখানকার সেরা নামকরা কোম্পানিতে এমডি হিসেবে জয়েন করেছে….

নীলি পরিচয় পর্বের মধ্যেই আমায় অদ্ভুতরকম ভাবে ছোট করেছে। তারপরও আমি হেসে হেসে নীলির ঐ ছেলে বন্ধুর সাথে হেসে করমর্দন করলাম। নীলি রওয়ানা দেয় ওর ছেলে বন্ধুর সাথে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে আর আমি হতভাগা দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখছি।

আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার পরি উড়ে যায় দুর অজানায় সুখের উদ্দেশ্যে। আর আমি চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে আমার পরির জন্য দোয়া করলাম__
” হে আল্লাহ! তুমি আমার পরিটাকে সুখে রেখো…শান্তিতে রেখো…
কোনো কষ্ট যেন ওকে স্পর্শ না করে….”

আমার গল্প এখানে’ই সমাপ্ত……

এটুকু লিখে আবির অফলাইনে চলে যায়। আর কখনো আবিরকে অনলাইনে পাওয়া যায়নি। এরপর আবির আর কখনো ওর পরিকে নিয়ে কিছু লিখেনি। আবিরের নামের পাশের সবুজ দাগটাও আর কখনো দেখেনি কোনো পাঠক।

লেখিকার কথা-
“সত্যি’ই কি গল্প এখানে সমাপ্ত???”
নাহ!!!
গল্প এখানে সমাপ্ত নয়। এরপর আবির গিয়েছিল নরসিংদীর সেই অজপাড়া গায়ে যেখানে আবির ওর নীলিকে প্রথম দেখেছিল। আবির ওখানে পা রাখার সাথে সাথে ঐখানকার ছেলে মেয়ে’রা ছুটাছুটি করতে থাকে নীলি আপুর জামাই এসেছে, জামাই এসেছে বলে।
আবিরের বাবা হাসি মুখে ওর বন্ধু পুত্রকে রুমে নিয়ে যায়। আবিরের মা হেসে জবাব দেয়-
“এতদিন পর মনে পরল তবে আমাদের কথা? আমরা তো ভাবছিলাম ভুলেই গেছ…”
আবির বলে__
” কি যে বলেন না!
বাবা মাকে কি কেউ ভুলতে পারে?!!!”

আবির আসার খবর শুনে নীলিমা হসপিটাল থেকে আসে। উঠোনে আসতে’ই শুনে ওর বাবা কার সাথে যেন বলছে_
” জামাই আইছে। রুমে বইয়্যা আছে। বাজার করতে অইব…”
নীলিমাকে দেখে ওর বাবা বলে__
” মা এসেছিস? রুমে যা। জামাই আইছে…”

আবির রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই….

এদিকে নীলিমা বিরক্ত গলায় উঁচু স্বরে জবাব দেয়_
“তোমরা এত জামাই, জামাই করো কেন সেটাই বুঝি না।”
নীলিমার মা রুম থেকে বের হতে হতে বলে__
” জামাইরে জামাই কইব না তো কি কইব?”
নীলি আরো জোরেশোরে বলে_
” মা-বাবা! তোমাদের আর কত বলব?!!! ওনি আমার বন্ধু, স্রেফ বন্ধু। আর কিচ্ছু না।”

মা:- কি বলছিস তুই এসব? তুই না আবিবের বিয়ে করা…. (….)….
নীলিমা:- বউ, এইতো?!!!
কিন্তু আমি মানি না এসব বিয়ে।
বাবা:- কি কস তুই এসব?
নীলিমা:- বাবা আমি ঠিক বলছি। ওনি আমার বন্ধু’ই শুধু। আর তাছাড়া ওনার বয়স আর আমার বয়সটা খেয়াল করেছ????
তাই বলছি, ওনার সাথে আমার যায় না।

নীলিমার কথা শুনে নীলিমার বাবা মা অবাক আর আবির?!!!
দুর থেকে’ই সবকিছু শুনে নিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিল…..

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে