গল্প:-♥ফুলশয্যা♥
পর্ব_ ০১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
আমি আবির।
মাহমুদুল হাসান ‘আবির’। পেশায় একজন শিক্ষক। ঢাকার কোনো এক স্বনামধন্য ভার্সিটির বাংলার প্রভাষক। বাবার ইচ্ছে লেখােড়া শেষ করে ওনার ব্যবসায়ে যোগ দিতে, কিন্তু বরাবরের মতই মুক্তমনা আমি কিছুতেই যেন মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বাবার ব্যবসায়ে জয়েন করতে পারি নি।ব্যবসায়ে ফাঁকি দিয়ে কাঁধে একটা গিটার নিয়ে বন্ধুদের অবাধে দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে বেড়াতাম। বাবা বোধ হয় বুঝে গিয়েছিল স্বাধীন ও মুক্তমননের অধিকারী এই আমি’কে কিছুতেই ব্যবসায়ের কাজে লাগানো যাবে না। আর সে জন্যই বাবা আমায় ঢাকায় মামার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। মামা যে ভার্সিটির সভাপতি সেই ভার্সিটিতেই বাংলার লেকচারার হিসেবে জয়েন করি। শুরু হয় আমার শিক্ষকতার জীবন। আজ ৫বছর অতিবাহিত হলো আমার শিক্ষকতার জীবনের।
সে বার পরিবারবর্গ সহ ২মামাকে নিয়ে যাচ্ছিলাম নরসিংদীর একটি ছোট্ট অজপাড়া গায়ে। যাকে নিয়ে কিংবা যার কথা শেয়ার করার জন্য এই লিখা সেই নীলিমার সাথে এই গ্রামেই প্রথম দেখা।
নীলিমা এ গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র। নীলিমা এ গল্পের নায়িকা। নীলিমার পদচারণা গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি।
নীলিমা পল্লীগাঁ’য়ের এক সহজ-সরল ও অত্যন্ত শান্তশিষ্ট একটি মেয়ে। পড়াশুনা এসএসসি পর্যন্ত’ই। এস.এস.এসি পাসের পর মেধাবী নীলিমার আর কলেজে ভর্তি হওয়া হয়নি। যদিও অন্য ৮/১০টা মেয়ের মত তারও দু’চোখ ভরা স্বপ্ন ছিল….
স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া করে অনেক বড় হওয়ার,
স্বপ্ন ছিল জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করার,
স্বপ্ন ছিল অসহায় বাবা-মায়ের মুখে জয়ের হাসি অঙ্কন করার,
স্বপ্ন ছিল ছোট্ট বোন’টিকে ঈদে নতুন জামা-জুতো আর স্নেহের ভাইটিকে একটা ল্যাপটপ কিনে দেয়ার।
নীলিমার স্বপ্ন কিন্তু খুব বেশী বড় ছিল না,
ওর স্বপ্নগুলো ছিল ছোট ছোট। তবুও সেসব কিছু’ই যেন নীলিমার করা হয়ে উঠেনি।
পাড়া প্রতিবেশীর নিন্দার আগুনে দগ্ধ হতে হতে একটা সময় নীলিমার লেখাপড়ায় ইতি টেনে দেয় নীলিমার গরিব ও অসহায় বাবা। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কলেজ প্রাঙ্গনে যেতে পারে নি নীলিমা। নীলিমার ছোট্ট থেকে দেখে আসা স্বপ্নগুলো একটু একটু করে ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায় নিন্দুকের কথার আঘাতে। নীলিমাকে জর্জরিত হতে হতো প্রতিনিয়ত, নিন্দুকের কথার আঘাতে।
,
নীলিমার অপরাধ__
নীলিমা কালো। নীলিমার গায়ের রং কালো, ভিষন রকম কালো….
তরুন শিক্ষক আবির এবং তার পরিবার আজ সেই বাড়িতেই যাচ্ছে। আবিরের বাবার বাল্যকালের বন্ধু ‘ছমির’….আর তারই মেয়ে নীলিমা। আবিরের বাবার ইচ্ছে বাল্যবন্ধু ছমিরের মেয়েকে ওনার পুত্রবধূ হিসেবে বাড়িতে তুলে নেওয়ার। প্রসঙ্গ আবিরের বাবা ঠিক তখন’ই তুলে যখন আবিরসহ ওর মামারা সবাই ঐ বাড়িতে রাতের খাবার খেয়ে নেয়।
আবিরের মা’তো অন্ধকার রাত্রেই হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পরে রাগে। আবিরের ছোট মামাও বোনের পক্ষ নিয়ে রাতের আঁধারে বেরিয়ে আসতে চায় বাড়ি থেকে। ওদের একটাই কথা আর সেটা হলো_
“এমন কালো মেয়েকে নিয়ে গেলে সোসাইটিতে মুখ দেখানো যাবে না।ওরা হাসাহাসি করবে।”
আবিরের বড় বোন আদিবার ভাষ্যমতে__
“মামা শুনো!
কালো’রাও মানুষ। ওরাও আমাদের মত এক’ই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। আর সবচেয়ে বড় সত্য হলো ওরাও আমাদের মতই এক আল্লাহর সৃষ্টি। তাই দয়া করে বন্ধ করেন বাজে কথা আর দেখেন আবির কি চাই? এ ব্যপারে ওর মতামত কি???
ঠিক তাই।
এই মুহূর্তে আবিরের মতামতটি নেওয়া সবচেয়ে জরুরী। তাই চলুন বন্ধুরা ঘুরে আসি আবিরের প্রোফাইল থেকে। দেখে আসি গল্পের নায়ক আবির কি বলে???
আবিরের ভাষ্য__
বাবা! মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে। আর আমি জানি, আমি এই মেয়েকে নিয়ে অনেক সুখী হবো যদি তোমার/তোমাদের সবার দোয়া থাকে। তাই আমি এই মেয়েকেই বিয়ে করতে চাই।
আমার কথা শুনে বাবা,মা আপু আর ডাক্তার দুলাভাই সবাই একসাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে।
ডিসেম্বরের তেইশ তারিখ আমি আমার ঘরের লক্ষ্মীকে নিয়ে বাসায় ফিরি। এইদিনেই ওকে আমি বিয়ে করি। বিয়েটা খুব সাদাসিধে ভাবেই হয়েছে। তার একমাত্র কারন আমার মা এবং এক মামার বিরোধ।
বিয়েটা সাদাসিধে ভাবে হলেও বাসর ঘর’টা সাজানো হয় আমার ইচ্ছে মত’ই। বাসর ঘরে প্রবেশ করে দেখি বউ আমার গুটিসুটি মেরে বিছানায় বসে আছে। আমাকে দেখে’ই খাট থেকে উঠে সালাম করে আবার খাটে গিয়ে বসল ইয়া লম্বা ঘোমটা দিয়ে।
মাথা থেকে পাগড়ীটা খুলে ধীরপায়ে হেঁটে গিয়ে আমি আমার সদ্য বিয়ে করা বউয়ের পাশে গিয়ে বসলাম।বেশ কিছুক্ষণ কাশি দেওয়ার পরও বউয়ের কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না।বউ আমার পূর্বের ন্যায় মাথায় আধহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। কি আর করার???
এভাবে বসে থাকলে যে পুরো রাত চলে যাবে। আর তাই কালবিলম্ব না করে আমি আমার বউয়ের একটা হাত আলতো করে ছুঁয়ে দিলাম।
মনে হচ্ছে নীলিমা আমার পরশে একটু কেঁপে উঠেছে কিন্তু তার বেশী কিছু নয়।আমার হাতের মুঠো থেকে হাত ছাড়ানোর কোনো চেষ্টা না করে ও বসে আছে। চুপটি করে আছে। ওর এই মৌনতা যেন আমায় জানান দিচ্ছিল ও সর্বপ্রকার পরাজয় স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমি তো এটা চাই না।
আমি চাই আমার বউ আমায় প্রথমে চিনুক, জানুক, ভালোবাসুক তারপর অন্যকিছু। কিন্তু ও কি না..???
– বিয়ের পর একজন স্বামী শুধু স্ত্রীর সাথে শারীরিক বন্ধনে নয়, ভালোবাসার বন্ধনেও আবদ্ধ হয়। কেবল শারীরিক সম্পর্ক নয়, বৈবাহিক সম্পর্কের আরেক নাম স্বামী-স্ত্রীর অপার প্রেমের এক বন্ধন। আর সেই বৈধ প্রেম’টা শুরু হয় ফুলশয্যার রাত থেকে’ই….
যায় হোক…
ফুলশয্যার রাত্রে আমি আমার বউকে প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলাম__
” নীলিমা! ফুলশয্যার রাত তো প্রতিটি মানুষের জীবনের একটি সর্বশ্রেষ্ঠ রাত, তাই না?”
– নীলিমা ঘোম’টার ভেতর থেকে মাথা নাড়ে। হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই বুঝিনি আমি। তবুও ওর এই মাথা নাড়ানো হ্যাঁ বোধক মনে করে ওর দিকে আরো একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। আর সেটা ছিল__
” তাহলে নিশ্চয় এ রাত সম্পর্কে তুমি জানো?”
নীলিমা এবারো মাথা নাড়লো। আমি নীলিমাকে উদ্দেশ্য করে বললাম__
“নীলিমা! আমি সাংকেতিক ভাষা বুঝিনা, তুমি যা বলার মুখে বলো। তুমি শুধু এটুকুই বলো এ রাত সম্পর্কে তুমি কিছু জানো কি না…???
নীলিমা এবার মুখ খুলল…
কাঁপা গলায় জবাব দিল_
” জি, জানি…”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম কি জানো???
ও লজ্জানত হয়ে নিচুগলায় বলল__
” ভাবিরা যা শিখিয়ে দিয়েছে।”
ওর দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম__
তা তোমার ভাবিরা কি শিখিয়ে দিয়েছে? আমায় কি বলা যাবে???
নীলিমা ক্ষাণিক’টা কেঁপে উঠল। তারপর নিচু স্বরে জবাব দিল_
” আপনি যা বলেন তাই করতে।”
_ আচ্ছা, তাই নাকি???
নীলিমা মাথা নেড়ে বলল হুম। আমি নীলিমাকে আবারো প্রশ্ন করলাম__
” আচ্ছা, আমি তোমাকে কি বলতে পারি???”
__ বউ আমার লজ্জায় বলল, জানিনা!
আমি দু’হাত দিয়ে বউয়ের ঘোমটা সরিয়ে বললাম-
“তোমার ভাবি এতকিছু শিখিয়ে দিল, তো এটা বলেনি আমি কি বলব/করব???”
লজ্জাবতী আমার লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে চুপসে গেল লজ্জাবতী পাতার মত’ই…..
চলবে……………