গল্প:- ♥ফুলশয্যা♥
পর্ব:- ০৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
আবির নীলিমার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। তারপর মণির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল_
” মণি! এখনো দাঁড়িয়ে আছ?
যাও…চালু করো।দেখি, সিসি টিভির ফুটেজ কি বলে….???”
মণি যাচ্ছি বলে হাসি চেপে এগিয়ে মিছেমিছি এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। হঠাৎ’ই পিছন থেকে ডাক দেয় নীলিমা। মণি পিছু ফিরে তাকায়। জিজ্ঞেস করে_
“কিছু বলবি?”
নীলিমা এক নিঃশ্বাসে এত্তগুলো কথা বলে ফেলে। নীলিমার ভাষ্যমতে__
” মণি!
আসলে কয়েকদিন যাবৎ লক্ষ্য করছিলাম রুমটা খুব অপরিষ্কার এবং নোংরা। তাই আজ যখন ওনি বাসা থেকে বের হয়ে গেল, ভাবলাম এই সুযোগে রুমটা পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। পরিষ্কার করার জন্য রুমের সব জিনিসপত্র একসাথে জরোও করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে ঘুম চলে আসে চোখে, সেই সাথে ক্লান্তিভাবটাও।তাই ভাবলাম একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক।কিন্তু এভাবে ঘুমিয়ে যাব যে বুঝতে পারিনি।
তোরা যখন ডাক দিলি, তখন’ই জাগলাম।”
মণি “থ” হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইমন মণির দিকে তাকিয়ে বলল_
” ব্যস! হয়ে গেল।
বোন আমার খাসা গল্প শুনিয়ে দিল।এরপর আর কষ্ট করে সিসি টিভির ফুটেজ চালু করার মানেই হয় না। কি বলেন আবির সাহেব?”
আবির-মণি দুজন তখন মুখ টিপে হাসছিল, ইমনের কথা শুনে আবির কোনোরকম হাসিটা চেপে উত্তর দিল__
“হ্যাঁ, সেটাই তো ইমন ভাই…”
ইমন:- তা মিসেস আবির!
আমাদের কি রাতভর এখানে এভাবেই দাঁড়িয়ে রাখবেন? কতদূর থেকে খুশির খবর শুনে এসেছি কয়েকদিন বেড়াবো বলে। বেড়ানোর স্বাদ যে প্রথম দিনেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।”
নীলিমা:- খুশির খবর?
সেটা আবার কি???
মণি:- ঐ যে ইমন মামা হতে চলেছে।
নীলিমা:- কি???
কার মামা???
কিসের মামা????
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মণি:- তুই এসব বুঝবি কিভাবে?
তুই তো ভেঁজা মাছটা উল্টে খেতেও জানিস না, থাক।
তোর বুঝে কাজ নেই। আবির ভাইয়া!
একটু এদিকে আসেন তো।
বজ্জাত মাইয়া তো কিছু বলবে না, আপনার থেকেই বরং শুনে নেই আপনাদের কাছে আসার ইতিহাস….!!!!☺☺☺
মণি-আবির-ইমন একসাথে রুমের বাহিরে চলে গেল।
নীলিমা কিছু বলতে যেয়েও পারল না। মণিকে রুমে রেখে তিনজন মিলে প্রায় মিনিট ত্রিশ হবে কিসব ফুসুর ফুসুর করল। তারপর একসঙ্গে রুমে প্রবেশ করল। নীলিমা ততক্ষণে রুমটা ঝাড়ু দিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। ওরা আসার সাথে সাথেই নীলিমা সোফার উপর ঝাড়ু রেখেই মণির কাছে ছুটে গেল। তারপর__
“মণি! শুন না..(…)….”
মণি:- চুপ, একদম চুপ!
আমি তোর কোনো কথায় শুনতে চাই না। যা শুনার শুনে নিয়েছি ভাইয়ার থেকে।
নীলিমা:- আমিও শুনাতে চাই না।
মণি:- তো..!!!??
এভাবে ডাকছিস কেন???
নীলিমা:- ওনি তোদের কি বলছেন?
মণি:- সেটা তোকে বলতে যাব কেন?
ওনি আমাদের বিশ্বাস করে বলছে।সবকিছু খুলে বলছে। তা তোকে শুনাবো কেন?????
নীলিমা:- সব মানে…???
ইমন:- সব মানে সব….
যা হয়ছে আর কি….(….)…..??
নীলিমা:- ???
আবির:- নীলিমা! ওরা অনেক দুর থেকে জার্নি করে এসেছে। ওদের আগে বসতে তো দাও। আর কি রান্না করছ? খেতে দাও। খুব খিদে পেয়েছে…..
নীলিমা:- ঠিক আছে…..
ভাইয়া-মণি চল….
ইমন মণি নীলিমার পিছু পিছু নীলিমার রুমে ঢুকল।নীলিমা ওদেরকে নিজ রুমে রেস্ট নিতে বলে রান্না করে প্রবেশ করল। চুলোয় ভাত বসিয়ে চটজলদি তরকারী কুটতে লাগল নীলিমা। আবিরের এভাবে ফিরে আসা সাথে ইমন-মণির আগমন, সুখবর কিছুই যেন নীলিমার মাথায় ঢুকছে না। আনমনে ভাবতে ভাবতে ধারালো ছুড়িটা কখন যে আঙ্গুলে বিধে যায় সেটা টের’ই পায়নি নীলিমা। যখন টের পায় তখন আঙ্গুল থেকে অনেকটা রক্ত ঝরে যায়। ব্যথায় কুকিয়ে উঠে নীলিমা। আহ্ করে চিৎকার দেয়।
পাশেই ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে ঢুকছিল আবির।
প্রাণপাখি নীলিমার চাপা কান্না তার বুকে শিলের মত বিধে। ছুটে আসে ওয়াশরুম থেকে রান্নাঘরে।
নীলিমা তখন কাটা আঙ্গুল ধরে কান্না করছিল। আবির নীলিমার কাটা আঙ্গুল দেখে শিউরে উঠে।ছুটে যায় নীলিমার কাছে। চোখের সামনে নীলিমার এমন করুণ অবস্থা সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছিল আবিরের। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আবির নীলিমার কাটা আঙ্গুলটা ধরে সেটা মুখে পুরে দেয়। শুষে নেয় নীলিমার আঙ্গুলের সবটা রক্ত। নীলিমা অবাক বিস্ময়ে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর আবির ছেড়ে দেয় নীলিমার হাত।
নীলিমা তখনও আবিরের দিকে সেভাবেই তাকিয়ে আছে।
আবির:- তোমাকে রান্না করতে কে বলছে???(জল ছলছল চোখে)
নীলিমা:- আসলে সকালে ছুটি দিয়ে দিছিলাম কাজের লোকদের। পরে আর রান্না করা হয়নি…
তাই ভাবছিলাম আমি’ই রান্না করি…
আবির:- মানে???
ছুটি দিয়েছ মানে? কিসের ছুটি দিয়েছ ওদের???
নীলিমা:- আপনি তো বিদেশ চলে যাবেন বলছেন, তাই… (…)….
আবির:- তাই আমার সাথে রাগ করে ওদের বিদায় করে দিয়েছ এই তো???
নীলিমা:- না, না…ঠিক তা না…
আমি তো…..(…)….
আবির:- ব্যস, এনাফ!
আর শুনতে চাই না। রুমে যাও….
নীলিমা:- কিন্তু….
আবির:- কোনো কিন্তু নাই।
তুমি রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। রান্না’টা আমি দেখছি।
নীলিমা:- আপনি…(….)…..
আবির:- বললাম না রুমে যেতে। এক কথা আর কতবার বলব???(ধমকের স্বরে)
নীলিমা:- যাচ্ছি….(কাপা স্বরে)
নীলিমা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শাঁড়িটা পাল্টে নিল। তারপর আবারো চলে আসল কিচেনে__
“আমি বলছিলাম কি আপনি তো…(…)….”
আবির:- তুমি আবারো এসেছ এখানে???তোমায় বলছি যে রুমে যাও সেটা কি তোমার কানে ঢুকেনি???
নীলিমা:- ঢুকছে।
আবার বেরও হয়ে গেছে।
আবির:- মানে???
নীলিমা:- মানে ওরা শুধু শুধু বসে আছে। আপনি গিয়ে বরং ওদের একটু সঙ্গ দেন আর মুড়ি-চানাচুর মেখে দিয়ে আসুন। আমি ততক্ষণে নুডলস রান্না করে ফেলি। মণি আবার নুডলস খুব পছন্দ করে।
আবির:- যা করার আমি করছি। তুমি বরং ওদেরকে গিয়ে মুড়ি চানাচুর মেখে দিয়ে আসো।
নীলিমা:- আমার হাত যে কেটে গেছে…..???
আবির:- ওহ্…স্যরি।
তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি ওদের দিয়ে আসছি মুড়ি…..
আবির চলে গেলে নীলিমা তাড়াতাড়ি নুডলসটা রান্না করে ফেলে। আবির এসে দেখে নুডলস রান্না কমপ্লিট। নোডলসের বাটিটা নিয়ে যায় আবির রুমে। দিয়ে আসে মণিকে। মণি ততক্ষণে এক তরকারী চুলা থেকে উঠিয়ে আরেক তরকারী বসিয়ে দেয় চুলায়। এদিকে ভাত হয়ে যাওয়াতে ঐ চুলায় চাও বসিয়ে দেয়।
আবির এসে চা চুলায় দেখে বলে__
” বাব্বাহ! চাও বসিয়ে দিয়েছ?”
নীলিমা:- হুম। মণি তো নুডলস খাবে, চা’টা ইমন ভাইয়ার জন্য…..
আবির:- ওহ্, ইমন ভাইয়ার জন্য? ???
আমি তো ভাবছিলাম আমার জন্য…. ????
নীলিমা:- ওহ্, আপনিও খাবেন?
দাঁড়ান দিচ্ছি….
আবির:- থাক…….???
আমি না হয় না’ই বা খেলাম…?
নীলিমা:- কেন??????
আবির:- এমনি….
দাও। চা দাও। দিয়ে আসি….
নীলিমা চায়ের কাপটা আবিরের হাতে ধরিয়ে দিলে আবির চা’টা দিয়ে আসে ইমনকে। দিয়ে আর একমুহূর্ত দেরী নয়। আবার চলে আসে কিচেনে। আজ কেন যেন একমুহূর্তের জন্যও আবিরের মন চাচ্ছে না নীলিমাকে চোখের আড়াল করতে। চা দিয়ে এসে কিচেনের দরজার সামনে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রাণের নীলিমাকে দেখছে। নীলিমা কি মনে করে যেন পিছু ফিরছিল। আবিরকে ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে “থ” হয়ে যায়। কিছুক্ষণ আবিরের দিকে তাকিয়ে থেকে লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিল নীলিমা। এলোমেলো শাঁড়ি দিয়ে শরীরটা ভালো করে তাড়াতাড়ি ঢেকে নেয় নীলিমা। তারপর__
” আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? কিছু লাগবে?”
আবির:- হুম…..
নীলিমা:- কি লাগবে?
আবির:- তোমাকে……???
নীলিমা:- কি???
আবির:- কিছু না। রান্না কতদুর???
নীলিমা:- এইতো প্রায় শেষের দিকে।
আপনি যান। আমি ৫মিনিটের ভিতর খাবার নিয়ে আসছি…..
আবির:- হেল্প করতে হবে???
নীলিমা :- না, আমি পারব…..
আবির:- ঠিক আছে। আসো তাহলে।আমি রুমে গেলাম…..
আবির রুমে চলে গেলে নীলিমা চুলা থেকে তরকারীর পাতিল উঠিয়ে চটজলদি কিচেন’টা গুছিয়ে নেয়। অতঃপর খাবার থরে বিথরে টেবিলে সাজিয়ে রেখে ইমন-মণিকে ডাকতে যায়। ইমন -মণি কিছুতেই খাবার খাওয়ার জন্য রাজি হচ্ছিল না, তথাপি নীলিমা একরকম জোর করে টেনে আনে ওদের। খাবার টেবিলে ওদের বসিয়ে ইচ্ছে মত নিয়ে খাওয়ার জন্য বলে আবিরকে ডাকার জন্য উপরে যায়। আবির তখন রুমের দরজা ক্ষাণিক’টা মিশিয়ে চেঞ্চ করছিল। নীলিমা ভাবল আবির হয়তো রুমে শুয়ে আছে তাই নক না করেই অকস্মাৎ রুমে প্রবেশ করে। অতঃপর নীলিমা ওর চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে।
আবির ড্রেস চেঞ্জ করে নীলিমার দিকে এগিয়ে আসে। তারপর_
” যা হবার তো হয়েই গেছে।
চোখ খুলুন ডাক্তার আপু……..”
নীলিমা ধীরে ধীরে চোখ খুলে।
লজ্জায় আবিরের দিকে তাকাতে পারছে না, তাই নিচের দিকে তাকিয়েই বলল_
” Sorry…..”
আবির:- কি হবে আর স্যরি বলে?
আমার তো সব শেষ হয়েই গেছে……???
নীলিমা:- আমি আসলে বুঝতে পারিনি আপনি রুমে এভাবে…(….)…..
আবির:- বাদ দাও তো।
চলো…..খাবো……
নীলিমা মাথা নিচু করে আবিরের পিছুপিছু রুম থেকে বের হলো। আবির খাবার টেবিলে বসতে বসতে ইমন-মণির দিকে তাকালো।তারপর__
” কি হলো? ভাইয়া বসে আছেন যে?”
ইমন:- বোন-ভগ্নিপতির বাড়ি আসছি। ওদের রেখে খাই কি করে?
আবির বসা থেকে উঠে মণি ইমনের প্লেটে খাবার দিল। তারপর নিজের প্লেটে খাবার নিয়ে বলল__
” নাও মণি!
এবার তোমরা খাওয়া শুরু করো।”
নীলিমা মাথা নিচু করে ডাইনিং টেবিলের বেশ ক্ষাণিক’টা দুরে দাঁড়িয়ে আছে।
মণি:- তোর আবার কি হলো???
এভাবে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন???
নীলিমা:-……..
ইমন:- নীলিমা! তুইও বসে পর…
রাত তো প্রায় শেষের দিকে….
আবির:- মণি…
কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে নাও। ভাইয়া ও আর কি খাবে???
ও তো খেয়ে নিয়েছে….
মণি:- সে কি?
কখন খেলো????
আবির:- এই তো একটু আগে রুমে।
মণি:- রুমে???
রুমে খাবার এলো কোথা থেকে???
রুমেও খাবার আছে???
আবির:- আছে…
স্পেশাল খাবার…….
মণি:- কিরে?
আমাদের রেখে স্পেশাল খাবার খেয়ে নিলি…???
তা স্পেশাল খাবারটা কি???
নীলিমা লজ্জায় পারছে না মাটির নিচে চলে যেতে।
ইমন:- আবির!
ও কি সত্যি’ই খেয়েছে নাকি তুমি মজা করতেছ???
আবির:- ভাইয়া মজা নয়।
ও খেয়েছে। কিভাবে বলব আপনাদের? ও খেয়েছে।
শুধু খায়নি। অনেক বেশী খেয়েছে। এতটাই বেশী খেয়েছে যে মিনিট দুয়েক চোখ বোজেও ছিল….
কি আমি কি মিথ্যে বলছি নীলিমা?
নীলিমা এতক্ষণে চোখ তুলে তাকায় আবিরের দিকে। আবির মুখ টিপে হাসছে তখন…….
চলবে….