গল্প সুখ পাখি পর্ব দুই

0
4130

গল্প সুখ পাখি পর্ব দুই
.
এটা বলেই রোদেলা ওর ব্যাগ থেকে একটা নীল খাম বের
করে ওটা আজমানের হাতে ধরিয়ে দিল। আজমান অপ্রস্তুতভাবে
বসে আছে এখনও। খামটা আজমানের হাতে দিয়েই রোদেলা
উঠে দাড়ালো, শুকনো একটা হাসি দিয়ে বললো,
: আমার বুবুর সুখ পাখি নাই।
রোদেলা হাটতে শুরু করেছে। একবারও পিছনে তাকায় নি সে।
আজমান রোদেলার চলে যাওয়া দেখছে। আজমানের কন্ঠটা
কেউ যেনো স্তব্ধ করে দিয়েছে তাই সে কিছু বলতে
চেয়েও কিছু বলতে পারছে না।
দেখতে দেখতেই চোখের আড়াল হয়ে গেলো
রোদেলা। কিন্তু আজমান এখনও শূন্য পথে তাকিয়ে আছে।
শুকনো চোখে তাকিয়ে আছে আজমান। ডান হাতে খুব শক্ত
করে ধরে আছে খামটা।
আজমান কাপা কাপা হাতে খামটা খুললো, খামের ভেতর একটা চিঠি।
কখনও আড়াই শো টাকা দামের পায়েল বুকে আকড়ে ধরে
একটা মেয়ে কতটা ব্যাকুল ভাবে কাদতে পারে তা হয়তো
বুবুকে না দেখে বুঝতে পারতাম না। প্রতি রাতে যখন দেখি বুবু
ফোনের স্কিনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তখন বুঝি অনুভুতি
আছে। বুবুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, বুবু এই ছবি গুলা কার? বুবু
মুচকি হাসি দিয়ে বলেছিলো, আমার সুখ পাখির।
আমাকে এই উত্তর দেয়ার প্রায় তিনবছর আগেই এই সুখ পাখিটা
বুবুর সব সুখ নিয়ে চলে গিয়েছিলা এটা আমার জানা ছিলো না। বুবু
সারা রাত কথা বলতো, ওর প্রথম প্রেমের গল্প বলতো,
ভালো লাগা খারাপ লাগা সবটা বলতো। মাঝে মাঝে খারাপ লাগা গুলা
বলতে গিয়ে,, অসহায়ের মতো কাদতো। বুবুর কান্না দেখে
আমিও কাদতে শুরু করে দিতাম। ফোলা চোখ গুলা নিয়ে বুবু
আরও একটা নতুন দিন অতিবাহিত করার প্রস্তুতি নিতো। আমি সকাল
বেলা হা করে তাকিয়ে ভাবতাম, রাতের বুবু আর সকালের বুবুর
মাঝে কতটা পার্থক্য।
বুবু ছোট থাকতে একবার ওর নানা বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো,
দুদিন সেখানে থাকার পর যখন বুবু ওর বাসায় ব্যাক করেছিলো,
তখন বুবু ওর বাবাকে বলেছিল, আব্বা তোমারে ছাড়া আমি থাকতারি
না। আমার পরাণ পুড়ছে। ঐ দিন বুবুর মা বলেছিলো, পরান কই
থাকে। বুবু ওর পেট দেখিয়ে বলেছিলো, আমার এই পেটেই
তো পরান আছে।
ঐ দিনের পর আর কখনও বুবু কোথায় বেড়াতে গিয়ে রাত থাকে
নি। বুবু ওর বাবাকে ছাড়া থাকতে পারতো না। কিন্তু আপনি কি জানেন
আজমান আহম্মদ? আমার বুবু প্রায় ৬ বছর ধরে ওর বাবার সাথে
দেখা করে না। কেন করে না আজমান আহম্মদ?
আমার বুবুর দোষটা কোথায় ছিলো একটু বলবেন? কেন
করেছিলেন এমনটা আপনি? আমার বুবু যখন আপনার দেয়া জিনিস
গুলা আকড়ে ধরে কাদতে শুরু করে, তখন মনে হয় আপনাকে
আমি খুন করে ফেলি। আমি এমনও রাত দেখেছি, বুবু সারারাত
কাদতে কাদতে পার করে দিয়েছে। আপনি চলে গেছেন,
প্রায় নয় বছর হবে কিন্তু আমার বুবু নয় দিনও ভালো থাকে নি।
আপনি আমার বুবুকে ভালো থাকতে দেন নি। আপনাদের সম্পর্ক
টা ছিলো মাত্র এক বছরের, কিন্তু এই একটা বছরে আমার বুবুর সুখ
স্বপ্ন সবটা শেষ করে দিলেন আপনি। আপনার মেয়ে
বন্ধুদের সাথে যখন গ্রুপ সেল্ফি তুলে যখন আপ দেন, তখন
আমার বুবু আপনার আর ওর কাপল পিকটা গ্যালারীর কোনা থেকে
বের করে। ছবিটায় আপনি কিংবা বুবু কাউকেই বুঝা যায় না। তবু আমার
বুবু পিকটা আকড়ে ধরে আবার কাদতে বসেন। বুবু আমার
জীবনের সব সুখ এনে দিয়েছে কিন্তু আমার বুবুর জীবনেই
সুখটা নেই। কেন এমনটা হলো বলতে পারেন?
আজমান আহম্মদ, আপনি বলতে পারবেন না। কি বলবেন আপনি?
সত্যিই কি কিছু বলার আছে আপনার?
প্রথম যখন আপনার ছবি দেখেছিলাম, তখন ভেবেছিলাম এমন
একটা ছেলেকে আমার বুবু এতটা ভালো কেমনে বাসে?
বুবুর হাতের তিলটাই আমার বুবু প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে একটা
করে চুমু খায়, আপনি নাকি বলেছিলেন বিয়ের পর এই তিলটাই
প্রতিদিন চুমু খাবেন।
আমার বুবু এখনও শাড়ী পড়ে নি কোনোদিন। কেনো
জানেন? কারণ কোনো এক বেইমান বলেছিল, তোমাকে
শাড়ী পড়ে কেমন লাগে তা প্রথম আমি দেখবো। ঐ
বেইমানটার জন্য আমার বুবু আজও শাড়ী পড়ে নি। আমি ঘুম
থেকে উঠে দেখি, বুবু আপনার দেয়া জিনিসগুলা বুকে নিয়েই
ঘুমিয়ে আছে। আপনার পছন্দের খোসা ছাড়ানো বাদাম হাতে
নিয়েও বুবুকে কাঁদতে দেখেছি। আপনি তো বুবুর অস্তিত্বে
মিশে আছেন। আপনাকে বুবু কিভাবে ভুলবে। সেই সাধ্য
হয়তো আল্লাহ বুবুকে দেয় নাই। আপনি কি জানেন, আমি
আপনাকে প্রচন্ড রকম ঘৃনা করি? আমার বুবু আপনাকে যতটা
ভালোবাসে, আমি ঠিক ততোটাই ঘৃনা করি আপনাকে।
. আমি কখনও কাউকে চিঠি লিখি নি আজমান আহম্মদ। কাল রাতে এই
চিঠিটা লিখেছি আমি, হাজার বার কাটাকাটি করে শেষ পর্যন্ত এই চিঠিটা
লিখেছি। এই কথা গুলা হয়তো আপনাকে সরাসরিও বলতে পারতাম,
কিন্তু আপনি কি বুঝতে পেরেছেন, এই চিঠিটা লিখতে গিয়ে
কতো বার আমি চোখ ভিজিয়েছি। আপনি কি এটা বুঝতে
পেরেছেন, আমি আপনার সামনে হাউমাউ করে কাঁদতে পারবো
না বলে এই চিঠিটা লিখেছি?
না, আপনি জানেন না। আপনি কিচ্ছু জানেন না। আপনি আমার বুবুর
আকুতি ভরা কন্ঠ কেমন হয় তা জানেন না। আপনি আমার বুবুর
চোখটা কতোটা মায়া ভরা তা জানেন না। আপনি আমার বুবুর কিচ্ছু
জানেন না আজমান আহম্মদ। এতো বছরের মাঝে আমি
কোনো দিনো আমার বুবুকে একটা দিনের জন্য ও
আফসোস করতে শুনি নি। আমার বুবুকে কখনও এটা বলতে শুনি
নি, যে বুবু ভুল করেছে। বুবু কাঁদতে কাঁদতে শুধু সবসময় এটাই
বলেছে, বড্ড ভালোবাসি আমি ওকে।
মাঝ রাতে বুবু যখন আপনার নাম নিয়ে ঘুৃম থেকে চিৎকার দিয়ে
সজাগ হয় তখন আমি বিরক্তির কন্ঠে বলতাম, বুবু আবারও আজমান?
বুবু তখন আতঙ্কভরা কন্ঠে বলতো, মনে হয় ওর কোনো
বিপদ। এমন স্বপ্ন দেখলাম কেন? আল্লাহ তুমি রহমত দান করো।
ভালো থাকুক সে।
তখন আমি হা করে তাকিয়ে শুধু বুবুকে দেখতাম আর ভাবতাম,
কাউকে এতোটা ভালো কেমনে বাসতে পারে কেউ?
বাইরে যখন বৃষ্টি শুরু হয়, বুবু তখন দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরে
টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দেয়। কেন জানেন?
কারণ বৃষ্টিটার শব্দটা তো দুজনের একসাথে শুনার কথা ছিলো।
বুবুকে যখন বলি, ছেলেটা তোমাকে কষ্ট ছাড়া কি দিয়েছে?
বুবু তখন একগাল হাসি দিয়ে কি বলে জানেন?
সবটুকু পূর্ণতা দিয়েছে আমায় সে। প্রতি রাতে যখন লুকিয়ে
লুকিয়ে কথা বলতাম, তখন অন্য রকম এক সাহস দিয়েছে সে
আমায়। আমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে যখন সে বুঝতে আমি কি চাই,
তখন আমি বুঝতে পারতাম আমি ওর কতটা জুড়ে আছি। মাঝরাতে ৪৫
মিনিটের রাস্তা হেটে আমার বাসার সামনে এসে দাড়িয়ে
থাকতো। বলতো জানালা টা দিয়ে হাতটা শুধু বের করবা, আমি
তোমার হাতের তিলটায় একটু স্পর্শ করবো।
ভেজা চোখ নিয়ে যখন সে বলতো, তোমাকে ছাড়া আমি
বাচতে পারবো না। আমার সব প্রাপ্তি তো ঐ টাতেই ছিলো।
আমার বেচে থাকার জন্য এই টুকুই যথেষ্ট।
. বুবু, এই আজমান আহম্মদই কিন্তু দিনের পর দিন তোমায় অবহেলা
করেছিল। এই আজমান আহম্মদই কিন্তু তোমার রাতের প্রতিটা
কান্নার কারণ। শুধু মাত্র উনার জন্যই কিন্তু তুমি তোমার বাবার সাথে
কথা বলো না।
এগুলা শুনে বুবু বলে, আরে পাগলি। এটা আমার ভাগ্য। আর কিছুই না
এতে আজমানের কোনো দোষ নেই।
. আচ্ছা আপনিই বলেন, এর প্রতিউত্তরে আমি কি বলবো
. আপনাকে পুরো চিঠিতে আজমান আহম্মদ বলেই সম্বোধন
করেছি। আপনাকে আমার সম্মান দিতে ইচ্ছা করে না আজমান
আহম্মদ। মাফ করবেন আমায়।
একটা কথা রাখবেন?
একবার আমার বুবুর মুখোমুখি হবেন? শুধু একবার।…
.
চিঠিটা এই পর্যন্তই লেখা। এটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে
আজমান। চশমাটা কেমন জানি ঝাপসা হয়ে আসছে ওর।
চলবে…
লেখক: আলভী আহম্মদ

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে