#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০
গল্প:- ভাঙন
লেখা:- জিন্নাত রিমা
নিরু খেতে বসে ভাতগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললো, ‘ আবারও সেই ডাল আর শুকনো মরিচ? একটা আলুও জোগাড় হলো না?’
মা চোখ রাঙিয়ে বোঝাতে চাইলেন যা আছে তা দিয়ে চুপচাপ খেয়ে নে। নিরু মা’র চোখ রাঙানোকে অগ্রাহ্য করে ভাত ভর্তি থালায় হাত ধুয়ে ওঠে গেল। আমি আর হিরু ভয়ে চুপসে গেলাম। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডাল মজা হয়েছে বলে আরেকটু চেয়ে নিলাম। গোগ্রাসে ডালভাত খেয়ে আমরা দু-বোন তৃপ্তির ঢেকুর তুলি।
মা বাবার মাঝে বনিবনা হচ্ছে না। তারা দুজনেই যেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ! সবসময় দুজনের মাঝে ঝগড়া হয়। শুনেছি বাবা আরেকটা বিয়ে করেছেন। ঝগড়ার বিষয় সেটা। বাবা স্পষ্ট করে বলে না আরেকটা বিয়ে করার কারণ। হিরুর ঘেন্না হয় বাবার নতুন বউয়ের কথা শুনলে। আমার ইচ্ছে করে বাবার নতুন বউটা দেখতে। আমার মায়ের মতোন ধবধবে ফর্সা গোলগাল চেহেরার চেয়ে সুন্দর কিনা জানতে।
বাবা আগে সপ্তাহে তিনদিন আমাদের সাথে আর তিনদিন ছোট মার সাথে থাকতেন। সপ্তাহের সাতদিনের শুক্রবারটা বাবা কোথায় থাকতেন সেটা আমরা জানতে চাইতাম না।
গত তিনমাস ধরে বাবা বাড়িতে আসেন না। মাঝেমধ্যে রহিম চাচার মাধ্যমে টাকা পাঠাতেন। এখন তা-ও বন্ধ।
হিরু প্রচণ্ড বকবক করতে পারে। আমার ওর সাথে ঘুমোতে ইচ্ছে করে না। বিশাল এই পাকা বাড়িতে অন্য রুমে একা থাকার মতো সাহস আমার হয়ে উঠে না। নিরু শোয় মায়ের সাথে। অন্য রুমে।
” শিরু আপা আমার স্বপ্ন আমি বড় হয়ে ডাক্তার হবো। রাবেয়া খালা আছে না। ওনার নাকি সবসময় বুকে ব্যথা করে। ইশশ! টাকার জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না। আমি ডাক্তার হয়ে প্রথমে ফ্রীতে ওনাকে দেখব।” হিরু ঘুমোতে আসলে প্রতিদিন একবার হলেও এই গল্পটা আমাকে শোনায়। আজ তার গল্পটা পাল্টে গেছে।
“শিরু আপা, প্রতিদিন ডালভাত খেতে তোর ভালো লাগে?”
” জানি না।”
”আব্বা কখন আসবে?”
“জানি না।”
“আমার মনে হয় কাল হয়তো আব্বা আসবে নয়তো রহিম চাচাকে দিয়ে টাকা পাঠাবে।”
আমি কোনো উত্তর দিই না।
হিরু থেমে থেমে বলে, ” দেখিস আপা আমি বড় হয়ে নিরুকে আর এভাবে ভাত রেখে উঠতে দিব না। ও যা চাই তা-ই খেতে দিব।”
আমি চোখ বন্ধ করতে করতে বলি, ” আমিও দিব না।”
হিরুর রাতে বলা কথা সত্যি হয়। সন্ধ্যায় বাবা আসেন। মা রাগ করে প্রথমে দরজা খুললেন না। খানিক পরে মা আমাকে ইশারা করলেন দরজা খুলে দিতে। বাইরে তখন ঘুটঘুটে আধার সাথে টুপটাপ বৃষ্টি। বাবা ভেতরে ডুকে বসতেই হিরু তোয়ালে এনে বৃষ্টিতে ভেজা মাথা মুছে দিল। আমি লুঙ্গিটা এগিয়ে দিলাম। নিরু এসে বাবার খোল দখলে নিল। মা বাবার মাঝে কোনো কথা হয় না। টুকটাক যা হয় আমরা তিন বোনের সাথে। মা অন্যমনস্ক ভাবে বাবার আনা দুই কেজি ওজনের ডিমওয়ালা বড় রুই মাছটা রান্না শুরু করেন। রাতে আমরা বাবার সাথে খেতে বসি। নিরু মাছের ডিম দিয়ে পরপর দু-থালা ভাত খেয়ে পেলেন। বাবা নিজের প্লেটের মাছটা তোলে রাখেন। মা পরে খাবেন বলে উঠে যায়। হিরু আরেকটা মাছের পেটি খুঁজে নিয়ে দুটো ভাত বেশি খাওয়ার চেষ্টা করে। আমি পেট ব্যথার ভান করে মাছটা তুলে রেখে দুপুরের ডালগুলো খুঁজে নিই।
সকালবেলা বাবা চলে যান। হিরুকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। বাবা মাকে প্রস্তাব করলেন আমার আর হিরুর মধ্যে যে কোনো একজনের দায়ভার পুরো নিবেন। আর নিরুর অর্ধেক। হিরু নাকি আমি কে যাব বাবার সাথে প্রশ্ন করার আগেই হিরু সম্মতি জানালো সে যাবে। আমাকে হ্যাঁ না কিছু বলতে হলো না।
আমরা আবার ফিরে গেলাম আমাদের ডালভাত খাওয়ার দিনে। মা এ-বাড়ি ও-বাড়ি কাজ করে এর চেয়ে বেশি জোগাড়ে সমর্থ নয়। হিরুর জন্য মাঝেমাঝে মন খারাপ হয়। স্বান্তনা দিই নিজেকে এই ভেবে যে একজন তো এই অভাব অনটন থেকে মুক্তি পেল।
নিরুটা দিন দিন শুকোতে থাকে। যে দেখে সেই আফসোস করে। সাহায্যটা কেউ করে না। আমার মনে হয় ভেতর ভেতর মেয়েটা কোনো অসুখ বাধিয়েছে নিশ্চয়ই। একটা ডাক্তার দেখাতে হবে। কিন্তু টাকার অভাবে সেটা হয়ে উঠে না।
সেই বছর আমার সহপাঠী সবাই প্রাইমারির পাঠ চুকিয়ে হাইস্কুলে পা দেয়। আমার আর লেখাপড়া হয়ে উঠে না। সারাদিন ঘরে থাকি টুকটাক কাজ করি। নিরুকে দেখি।
এক ভোররাতে নিরুর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। যেনতেন জ্বর না। গ্রীষ্মের তীব্র গরমেও নিরু গায়ে কাঁথা জড়িয়ে নেয়। আমি কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপি, ১০১, ১০২ কিংবা তারচে বেশি। নিরু কিছু মুখে দেয় না। পানিও না।
কী খেতে ইচ্ছে করে জানতে চাইলে নিরু কানের কাছে ফিসফিস করে বলে ,” আপা, বেশি করে পিয়াজ দিয়ে ডিম ভাজা গরম ভাতে খুব মজা, না?”
আমি ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলি,” খাবি?”
সে বলে, ” কই পাবো?”
আমি দেখি বলে ওকে শুয়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। ভাগ্য সহায় হলো। পুরাতন বই খাতা কিনে এমন একজনকে পেয়ে গেলাম। কেজি প্রতি দশ টাকা করে। আমার পঞ্চম শ্রেণির বই আর পুরাতন গাইড বই গুলো মেপে তিনি দেড় কেজির দাম দিলেন পনেরো টাকা। স্কুলে আর যাওয়া হতো না বিধায় আমি রোজ বইগুলো নিয়ম করে পড়ার নামে ছুঁয়ে দিতাম। শুধুমাত্র পনেরো টাকার বিনিময়ে স্বপ্নগুলো বিক্রি করে আমি নিরুকে খুশি করতে একটা ডিম কিনে নেয়।
নিরু গড়গড় করে বমি করে মা এক হাত বুকে আরেক হাত পিঠে দিয়ে ধরে থাকে। আমি চেয়ে থাকি। মাঝে মাঝে হাতের মুঠোয় ডিমটা নিয়ে নিরুকে দেখায়। সে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। হয়তো ভাবে,’ কতদিন ডিম খাওয়া হয় না।’
তিনদিন পেরুলো। নিরুর জ্বর কমে না। গরম ভাতে বেশি করে পিয়াজ দিয়ে ডিম ভাজাও খাওয়া হয় না।
আমি অপেক্ষা করি নিরুুর সেরে উঠে ডিম ভাত খাওয়ার কিংবা আমাদের টানাটানির সংসারে আরেকজন সদস্য কমে যাওয়ার।