গল্প:- ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ০২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
ড্রেসিংটেবিলের সামনে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়ায় আবির। নীলিমার দৃষ্টি এতক্ষণে আয়নার ভিতর দিয়ে আবিরের দিকে যায়। আবিরের রাগান্বিত চাহনী দেখে ভয়ে কেঁপে উঠে নীলিমা।
“ওনি এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
ভয়ে ভয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নীলিমা।
ভীরু চাহনীতে আবিরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে নেয় একবার। আবির তখন আর স্থির দাঁড়িয়ে নেই। একপা দু’পা করে নীলিমার দিকেই এগিয়ে আসছে। এটা দেখে তো নীলিমার কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। মনে মনে আল্লাহু নাম জপছে। আবির নীলিমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে কঠিন স্বরে প্রশ্ন করে, এসব কি শুরু করছেন? নীলিমা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে, কিকিকিকি কি…???
ঝাঁঝালো গলায় আবিরের পাল্টা প্রশ্ন, কিসের গোসল এটা? লজ্জায় নীলিমা মাথা নিচু করে ফেলে। আবারো আবিরের তাড়া, কি হলো? জবাব দিচ্ছেন না যে? নীলিমা তখনো মাথা নিচু করে আছে। কি করে বুঝাবে ও সেটাই বুঝতে পারছে না। কি করে বলবে-
” আর যায় হোক, কেউ অন্তত এটা বিশ্বাস করবে না একটা ছেলে একটা মেয়ে ফুলশয্যার রাত্রে একই রুমে থাকার পরও তাদের মধ্যে কিছুই হয়নি। আর তাইতো….”
কি হলো? চুপ করে আছেন যে?
নীলিমার কোনো জবাব নেই দেখে, আবির অট্টহাসিতে ফেটে পরে। আবিরের এমন রহস্যজনক হাসির কারন বুঝতে পারে না ছোট্ট নীলিমা। বোকার মত শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে নীলিমার মুখের দিকে মুখ নিয়ে যায়। নীলিমা চোখ দু’টি বন্ধ করে ফেলে। আবির দৃঢ় গলায় বলে, অভিনয়টা তাহলে ভালো’ই পারেন।
Good, Very good….
আমিও এটাই চাই। আমাদের মধ্যকার কথা যাতে বাহিরে না যায় আমি সেটাই চাই। যাক, এ ব্যাপারে তাহলে আমায় আর কিছু বলতে হবে না। নীলিমা চোখ মেলে তাকায়। আবির ওয়াশরুমে চলে যায়। জল ছলছল দৃষ্টিতে নীলিমা আবিরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
অজপাড়া গায়ের এক নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে নীলিমা। সেখানেই ওর বেড়ে উঠা। এতবড় বাড়ি, এত সুন্দর পরিবেশে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য নীলিমার আগে কখনো হয়নি। আজ তাই রুম থেকে বের হয়ে প্রত্যেকটা কদমে কদমে মুগ্ধ দৃষ্টিতে নীলিমা এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।
” ছমিরের মাইয়্যা নিলীর তো কপাল খুইল্যা গেছে। বড় ঘর থেইক্যা লোক নীলুরে দেইখ্যা গেছে। সামনের মাসেই বিয়া।”
” শুনেছি পোলার বাপটা নাকি সিদাবিদা। অনেক ভালা।”
” বড় বইনড্যাও ভালা। খালি শাওরি’ডাই কিরাম মুখ কালা কইরা আছিল।”
” জামাইডা পুরা হিরার টুকরা। হুনলাম শহরের বড় কলেজের মাস্টার।”
” হ, সব’য় কপাল। কালা অইলে কি অইব, মাইয়্যার কপাল ভালা। কপাল গুনেই এত বড় ঘরের বউ অইতে পারছে।”
নীলিমা শুনেছে। শ্বশুর বাড়ির এমন হাজারো গুনকীর্তন নীলিমা বিয়ের আগেই শুনেছে। আর সেই শুনা থেকেই নীলিমা শ্বশুর বাড়িটা মনের গভীরে কল্পনার তুলিতে এঁকে নিয়েছে। আজ এ বাড়িতে আসার পর মনে হচ্ছে যা শুনেছে, যা কল্পনা করেছে এ বাড়িটা তার থেকেও বহুগুনে সুন্দর। যা দেখে ঘোর লেগে যায় নীলিমার। ঘোর কাটে শ্বশুরের ডাকে।
” কিরে মা? বাড়ি দেখা হলো?”
নীলিমা মাথার ঘোমটা’টা টেনে মিষ্টি হেসে মাথা ঝাকায়, জি আব্বা!
” হুম! তা পছন্দ হয়েছে তোর শ্বশুর বাড়ি?”
শ্বশুরের প্রশ্নোত্তরে মৃদু মাথা নেড়ে, শাশুড়ির রুমে ঢুকে নীলিমা। শাশুড়ি তখন খাটে হেলান দিয়ে বসে পান চিবুচ্ছে। নীলিমা কাছে গিয়ে সালাম দেয় শাশুড়িকে। আধশোয়া থেকে উঠে বিছানায় বসেন ওনি। মা! বলছিলাম কি সকালের জন্য কি ভাত রান্না করব?
নীলিমার শাশুড়ি ভ্রু কুঁচকে নীলিমার দিকে তাকান। চোখে মুখে কেমন বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠেছে ওনার। আর সেই বিরক্তিভাব নিয়েই প্রশ্ন করেন নীলিমার শাশুড়ি, কেন? বাপের বাড়িতে সকালে কি কখনো রান্না হয়নি? নাকি বাপ মা শেখায় নি কখনো?
বাপ মা তুলে কথা বলাটা নীলিমা একদম সহ্য করতে পারে না। নীলিমা যথেষ্ট প্রতিবাদী মেয়ে। গ্রামে থাকলে এতক্ষণে কেউ বাপ মা তুলে কথা বললে এর উপর্যুক্ত জবাব দিয়ে দিত। কিন্তু আজ পারছে না। কারন, এ বাড়িতে আসার আগে নীলিমার মায়ের শেষ কথা ছিল- মা’রে! পরের ঘরে যাচ্ছিস। যেখানে খুব ভেবে চিন্তে একেকটা কদম ফেলতে হয়। তাই দয়া করে যত কিছুই হোক মুখে মুখে প্রতিবাদ করিস না। পরে রাগ কমলে বুঝিয়ে বলবি। নীলিমা তাই শাশুড়ির মুখের কথায় কিচ্ছু বলেনি। চুপটি করে নীলিমা রুম থেকে বের হয়ে গিয়ে রান্নাঘরে ভাত বসায়। কাজের মেয়েটা ছুটে এসে কিছু একটা বলতে চাইছিল নীলিমাকে, তার আগেই মেয়েটাকে সরিয়ে নেয় শাশুড়ি।
সকাল ০৮টা_
টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে রাখছে নীলিমা। নিজেকে কেন যেন আজ ওর বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি নায়িকা সাবানার মতই লাগছে। কিরকম কারো কোনো হেল্প ছাড়াই টেবিলে খাবারগুলো থরে বিথরে সাজিয়ে রাখছে।
সবাই এসে টেবিলে বসেই “থ” হয়ে যায়। নীলিমার তিন মামী শাশুড়ি সহ, তিন মামা, ননাস, ননাসের জামাই সবাই, সবাই কেমন হা করে একবার খাবার তো আরেকবার নীলিমার দিকে তাকাচ্ছে। শুধু নীলিমার শ্বশুর কিছু না বলেই খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।
” কি হলো? তোমরা বসো?!!!
দেখো কি মজাই না হয়েছে। নীলিমা খাবার দে তো ওদের প্লেটে।”
শ্বশুরের কথায় কাঁপা হাতে সবার প্লেটে প্লেটে ভাত দেয় নীলিমা। সবার প্লেটে ভাত দেয়া শেষে ভাতের উপর মাছের ঝুল, আলুর টুকরা আর একটা করে মাছ দেয়।
হ্যাঁ, নীলিমা রান্না করেছে। ভাত, আলু ভর্তা আর পাতিল ভর্তি পানি দিয়ে মাছের ঝুল তরকারী। পল্লিগ্রামের ১৫বছরের মেয়ে নীলিমা। সবে ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠেছে। পড়ালেখায় ভালো ছিল বলে সবসময় পড়া লেখা’য় করত। চুলোর আশেপাশে নীলিমা কখনো যায়নি। মায়ের কোনো হেল্প লাগলে নীলিমার মা লিমাকেই ডাকত। তাই রান্না সম্পর্কে নীলিমা কিচ্ছু জানে না। সে’বার মা নানুর বাড়িতে গিয়েছিল। বোনটার গায়েও প্রচন্ড জ্বর ছিল। তাই বাধ্য নীলিমা সেদিন’ই প্রথম রান্না করে। আলু ভর্তা, আর ডিম ভাজি। বিকেলে রান্না করেছিল মাছের ঝুলের তরকারী। এটুকুই শিখেছিল নীলিমা সেদিন। আজও তাই ঠিক এগুলোই রান্না করেছে নীলিমা।
সবাই খাওয়া শেষে টেবিল ছেড়ে চলে গেলে নীলিমার শাশুড়ি তিক্ত গলায় নীলিমাকে কথা শুনায়_
” এই মেয়ে! তোমার বাপ মা কি রান্নাও শেখায়নি তোমাকে….(……)….???”
– আহ, আদিবার মা। চুপ করো না। ওকে কেন ধমকাচ্ছ? মা, তুই রুমে গিয়ে দ্যাখ তো আবির উঠছে কি না? নীলিমা মাথা নিচু করে রুমের দিকে পা বাড়ায়। পিছনে ওর শ্বশুর, শাশুড়িকে থামানোর বৃথা চেষ্টা করছে,
” এবার তো একটু শান্ত হও। তুমি কার সাথে রাগ দেখাচ্ছ? ১৫বছরের এই ছোট্ট মেয়ের সাথে?! যার এই সময় ছুটাছুটি করে স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলা করার বয়স ছিল তাকে? আরে, এতো এখনো বাচ্চা’ই আছে। এ রান্না শিখে কি করবে? শুধু অন্তিম যাত্রায় বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে ওর শেষ ইচ্ছা পূরন করলাম, যাতে ও মরে শান্তি পায়। আর আমি বুঝি না তুমি কেন ওর পিছনে এভাবে লাগছ! ও বেচারীর কি দোষ? ও তো গিয়েছিল তোমার কাছে আর তুমি কি করছ….(…..)….???
একটু পর থেকেই এলাকার মানুষজন আসা শুরু করবে বউ দেখার জন্য। যে মহিলা ছেলের বউ দেখার জন্য পুরো দুনিয়া ছেকে ফেলেছে সে কি না শেষে অজপাড়া গায়ের কাঠ কাটে কাঠুরিয়ার এমন কালো মেয়েকে পুত্রবধূ করেছে। এ মুখ আমি সোসাইটিতে দেখাব কি করে…..(….)….???
সিড়ির উপরে দাঁড়িয়ে পুরো কথা শুনে চোখের জল ছেড়ে দিয়ে সে স্থান ত্যাগ করে নীলিমা। রুমে ঢুকতেই ভেসে এলো বাথরুম থেকে আবিরের ডাক, মা! আদিবা আপু, কেউ আছ? তোয়ালেটা দিয়ে যাও না একটু। অনেক খুঁজে তোয়ালেটা বের করে অত্যন্ত ধীর গতিতে নীলিমা সামনের দিকে এগুচ্ছে আর শাশুড়ির কথাগুলো ভাবছে। আচমকা শাঁড়ির সাথে পা আটকে হুমড়ি খায় নীলিমা। আবির ঠিক তখনই ওয়াশরুমের দরজা ক্ষাণিকটা ওপেন করে ডাক দিচ্ছিল, লেইট হয়ে যাচ্ছে তো মমম….(….)…???
তার আগেই কেল্লাফতে। হুমড়ি খেয়ে নীলিমা দরজা ঠেলে ভিতরে আবিরের উপর পরে।
নাহ! কোনো সিনেমাটিক স্টাইলে ওরা একে অপরের চোখের গহীনে ডুবে থাকেনি। পরা মাত্র’ই নীলিমা সোজা হয়ে ভয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। আর আবির চোখ বড় বড় করে সেদিকেই তাকিয়ে আছে।
নিচের দিকে তাকিয়েই কাঁপা গলায় নীলিমা বলে, মাফ করবেন। আসলে শাঁড়ির সাথে….(…..)….???
পুরো কথা বলতে পারেনি নীলিমা। তার আগেই আবিরের রাগী কন্ঠে ভেসে এলো, যেটা পরে নিজেকেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না, সেটা না পরলেই কি নয়?
চলবে….