গল্প: প্রতিদান লেখা: জান্নাতুল ফারিয়া

0
1710

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০

গল্প: প্রতিদান
লেখা: জান্নাতুল ফারিয়া

আজ অনেক বছর পর গ্রামের মাটিতে পা রাখবো । মনের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এই কয়েক দিন যাবত রাতে ঘুম হয় না এটা ভেবে যে, কখন গ্রামের আলো-বাতাস শরীর স্পর্শ করবে। সেই যে ছোট বেলায় পাড়ার রহিম চাচার আম বাগান থেকে আম চুরি করে বাবার লাঠি পেটা খেয়ে বাড়ির বাইরে এসেছি, এরপর আর বাবা মায়ের মুখ দেখার ভাগ্য হয়নি । ভয়ে পালিয়ে গিয়ে ছিলাম ফুপির বাড়িতে, কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই বাবা আমার জন্যে সিঙ্গাপুরে আসার কাগজপত্র ব্যবস্থা করে ফেলেন। সেখানে আমার চাচা থাকে পুরো পরিবার নিয়ে। আমাকে দেশের বাইরে থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যেদিন বাবার যোগ্য সন্তান হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবো, সেদিন যেনো বাবার সামনে আসি। এর আগে বাবা আমার মুখ দেখবে না, এটাই তার প্রতিজ্ঞা।

আসল ব্যাপার হলো যে, রহিম চাচা সেদিন বাবাকে অনেক অপমান করে ছিলো। এমন কি এটাও বলে ছিলো যে, আমার বাবা শুধু নামেই শিক্ষক, আসলে উনি চোরের বিদ্যা শিখায়, আর তাই আমার এই অবস্থা। আজ আমি বাবার যোগ্য সন্তান হয়ে মায়ের কোলে ফিরবো। এতো বছরের ভেতর কখনো বাড়িতে কথা বলার সৌভাগ্য হয়নি আমার, এটাও একটা শর্ত।
যাক! আজকে বাবাকে চমকে দিবো। আমি আজ তার যোগ্য ছেলে, একজন ডাক্তার । এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি ভাড়া করি গ্রামের উদ্দেশ্যে। কিন্তু স্টেশন পর্যন্ত এসে গাড়ি আমায় বিদায় জানালো। গ্রামের কাঁচা রাস্তায় গাড়ি যাবে না।
কি আর করা? বাড়ি অব্দি যেতে এবার ভ্যানের সাহায্য নিতে হবে। অবশ্য স্টেশন থেকে মিনিট পাঁচেক হাটলেই গরুর গাড়ি পেতাম, কিন্তু এতো গুলা ব্যাগ নিয়ে ১মিনিটের রাস্তাও হাটা সম্ভব হবে না।
দাঁড়িয়ে থাকতে পিছন থেকে ১০/১১বছরের একটা মেয়ে এসেই শার্টটা টেনে ধরলো_
-৫টা টেহা দিবেন সাহেব? আইজ্জা কিচ্ছু খাই নাই। মা আইজ অসুস্থ্য দেইক্কা ভিক্কা করতে পারে নাই। আমিই তাই আইজ্জা ভিক্কা করতে আইছি।
-নাম কি তোমার?
-কথা।
-তোমার বাবা কি করে?
-গাড়ির নিচে পইরা মইরা গেছে, রিকশা চালাইতো বাপে।
-সংসার চলে কি করে?
-মা’র ভিক্কার টেহায়।
-লেখা পড়া করতে ইচ্ছা করে না?
-করিতো সাহেব। ফোরে অব্দি পড়ছি, ফাইভে উঠছি রোল আমার দুই হইছে। কিন্তু বাপে মইরা যাওয়ায় তিন মাস ধইরা পড়ি না।
-কাজ করবে?
-আমারে কেউ কাম দেয় না, কয় পোলাপাইনরে কামে রাখলে পুলিশে ধরবো।
-ফুল বিক্রি করবা?
-এহনো খাইতে পাই নাই, বাইত মায় একলা। ফুল কিনার টেহা কই পাইমু?
-আমার সাথে আসো।

স্টেশনের পাশেই একটা দোকান থেকে এক প্যাকেট পাউরুটি আর কয়টা কলা কিনে দিলাম। আরো আছে ৫কেজি চাল, সাথে ২কেজি আলু আর ডাল। সাথে জ্বরের কারণে জাতীয় অষুধ নাপা এক্সটা কিনে দিয়ে বলেছি ওর মাকে দিতে।
পাশেই ছিলো মস্ত এক পাইকারি ফুলের দোকান, যেখানে ভেঙ্গে একটা দুটো ফুল বিক্রির নিয়ম নাই। হাতে ধরিয়ে দিলাম অনেক গুলা গোলাপ, আর ১০টার মতো বেলি ফুলের মালা।
-এগুলা বিক্রি করে যা লাভ হবে, তা দিয়ে সংসার চালাবে। আর বাকিটা দিয়ে আবার ফুল কিনবে। তবে অবশ্যই আগে স্কুল যাওয়া লাগবে, এরপর বাকি সময় কাজ করবে। সন্ধ্যা হলে বাসায় গিয়ে বই পড়বে। মনে থাকবে?
-আইচ্চা সাহেব।
আল্লাহ আপ্নের ভালা করবো, দুনিয়ায় এহনো ভালা মানুষ আছে।
মেয়েটা দৌড়ে চলে যায় তার বাড়িতে। স্টেশনের পাশের বস্তিতে বাস করে। বাসায় গিয়ে মাকে নিয়ে খেয়ে এরপর ফুল বিক্রি করতে চলে আসবে।

দাঁড়িয়ে ভাবছি! কতো রকম হয় মানুষের এই ছোট্ট জীবন। ভাবতে ভাবতে পিছন থেকে এক বৃদ্ধা ভ্যান চালকের ডাক পরলো_
-কই যাইবেন সাহেব?
-সখীপুর গ্রামে রফিক মাস্টারের বাড়ি।
-আপ্নে মাস্টরের কি হোন?
-পরিচয় বলাটা কি খুব দরকার?
-না সাহেব! আসলে হইলো গিয়া আগেতো আপ্নেরে এলাকায় দেহি নাই, তাই জিগাইলাম আরকি।
-রফিক সাহেব এখন হয়তো অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, তাই না?
-হু সাহেব, খুব ভালা মানুষ উনি। এহন বাইত বইহা বই ফরে, আর লেহালেহি করে।
-আপনি চিনেন?
-হু! আমার উপ্রে রাগ দেখাইয়া পোলারে এমন পিঠানি দিছে, পরে গিয়া আর হের মুখ দেহি নাই।
-আপনি রহিম চাচা?
-হু সাহেব, আমি রহিম। কিন্তু আপ্নে ক্যাডা?
-চাচা আমি নিশান, আপনাদের নিশু। ছোট বেলায় আম চুরির জন্যে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে।
-বাবা নিশু! কত্ত বড় হইয়া গেছো। আমারে মাফ কইরা দিও বাবা। তোমার দুষ্টামি গুলা চুরি ভাইব্বা কি অপমানডাই না করছি তোমার বাপরে, আর আমার নিজের ঘরেই দুই দুইখান চোর হইছে। আমার জমিজমা সব লেইক্কা নিছেগা।

কথাটা শেষ হতে না হতেই চোঁখ থেকে অশ্রু ঝরে পরলো রহিম চাচার। গলায় ঝুঁলানো গামছা দিয়ে অশ্রুটা মুছে নিলো, কিন্তু আমি যে স্পষ্ট দেখেছি চাচার কান্না। চাচাকে জরিয়ে ধরে শান্তনা দিই, কিন্তু চাচা বলে উঠে_
“বাবা তোমার শইল্লে আমার শইল্লের ঘাম লাগবো”
বুঝতে বাকি রইলো না আর, এসব ওনার প্রতি ওনার ছেলেদের অবহেলার ফল এমন আচরণ করে।
গ্রামের মেঠোপথ ধরে ভ্যান যাচ্ছে, আর মনটা কেমন যেনো শীতল হয়ে যাচ্ছে এই মাটি আর হাওয়ায় গন্ধে। এক অন্যরকম অনুভূতি।
-আচ্ছা চাচা, চাচী কেমন আছে?
আর আপনার মেয়ে জিমু নিশ্চয় অনেক বড় হয়ে গেছে এখন।
-হু বাবা, অনেক বড় হইয়া গেছে। বিয়া দিছিলাম এক বড় বাড়ি দেইক্কা, মাইন্সের চামড়ার গন্ডার গুলা আমার মাইয়াডারে আগুনে পোড়াইয়া মাইরা ফেলছে যৌতুকের টেহার লাইগা । এরপরেত্তে তোমার চাচীও আইজ্জা ২বছর ধইরা পাগল হইয়া গেলো।
-পুলিশে রিপোর্ট করেননি?
-হাসাইলা বাবা। (মুচকি হাসি দিয়ে) যদি পুলিশরে টেহা দেয়ার মতোন টেহা থাকতো, তয় মাইয়াডারেই দিয়া দিতে পারতাম। মাইয়াডা এই বয়সে মরতে হইতো না।

কি বলবো? ভেবে পাচ্ছি না আমি। গ্রামতো সেই আগের মতোই লাগছে, কিন্তু মানুষ গুলা এতোটা পশুতে রূপ নিলো কি করে? চাচাকে আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ি এসে পরলাম, তা বুঝতেই পারিনি।
বাড়ির সদর দরজা অব্দি ভ্যান ঢুকিয়ে চাচা ডাকছে_
-রফিক মাস্টর, ও রফিক মাস্টর! বাড়ি আছোনি? বাইরে আইহা দেহো কারে নিয়া আইছি।
-কে? কে ডাকছে?
চশমাটা মুছতে মুছতে ঘর থেকে বাবা বেরিয়ে আসলো। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। দৌড়ে গিয়ে বাবার পায়ে পরে যাই।

-কে তুমি বাবা? (বাবা)
-বাবা আমি! আমি তোমার নিশু। আজ আমি তোমার যোগ্য সন্তান হয়ে বাড়িতে পা রেখেছি, এবার আমায় ক্ষমা করে দাও।
-নিশু তুই আসছিস।
কথাটা বলেই বুকে টেনে নিলো। কখনো মার খেয়েও এভাবে কান্না করিনি, আজ যতোটা অশ্রু ঝরছে। এই কান্না হচ্ছে সুখের কান্না, যা বলে বুঝানোর মতো নয়।

ঘর থেকে মায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । বাবাকে উদ্দেশ্য করে_
-কে এলো?
এক দৌড়ে ঘরে চলে যাই। মা আমাকে চিনতে পারেনি আর দেখতেও পাচ্ছে না। চোঁখে ছানি পরেছে, আর আগ থাকতে অপারেশন না করায় এখন দুটো চোঁখই অন্ধ হয়ে যায়।
যা হবার হবে। আমার প্রথম রুগী হবে আমার মা। মায়ের চিকিৎসা দিয়েই আমার ডাক্তার জীবন শুরু করবো এবার। বাবাকে বলেছি গ্রামের পাশে আমাদের অর্ধেক করা যে বিল্ডিংটা পরে আছে, এটাকে যেনো হাসপাতালে রূপ দেওয়া হয়। কারণ নতুন করে জায়গা আবার হাসপাতাল করা অনেক ঝামেলা আর অনেক সময় খরচা ব্যাপার আছে।

দীর্ঘ তিন মাস পর হাসপাতালের কাজ শেষ হলো। যদিও একটা হাসপাতালের তুলনায় অনেক জলদি সবটা হলো । দেশের নামকরা অন্য হাসপাতালের অনেক ডাক্তার আসবে একেকদিন, সাথে স্থায়ী কজন নতুন ডাক্তার আর অভিজ্ঞ কিছু নার্স নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু আমি এখনো কাজে হাত দেইনি। কারণ আমার কাজ শুরু হবে মায়ের অপারেশন দিয়ে। হাসপাতালের পোস্টার বেরোলো। সাথে বিজ্ঞাপন দেয়া হয় আমার সাথে মায়ের ছবি দিয়ে বড় অক্ষরে লেখা এই যে, “আমার মায়ের অপারেশনের জন্যে একটি চোঁখ লাগবে। বিনিময়ে যা চাইবে, তাই দেয়া হবে।” দুটো চোঁখের কথা বলিনি কারণ: আমার মায়ের চোঁখের আলো ফেরাতে অন্য কারো আলো আমি একজন ডাক্তার হয়ে কেড়ে নিতে পারি না।

৩দিনের মধ্যেই একজনকে পাওয়া যায়, যিনি কোনো কিছুর মূল্য ছাড়াই একটা চোঁখ দিতে রাজি হয়। একটু অবাক হলাম শুনে। দুনিয়ায় এখনো এমন ভালো মানুষ আছে, যারা প্রতিদান ছাড়াই এভাবে পাশে দাঁড়ায়।
সব কিছু ঠিকঠাক। অপারেশন ভালো ভাবেই হয়ে যায়। সন্ধ্যা হবে বলে… যে মানুষটা আমার মায়ের জন্যে এতো বড় ত্যাগ স্বীকার করলো, তার প্রতি খেয়াল রাখাটাও কিন্তু আমার দায়িত্ব। সেই মহিলার কেবিনে যাই ওনাকে দেখতে। আর গিয়ে দেখি সেখানে “কথা” মানে ফুল কিনে দেয়া পিচ্ছু সে মেয়েটা ।
– কথা! তুমি এখানে কি করো?
-হু সাহেব, আমি। আইজ্জা হাফ কেলাস হইছে, তাই অর্ধেক বেলায় ফুল বেইচ্চা বিকালে বাড়ি আইহা এহন মায়রে দেখতে আহি।
-কে তোমার মা?
-এই যে, এইডা আমার মা। আপ্নের মায়রে একটা চোঁখ দিছে।
-উনি তোমার মা? আমার মায়ের জন্যে এতো বড় ত্যাগ স্বীকার করলে?
-সাহেব, আপ্নের কারণে আইজ আমি আবার স্কুলে যাইতাছি, আমার মায়রে ভিক্কা করতে হয় না। সেইদিন স্কুল থেইক্কা বাড়ি যাওয়ার সময় পোস্টারে আপ্নের ছবি দেখছি, আর আমি সব পড়ছি কি লেহা। বাড়ি গিয়া মায়রে সব কইছি পরে মা নিজেই কইলো চোঁখ দেবার লাইগা। মায় কইলো_ “তোর মায়ের অষুখে উনি যদি আগাইয়া আইতে পারে, তয় তুই কেন তার মায়ের অসুখে আগাইয়া যাইবি না”
আমি কইছিলাম সাহেব আমি নিজে চোঁখ দিমু, কিন্তু মা কইলো আমি বাচ্চা দেইক্কা আপ্নেরা নিবেন না। তাই মা দিলো। আর কইলো আমারে আপ্নের মতো ভালা মানুষ হইতে, বড় হইয়া এমন ডাক্তার হইতে।

কথার মুখে এই কথা গুলা শুনে আমি আজ বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। বলার ভাষা পাচ্ছি না। এখনো ভালো মানুষ আছে দুনিয়ার বুকে, যারা সামান্য উপকারের প্রতিদান দিতে নিজের জীবন কুরবান করতেও দুবার ভেবে দেখে না।
সিদ্ধান্ত নিলাম কথা আর কথার মা এবার থেকে আমাদের বাড়ি থাকবে। কিন্তু কথা কিছুতেই তা মানতে রাজি নয়। তখন বলে উঠলো_ “আমার মা আপ্নেগোর বাড়িতে টুকটাক কাম করবো, আর আমিও। তয় আপ্নেগো বাড়ি থাকমু। এমনি থাকতে পারুম না”
মুখে মুচকি হাসি আর চোঁখে আনন্দ অশ্রু নিয়ে গাল গুলা টেনে বলছি_ “আচ্ছা ঠিক আছে, পাঁকা বুড়ি একটা।”

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে