গল্প তেলাজীবন।-লেখা~মাইসারা মেঘ।

0
692

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
গল্প তেলাজীবন।
লেখা~মাইসারা মেঘ।

— এই যে পিংক কালারের তেলাপোকাটি দেখতে পাচ্ছেন এটা মূলত তেলাপোকা নয়,
এটা আমার বান্ধবী পিংকি,ভাগ্য দোষে সে তেলাপোকা হয়ে গেছে।
বেশ কিছুদিন যাবত তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না,তাই একটি মিসিং ডায়েরি লেখাতে এসেছি,
আমি সূচনা রহমান।

— মানে কী? পাগল হয়েছেন? তেলাপোকা মিসিং ডায়েরী লেখাতে আপনি থানায় এসেছেন?
আবার বলছেন সে কিনা আপনার বান্ধুবী হয়?

দেখুন মিস সূচনা রহমান!
এটা কোনো পাগলা গারদ নয় যে এখানে আপনার পাগলামি এলাউ করা হবে।
আপনার বরং কোনো মানসিক হসপিটালে এডমিট হওয়া উচিত।

কিছুটা কড়া মেজাজেই কথা গুলি বললেন ওসি সিমরান মাহমুদ স্মরণ।
মেয়েটার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তাঁর, এটা কোন ধরণের পাগলামি!

— দেখুন স্যার আমি মোটেই পাগলামি করছি না, আমি স্বজ্ঞানেই বলছি, আপনি পুরো ব্যাপারটা তো শুনুন আগে।

— কী শুনবো হ্যাঁ?আপনার বানানো যতসব থার্ডক্লাস অদ্ভুত রচনা?

— ভালোয় ভালো বলছি পুরো ঘটনাটি শুনুন, নয়তো এই যে আমার হাতে কৌটোটি দেখতে পাচ্ছেন এটাতে প্রায় ৫৪টি তেলাপোকা রয়েছে, সবকটি আপনার গায়ে ছেড়ে দেবো এখন।

— হোয়াট? কি যা তা বলছেন? তেলাপোকা ছেড়ে দেবেন মানে?

— জ্বি হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন।
চুপচাপ আমার পুরো কথা শুনুন।

এই যে এই পিংক কালারের তেলাপোকাটি মানে পিংকি ও খুব তেলাপোকা প্রেমী মেয়ে ছিলো, তেলাপোকা ভীষণ ভালোবাসতো।
একদিন সে বারান্দায় বসে চকলেট বিরিয়ানি খাচ্ছিলো হঠাৎ সেখানে একটি হলুদ তেলাপোকার আগমন ঘটেছে, হলুদ তেলাপোকাটি উড়ে এসে পিংকির বিরিয়ানির প্লেটের পাশে বসেছে, পিংকি তো তাঁকে দেখে পুরাই ফিদা, এত কিউট তেলাপোকা হয় ওর জানা ছিলো না, হলুদের উপর ঝাপসা ঝাপসা নীলছে সাদা রঙটা ওর সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
পিংকি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুধু,
আর সেই ফাঁকে পিংকির বিরিয়ানিগুলো কুট কুট করে খেয়ে নিচ্ছিলো সে, খাওয়া শেষে সে পিংকির হাতে এসে বসলো, পিংকির অবাক হওয়ার আর শেষ রইলো না।

হঠাৎ পিংকি খেয়াল করলো তাঁর হাতে একটি মশা কামড়াচ্ছে আর অমনি তেলাপোকাটি গিয়ে খপ করে ওই মশাটি খেয়ে ফেলেছে, আবেগে পিংকির চোখে জল এসে গেলো, ওই ভয়ঙ্কর মশার হাত থেকে তেলাপোকাটি তাকে রক্ষা করেছে।

সেই থেকে তেলাপোকাটির সাথে পিংকির বেশ ভাব জমে যায়, পিংকি যখন পড়তে বসে তেলাপোকাটি তাঁর পড়ার টেবিলের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, তাঁর বই এর ভাঝে লুকিয়ে লুকোচুরি খেলে, পিংকির হাতে এসে বসে।
পিংকি তেলাপোকাটির রঙের সাথে মিলিয়ে নাম দিয়েছিল নীতেলা।
দেখতে দেখতে পিংকি নীতেলার প্রেমে পড়ে যায়।
আর সেই প্রেমে পড়াটাই তাঁর জীবনে কাল হয়ে দাড়ায়, বলেই থামলো সূচনা…..

এই দিকে ওসি স্মরণ সাহেব গ্লাসের পর গ্লাস পানি খাচ্ছেন।
এ কেমন অদ্ভুদ কাহিনী শুনছেন তিনি, মানুষ তেলপোকার প্রেমে পড়ে?
ছিঃ কী জঘণ্য ব্যাপার!

— জ্বি তারপর কি হলো?

— আপনি হয়তো ভাবছেন মানুষ হয়ে পিংকি কেন একটা তেলাপোকার প্রেমে পড়তে গেল তাই তো!আসলে এখানে পিংকির কোনো দোষ ছিলো না, তেলাপোকাটি পিংকি কে বশ করে ফেলেছিলো, যার ফলে পিংকি ভাবতে বাধ্য হয়েছিলো সেও পূর্বজন্মে কোনো তেলাবংসে জন্মেছিল, যেকারণে নীতেলার প্রতি তাঁর এমন দুর্বলতা তৈরি হয়েছে।

— আচ্ছা আচ্ছা! অদ্ভুত রহস্য বটে। তারপর কি হলো?

— তারপর আর কী! যা হবার নয় তাই হলো, পিংকি নীতেলার প্রতি এতটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে যে নাওয়া খাওয়া ভুলে কেবল নীতেলার সাথেই সময় কাটাতো, ধীরে ধীরে সে তেলাপোকার রূপ নেবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে, আর যাই করুক সে আর মানুষ হয়ে থাকতে চায় না, তেলাপোকা হয়ে সে নীতেলাকে বিয়ে করে সংসারী হতে চায়।
দেরী না করে সে নীতেলাকে পুরো ব্যাপার টা জানায়, নীতেলাও তাঁর প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে।
এখন ব্যাপার হচ্ছে পিংকিকে কি করে তেলাপোকা বানানো যায়! অনেক ভেবে নীতেলা ওদের বংশের সাতেলা নামক এক সাধুবাবার সাহায্য নেয়। সাধুবাবা সাতেলা অনেক যজ্ঞ সাধনা করে একটা উপায় বের করেছে পিংকিকে তেলাপোকার রুপ দেবার জন্য।উপায়টি হচ্ছে পিংকি যদি নীতেলার ডিম দিয়ে শরবত বানিয়ে তিনবেলা পান করে এবং মাঝরাতে ওই শরবতে গলা সমান সাতদিন ডুবে থাকে তবেই পিংকি তেলাপোকার রূপ নিতে পারবে।
সব শুনে পিংকি নিজের কষ্টের তোয়াক্কা না করে সাধুবাবা সাতেলার দেওয়া নিয়ম গুলো পালন করতে থাকে, কারণ একটাই, নীতেলাকে সে কিছুতেই হারাতে পারবে না। আস্তে আস্তে সাতদিন হয়ে যায়। সাতদিন পর পিংকির কোনো সাড়া না পেয়ে পিংকির মা পেয়ারা বেগম পিংকির রুমে গিয়ে দেখলেন গলা সমান ডুবে থাকা শরবতে একটি তেলাপোকার খোলস পড়ে রয়েছে কেবল। পিংকি সেখানে নেই, সারা বাড়ি খুঁজেও পিংকির কোনো খোঁজ মিললো না। অতঃপর পিংকির মা পেয়ারা বেগম সব ঘটনা আমাকে জানায়।
আমার মনে হচ্ছে এখানে নিশ্চয়ই নীতেলার হাত রয়েছে,কেননা সেদিনের পর থেকে নীতেলাকে আর কোথাও দেখা যায়নি।

— আচ্ছা সব কিছু বিবেচনা করে আপনার এটা মনে হয়নি যে পিংকি হয়তো নীতেলার সঙ্গে পালিয়ে গেছে!!

— বলছেন?তবে যদি পালিয়েই যাবে আমায় কেনো জানালো না?

— কাউকে জানিয়ে পালালে তো পালানোর আনন্দ টা ঠিক উপলব্ধি করা যায় না, তাই জন্যে হয়তো আপনাকে জানায়নি।

— আচ্ছা! তবে চলুন তাহলে আমরাও পালাই।

— মানে? কী যা তা বলছেন! পালাবো মানে? তাও আপনার সাথে?

— অবশ্যই আমার সাথে, কারণ এই মূহুর্তে আমি আপনার প্রেমে পড়ে গেছি। পালাবেন নাকি গায়ে তেলাপোকা ছেড়ে দেবো??

— এটা কিন্তু ঠিক নয়, এভাবে ব্ল্যাকমেইল করে আমার দেহ পাবেন কিন্তু মন পাবেন না।

–হা হা হা, কোনো ব্যাপার না, দেহর মধ্যে তেলাপোকা ছেড়ে দিলেই দেহের ভেতর থেকে মন গড়গড় করে বেরিয়ে আসবে।

অতঃপর সূচনা স্মরণকে নিয়ে পালালো, অনেকদূর যাওয়ার পর সূচনা হঠাৎ দাড়িয়ে পড়লো, এমন আচমকা দাড়িয়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলো স্মরণ__

— মনে হলো কানের বাম পাশ দিয়ে কিছু একটা উড়ে গেছে, আর আমাদের থামতে বলছে বারবার।

— হ্যাঁ হ্যাঁ ওই যে দুটো তেলাপোকা উড়তে দেখা যাচ্ছে।এরা আবার আপনার পিংকি আর নীতেলা নয় তো?

–দাড়ান দাড়ান দেখছি!

তেলাপোকা দুটি উড়তে উড়তে এসে একটি সূচনার ঘাড়ের উপর বসলো, তারপর ফিসফিস করে বললো “আমি পিংকিরে সূচনা! তেলাপোকার রূপ পেয়ে সেদিন খুশির ঠ্যালায় কাউকে কিছু না জানিয়ে নীতেলাকে নিয়ে পালিয়েছি। কিন্তু তোর সাথে হঠাৎ এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি, যাই হোক তোর সাথে এই ভদ্রলোক কে?

— আর বলিস না পিংকি! তোকে খুঁজতে গিয়ে আমিও ওনাকে নিয়ে পালিয়েছি। উনি ওসি সিমরান মাহমুদ স্মরণ।
আর এই যে স্মরণ সাহেব! আপনি শুনুন, এই হচ্ছে আমার বান্ধুবী তেলাপিংকি, সাথে ওর বর নীতেলা।
চলুন এবার আমরাও বিয়ে করি, সাক্ষী হিসেবে ওরা দুজন তো রয়েছেই। আর কোনো টেনশন নেই।

এদিকে স্মরণের আর অবাক হওয়ার শেষ রইলো না, মনে হচ্ছে সে একটি তেলামানুর জগতে রয়েছে, যেখানে মানুষ আর তেলাপোকার মধ্যে অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে ওঠে খুব সহজে।
সবচাইতে আকস্মিক বিষয় হলো তেলাপোকার ভয়ে এমন অবস্থায় বিয়ে করতে হবে আর সেই বিয়ের সাক্ষী হিসেবে কিনা দুটো তেলাপোকাকে মিনে নিতে হবে, এসবের মধ্যে থেকে স্মরণের নিজেকে তেলা তেলা মনে হচ্ছে। আবেগে নিজের নাম দিতে ইচ্ছে করছে তেলা স্মরণ।

অতঃপর তাঁদের বিয়ে হলো, দুজনের ছোট্ট সুন্দর সংসার। মাঝে মাঝে তেলাপিংকি আর নীতেলাও বেড়াতে আসে তাদের সংসারে।
স্মরণ কোনো কারণে সূচনার ওপর রেগে গেলে তেলাপিংকি আর নীতেলা তাঁকে ভয় দেখায়। ওদের ভয়ে স্মরণ কিচ্ছুটি বলতে পারে না। একজন পুলিশ অফিসার হয়েও তাকে দিনদিন তেলাপোকার ভয়ে কুঁকড়ে থাকতে হচ্ছে। বিষয়টি মেনে নিতে কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও মুখফুটে কিছু বলতে পারে না স্মরণ। নিরবে নিঃশব্দে সহ্য করে যায় এই তেলাজীবন।
মানুষ হয়ে বাঁচার ইচ্ছেটাই দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, মন চায় নিজেও তেলাপোকা হয়ে যাক। তবে আর যাই হোক সূচনা মেয়েটা খুব ভালোবাসে তাঁকে। এইটুকু ভরসা নিয়েই নিজেকে অর্ধতেলা ভাবে স্মরণ, স্বার্থক ভাবে সে এই তেলাময় জীবন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে