#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০
গল্প: এক মুঠো বিকেল
লেখা: তানভীর তূর্য
.
তরুর একলা প্রহরগুলো কাটে খাঁচার ময়না পাখিটার সাথে গল্প করে এবং শাশুড়ির চেঁচামেচি শুনে। আজকাল তরুর নিজেকে যন্ত্রমানবী ছাড়া অন্যকিছু বলে মনে হয় না। যেন প্রাণহীন অনুভূতিহীন একজন। দেহের ভেতরে শুষ্ক আর ফাঁকা একটা আত্মা এখনও কোনোরকমে জীবিত আছে বলে নিজের অস্তিস্ত্বটুকু টের পায় সে। তবে তরু খুব করে চায় আত্মা তাকে ছেড়ে বহুদূরে চলে যাক। তাহলে হৃদস্পন্দনের মধ্য দিয়ে আত্মাটা তার অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখার যে দায়িত্ব সুনিপুণভাবে পালন করে আসছে তা থেকে অনন্তকালের ছুটি পাবে। তার এখন প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগে। প্রচণ্ড ঘুমাতে ইচ্ছে হয়। ঘুমের মাঝেই যেন কেটে যায় শত সহস্র শতাব্দী।
তরু প্রায়ই ময়না পাখিটাকে বলে, “তোর সাথে আমার দারুণ মিল জানিস তো। তুইও খোলা আকাশে পাখনা মেলার জন্য অপেক্ষা করিস আর আমিও পরম শান্তিতে একটু ঘুমানোর জন্য অপেক্ষা করি। আমরা দুজনেই অপেক্ষা করি। পার্থক্য শুধু এই যে তোর খাঁচাটা অনেক ছোট আর আমারটা বেশ বড়। বিশাল ছাদ এবং চার দেয়ালের চাকচিক্যময় বড় একটা খাঁচা।”
ময়না পাখি তরুর কথা বুঝতে পারে কিনা কে জানে! সে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে ডানা ঝাপটায়। তরু তখন নির্লিপ্ত চোখে একদৃষ্টে ময়না পাখির দিকে তাকিয়ে থাকে।
এই বাড়িতে ময়না পাখিটায় তরুর গল্প করার একমাত্র সঙ্গী। তবে ময়না পাখির সাথেও গল্প করতে হয় লুকিয়ে লুকিয়ে। তার শাশুড়ি সুরমা বেগম একবার দেখে ফেললেই সর্বনাশ। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকবেন, “সামান্য একটা পাখির সাথে কীসের এত গুজুর গুজুর বউমা? তোমার মাথাটা কি একেবারে খারাপ হয়ে গেল নাকি?”
তরু কোনো উত্তর দিতে পারে না। সে জানে, কিছু বললেই সুরমা বেগম পৃথিবী ওলট পালট করে দেওয়ার প্রচেষ্টায় রত হবেন। সুরমা বেগম সুযোগ পেলেই তরুকে হেনস্থা করেন। তার মতে শাশুড়িদের এরকম হতেই হয় তা না হলে সংসারে নিয়ম কানুন বলে কিছু থাকবে না। শাশুড়ির কথায় ছেলের বউরা নিঃশ্বাস নিবে আর নড়াচড়া করবে এটাই চিরন্তন নিয়ম।
অথচ বিয়ের পর পর সুরমা বেগম তরুকে কত স্নেহেই না আগলে রাখতেন। ঠিক মায়েরা যেভাবে তার মেয়েদের আগলে রাখে। কিন্তু আজ সব মিথ্যে। সবই মিথ্যে।
তরুর খুব ইচ্ছে করে তার শাশুড়িকে বলতে যে, শাশুড়ি শব্দটার পরে একটা মা শব্দ থাকে। একসাথে হয় শাশুড়ি মা। আপনি চিরকাল শাশুড়ি হয়েই থেকে গেলেন। কই, মা হয়ে উঠতে পারলেন না তো!
তরুর বলা হয়না কিছুই। বললেই যে শত অপমান আর গঞ্জনা গায়ে এসে পড়বে।
ময়না পাখিটার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলা ছাড়াও তরু আরেকটা কাজ লুকিয়ে লুকিয়ে করে। খাটের নিচ থেকে হারমোনিয়ামটা বের করে পরম মমতায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ধুলার আস্তরণ মুছে নেয়। তারপর সেটা কোলের উপর নিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। এই হারমোনিয়ামে যে তার অনেক আবেগ, অনেক ভালোবাসা, অনেক স্মৃতি মিশে আছে। তাই হারমোনিয়ামটা সামনে নিয়ে সে ফিরে যায় পেছনে ফেলে আসা বর্ণিল দিনগুলোতে।
ছোটবেলাতে বাবার কাছে গান শুনতে শুনতেই গানের প্রতি ভালোবাসা জন্মানো। এরপর বাবার কাছেই গান শেখা। স্কুল আর পাড়ার অনুষ্ঠানগুলোতে টুকটাক গাইতে গাইতেই গানের সাথে পথচলা শুরু। বাবা একদিন এই হারমোনিয়ামটা কিনে এনে হাতে দিয়ে বলেছিলেন, “মা রে, আজ সাত সুরের মশাল তোর হাতে তুলে দিলাম। এই মশাল জ্বেলেই একদিন তোকে তোর স্বপ্নকে ছুঁতে হবে। স্বপ্নকে সত্যি করতে হবে।”
তরু সেদিন সত্যি সত্যিই গানকে সঙ্গী করে স্বপ্ন ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। এই হারমোনিয়ামেই গান করে জাতীয় পর্যায়ে কত পুরস্কার পেয়েছিল সে। চারপাশের সবার ভালোবাসা তাকে সামনে এগিয়ে যেতে সাহস যুগিয়েছিল বারবার।
হঠাৎ করেই তার শিহাবের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। আসলে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের নিজের সিদ্ধান্ত বিকশিত করার সুযোগ খুব কমই থাকে। তরুকেও নিজের ইচ্ছেগুলো সরিয়ে দিয়ে বিয়েতে রাজি হতে হয়েছিল। বিয়ের আগে সে শিহাবকে বলেছিল, “গান আমার প্রাণ। আপনার কাছে শুধু একটা জিনিসই চাইবো। তা হলো গান নিয়ে আমি আমার মতো করে থাকতে চাই। আমার মতো করে বাঁচতে চাই।”
শিহাবও তখন খুশি মনে তার চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছিল। তরু ধরে নিয়েছিল নতুন জীবনে নতুন মানুষটার হাত ধরে সে তার স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। বিয়ের পর তার শাশুড়িও কত খুশি হয়েছিল! এর ওর কাছে গর্ব করে তাকে নিয়ে নানারকম গল্প করতো। তরুর বড় ভালো লাগতো শাশুড়ির ছেলেমানুষি দেখে।
কিন্তু বিয়ের মাস চারেক পর যখন একটা অনুষ্ঠানে গাইবার প্রস্তাব আসলো তখনই সবকিছু যেন এক নিমিষে বদলে গেল। শাশুড়ি বলতে লাগলো, “বাড়ির বউ হয়ে এক ঘর লোকের সামনে এসব আদিখ্যেতা করার কোনো মানেই হয় না।”
শিহাবও বেঁকে বসলো। অথচ শিহাব উচ্চশিক্ষিত এবং আধুনিক একজন মানুষ। হঠাৎ করেই নিজের মানুষটাও চোখের সামনেই একদম অচেনা হয়ে গেল।
তারপর থেকেই তরুর স্বপ্ন যাত্রার সমাপ্তি ঘোষিত হলো। তরুর পায়ে পরিয়ে দেওয়া হলো সংসার নামক বেড়ি। তাকে বারবার বুঝিয়ে দেওয়া হলো স্বামী সংসারের বাইরে একজন মেয়ের আর কোনো জীবন থাকতে পারে না। সে আটকে গেল চার দেয়ালের এক খাঁচায়। যে খাঁচায় বসে সে অপেক্ষা করে শিহাব তাকে একটু হলেও বুঝবে। তাকে একটু সময় দিবে। কিন্তু তরুর অপেক্ষার প্রহরগুলো দিনে দিনে বাড়তেই থাকলো।
একটা বাচ্চা থাকলেও তরু হয়তো প্রাণখুলে বাঁচতে পারতো। এ বিষয়ে শিহাবকে বলার পরেও অগ্রাহ্য করেছে বারবার। সে নাকি বাচ্চার ঝামেলায় এখনই যেতে চায় না। ওদিকে তরুর শাশুড়ি ভাবে সমস্যা হয়তো তরুর। তাই বিয়ের এতদিন পরেও সংসারে একটা বাচ্চা আসলো না। আকারে ইঙ্গিতে অপয়া শব্দটা তার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। তরুর বলার কিছু থাকে না। নীরবেই সহ্য করে যেতে হয়।
পাশের বাসার নীলু আপা তরুকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। তিনি তরুর এই অবস্থা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। তিনি প্রায়ই বলেন, “জানিস তো তরু, ওই যে আমরা এখন এ সমাজের নব জাগরণের কথা বলে বড় বড় লেকচার দিই সেগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যে। হাজার বছর আগে এ সমাজ যেখানে ছিল এখনও সেখানেই পড়ে আছে। শুধুমাত্র আমরা বাইরে বাইরে রঙিন আর বাহারি একটা চাদরে নিজেদের মুড়ে নিয়েছি কিন্তু ভেতরে ভেতরে লালন করি সংকীর্ণ আর ঘৃণ্য একটা মানসিকতা। যা থেকে আমরা খুব সহজেই বের হতে পারি না।”
এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে কয়েক ফোঁটা অশ্রু তরুর গাল বেয়ে গড়িয়ে যায় সে বুঝতে পারে না। অশ্রুর ফোঁটাগুলো হারমোনিয়ামের ওপর পড়ে বিষাদের অদ্ভুত সুর সৃষ্টি করে। যে সুর তরু ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় না। কখনও কেউ শুনবেও না।
আজ তরুর জীবনের বিশেষ একটা দিন ছিল। আজ তার আর শিহাবের তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী। সকালে শিহাব বের হয়ে যাওয়ার পর তরু ভেবেছিল শিহাবের অন্তত একটা ফোন নিশ্চয় আসবে। মনে মনে সে অপেক্ষাও করছিল। কিন্তু দিনটা এখন শুধুমাত্র তরুর একার কাছেই বিশেষ। শিহাবের কাছে কোনো বিশেষত্বই আর অবশিষ্ট নেই।
শিহাব রাতের খাবার সেরে এখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে কিছুই মনে রাখেনি। তরু শিহাবকে বলল, “সারাদিনে আজকের দিনটার কথা তোমার একবারও মনে হয়নি?”
শিহাব চোখ বড় বড় করে বলল, “আজ আবার কী দিন?”
তরুর কষ্ট পাবার কথা কিন্তু কেন যেন তার হাসি আসলো। সে বলল, “থাক, তোমার জেনে আর লাভ নেই। দিনটা না হয় একলা আমার কাছেই থাকুক। আজ তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো, দিবে?”
শিহাব ভ্রু কুঁচকে বলল, “এত ভণিতা করছো কেন? বলো।”
হঠাৎ তরু শিহাবের হাত দুটো ধরে আকুতি নিয়ে বলল, “আমি তোমার কাছে এক মুঠো বিকেল চাই। সেই বিকেলে আমি তোমার হাত ধরে হাঁটতে চাই। সেই বিকেলে তোমার কাঁধে একটু মাথা রাখতে চাই। সেই বিকেলে আমি প্রাণখুলে তোমার জন্য গাইতে চাই। দিবে, আমাকে এক মুঠো বিকেল?”
শিহাব বিরক্তি নিয়ে বলল, “রাত বিরাতে এ কোন নাটক শুরু করলে!”
বলেই পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। তরু মনে মনে বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলো।
গভীর রাত।
শিহাব গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন। রাতের পর রাত পার হয়ে যায় কিন্তু তরু ঘুমাতে পারে না। বুকের মধ্যে তীব্র অভিমান জমে আছে। ভাবলো, প্রশান্তিময় ঘুমের জন্য এই সিদ্ধান্তটা তার আরও আগেই নেওয়া উচিৎ ছিল।
সে দ্রুত ড্রয়ার খুলে স্লিপিং পিলগুলো খেতে এক মুহূর্ত দেরি করলো না। তারপর শিহাবের পাশে শুয়ে একটা হাত বাড়িয়ে শিহাবের পিঠ আলতো করে ছুঁয়ে দিলো। সাথে সাথে হাত গুঁটিয়েও নিলো। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। সে অশ্রু শিহাব দেখতেও পেলো না। আর দেখবেও না কোনোদিন। তরু চোখ বন্ধ করলো। তরুর বিশ্বাস অন্য কোনো অদেখা ভুবনে এক মুঠো বিকেল সে নিশ্চয় পাবে।