গল্প- আবার হলো দেখা | লেখা- ফারজানা রুমু

0
3071

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০

গল্প- আবার হলো দেখা
লেখা- ফারজানা রুমু

কখনও ভাবতে পারিনি এভাবে হঠাৎ তার সাথে আবারও দেখা হবে।

তার সাথে প্রথম পরিচয়টা ছিল একটা রংনাম্বার এর মাধ্যমে। এস এস সি পরীক্ষার পর প্রথম ফোন হাতে আসে আমার। নতুন ফোন পেয়ে কী প্রকার খুশিটা হয়েছিলাম আমি। এখনকার দিনে ছেলে মেয়েরা এনড্রোয়েড ফোন পেলে যেমন খুশি হয়, তেমনি আমিও খুশি ছিলাম। কিন্তু আমারটা শুধুমাত্র একটা নরমাল বাটন ফোন। ফোন পাওয়ার পর খুশিতে একে একে আমার সব বান্ধবী ফোন করে জানাই। কিন্তু আব্বু-আম্মুর একটাই শর্ত ছিলো, সারাদিন ফোন নিয়ে থাকলে চলবে না। পড়াশোনা ঠিকমতো করতে হবে। এস এস সি তে যেমন ভালো রেজাল্ট করেছি, তেমনি এইচ এস সি তেও ভালো করতে হবে। নয়তো ফোন হারাতে হবে। এই শর্তেই কলেজ জীবন শুরু করি।

আমার একটা অভ্যাস ছিলো অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পড়াশোনা করা। এমনই একদিন রাত জেগে পড়ছিলাম। হঠাৎ আমার ফোনে একটা কল আসে। এতো রাতে ফোন? আব্বু-আন্মু জানলে একেবারে শেষ করে দেবে। ভয়ের ঠেলায় দিলাম ফোন বন্ধ করে। পড়তে পড়তে কখন যে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। সকালে আম্মুর ডাকে ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙতেই দৌড় দেবো কলেজে। হঠাৎ ফোনের কথা মনে হতেই ফোনটা আবারও চালু করেই কলেজে চলে যাই। তিথি আমার ছোটকালের বান্ধবী। স্কুল জীবন একসাথে শেষ করি। আর কলেজেও এখন আমরা একসাথে। তিথিকে বললাম গতকাল রাতের ঘটনা। তখন ও আমাকে বললো অপেক্ষা করতে। আবার ফোন আসলে আমরাও সাড়া দিবো। যথারীতি ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরি। বাসায় ফিরে দৈনন্দিন রুটিন মতো কাজ করি। হঠাৎ সন্ধ্যায় আবার সেই ফোন।

“আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। রাতুল আছে?”

“জি না। এটা রংনাম্বার।”

বলেই ফোনটা কেটে দেই। এরপর সেই নাম্বার থেকে আর কোনো কল আসেনি। সেদিনের পর আমি নাম্বারটা ডিলিট করে দেই, সাথে ভুলেও যাই নাম্বারটার কথা।

কিন্তু হঠাৎ আবার সেই নাম্বার থেকে কল আসে। রাত তখন ১০ টা। মাত্র রাতের খাওয়া শেষ করে রুমে আসতেই দেখি ফোন বাজছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠে,,,,

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছেন?”

“আমি সাদাত। সেদিন ভুল করে আপনার নাম্বারে ফোনটা চলে আসে। আসলে আমি যে বন্ধুটিকে কল দিতে গিয়েছিলাম একটা নাম্বারের হেরফেরের জন্য কল আপনার নাম্বারে আসে। I’m sorry.”

“আচ্ছা, ঠিক আছে। It’s ok । রাখছি তাহলে।”

“কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতাম। আসলে যে জন্য আবার কল দিলাম আপনাকে।”

“বলুন।”

“আপনার কণ্ঠটা খুব মিষ্টি। তাই আবার কল দিলাম। আপনি কি বিরক্ত হচ্ছেন আমার কথার?”

“তা নয়। আসলে এখন একটু পড়তে বসবো।”

“আচ্ছা, আজ তাহলে রাখি। কাল না হয় আবার কথা হবে। কিন্তু আপনার নামটা জানলে ভালো হতো।”

“আমি কেয়া। আর কিছু?”

“না। ঠিক আছে, এবার যান। পরে আবার কথা হবে।”

বলেই কলটা কেটে দেয়। কিন্তু যতক্ষণ কথা বলছিলাম কেন ভালো লাগছিলো আমার। এভাবে আবারও ৩/৪ দিন কেটে যায়।
আবারও একদিন ফোন দেয়।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন?”

“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”

“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কীসে পড়েন?”

“এবার এইচ এস সিতে ভর্তি হলাম। আপনি?”

“সামনের বছর এইচ এস সি ফাইনাল দেবো। তাহলে তোমাকে তুমি করে বলতেই পারি।”

সাদাতের কথায় হেসে দেয় কেয়া।

আগে সাদাতের সাথে ৩/৪ দিন পর পর কথা হলেও, ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। তারপর প্রতিদিনই কথা হয় ওর সাথে। কিন্তু তা খুব অল্প সময়ের জন্য। ও বলতো কথা বলার জন্য যেন পড়াশোনার কোন ক্ষতি না হয়।

এভাবে আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়, এরপর বন্ধুত্ব থেকে ভালো লাগা।

ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় মাত্র ১০ মিনিটের জন্য। ছোটবেলা থেকেই আমি ভিতু প্রকৃতির। ওর সাথে প্রথম দেখা হয় আমার কলেজে। আরো কিছুক্ষণ থাকতে বলেছিলো আমায় সে। কিন্তু ভয়ে তো আমার নাজেহাল অবস্থা। অবশেষে আমার অবস্থা দেখে সে হেসেই দেয়। দেখা হওয়ার পর ওর সাথে আমার এতোটুকুই কথা হয় ” বাসায় পৌঁছে জানিও। রাতে কথা হবে”। বাসায় আসার পর ভেবেই নিয়েছিলাম হয়তো আমাকে আর ভালো লাগবে না ওর। আমি যে ভিতু। এমন মেয়েকে কারো ভালো লাগবে নাকি। কিন্তু সে আমাকে ভুল প্রমাণ করে তখন ওর প্রতি ভালোলাগা আরো বেড়ে যায়।

দেখতে দেখতে কেটে গেল একটা বছর। সামনে আমার পরীক্ষা।

রাত ১০ টা,,,,,,

প্রতিদিনের মতো আজও রাতের খাবার খাওয়া শেষ করে পড়তে বসি। হঠাৎ ওর ফোন আসে।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?”

“আলহামদুলিল্লাহ। আজ এতো চুপচাপ মনে হচ্ছে?”

“ভেবেছিলাম এখন জানাবো না। কিন্তু এখনই বলা উচিত তোমায়।”

“কোন সমস্যা?”

“কাল আমার ফ্লাইট। ৫ বছরের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছি। পড়াশোনা শেষ করেই আবার আসবো। চিন্তা করো না। গিয়ে ফোন করবো। পড়াশোনা ভালো করে করো। পরীক্ষা যেন ভালো হয়।”

এক নাগারে কথাগুলো বলে ফোন রেখে দিলো। আর এখানে আমার সবকিছু যেন শেষ হয় যাচ্ছে। একদিকে ভালো করে কাঁদতেও পারছি না ভয়ে, আরেকদিকে কান্না ধরে রাখতেও পারছি না। অবশেষে না পেরে বাথরুমে গিয়ে কেঁদে মনটা কিছুটা হালকা করি।

ও বলেছিলো পৌঁছে ফোন দিবে সেই অপেক্ষায় ২ দিন পার করি। কিন্তু আর কেন ফোন আসেনি। ধরেই নিয়ছি সবকিছুর শেষ হলো। ধীরে ধীরে নিজেকে শক্ত করি। পড়াশোনায় মন দেই আবার। পরীক্ষাও দেই ভালো মতো। দেখতে দেখতে কেটে গেল ৬/৭ টা বছর। পড়াশোনা শেষ করে একটা স্কুলে চাকরি করছি। কিন্তু তাকে যে ভুলিনি। হয়তো সে ভুলে গেছে আমাকে। দোয়া করেছিলাম আর যেন সে সামনে না আসে আমার। পুরনো কষ্ট আর সহ্য করার ক্ষমতা নাই। দুরে থেকেই ভালো থাকুক সে।

কিন্তু আবারও দেখা হলো তার সাথে।

স্কুলের এক অনুষ্ঠানে হঠাৎ আবারও সামনাসামনি হলাম। তবে তার সাথে ছোট্ট এক ছেলে। ছেলেটি হঠাৎ তাকে বলে উঠে,,,,,

“চাচু, এই সেই ম্যাম। যিনি আমার খুব প্রিয়।”

কথাটা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সাদাত। আর কেয়া কেবল একটা চাপা হাসি দিয়ে এগিয়ে যায় সামনে, তার বেদনাময় অতীতকে পিছনে ফেলে।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে