গল্পের নাম:ভালবাসার গোধূলিবেলা | লেখিকা:ফাইজা হাবীব নীবুলা| ভালোবাসার গল্প

0
990

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০
গল্পের নাম:ভালবাসার গোধূলিবেলা
লেখিকা:ফাইজা হাবীব নীবুলা

আফজাল সাহেব আজ ও একটি রুমের সামনে এসে থমকে গেল।ভেতরে নার্সের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে,না আজও ১০২ নং রুমের মেডামের মন খারাপ।মেডামের মন ভালো করতেই আফজাল সাহেব দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেন।কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই একটি মায়াবী কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন,কে আপনি?আমার ঘরে ঢুকেছেন কেন?
কী উদ্দেশ্য, কী কার্যসিদ্ধির আশায় ঢুকেছেন?
নার্স ১০২ নং রুমের মেডামের আচমকা এমন করে প্রশ্ন দেখে তাড়াতাড়ি করে বললো,মেডাম আপনার মন খারাপ,আপনার সময় কাটানোর জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন বড় সাহেব,উনি সেই বিজ্ঞাপন পড়েই এসেছে।আপনার সাথে গল্প করবেন,বই পড়ে শুনাবেন।
নার্সের কথা শুনে ১০২ এর মেডাম একটু সুস্থির হলেন।আফজাল সাহেব স্মিত হেসে এগিয়ে গেলেন, শুনানো শুরু করলেন আজকের গল্প।
গল্পে দেখা গেল, একটি সদ্য কৈশোরে পেড়িয়ে যৌবনে পা দিয়েছে এমন একটি সদ্য ফোটা গোলাপ ফুল ঢাকা মেডিকেল কলেজে পা দিয়ে ছিল, আজকে প্রথম দিন তাই রোদেলার মন দুরুদুরু করছে।কি যে হবে!সিনিয়ার ভাইয়া আপুরা আজকে নিশ্চিত যার্গ দিবে,ঐ যে সামনেই চলছে বিশাল নাটক।৩য় বর্ষের সবাই নতুন ফ্রেশার দের র‍্যাগ দিচ্ছে।চুপচাপ মেয়ে হিসেবে রোদেলার সুনাম ছিলো স্কুল কলেজে,কিন্তু আজ এই অন্তর্মুখী স্বভাবই যেন মাঝ নদীতে ডুবিয়ে দিলো।বাংলায় একটি কথা প্রচলিত ছিলো, হতভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়,রোদেলার কপালটাই যেন ওমন।তাই তো ওর ভাগ্যে পড়লো এক সিনিয়ার বড়ো ভাইয়ার সাথে নেচে দেখাতে হবে।এই পানিশমেন্টের কারণ একটাই ঐ যে রোদেলা ভুল করে বলেছিলো ও ভালো নাচতে পারে।এখন এই পানিশমেন্ট নিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো মাথা নিচু করে রোদেলা।এদিকে
যার সাথে জুনিয়র মেয়েটির নাচার কথা হচ্ছিলো সে কিন্তু এতক্ষণ নিজের দুনিয়ায় বিভোর ছিলো,হঠাৎ করে চোখ উঠিয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে রইলো বিহান,মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো মেয়েটাকে মূর্তির মতো লাগছে কেন? এদিকে চারদিকের চাপে রোদেলা যখন বিহানের দিকে নিরুপায় হয়ে তাকালো, রোদেলার অশ্রুভেজা চোখ দেখে বিহানের মনে হলো বিশ্বের সব কিছু থমকে গেছে,থমকে গেছে ঐ ভেজা নয়নদুটির মধ্যে,যেন সমগ্র বিশ্ব ঐ দুটি চোখের মধ্যে হারিয়ে গেছে।
এই টুকু পড়ার পর আফজাল সাহেব চোখ তুলে তার সামনের রোগিনীর দিকে তাকালো,দেখলো দুটি নিষ্পাপ চোখ একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে,চোখের উৎসুক দৃষ্টি বলে চলেছে,তারপর?
নার্সকে জুস দেয়ার জন্য চোখ দিয়ে ইশারা করে আফজাল সাহেব পুনরায় গল্প শুরু করলেন,আর গল্পের মনোযোগে নার্স দেখলো মেডাম চুপচাপ জুস খেয়ে নিচ্ছে।
বিহান নিজের ভেতরের মধ্যে চলমান অনুভূতির ঝড়কে সামাল দেবার পূর্বেই দেখলো রোদেলাকে সবাই অনেক কটূক্তি করে চলেছে।তাই সমস্যা সমাধানে বিহানই বললো, তুমি শুধু আমার হাতটা ধরো, আর কিছু করতে হবে না।বিহানের এই কথা শুনে বিহানের সব বন্ধুরা যেন ডাকাতদলের মতো হারে রে রে বলে তেড়ে আসতে নিলেই বিহানের চোখের গরমে থেমে গেল আর রোদেলা এই বৈরি পরিবেশের মাঝে খুঁজে পেলো একটা নিরাপদ আশ্রয়ী বটগাছ।আর যেই মুহূর্তে রোদেলা বিহানের হাতে হাত রাখলো সেই মুহূর্তে বিহান এই হাত সারাজীবন ধরে রাখার প্রতিজ্ঞা করলো।এইভাবেই শুরু হয়েছিলো বিহান আর রোদেলার গল্প যা দিনে দিনে ছোট্ট চারা থেকে দুজনের ভালোবাসার জলে মহীরুহে পরিণত হয়েছিলো।কিন্তু একদিন হঠাৎ এক ঝড়ে সেই গাছটা পড়ে গেল,উপড়ে গেল এতদিনের ভালোবাসার ফসল।এইটুকু পড়ে থেমে গেলেন আফজাল সাহেব,তার সামনে বসা শ্রোতা বলে উঠলো কি হয়েছিলো বিহান আর রোদেলার?আফজাল সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,মেডাম আপনার খাবারের সময় হয়েছে,লাঞ্চের পর জানতে পারবেন কি হয়েছিল রোদেলা বিহানের।
অন্যমনষ্কভাবে মেডাম দুপুরের খাবারটুকু শেষ করলো, ঔষধ খেয়েই বললো,তারপর??
দুজন যখন ভালোবাসার তুঙ্গে তখনই এলো একটি সংবাদ যা একই সাথে ছিলো দুঃখের আবার একদিকে সুখের।মেডিকেল কলেজের শেষে ইন্টার্ন এর সময়ই ইউ.এস.এ থেকে স্কলারশিপের কাগজ চলে এলো বিহানের,কিন্তু রোদেলাকে ফেলে যাবে কি করে?রোদেলা তাই বিহানকে ভালোবাসার দোহাই দিয়ে রাজি করালো,বিহান উড়াল দিলো একদিকে, আরেকদিকে রোদেলার ভাগ্যকাশে মেঘের অমানিশা ঘনিয়ে উঠলো।রোদেলার বাবা তার বিজনেস পার্টনারের ছেলের সাথে রোদেলার বিয়ের বন্দোবস্ত করলো,কিন্তু রোদেলা কি করে মেনে নেয়,তার বিহানের অস্তিত্ব যে তার ভেতরে, রাতের আঁধারে বিয়ের আগের রাতে পালালো।কিন্তু শেষ ভরসা হলো না,যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো সে ছিলো মানুষরূপী অমানুষ।রোদেলাকে অপহরণ করে এক ভয়াবহ অত্যাচার এর অধ্যায় শুরু করলো।এদিকে বিহান যখন রোদেলার সাথে যোগাযোগ করতে পারলো না তখন তৎক্ষনাৎ দেশে ফিরে এলো সে।পুলিশের সাথে মিলিত অভিযান চালিয়ে যখন রোদেলাকে খুঁজে বের করলো ততদিনে রোদেলা তার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে,পরিণত হয়েছে এক জড় পদার্থে।রোদেলাকে তৎক্ষনাৎ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রোদেলা আগের থেকে কিছুটা সুস্থ হলেও প্রচন্ড মানসিকচাপে পুরাতন সব ভুলে গেছে,এমনেশিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।
গল্প পড়া শেষ করে চশমা খুলে আফজাল সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বসে রইলো।হটাৎ করে মেডাম বলে উঠলো, বিহান এই গল্পটা তোমার আমার না?বিহান আমি তোমাকে ভুলে গেছি?আমাদের ভালবাসা ভুলে গিয়েছি?এই কথা বলে কাঁদতে কাঁদতে রোদেলা বিহানকে জড়িয়ে ধরলে,নার্স রোদেলার শরীরে ঘুমের ঔষুধ পুশ করে দিল।এলিয়ে পড়লো বিহানের বুকে রোদেলা এক পশলা বৃষ্টির মতো,রোদেলাকে কেবিনে রেখে বিহান বাইরে এসে রাতের আঁধারের বুকে টিপটিপ করে জ্বলতে থাকা আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।পিছন থেকে বাবা বলে জড়িয়ে ধরলো,একটি ছোট্ট বাচ্চা।মা আবার তোমাকে আর আমাকে ভুলে গেছে,হুম এই জনাবই হচ্ছে বিহান আর রোদেলার কলিজার টুকরা।রোদেলা অমানবিক অত্যাচার সহ্য করেও নিজের সন্তানকে বাঁচিয়ে রেখেছে।বিহান একবার ভুল করেছে হাত ছেড়ে রোদেলার, আর রোদেলাকে একা ছাড়বে না।তাই তো গল্পের ছলে রোজ রোদেলাকে মনে করাতে চায় সেই পুরাতন দিনগুলি,দিনশেষে গোধূলিবেলায় এসে যদিও বা রোদেলার সব মনে পড়ে তবে পরদিন আবার ভুলে যায়,এভাবেই চলে রোদেলা আর বিহানের ভালোবাসার চক্র।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে