তৃতীয় পর্ব
৭.
‘শবনম! আমার চা কোথায়?’ নির্ঝর আদুরে গলায় ডাকল ।
আমি নির্ঝরের ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে কিচেন থেকে চায়ের কাপ হাতে বেরিয়ে এলাম। দেখলাম নির্ঝর বারান্দায় তার রকিং চেয়ারটাতে বসে দুলছে। চোখ বুজে আছে সে। আমি খুব ধীর পায়ে নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। চোখ বুজা অবস্থাতেই নির্ঝর হাত বাড়িয়ে দিল। আমি অবাক বিস্ময়ে বললাম,’কী করে বুঝলে আমি চা নিয়ে এসেছি?’
জবাবে নির্ঝর মুচকি হাসল। দু শব্দে বলল,’ভালোবাসার টান।’
আমি হেসে বললাম,’তুমি বসো। আমি আব্বুকে চা’টা দিয়ে আসি।’
নির্ঝর মাথা নাড়ল । ইশারায় বলল দেরি না করতে। আমি দ্রুত পায়ে আব্বুর জন্য চা নিয়ে গেলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে করাঘাত করতেই ভিতর থেকে আওয়াজ আসল। ‘আমার শবনম মামুণি, জলদি নিয়ে এসো তোমার ম্যাজিকাল চা।’ আব্বু বললেন।
আমি সহাস্যে ধীর পায়ে আব্বুর কাছে গিয়ে তার হাতে চা’টা দিতেই তিনি প্রথমে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির সাথে বললেন,’মামুণি, কেমন লাগছে এখানে তোমার? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো এডজাস্ট করতে?’
আমি সহাস্যে বললাম,’আব্বু , যখন থেকে আমি আপনাকে আব্বু হিসেবে পেয়েছি তখন থেকেই সমস্যা আমাকে দেখলে পালিয়ে বেড়ায়।’
আব্বু আমার কথাটা শুনে খুব হাসলেন। বললেন,’হয়েছে, মামুণি । এবার নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসার ঝাঁপি খুলে বসবে । কিন্তু এখন আমি প্রশংসা শুনার মুডে নাই।’
আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,’আব্বু, আমি এখন মোটেই প্রশংসা করব না। কারণ আমি জানি আমার আব্বুটার যতই প্রশংসা করা যায় ততই কম হবে।’
আমার কথা শুনে আব্বু চোখ বড় করে তাকালেন। আবার মুহূর্তেই হেসে ফেললেন। তারপর বললেন,’যাও তো নির্ঝর কী করছে দেখ। আমার ছেলেটা যে এবার সংসারে থিতু হয়েছে–তাতেই আমি তোমার কাছে ঋণী। নয়তো আমার ছেলেটা জীবন থেকে ছিটকে পড়েছিল ঠিক আকাশ থেকে পড়া কোনো এক তারার মতো। তোমার কারণেই আজ আবার আমার ছেলেটাকে ফিরে পেয়েছি আমি। নয়তো আমার ছেলেটা সব সময় অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকত। সে তার সাথে ঘটে যাওয়া কষ্ট থেকে কখনোই বের হতে পারত না। কাঁচ যেমন কাঁচ কাটে। তেমনি দুঃখ ও দুঃখকে বিনষ্ট করে দিতে পারে। তা আমি তোমাদের দুজনকে না দেখলে কখনোই জানতে পারতাম না।’
আমি নীরবে বাবার কথা শুনছিলাম। কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না বলার মতো। তারপর আব্বু তাগাদা দিয়ে বললেন,’যাও মামুণি। এবার একটু রেস্ট কর গিয়ে ।’
আমি আর কোনো কথা বাড়ালাম না। আব্বু ততক্ষণে চা শেষ করে ফেলেছেন। আমি
ধীর পায়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
৮.
আমি রুমে এসে দেখলাম নির্ঝর চা শেষ করে ফেলেছে। আমি তার পাশে দাঁড়ালাম। সে আমার হাত ধরে তার পাশে বসাল। তারপর বলল,’শবনম, আমি চাই আজ বৃষ্টি নামুক সেদিনের মতো। যেদিন তোমাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম। মনে আছে তোমার?’
আমি লজ্জাবনত হাসি হাসলাম। কেন যেন নির্ঝর যখনই ওই রাতের কথা বলে লজ্জারা এসে ভীর করে আমার মুখে। আমি তৎক্ষনাত মুখ নত করে ফেলি। নির্ঝর আমার এই কাণ্ড দেখে খুব মজা পায়। আর তাই, প্রায় সময় এই রাতটির কথা সে বলে থাকে। আমাকে লজ্জা দিতে তার বেশ ভালো লাগে। আমার চিবুকে হাত দিয়ে মুখ তুলে নির্ঝর বলল,’আহা রে, আমার লজ্জাবতী বউটা!’ এটুকু বলে একটু থেমে নির্ঝর আবার বলল,’আচ্ছা, শবনম! তুমি এত লজ্জা পাও কোথায়? বলতো।’
আমার নির্ঝরের কথায় আরো বেশি লজ্জা লাগছিল। আমি তৎক্ষনাত সেখান থেকে উঠে যেতে উদ্যত হতেই নির্ঝর আমার হাত নিজের শক্তপোক্ত হাত দিয়ে ধরে ফেলল। বলল,’বিয়ের পর থেকে এতবার এই কথাটা তোমায় বললাম। তাও তুমি এখনও লজ্জা পাও। তবে যাই হোক আমার কাছে আমার এই লজ্জাবতী লতাকেই ভালো লাগে। এটাই তোমার ভূষণ। এটাতেই আমি বারেবারে ঘায়েল হই।’
আমি নিরুত্তর। নির্ঝর আমাকে তার শক্তপোক্ত হাতের বাহুডোরে খুব শক্ত করেই আবদ্ধ করলো এবার। যেন সেই বাহুবন্ধনে একটু ঢিল পড়লেই আমি হারিয়ে যাব! আমিও ছাড়া পাবার চেষ্টা করিনি। এই শক্ত বাহুবন্ধন’ই আমার একমাত্র বিশ্বাসের জায়গা। আমার ভরসার স্থল। যার উপর আমি চোখ বুজে ভরসা করতে পারি।
আমি আমার মাথাটা তার প্রশস্ত বুকে রাখলাম। নির্ঝর আলতো হাতে বিলি কাটছে আমার মাথায় । আর ফিসফিসিয়ে বলছে,’এবার আমার জুনিয়র শবনম চাই।’
আমি তৎক্ষনাত বললাম,’নাহ্! কোনো জুনিয়র শবনম নয়, জুনিয়র নির্ঝর চাই।’
কথাটা বলতেই আবার লজ্জারা এসে ভর করলো আমার মধ্যে । নির্ঝর বেশ বুঝতে পারছে। আমি তার দিকে না তাকিয়েই বুঝতে পারছি সে মুচকি হাসছে। আমি তার বুকের স্পন্দন বুঝতে পারছি। একটা নির্দিষ্ট তালে উঠানামা করছে তার বুক। শুনতে পাচ্ছি ঢিপ ঢিপ আওয়াজ, আর স্পষ্ট টের পাচ্ছি তার ছন্দপতন।
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। যেন প্রকৃতিও নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে চারপাশে। আমি সেই নিস্তব্ধতার জাল ভেদ করে আমি নির্ঝরের হৃদস্পন্দন কেবল অনুভব করছি আর শুনছি তার হৃদয়ের নানা অব্যক্ত কথন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি এলো। বৃষ্টির ঝাপটা গ্রিলের ফাঁক গেলে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের দুজকে। আমরা সেই স্নিগ্ধ পরশ অনুভব করছি। এক স্বর্গীয় অনুভূতিতে ছেয়ে গেছে আমাদের মন।
নিস্তব্ধতার চাদর ভেদ করে নির্ঝর বলে উঠল,’আজ বৃষ্টি ছুঁবে না?’
আমি নিরুত্তর। আমি জানি নির্ঝর এখন সেই রাতের কথা ভাবছে। যেদিন প্রথম দেখেছিল আমাকে।
নির্ঝর আবার বলল,’জানো, শবনম! আমি কিন্তু বৃষ্টি পছন্দ করতাম না। রাইমা চলে যাবার পর থেকে আমি নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছিলাম ঘরের অন্ধকারে । দিনের আলোয় জানলা খুলতাম না। আমার ভয় হত খুব। বাবা খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন আমাকে নিয়ে। আমি কেন স্বাভাবিক হই না! এরকম দুর্ঘটনা কি শুধু একা আমার জীবনেই ঘটেছে? বাবা বারবার আমাকে এই প্রশ্ন করতেন…….।’
আমি নির্ঝরকে বাধা দিলাম। তার মুখে আমার হাতটা রাখলাম। সে আমার হাতটা নিজ হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,’আমি বলতে চাই শবনম। সব না জানালেও কিছুটা তো তোমাকে বলতেই পারি। সেদিন বিদুৎ চমকাচ্ছিল। বৃষ্টি হচ্ছিল তুমুল। আমি তো বৃষ্টি পছন্দ করতাম না। সেদিন কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমি বারান্দার দরজা খুলে সৌদামিনীর ঝলকানিতে প্রথম তোমার মুখ দেখি।’
আমি নীরবে শুনছি নির্ঝরের কথা। নির্ঝর তার কথা থামাতে আমি তার দিকে মুখ তুলে তাকাই। নির্ঝর আমার দৃষ্টি পড়ে নেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করল,’তখন আমার মনে হয়েছিল, আমিই পৃথিবীর সবচাইতে দুঃখী মানুষ নই। আমার চাইতেও অনেক অনেক বেশি দুঃখ বয়ে বেড়াচ্ছে এই মেয়েটা।’
নির্ঝর গলার স্বর স্বাভাবিকের চাইতে আরো একটু উঁচিয়ে বলল,’জানো শবনম, তখন ওই জীবনের কাছ থেকে নিরাশ আমার মনে একটা কথার’ই উদয় হয়েছিল যে, আমি এই মেয়েটার দুঃখ ঘুচাব। ব্যস! সেই থেকে শুরু। অবরুদ্ধ এই আমি সমস্ত অন্ধকারকে পেছনে ফেলে পা বাড়ালাম আলোর দিকে। আর তুমি হলে আমার সেই আলোকবর্তিকা।’
বৃষ্টি থেমে গেছে। প্রকৃতি নিস্তব্ধ । জানি , সজীবতায় ছেয়ে গেছে সমস্ত প্রকৃতি। ঠিক যেন আমার মতো। আজ অনেক বছর পর নির্ঝর তার জীবনের এক কালো অধ্যায়ের অতি ক্ষুদ্র অংশ আমাকে বলেছে। আমি তার কাছে কখনো জানতে চাইনি। সেও আমাকে কখনো বলেনি। তবে আজ বলেছে। হোক তা অতি ক্ষুদ্র অংশ কিন্তু বলেছে তো।
চলবে…ইন শা আল্লাহ্