গল্পগুলো অজানাই থাক
_________ফাতিমা আক্তার অদ্রি
সূচনা পর্ব
১.
‘বাবা’ শব্দটিতে আসলেই কি অদ্ভুত কোনো ক্ষমতা আছে?
ছোটোবেলা থেকেই আমার মনের গহীনে এই প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি চলছে ক্রমাগত। সময়ের পরিক্রমায় তা বেড়েছে বৈ কমে নি। এখনো মনে পড়ে ছোটোবেলার সেইসব স্মৃতি–যা আমি এখনো মনে করতে ভয় পাই, পাই এক দুর্জ্ঞেয় কষ্টানুভূতি।
যখন স্কুলে যেতাম তখন দেখতাম বাবা নামের মানুষগুলো তাদের সন্তানদের আদর করে করে খাবার খাওয়ায়। খুব যত্ন করে। আমি নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতাম সেই বাবা নামক মানুষগুলোর দিকে আর খানিক পর পর তাকাতাম সেই বাবা নামক মানুষগুলোর সন্তানের হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে। আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরুতো না। আমার সামনে কোনো আয়না থাকত না। তবে আমি ওইটুকু বয়সেই বেশ ভালোই বুঝতে পারতাম; আমার মুখটা হয়ে যেত বিবর্ণ আর চোখ অশ্রুতে টলমল। যেন আমার গালে একটা মৃদু টোকা দিলেই গড়িয়ে পড়বে চোখের দেয়ালের উপর জমে থাকা স্বচ্ছ জলের ধারা।
আমি শবনম। এখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়ছি। সময়ের সাথে সাথে বয়সটাও বেড়ে গিয়েছে । কিন্তু মনটা এখনো না পাওয়ার কষ্টে আর্তনাদ করে। আমার কাছে কোনো ভাষা থাকে না নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য। অনেকটা সামলে নিয়েছি নিজেকে। কিন্তু ওই যে, বাস্তবতা বলে একটা শব্দ আছে। সেই শব্দটার কশাঘাত বড়ই নিদারুণ। যখনই কোনো বাবাকে দেখি; বিশেষ করে তাদের সন্তানের প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখলে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখ ভারী ওঠে আর মনের মধ্যে ওঠে এক ভয়ংকর প্রলয়ঙ্কারী তুফান ।
আজও আমি খুঁজে পাই না আমার প্রশ্নের উত্তর। আজও আমি জানতে পারিনি বাবার এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবার কাহিনী। বাবার চলে যাবার গল্প কি অজানাই থাকবে চিরকাল? আমি ভেবে পাই না! কেন এমন হয়েছে আমাদের সাথে? বাবা কেন আমাদের রেখে চলে গেলেন? জন্ম দিলেই কি বাবার কর্তব্য শেষ হয়ে যায়? সব দায়িত্ব কি শুধু ‘মা’ নামক মানুষগুলোর উপর বর্তায়? আমার মনের মধ্যে প্রশ্নেদের আন্দোলন চলছে ক্রমাগত সেই শৈশব থেকে। তবে আজও উত্তর আমায় দেয়নি ধরা। প্রশ্নের বেড়াজালে আবদ্ধ মানুষের কষ্ট শুধু তারাই বুঝে যারা এমন হাজারও প্রশ্নের সম্মুখীন। এসব কষ্ট তারাই বুঝবে যারা প্রতিনিয়ত সমাজের মানুষগুলোর কাছ থেকে বারেবারে আঘাত পায়। আঘাতে জর্জরিত হয়, রক্তাক্ত হয় যাদের হৃদয় ।
‘শবনম! দেখতো রাফিটা কই গেলো?’ মায়ের চিৎকারে আমার চিন্তা থমকে গেল । আমি জবাবে বললাম,’দেখছি আম্মু।’
আমি এতক্ষণ বসেছিলাম আমার রুমের বারান্দায় । রাফি আমার ছোট ভাই। এবার এইচ এস সি দিবে। আমরা দু ভাই বোনকে মানুষ করতে আমার আম্মুর যে ত্যাগ তা অবর্ণনীয় । কখনোই বলে শেষ করা যাবে না। বসা থেকে উঠার আগে চোখ মুছে নিলাম। আম্মু আমাকে দেখলেই বুঝে যাবেন যে আমি কেঁদেছি। কী অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে মায়েদের! আমার খুব অবাক লাগে। আমি সাধারণত লুকিয়ে লুকিয়ে কান্না করি। কারো সামনে কান্না করতে পারি না। লজ্জা লাগে খুব বেশি। কিন্তু লুকিয়ে কান্না করলেও আম্মু কীভাবে যেন বুঝে যান! আমার সত্যিই অবাক লাগে বিষয়টা! পৃথিবীতে মায়েরা সব থেকে বেশি ক্ষমতার অধিকারী: আমি এই একটা বিষয় থেকেই তা বুঝতে পারি। তারা অপরাজেয় ।
দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে পরপর কয়েক ঝাপটা পানি দিলাম মুখে। যাতে আম্মু কোনোভাবেই বুঝতে না পারেন যে আমি আবার কেঁদেছি। যদিও আমি জানি এটা আমার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা। আম্মুর সামনে পড়লেই তিনি বুঝে যাবেন বিষয়টা ।
২.
আমাদের বাড়ির সামনেই বড় একটা উঠোন। উঠোন পেরিয়ে বড় একটা খেলার মাঠ আছে। রাফিকে খুঁজছি । ছেলেটা দিন দিন বেয়াড়া হয়ে উঠছে। সারাদিন খেলা আর খেলা। খেলা ছাড়া সে আর কিছুই বুঝে না। আমি হেঁটেই যাচ্ছি। রাফিকে দেখতে পাচ্ছি না। এদিকে আম্মু আবার দুশ্চিন্তা করতে শুরু করবে। সামনে নিঝুমকে দেখেই আমি মনে মনে স্বস্তি পেলাম। নিঝুম যেখানে আমার ভাইটাও সেখানে থাকবে। দুজন একেবারে প্রাণের দোস্ত ।
মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিঝুমকে ডেকে বললাম রাফিকে ডেকে দেবার জন্য। সে তৎক্ষনাত দিল এক ভৌ দৌঁড় । দু’তিন মিনিটের মধ্যেই রাফি আমার সম্মুখে হাজির হলো। আমি এবার তার কান মলা দিয়ে ধরে বললাম,’ আম্মু যে সেই কবে থেকে ডাকছে, তার কি কোনো খবর আছে তোর?’
‘আপু সরি রে! এবারের মত মাফ করে দে। দেখ, আমি আর জীবনেও খেলব না। এই তোকে ছুঁয়ে বলছি।’ রাফি সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল।
আমি তৎক্ষনাত বললাম,’আমাকে ছুঁয়ে আর কত মিথ্যা কথা বলবি তুই? তোকে আর কোনো সুযোগ দেয়া যাবে না।’
‘আপু সরি বললাম তো।’ একটু থেমে রাফি আবার বলতে শুরু করল,’তুই জানিস না ক্ষমা করা মহৎ গুণ। তোর মধ্যে এই গুণটা একদম নাই। অর্জন কর, বুঝলি!’
আমি খ্যাপাটে গলায় বললাম,’লাগবে না আমার এই গুণ। তাড়াতাড়ি চল আম্মু ডাকছে। তখন আম্মু নিজেও আমাদের খুঁজতে বেরিয়ে পড়বে।’
রাফি তিরিক্ষি মেজাজে বলল,’তুই খুব নিষ্ঠুর আপু!’ তৎক্ষনাত আবার গলার স্বর নরম করে বলল,’আপু আজকে আম্মুর পিটানি থেকে বাঁচিয়ে নিস আমায়। প্লিজ আপু, প্লিজ।’ রাফির কণ্ঠে অনুনয় ঝরে পড়ছে।
আমি তার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। আমার ভাইটা অত্যন্ত ফাজিল। আমি মুখে হাসি রেখেই বললাম,’চল এবার। বাকিটা দেখা যাবে বাসায় গেলে।’
৩.
আম্মু খাবার বেড়ে দিচ্ছেন আর সমানে চেঁচাচ্ছেন । রাফি মুখটা একেবারে করুণ করে রেখেছে। একেবারে যেন ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে পারে না। আমি কোনোরকমে বললাম,’ আম্মু খাবার সময় এখন আর বকো না। খাবার শেষ হলে তখন নাহয় আবার শুরু করো।’
আম্মু সাথে সাথে বড় বড় চোখ করে তাকাল আমার দিকে। আমি ভয়ে মিইয়ে গেলাম। আম্মু বলল,’তোদের তো কোনো চিন্তা নাই । সব চিন্তা আমার। তোদের যে মানুষ করছি, সেইটাই আমার অপরাধ। একজন তো ফেলে রেখে বেঁচে গেছে। আপদ বিদেয় করে সে এখন সুখে আছে। সব জ্বালা হইছে আমার।’ এভাবে চিৎকার করতে করতে আম্মু হাতের সব বাটি , গ্লাস ধপাস ধপাস করে রাখছেন। আর শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছছেন।
আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। উঠে গিয়ে আম্মুর পাশে বসে জড়িয়ে ধরলাম আমার আম্মুকে। আমারও খুব কান্না পাচ্ছে। কান্নার তোড়ে আমার গলা ধরে গেছে। ধরা গলায় বললাম,’আম্মু, তোমাকে কতবার বলেছি, ওই অমানুষটার নাম আর কখনো মুখে উচ্চারণ করবে না। না আকারে না ইঙ্গিতে! আমাদের শুধু একজনই জন্মদাত্রী এবং সেটা তুমি। তুমি আমাদের আম্মু, তুমিই আমাদের সব। আমাদের কোনো বাবা নামক নিষ্ঠুর প্রাণীর দরকার নেই।’
আম্মুর চোখের জল আমি নিজ হাতে মুছে দিলাম। আমার আম্মুটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে । আমি এবার রাফির দিকে তাকালাম। রাফির কান্নাভেজা মুখটা দেখে আমার বুক কেঁপে উঠলো। আমার ভাইটা খুব সহজে কাঁদে না। তার আমার মতো কাঁদার বাতিক নেই। কিন্তু আম্মুর চোখের জল সে সহ্য করতে পারে না। তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। হঠাৎ রাফি তার জায়গা থেকে উঠে এসে আম্মুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। বলল, আম্মু আমি আর কক্ষণো তোমার অবাধ্য হবো না। তুমি যা বলবে তাই করব। তুমি যদি খেলতে নিষেধ করো। তবে আমি আর কখনো খেলতে যাব না। এই দেখ তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিলাম।’
আমি দেখছি আমার মা আর ভাইটা সমানে কেঁদে চলেছে। আমি দুজনকেই জড়িয়ে ধরলাম। আম্মু এবার কান্না থামিয়ে বললেন,’হয়েছে আমার সোনামণিরা! আর কাঁদতে হবে না। এবার খেতে শুরু কর।’
রাফি বলল,’আম্মু আজকে আমরা সবাই এক প্লেট থেকে খাব। তুমি খাইয়ে দেবে।’
আম্মুর চোখ তখন খুশিতে চকচক করছিল। সহাস্যে বললেন,’আচ্ছা ঠিক আছে। আজকে আমি আমার সোনামণিদের নিজ হাতেই খাইয়ে দেব।’
আমাদের দু’জনের মুখে আম্মু নিজ হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন । আর আমরা তৃপ্তির সাথে খাচ্ছি। আর আমি আর রাফিও আম্মুর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছি। এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি ।
চলবে…ইন শা আল্লাহ্
sihoron jagano lojjaboti.
apnar golpo mon dia pori
shob gula part chai