গল্পগুলো অজানাই থাক দ্বিতীয় পর্ব

0
1009

৪.
সকাল থেকেই আম্মু আয়োজনের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন । আজ নাকি আম্মুর দূর সম্পর্কের কোনো আত্মীয় আসবে। আর তাই আম্মুর কোনো রেস্ট নেই। সেই ভোর পাঁচটা থেকে কাজে লেগে পড়েছেন। আমিও উঠে পড়ি তখন। আমার খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস আছে। তাই ঘুম থেকে জলদি ওঠা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা হয় না।

রাফি গতকাল রাতেই বাজার করে এনেছে। আজ আম্মু কিন্তু বাড়াবাড়ি রকমের আয়োজন করছেন। আমি ভেবে পাচ্ছি না এতো আয়োজনের কী মানে!

নানান নাশতা, শরবত, আর পোলাও, মুরগির রোস্ট, খাসির রেজালা আরো কত কী! তারপর পায়েসসহ কয়েক প্রকার মিষ্টি জাতীয় খাবারের ব্যবস্থাও করেছেন। এতটা আয়োজন আমার কাছে বাড়াবাড়িই মনে হলো।

দুপুর নাগাদ মেহমান চলে আসলো। মোট পাঁচ জন সদস্য আসলেন। দুজন মাঝ বয়সী মহিলা, একজন বৃদ্ধা, আর একজন মাঝ বয়সী পুরুষ ও আরেকজন যুবক ছেলে।

আমি এনাদের পর্দার আড়াল থেকে দেখেই চলে গিয়েছি। রাফি তাদের বসার ব্যবস্থা করলো। কিছুক্ষণ পর আম্মু আমার রুমে এসে বললেন ভালো একটা কাপড় পরে নেবার জন্য। আমি তো পুরোই হতবাক। আমি বিস্মিত স্বরে বললাম,’আম্মু , এই ড্রেসে কী খারাপ আছে? ভালোই তো আছে এটা।’

তোকে পরতে বললাম পর। আর কোনো কথা না। আর একটু সাজগোজ করে নিস। আম্মুর এ কথায় খুব রাগ হলো। এই কথার মানে হলো এই মেহমানদের আগমন ঘটেছে আমাকে দেখার জন্য।আজকে যে আবার কত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে কে জানে!

আম্মুরই বা কী দোষ! উপযুক্ত মেয়ে বাসায় থাকলে কোনো মায়েরই মাথা ঠিক থাকার কথা না। আমি কোনোরকমে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। আম্মু ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে আমার রুম থেকে।

ব্লু আর সাদার মিশেলের একটা থ্রি পিস পরেছি। আম্মু জানেন যে আমি মোটেই শাড়ি পরতে রাজী হব না । তাই বোধহয় আজ আর শাড়ি পরতে বলেননি। মুখে হালকা ক্রিম মাখলাম আর চোখে দিলাম কাজল। আমি কখনোই কপালে টিপ পড়ি না।

রাফি হন্তদন্ত হয়ে আমার রুমে প্রবেশ করল। আমকে এক পলক দেখেই বলল,’আজকে বুঝি আমাদের ঘরে কোনো পরী চলে এসেছে? তাহলে আমার পেত্নী মার্কা বোনটা কই গেল?’

মাথা নাড়িয়ে এদিক সেদিক উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি এই বেয়াড়া ছেলেটা আমাকে খ্যাপানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ না দেখে সে আমার কাছে এসে পুনরায় প্রশ্ন করল,’পরী! আপনি আমার পেত্নী বোনটাকে দেখেছেন?’

আমি বড় বড় চোখ করে তাকালাম তার দিকে । তারপর তার কান মলে দিয়ে বললাম,’আমি পেত্নী? আবার বল কি যেন বলছিলি তুই?’

‘এহ্ রে! তোমার কথা আমার আপুনির মতো লাগছে কেন? তাহলে তুমিই কি? ইশ আপু একদম চিনতেই পারিনি। এত সুন্দর লাগছে কেন তাহলে? আমি ভাবলাম আমাদের বাসায় পরী চলে আসছে।’ রাফি মুখ কুঞ্চিত করে ব্যথা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল।

আমি আরও জোরে কান মলে ধরলে রাফি চিৎকার করে বলে,’আহ্ ! আপু লাগছে তো!’

‘পেত্নীরা এভাবেই মারে। জানিস না তুই?’ আমি খ্যাপাটে গলায় বললাম।

‘আপু ছাড় তো! আম্মু তোকে নিয়ে যেতে বলেছে। তোর হবু বর তোর জন্য অপেক্ষা করতেছে।’ মুখ ফুলিয়ে বলল রাফি।

রাফির কথা শুনে আমি তার কান ছেড়ে দিলাম। এর মধ্যেই আম্মু হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করে আমাদের দুজনকে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,’তাড়াতাড়ি আয় শবনম। রাফিটাও যে কী করে না! তাকে ডাকতে পাঠালাম আর সে নিজেই আটকে রইল।’

৫.
‘আপনার বাবা কী আপনাদের সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ করেন না?’ আমার সামনে বসা ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন।

তার প্রশ্ন শুনে আমার মাথা দপদপ করছে। আমি বুঝতে পারছি খুব ভালো মতোই যে শেষমেশ এই বিয়েটাও হবে না। আমি প্রচণ্ড রাগে হিসহিসিয়ে বললাম,’আপনি কি আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না?’

সামনে বসা ভদ্রলোক ইতস্তত করতে করতে বললেন,’ইয়ে মানে..একটু তো শুনেছি চাচীর কাছ থেকে। কিন্তু আপনার কাছ থেকে জানতে পারলে ভালো হয় না? তাই আরকি…!’

‘আমার সম্পর্কে জানতে চাইলে তো আমার কথাই জিজ্ঞেস করা দরকার। কিন্তু আপনি তো জানতে চাইলেন আমার বাবা সম্পর্কে !’ তেজী গলায় বললাম আমি।

ভদ্রলোক কেমন যেন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হয়তো আমার মতো বাবাহীন মেয়ের কাছ থেকে এমন তেজী স্বরের উত্তর আশা করেননি। একটু ধাতস্থ হয়েই
পরক্ষণেই বললেন,’শুনেছি আপনার বাবা আপনাদের ছেড়ে পালিয়েছে । সেই কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এই কারণটা জানার উপর আমার মতামত নির্ভর করবে । তাই আপনাকে এই প্রশ্ন করতে বাধ্য হলাম।’

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,’একজন মানুষের পরিচয় বলতে কি বাবার সমস্ত ইনফরমেশনকে বুঝায়? মায়ের ইনফরমেশনকে বুঝায় না? বাবা–মার কথা বাদই দিলাম । একজন মানুষের পরিচয় বলতে তো তার নিজস্বতাকে বুঝায়। আর আপনি আমাকে বিয়ে করবেন কি না তা আমার বাবার পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে!’

এতটুকু বলেই আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম । একটা দোয়েল পাখি বারান্দার রেলিংয়ের উপর বসে তারস্বরে গাইল। আবার ফুরুৎ করে উড়াল দিলো। আমি পাখিটার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সামনের মানুষটার দিকে সরাসরি তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। তারপর বললাম,’আপনি কি আমার বাবার সাথে সংসার করবেন?’

ভদ্রলোক একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর বোধহয় বুঝতে পেরেছেন যে আমি কারো হাতের পুতুল হয়ে চলার মতো মেয়ে নই। তৎক্ষনাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,’আপনাকে আমি কখনোই বিয়ে করব না। এত অভদ্র, বেহায়া মেয়েকে তো আমি কক্ষণো বিয়ে করব না। তার উপর পিতৃ পরিচয়হীন একটা মেয়ে! কিন্তু কথার কি ঝাঁঝ।’

আমি আবারো তার দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। কিছু বলাটা একেবারেই যুক্তিসঙ্গত হবে না। আমি এই বিষয়টা খুব ভালো করে জানি। তাই চুপ থাকলাম। এই ধরনের মানুষগুলো শুধু লেখাপড়াই করে কিন্তু আফসোস! এদের মধ্যে নূন্যতম মনুষ্যত্ব বোধটুকুও নেই। এরা আসলে শিক্ষিতের মুখোশের আড়ালে একেবারেই অঘা। আর এমন অঘাদের সাথে আমি কথা বলাই পছন্দ করি না।

৬.
বুষ্টির তোড় বাড়ছে। দু’হাঁটুর মাঝখানে মুখটা রেখে বারান্দায় বসে আছি । আরেকটা বিয়ে ভেঙে গেলো। আম্মু খুব কেঁদেছেন এটা নিয়ে । আম্মুর চোখের জল আমার হৃদপিন্ডটাকে যেন কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ার মতন করে খুঁড়ছে বারংবার। আর তাতেই রক্তক্ষরণ হচ্ছে। রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়ের সমস্তটুকু । তবুও আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছি, বেঁচে আছি।

বৃষ্টির পানির ঝাপটা আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমি সরছি না, নড়ছি না। আজ বৃষ্টির এই শীতল স্পর্শ আমার কাছে খুব আপন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি আমাকে তার পবিত্র স্পর্শে জানান দিচ্ছে আমার কষ্টে আমার সমব্যথী হবার। একটু পর উঠে দাঁড়ালাম। জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখছি। যদিও বৃষ্টির কারণে আকাশ অস্পষ্ট । তবুও দেখছি। ভালো লাগছে দেখতে। ডান হাতটা বের করে দিলাম। আমার হাতের তালুতে জমছে বৃষ্টির ফোঁটা টুপ টুপ শব্দ করে। আমি সেই পানি আবার ছিটিয়ে দিচ্ছে আমার চারপাশে।

হঠাৎ আমার চোখ পড়ল সামনের বাড়ির দিকে। এক জোড়া চোখ ঠিক আমার দিকে তাক করা। আমি সেই মানুষটাকে চিনতে পারলাম না। আমার কাছে খুব বিরক্ত লাগল এভাবে তাকিয়ে থাকাটা। আমি দ্রুত সরে গেলাম সেখান থেকে। যদিও আমার খুব ইচ্ছে করছিল বৃষ্টি ছুঁতে ।

ঘরের মধ্যে ঢুকতেই আমার মনটা আবার বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। আমি ভাবতে লাগলাম সে কে? হঠাৎ মনে পড়ল, ওখানে যে থাকে সেই ছেলেটাতো ঘর থেকে বের হয় না। রাফির কাছ থেকে শুনেছিলাম। ছেলেটা লন্ডন থেকে এসেছিল এই তো মাত্র কয়েক মাস আগে। আর আসার পর থেকেই দরজা বন্ধ করে, ঘর অন্ধকার করে পড়ে থাকে। কারো সাথে কথা বলে না, দেখা করে না। শুধু রুমে পড়ে থাকে।

হঠাৎ আমার মনের মধ্যে প্রশ্নের উদয় হলো। আচ্ছা কেন ছেলেটা এভাবে কারো সাথে কথা বলে না! কেন সে অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকে! কেনই বা সে বাহিরে বের হয় না! কি হয়েছে ছেলেটার? কী এমন কষ্ট; যে কষ্ট তাকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে?

রাফি হুড়মুড় করে আমার রুমে ঢুকে পড়ল। সেই শব্দে আমার ভাবনার জগতে ভাটা পড়ল। আমি একটু খেয়াল করতেই দেখতে পেলাম রাফিকে খুব বিমর্ষ মনে হলো। আমি বিছানায় বসে ছিলাম। রাফি এসে আমার পাশে বসল। বলল,’ আপু, সবার বাবা কত্ত ভালো হয়। আমাদের বাবাটা এমন কেন? আমাদের কেন ছেড়ে চলে গেল? কেন আমাদের খোঁজ রাখে না? কেন আমাদের ভরণপোষণ করে না?’

আমি রাফির কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি নিজের কণ্ঠ স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করলাম,’রাফি, ভাই আমার। কী হয়েছে?’

রাফি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’বাবা নেই বলে তোর কতগুলো বিয়ে ভেঙে গেল। বাবা নেই বলে আমার সাথে অনেকে খেলতে চায় না। বাবা নেই বলে অনেকে আড়চোখে তাকায় আমাদের দিকে। কেউ কেউ আবার করুণ চোখে তাকায়।’ রাফি থামল।

এবার রাফি গলার স্বর উঁচু করে বলল,’আপু জানিস, ওই করুণ দৃষ্টি আমাকে বারংবার তীক্ষ্মভাবে আঘাত করে একেবারে হৃদয়ের গভীরে, বারবার আমি ওই দৃষ্টিতে মারা যাই। কেন বল না ওরা ওভাবে তাকায়?’

আমি বাকরুদ্ধ। বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে এটা জানার পর আমার অনেকগুলো বিয়ে ভেঙে গেছে। আমাদের আর্থিক অবস্থার জন্য তো অনেকে রিজেক্ট করেই–তবে বেশিরভাগ রিজেকশন আসে বাবা ছেড়ে চলে গেছে জানার পর। আর তাই আম্মুর আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আমি ভাবি বিয়েই করব না। লেখাপড়া শেষ করে ভালো একটা জব করব। আম্মু আর ভাইকে নিয়ে কাটিয়ে দেব বাকি জীবন।

চলবে…ইন শা আল্লাহ্

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে