গল্পঃ প্রচলিত পর্ব ১
হাবিবা সরকার হিলা
লতিফার ভেজা শরীরটার দিকে তাকিয়ে আসগর আলী বিড়বিড় করে উঠে,
-বেহায়া মাগী! চুল মুছনের ঢং দেখ নায়িকা মৌসুমী ফেইল!
লতিফা গামছায় চুল পেঁচিয়ে শরীর বেঁকিয়ে তাকায়,
-কিছু কইলা?
-কি কমু আবার! তোর ঘাটে গোসল না করতে গেলে হয় না?
– হ হয়! প্রত্যেকদিন পুকুর থিকা বালতি ভইরা পানি আইন্না দিও ঘরের কোণায় গোসল সারুম!
-কে? তুই আনতে পারস না?
-তোমার সংসারে বান্দী খাইট্টা মাজার হাড় ক্ষয় করছি হেতে হয় না? হাত -পা ভাইঙা ঘরে বইসা থাকি রান্ধনের যোগান দিব কেডা!
আসগর আলী কথা বাড়ায় না। উবু হয়ে গুম ধরে বসে থাকে।
মুলির বেড়ার ঘর, টিনের ছাউনি। খসখসে সিমেন্টে লেপা মাটির ভিটে। পরিপাটি করে সাজানো বিছানা, আলনার কাপড় দেখলে বোঝা যায় এবাড়ির গৃহিনী বেশ গোছানো। বাচ্চাদের পড়ার টেবিল,রঙজ্বলা স্টিলের আলমারির পাশে একটা ছোট্ট ফ্রীজ! এখানে বিত্ত নেই তবে স্বাচ্ছন্দ্য আছে। আয়তাকার উঠানে পাশাপাশি ঘর তুলে আরো আট-দশ খানা পরিবার বাস করে৷ আসগর আলীর জ্ঞাতিগুষ্টি সব। আসগর আলীর ঘরের পাশে সুলতান শেখের রঙিন টিনের ভিটে পাকা ঘর। সুলতান শেখ আলীর চাচাতো ভাই
, বহুবছর আরব দেশ থেকে এসেছে। তার ঘর-গৃহস্থে বিত্তের ছোঁয়া। আসগর আলীর ইচ্ছা হয় জমানো টাকার সাথে কিস্তির টাকা তুলে একটা ঘর তোলা হোক। কাঠের পাটাতনের চকচকে টিনের ঘর।
-ছেলে দুটো বড় হচ্ছে।এক ঘর এক দুয়ারে আর কতদিন!
লতিফাকে একথা বলতে মুখে ঝামটা মারে,
-হইছে, যে কয়ডা টেকা ভাইঙা ফেললে পোলা দুইডার ভবিষ্যত হইবে কি! টেকায় নজর দেবার ইচ্ছা ছাড়ান দাও ওগুলান তুমি কব্জা করতে গেলে খুনোখুনি হয়ে যাবে।
অন্যসব পুরুষ মানুষ হলে বান্দীর চুল ছিঁড়ে টাকা উদ্ধার করত।আসগর আলী পারে না সে বউকে খানিকটা ভয় পায়।
লতিফা তার বউ হয়ে এসেছে সে বারো বছর আগের কথা। কতই বা বয়স ছিল চৌদ্দ-পনের। লতিফার বাবা-মা নেই, চাচার সংসারে মানুষ। আসগর আলীর মা ভেবেছিলেন ছুড়ি দেখতে শুনতে মন্দ নয়, বাপ-মা মরা মেয়ে স্বামীর কথায় সারাজীবন উঠবস করবে। লতিফার চাচা জুলহাস ব্যাপারী বলেছিল ভিন্ন কথা।
বিয়ের দিন আসগর আলীর হাতে নরম একখানা হাত তুলে দিয়ে বলেছিল,
-আমগো লতু পাগলি আছে, ওর মাথায় রাগটা একটু বেশি।বাবা,তুমি ওরে দেখেশুইন্নে রাইখো।
আসগর আলী আমলে নেয় নাই৷ ওতো কথার কথা বিয়ের সময় সবাই বলে। সে রাজমিস্ত্রীর কাজ করে।পয়সা খারাপ পায় না কিন্তু খাটতে হয় খুব। রাতে চৌকিতে গা এলিয়ে দেয়।
-বউ, এট্টু হাত-টা টিপ্পা দে। শরীর ব্যথায় কাইত হইতে পারি না।
বালিশখানা মাথায় দিয়ে লতু পাশ ফিরে শোয়।
-সারাদিন আপনেও গতর খাটাইছেন আমিও খাটাইছি। আপনে বাইরে আমি ঘরে। চুপচাপ ঘুমান যান, শরীর টিপনের শক্তি নাই।
আসগর আলী তাজ্জব হয়ে যায়। নতুন বউয়ের মুখে একেমন কথা! তার বৃদ্ধা মা এখন সরিষার তেল গরম করে বাজানের শরীর মালিশ করে দেয়।আর তার বউ বলে শরীর মাজন একটা ব্যারাম। একদিন আরাম পাইলে অভ্যাস হইয়া যায়।
লতিফা চঞ্চল। পুকুর থেকে মাটি তুলে ঘর লেপাঘষা করে, সারা বাড়ির মস্তবড় উঠান একা ঝাড়পোছ করে ঝকঝকে করো তুলে।আসগর আলী রাগ কর,
-তুই নতুন বউ মানুষ। উঠান ঝাট দিতে যাস কে?
-হ! হাঁটু হমান পাতায় তলাইয়া থাকে৷ তোমার মা-বইন কেউ পরিষ্কার করে না কেন!
-মাগী তুই মা তুইল্লা কস!
আসগর আলী হাতের তালপাতার পাখা সজোরে তুলে ধরে।
লতিফার চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ। চোখে চোখ রেখে বলে,
-গায়ে একবার হাত তুলে দেখ। তোমগো বাড়ির আমগাছের ডালে ফাঁসি দিয়া জেলের ভাত খাওয়ামু।
-দে গা, যা।
-হ! থানার পুলিশ পাছার মধ্যে বাইড়ানি দিলে বুঝবা মজা কারে কয়।
গ্রামের মহিলারা যেখানে দুইবেলা লাথি ঝাটা খেয়ে স্বামীর পা ধরে বসে থাকে। লতিফা সেখানে ব্যতিক্রম। মারতে এলে কোমরে আঁচল গুঁজে তেড়ে আসে।তাড়িয়ে দিতে চাইলে নিজেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়৷ আসগর আলী তবু লতিফার উপর রাগ করে থাকতে পারে না।
তাদের ভাইদের যেখানে যাকাতের টাকায় ভরসা করতে হয় সেখানে তার ঘরে রঙিন টিভি,ফ্রীজ শোভা পায়। বড় ভাই নিজের ভাগের জায়গা বিক্রি করে দেশান্তরি হল, আসগর আলী টিনের ঘরের স্বপ্ন দেখে৷ চৌদ্দ বছরের লিকলিকে কিশোরী জীবন নৌকার এত দক্ষ মাঝারি কে জানত! পাড়ার বউঝিরা কিস্তি তুলে স্বামীর হাতে তুলে দেয় আর লতিফা কিস্তির টাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাগজ কিনে।বিকেলে পরের বাড়ির কথা কানাকানি আর উকুন বেছে সময় পাড় করে না। ঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে বসে ঠোঙা বানায়৷ ছেলেদুটোর স্কুলখরচ-বেতনের কথা আসগর আলীর ভাবতে হয় না। লতিফা আছে।
আসগর আলী তবু বউয়ের উপর বিরক্ত হয়। ঘাটে শরীর ধুয়ে সুলতান শেখেন উঠান মাড়িয়ে আসতে হয়। সুলতান শেখ বাবু সেজে দাওয়ায় চেয়ার পেতে বসে থাকে।
-ভাবীর শরীরডা ভালা?
-জ্বী ভাই, ভালা।
শরীরডা কেমন শুকনা শুকনা লাগে। বহেন, ঝুমুরের মা চা জ্বাল দেয়, এক কাপ চা খাইয়া যাইয়েন নে।
-ভেজা শরীরে কেমনে বহুম! বিকেলে আহুম নে।
-আইবেন কিন্তুক।
সুলতান শেখ মুখে কথা বলে, দুইচোখ লতিফার ভেজা শরীরটাকে গিলে খেতে চায়। ভেজা কাপড় থেকে ছলাৎ ছলাৎ পানি ঝরিয়ে লতিফা নিজেদের ভাগের উঠানে এসে গামছায় চুল প্যাঁচায়। সুলতান শেখ দূর থেকে আড়চোখে লতিফাকে লক্ষ্য করে।
বিকেলে লতিফা অবশ্য চায়ের দাওয়াতে যায় না। সুলতান শেখ নিজেই আসে। ভদ্রলোক শৌখিন থাকতে ভালোবাসে।পরনে সাদা লুঙ্গি-পাঞ্জাবিতে দামী আতরের গন্ধ।
-ভাবী, ব্যস্ত নাকি?
হাতের ঠোঙা রেখে লতিফা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
-কী সৌভাগ্য! আপনে! বহেন বহেন।
চেয়ার আঁচলে মুছে লতিফা বসতে দেয়। সুলতান শেখ কথা বলে, ভাবী বলে সস্তা রসিকতাও চলে এতে দোষ নেই। লতিফা ঠোঙা বানায় আর হাসে। কাজ থেকে ফিরে এদৃশ্য দেখে আসগর আলীর অঙ্গ জ্বলে যায়।
সন্ধ্যায় আসগর আলী একটু বেশিই গম্ভীর। লতিফা একটু বেশিই উচ্ছ্বল।
-সুলতান ভাই অনেক কামের মানুষ।
-কেন?
-এত টেকা পয়সা।আবার আদম ব্যবসায় নামছে। দুবাই লোক পাঠাইব।
-তোমারে কেডা কইল?
-আমার লগে তো নিত্যিই কতা হয়। এক উঠানে ঘর।
-ও।
আসগর আলী আর কথা বাড়ায় না।
রাতে লতিফার গলা জড়িয়ে ধরলে ও বিরক্ত হয়,
-ছাড়ান দাও। পোলা দুইডায় ঘুম যায়।
-হে তো প্রত্যেক রাইতেই ঘুম যায়। এদিক ঘুরো!
-হুরো! বুড়া বয়সে ভিমরতি! ঘুম যাও!
আসগর আলী পাশ ফিরে শোও। মাথার শিরা দপদপ করতে থাকে।
-কুজাতের ঘরে কুজাত! ছিলান জানি কোথাকার! জামাই ধরলে দোষ পরপুরুষরে গতর দেখাইতে সরম লাগে না!
-চলবে
গল্পঃ প্রচলিত
হাবিবা সরকার হিলা