গল্পঃ পরগাছা

0
1210

গল্পঃ পরগাছা

হাবিবা সরকার হিলা
সন্ধ্যাদির কালো ব্লাউজের ফাঁকে ঘিয়ে বরণ কাঁধ,পিঠের একাংশ বেরিয়ে থাকে। এলোচুলে মস্তবড় একটা খোপা , সিঁথি টেনে লম্বা করে সিঁদুর পরে। ফর্সা মুখে জ্বলন্ত সূর্যের মত রক্তিম লাল টিপ শোভা পায়। সন্ধ্যাদিকে আমার ভালো লাগে। এনজিওতে যারা টাকা লোন নিতে আসে তাদের মত চেহারায় মলিন ছাপ নেই, শাড়ির আঁচলখানা মুখে চেপে আড়ষ্ট চোখে তাকায় না। পাঁচ বছর ধরে এনজিওতে কাজ করি সন্ধ্যাদির প্রতি সপ্রতিভ মহিলা একজনও দেখি নি।

এদেশের এনজিও গুলো গড়ে উঠে অসহায় নিম্নবিত্ত মহিলাদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে। বাহ্যিকভাবে যতই ভারী ভারী কথা শোনাক তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের মুনাফা অর্জন। অশিক্ষিত মহিলারা কজানেন না তাদের উন্নয়ন কাকে বলে। স্বামীর দোকানে আরো মূলধন প্রয়োজন, স্বামীর জন্যে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড অটোরিকশা কিনবে বা দুই-তিনটা বাছুর কিনে লালন করবে এইরকম আরো কত কিছু। অধিকাংশ সময় দেখা যায় যে উদ্দেশ্যে তারা ঋণ নিচ্ছে তা আর পূরণ করা হয় না। মুদি দোকানদার অনেকগুলো টাকা পায়,ঘরের টিন বদলাতে হবে, ছেলের স্কুলের বেতন এটা সেটা করে ঋণের টাকা শেষ হয়ে যায়।কিন্তু কিস্তি বোঝা বছরের পর বছর টানতে হয়, সাথে স্বামীর লাথিগুতা ফ্রী৷ যেই লোক একদিন তাকে ঋণ নিতে উৎসাহ করেছিলেন কিস্তির টাকা চাইতে গেলে তার কাছেই প্রতি সপ্তাহে শুনতে হয়,

-যা মাগী,এনজিওর বেটাগো লগে শুইয়া টাকা শোধ কর গা। আমারে আর জ্বালাইস না।

সন্ধ্যাদি ব্যতিক্রম। সে প্রথম দিন এসেছিল বাসন্তী রঙের ডোরাকাটা শাড়ি গায়ে, লাল ব্লাউজ,মাথায় এক চিলতে ঘোমটা। তার সিরিয়াল ছিল অনেক পিছনে। বেঞ্চে বসে পা নাচাচ্ছিল আর কিছুক্ষণ পর পর ফোনে কথা বলছিল। তার যখন কথা বলার সুযোগ এল জিজ্ঞেস করলাম,
-ঋণ নিবেন কেন?
– তা দিয়া আপনের কাজ কি?
-কারণটা উল্লেখ করতে হবে।
-ও। সুদে টাকা লাগাব। এক হাজারে এক মাসে ২৫ টাকা করে দিবে,বিশ হাজারে পাঁচশ টাকা। সালামের পোলা বিদেশ যাইব,সালামের বউ সুদে টাকা নিবে।

এটা অভিনব।কাউকে শুনি নি ঋণের টাকা নিয়ে সুদের ব্যবসা করে৷
-তা আপনি কিস্তি টাকা শোধাবেন কি করে? স্বামী জানে?
-যার টা খাই না,পরি না তারে জানানোর দরকার কি!

সন্ধ্যাদি পা নাচাতে নাচাতে উত্তর দেয়।

-আর কিস্তির টাকার চিন্তা কইরেন না। আমার মেলা বিজনেস আছে।

-বিজনেস!

অন্য মহিলারা তখন মাথা নেড়ে সায় দেয়।

-হ। সন্ধ্যাদির রেডিমেড থ্রি-পিস, শাড়ি-কাপড়ের ব্যবসা আছে আবার ঘটকালিও করে।

-বড় দোকান?

-স্যারের যে কথা। ওই গ্রামের বউঝিগো কাছে সেল করি। তয় ভালো মুনাফা থাকে।

সন্ধ্যাদি আত্মবিশ্বাসের সাথে সেদিন ঋণ নিয়েছিল। এরপর থেকে সন্ধ্যাদিকে আমি লক্ষ্য করতাম। গ্রামের মহিলারা কিস্তির টাকা দিতে আসত রোববার। সবাই মিলে যাকে বলে গল্পের আসর জমাত। একই পাড়ার মানুষ, সবার হাঁড়ির খবর সবার জানা। সন্ধ্যাদি জিজ্ঞেস করে,
-বুড়ি বয়সে আবার পোয়াতি হইছস? তোর ঘরে না সেয়ানা দুইডা পোলা।
-পোলার বাপের একটা মাইয়ার শখ হইছে।
-হইছে। দুই বেলা খাওনের যোগান নাই মাইয়ার মুখ দেখব। ঢং!
সন্ধ্যাদি মুখরা। অন্য কেউ হয়ত গায়ে চিমটি কেটে রসিকতা করে,
-কীগো বৌদি,তোমার জন মাইয়া চায় না? তোমারও তো দুইটা ছেলে।

সন্ধ্যাদি হাসে।
-ছোটটা জন্মানোর পর লাইগেশন করে আসছি। আমার আর ঝামেলা নাই।

-লাইগেশন! অন্যসব মহিলাদের চোখ বড় বড় হয়।

-দাদা রাজি হলেন।

-হ। সরকারি হাসপাতালে করাইলে নগদ দুই হাজার টাকা দেয় । টাকার জন্যে ওই বেটা ২১ হাত জলে নামতে পারে।
সন্ধ্যাদি খিটখিট করে হাসে।

অারেকদিন দেখি সন্ধ্যাদির মুখ খুশিতে ডগমগ।তার ছেলে বার্ষিক পরীক্ষায় ৬০৬ পেয়েছে।

-পোলাডারে কষ্ট করে মানুষ করো,বৌদি। এই পোলাই তোমার দিন ফিরাইব।

-হইছে। যার বাপ দিল না ভাত তারটা খাওনের আশা করি না৷ নিজে পড়াশোনা শিখে মানুষ হোক, নিজের ভাত যোগাতে পারলেই চলবে, আমার চিন্তা পরে।

সন্ধ্যাদির স্বামী রাজমিস্ত্রীর কাজ করে। যা কামায় জুয়া খেলে লুটায়। সংসার খরচ থেকে ছেলেদের পড়াশোনা সবই সন্ধ্যাদির ঘাড়ে। তবু তার দুই গালের আভা আর গজ দাঁতের হাসি জানান দেয় সন্ধ্যাদি ভালো আছে। আসলে সন্ধ্যাদিদের ভালো থাকতে হয়।

একদিন কিস্তির টাকা দিতে এসে ভ্যানিটি ব্যাগে হাত দিয়ে সন্ধ্যাদি চিৎকার করে উঠে,
-ঠাকুর! আমার পাঁচশ টাকার নোট গেল কই?
পাশের মহিলারা হৈ হৈ করে উঠবে। এখুনি সবার ব্যাগ চেক করা হবে। অভাবে স্বভাব নষ্ট।
সন্ধ্যাদি পা নাচিয়ে খিটখিট করে হেসে উঠে।
-তোগোরে সন্দেহ করি না। আমার ঘরে যে চোর পুষি হেই টাকা নিছে।
-ঘরের চোর!

-হ! জুয়ার টাকায় কমতি পরলে জুয়াড়িও চোর হয়ে যায়।

ধীরে ধীরে সবাই টাকা দিয়ে চলে যায়। সন্ধ্যাদি বেঞ্চ থেকে উঠে এসে বলে,
-স্যার, আমগো বাড়ি যাইবেন? কিস্তির টাকা লইয়া আনতেন,গরীবের বাড়ি এক কাপ চাও খাইয়া যাইতেন।

গররাজি হবার কোনো কারণ দেখলাম না। সন্ধ্যাদি নিঃসঙ্কোচে আমার সাথে রিকশায় চড়ে বসল। বেশি দূরে নয়, দশ টাকা রিকশা ভাড়া।মোড়ের চায়ের দোকানে বসা উঠতি বয়সের ছেলেরা জিজ্ঞেস করল,

-কীগো বৌদি, সাথে কে?

-এনজিও স্যার। কিস্তি টাকা নিতে আসছেন।

সন্ধ্যাদির এক চিলতে ঘর। বিত্তের বালাই নাই কিন্তু পরিপাটির কৃপনতা নেই। বিছানার তোশক-বালিশ, মুড়ির টিন, শোকেসের জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড৷
সন্ধ্যাদি আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত হাসি হাসে,

-আজ বুঝি বাবু বড় দান হারছে। পাঁচশ টাকায় কুলায় নি।আপনি চেয়ারটায় বসেন, চায়ের ব্যবস্থা করি।

চা টা খেয়ে টাকা নিয়ে উঠলাম।

সন্ধ্যাদি দরজা ভিজিয়ে এগিয়ে দিতে আসল,

সাইকেলে বসা একটা ছেলে ডেকে বলল,

-বৌদি,আমার জন্যে একটা ভালো মেয়ে দেইখেন।

-কেমন মেয়ে চাই?

-বাপের অনেক টাকা হলেই চলবে আর ধরেন আপনের মত ফিগার।ছেলেটা চোখ টিপল।

বৌদি-ঠাকুরপোর এতটুকু রসিকতা চলে। সন্ধ্যাদি হাসে।

রিকশায় উঠার আগে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই সন্ধ্যাদিকে বলে ফেললাম,

-আপনি তো স্বাবলম্বী, নিজের খরচ নিজে চালাতে পারেন। কেন মুখ বুজে এই লোকের সাথে টিকে আছেন?

সন্ধ্যাদি আলতো করে সিঁথির সিঁদুরে হাত দেয়। তিক্ত হাসি হেসে বলে,

-এইটুকু চলে গেলে যারা আজ বৌদি ডাক দেয় তারা কাল মাগী বলে দরজা ধাক্কা দিবে।
ওই যে, খালি রিকশা আসছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে