গল্পঃ “ডায়েরি” | লেখনীতেঃ নূর নাফিসা

0
2041

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০

গল্পঃ “ডায়েরি”
লেখনীতেঃ নূর নাফিসা
.
.
আমি নিঝুম। নামটা রেখেছেন ছোট মামা। মামা কি ভেবে রেখেছেন তার কারণ জানি না। তবে ভাগ্যের সাথে নামের প্রচন্ড মিল। সব নিঝুমের ক্ষেত্রে হয়তো মিল লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু আমি নিঝুমের জীবনে লক্ষিত। ছোট থেকেই চুপচাপ স্বভাবের ছিলাম। মা বাবা আদর করতেন খুব, যেটা সকল বাবা মা ই হয়তো করে থাকেন সন্তানদের। আমরা তিন বোন ও এক ভাই। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম আমাদের। বাবা ছিলেন মাছ ব্যবসায়ী। জেলেদের কাছ থেকে পাইকারি দরে মাছ কিনে বাজারে বিক্রি করতেন। সেই আয়ে চলতো আমাদের সংসার।
পরিবারের বড় মেয়ে আমি। আমার বয়স যখন তিন বছর তখন আমার মেঝো বোনের জন্ম। সে যখন কাঁদতো আমিও নাকি তার কান্না দেখে কাঁদতাম। আর তা দেখে আশেপাশের সবাই হাসতো। স্মরণে তো নেই, তবে বিষয়টা ভাবতে গেলে এখন আমারও হাসি পায়। আর ভাবি, “আমি কাঁদতাম কেন?”
পাঁচ বছর বয়সে মা হাতে আদর্শ লিপি বই দিয়েছেন। অন্যান্য বাচ্চারা পড়তে পড়তে নাকি বই খেয়ে ফেলে। আর আমি আমার বই রেখেছি খুব যত্ন করে। এতে প্রতিবেশীরা প্রশংসা করে। আমি অনুপ্রাণিত হই এবং আরও সুন্দরভাবে বই গুছিয়ে রাখি। হয়তোবা প্রশংসাই অনুপ্রেরণার হাতিয়ার, যা পাঁচ বছর বয়সেও আমাকে গ্রাস করতে পারে। আদর্শলিপি বাড়িতেই পড়তাম মায়ের সাহায্যে। আর মক্তবে যেতাম আরবি শিখতে। ছয় বছর পূর্ণ হলে শুরু হলো স্কুল যাত্রা। মক্তবের পাশাপাশি স্কুলে যেতাম প্রতিদিন। নতুন পরিবেশে প্রথম প্রথম ভয় পেলেও ধীরে ধীরে ভয়কে জয় করে মনে ভালোলাগার জন্ম নিয়েছে।
শিক্ষকদের কথামতো প্রতিদিনের পড়া প্রস্তুত রাখতাম ও ক্লাসে উপস্থাপন করতাম। এভাবে শিক্ষকদের মনেও জায়গা করে নিলাম। খুবই আনন্দে কাটাতে লাগলাম সময়।
যখন আমার বয়স নয় বছর, তখন ছোট বোনের জন্ম হলো। আমি মহা খুশি যে আমাদের ঘরে ছোট্ট একটা বাবু এসেছে। এমনিতে তেমন কারো সাথে কথা বলি না। অথচ বোনের জন্মের খবরটা আশেপাশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিয়েছি। পিছু পিছু ছুটেছে মেঝো বোন জাকিয়া। যাকেই পেয়েছি তাকেই বলেছি, “আমাদের ঘরেও ছোট্ট বাবু আছে।” কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলতো, “এবার তোদের আদর কমে যাবে।”, “তোদের খাবারের ভাগ কমে যাবে।”, “দিয়ে দে বাবুটা।” সব দুষ্টুমি সহ্য হতো তবে বাবু চাইলে রেগে যেতাম খুব। প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারতাম না, কিন্তু মনে মনে তার গোষ্ঠী উদ্ধার করতাম। তবে বাবুটা সত্যিই চলে গেলো অন্যের ঘরে। সাত মাস বয়সে তাকে নিঃসন্তান ফুপি চেয়ে নিয়ে গেছেন। খুব কেঁদেছি দুই বোন। কিন্তু আমাদের বাচ্চাদের কথা কে শুনবে? মাকেও প্রথম প্রথম কাঁদতে দেখেছি তবে মনে হলো অতি দ্রুতই ব্যাথা ভুলে গেছেন তিনি। হয়তোবা তার কারণ, ফুপির অবস্থা ভালো এবং সাচ্ছন্দ্যে লালিত হবে আমাদের বোন। আর মা আমাদের সান্ত্বনা দিতেন যে, আরেকটা বাবু কিনে এনে দিবেন।
বিগত পরীক্ষাগুলোতে ফলাফল ভালো হলেও চতুর্থ শ্রেনীতে ইংরেজি ও গণিতের ফলাফল ভালো হয়নি। যার ফলে পঞ্চম শ্রেনীতে প্রাইভেট পড়তে দিলেন বাবা মা। অতঃপর পড়াশোনায় সর্বোচ্চ চেষ্টা এনে পিএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলাম। শিক্ষকরাও খুশি, বাবামাও খুশি, আমিও খুশি। জাকিয়া স্কুলে ভর্তি হলে নিজের পড়ার পাশাপাশি তার পড়াশোনাও দেখতে লাগলাম।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পূর্বের তুলনায় টাকা বেশি লাগবে। তবে টাকাপয়সার চিন্তা আমার মাথায় নেই। কারণ হয়তোবা বয়স, নয়তো নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার আনন্দ। তবে আনন্দটা প্রায় মাটিতে লুটিয়ে পড়তে যাচ্ছিলো, যা আমার মা খুঁটি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছেন। বাবার কাছে টাকার কথা বললে তিনি বললেন পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে। মেয়ে মানুষ, এতো পড়াশোনা করে কি হবে! পেটে ভাত না দিয়ে তো আর পড়াশোনা করানো যাবে না। মায়ের সাথে এ নিয়ে কিছুটা রাগারাগিও করলেন। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। আর বুঝি হবে না আমার পড়াশোনা! অতঃপর মা নিজের লুকিয়ে রাখা সঞ্চয় বের করে আমাকে স্কুলে ভর্তি করালেন। এই টাকা সঞ্চয় করেছিলেন হাতের টুকিটাকি কাজ করে। যদিও ভর্তি হতে পেরে আনন্দ লাগছিলো তবে বাবাকে সেদিন রাগারাগি করতে দেখে ভয়ও লাগছিলো। পরবর্তীতে বই কেনার জন্য যখন বাবা টাকা দিলেন তখন বুঝতে পারলাম রাগটা আমার পড়াশোনা নিয়ে নয়। রাগটা আসলে ছিলো টাকার দুশ্চিন্তায়। অন্যদিকে স্কুলে উপবৃত্তির তালিকায় নাম বসাতে পেরে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ হলো।
নতুন বই পেয়ে পড়াশোনায় জমে গেছি। নিজের প্রচেষ্টা ও স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগিতা দ্বারা এগিয়ে যেতে লাগলাম। প্রাইভেটের চিন্তা আর মাথায়ই আনলাম না। পরিবারের আর্থিক অবস্থা দেখে নিজেরই বিবেকে বাধা দিতে শুরু করলো। ফলশ্রুতিতে অন্যদের মতো আমার রেজাল্ট ভালো হতো না।
যখন অষ্টম শ্রেণীতে পদার্পণ করলাম তখন আমাদের বাড়িতে নতুন মেহমান হয়ে জন্ম নিলো আমার ছোট ভাই তুহিন। নতুন বাবুকে নিয়ে জাকিয়া বেশ খুশি থাকলেও আমি লজ্জা অনুভব করতাম। কারণ আমার আর ভাইয়ের বয়সের পার্থক্য তেরো বছর। কেউ কেউ মাকে বিদ্রুপস্বরূপ বলতো, “মেয়ে বিয়ে দিলে ক’দিনও যাবে না নানী হয়ে যাবে, এতোদিনে আবার মা হওয়ার শখ জন্মেছে।” এধরণের কথায় মায়ের কেমন লাগতো জানি না, তবে আমার খুব লজ্জা লাগতো, কান্নাও পেতো। মাঝে মাঝে বাবুর প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়তাম এবং তার কাছ ঘেঁষতাম না তেমন। অথচ জাকিয়া ওদিকে হেসেখেলে বেড়াচ্ছে। আমার রাগ করার কারণ, ঘরের কাজকর্ম প্রায় সবই আমাকে সম্পাদন করতে হয়, কোনো কাজ যথাসময়ে না করলে মা বকা দেয়, বয়সের দোষে আমার মেজাজও খিটখিটে হয়ে যায়। সবমিলে একধরনের মানসিক ব্যাধিতে ভুগতে থাকি। যদিও তখন আমি “মানসিক” শব্দটার সাথেই তেমন পরিচিত ছিলাম না। ধীরে ধীরে তুহিন বড় হতে লাগলে আমার কাজের চাপ কমতে থাকে। মা কাজের ভার বহন করে, আমি পড়াশোনায় আবার মনযোগী হতে থাকি। কিন্তু ফলাফল ভালো নয়!
বরাবর রেজাল্ট ভালো হচ্ছিলো না বলে জেএসসির দুতিন মাস আগে মা নিজ থেকেই প্রাইভেট পড়তে বললেন। আমি ইংরেজি ও গণিত প্রাইভেট শুরু করলাম। আবারও আর্থিক সমস্যায় পড়ে গেলাম। পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে দুএক মাস অন্তর অন্তর বেতন পরিশোধ করতে হতো, যার জন্য খুবই লজ্জিত বোধ করতাম। এদিকে সময়ের স্বল্পতার কারণে পড়াশোনাও অন্যদের মতো আয়ত্তে আনতে পারলাম না। আঠারো বছর বয়সে নাকি সবাই ঝড়ের সম্মুখীন হয়। আমার ক্ষেত্রে সেই ঝড় বোধহয় আঠারো থেকে তেরোতে নেমে এসেছে। যা মোকাবেলা করার যথেষ্ট শক্তি আমার ছিলো না। জেএসসি অতিক্রম করতে পেরেছি তবে ন্যূনতম ফলাফল নিয়ে। আমার ক্লাসের পারফরম্যান্স দেখে বোর্ড পরীক্ষায় এমন ফলাফলে কোনো কোনো শিক্ষকও হতাশ! আর আমি লজ্জিত। খুব কান্না করি। তবে কাউকে দোষারোপ করতে পারিনি। কেননা সদস্যসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আমার পরিবার আর্থিক দিক থেকে এমনিতেই অনুন্নত। তবুও যে আমাকে পড়াশোনা করাচ্ছে এটাই তো অনেক কিছু আমার জন্য।
খুব ইচ্ছে ছিলো বিজ্ঞান বিভাগে পড়বো, ভবিষতে ডাক্তার হবো। কেননা সকল পেশা দূরে রেখে ছোট থেকে “ডাক্তার” শব্দটার সাথেই বোধহয় প্রথম পরিচিত হয়েছি। যার ফলে কেউ জীবনের লক্ষ্য জানতে চাইলে বলে দিতাম “ডাক্তার হবো”। কেন জানি পেশাটা তখন আমার কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মানজনক মনে হতো। ভাবতাম এর চেয়ে উচ্চতর কোনো পেশা বুঝি আর নেই। তাই স্বপ্নটাও উচ্চ স্থানেই তাক করে রেখেছি। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সময় পিছু হটে গেলাম। শুনেছি এবং দেখেছি বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে গেলে অনেকগুলো বিষয় প্রাইভেট পড়তে হবে, যার বেতন পরিশোধ করতে সক্ষম নয় আমার পরিবার। ভর্তি হলাম মানবিক শাখায়। নিশ্চুপে মেনে নিলাম ভাগ্য। জেনেছি মানবিক শাখায় পড়ে ভালো উকিল হওয়া যায়। যদিও উকিল সম্পর্কে আমি জ্ঞাত নই। বিনা ভবনায়ই সেই ইচ্ছে বাদ দিলাম। কেননা নিজের মধ্যে এক দূর্বলতা কাজ করতে শুরু করলো। নিজের বিবেকই সায় দিলো যে, আমি মেয়ে। আমার দ্বারা ওকালতি করা সম্ভব নয়। যদি পারি তো ভবিষ্যতে শিক্ষক হবো। মেয়েদের জন্য হয়তো এটা মার্জিত ও সম্মানজনক কাজ হবে।
পড়াশোনা করতে লাগলাম। যদিও অন্যান্য বিষয়ে প্রাইভেট গুরুত্ব নয়, ইংরেজি ও গণিত নিয়ন্ত্রণ প্রাইভেট ছাড়া বোধহয় সম্ভব নয় আমার জন্য। জেএসসিতে তো রেজাল্ট ভালো হলো না। অন্তত এসএসসিতে যেন রেজাল্ট ভালো করে তার ঘাটতিটা কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারি সেই পণ করলাম। বাড়ির আশেপাশের বাচ্চাদের সন্ধান করতে লাগলাম প্রাইভেট পড়ানোর জন্য। কিন্তু কিছু শিক্ষিত ছেলেমেয়ে থাকায় সেই সুযোগটাও পেলাম না। তাদের রেখে কোন অভিভাবক নবম শ্রেণির পিচ্চি মেয়ের কাছে তাদের বাচ্চাদের পড়তে দিবে? যার কি না সামান্য জেএসসির রেজাল্টই ভালো হয়নি!
পরোক্ষভাবে কারো কারো মুখে এমন কথা শুনে কষ্ট লাগতো ভীষণ। তবে আমি চুপচাপ সহ্য করে নিতাম। ধৈর্যের ফল নাকি রত্ন হয়ে ফোটে। কে জানে আমি তার অধিকারী কি না! অতঃপর অন্যের ছেলেমেয়েদের পড়ানোর কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের বোনকে সর্বোচ্চ সামর্থ্য দ্বারা পড়াশোনায় সময় দিতে লাগলাম। সাথে অর্থের চাহিদা পূরণে মায়ের মতো টুকিটাকি কাজে জড়িত হয়ে পড়লাম। মাঝে মাঝে মা কিছু টাকা দিতেন, কখনো কখনো বাবা দিতেন। তা জমা করে প্রাইভেটের বেতন পরিশোধ করতে লাগলাম। অন্যান্যদিকে কোনো অর্থ খরচ করতাম না৷ বন্ধুবান্ধব প্রায়ই পিকনিক করতো, একত্রে এটা সেটা কেনাকাটা করতো। আমাকে সাথে যেতে বললে আমি নানান অযুহাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করতাম।
পরপর দুইটা সেমিস্টার পরীক্ষায় জাকিয়ার রেজাল্ট ভালো হলে প্রতিবেশীদের মধ্যে দুজন তাদের নার্সারি ও দ্বিতীয় শ্রেনীর বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য বললেন। অথচ পূর্বে তাদের মুখেই “পিচ্চি” শব্দটা শুনতে হয়েছিলো। সেই ক্ষোভে আমি নিষেধ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মা বললেন পড়াতে। তাই আর নিষেধ করা সম্ভব হলো না। মা বাবার কথার উপরে কথা বলতেও শিখিনি কখনো। সেই উপহার হিসেবে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবার পরপরই বিয়ের সমন্ধ আসতে লাগলো। তখন নিজের সামনে প্রশ্নের এক বিশাল পর্বত গড়ে উঠলো! “আমি কি বড় হয়ে গেছি?” সাথে মনে ভয়ের সৃষ্টি হলো, “এই বুঝি আমার পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটতে চলেছে!”
ঘটেছেও তা-ই! টেস্টের আগেই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো এক ইলেক্ট্রিক মেকারের সাথে। শিক্ষাগত যোগ্যতায় আমার বর এইচএসসি পাস। ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছিলো, সংসার সামলাতে অল্পবয়সেই চাকরির তাড়ায় পড়াশোনা বাদ দিয়েছে। তিনি অনেকটা ধার্মিকও বটে৷ আমাকে প্রথম থেকেই শালীনতার সাথে চলাচলের আদেশ করেন। আমার এতে কোনো আপত্তি ছিলো না। কারণ আমি এমনিতেই শালীনভাবে চলি। নতুন থাকতে সবটা ভালোই ছিলো কিন্তু পরে বুঝলাম আসলে এমন শ্বশুরবাড়ি হয়তো কোন মেয়েরই প্রত্যাশিত নয়। যে শ্বশুরবাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি পায় না, নিজের ইচ্ছায় বাবামায়ের সাথে একটু সময় কাটাতে পারে না। বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা প্রকাশ করলেই আমার শ্বাশুড়ি সরাসরি নিষেধ করতেন। মা আবদার করলেও নানান অযুহাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করতেন। মা কষ্ট পেতেন তবুও বলতেন, “ধৈর্য ধারণ কর মা। মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়। সবার সাথে মিলেমিশে থাকিস, কারো সাথে তর্কে জড়াবি না। তুই ভালো থাক, দেখবি আমরাও ভালো আছি।”
আমার খুবই কষ্ট লাগতো। প্রায়ই বাড়ি যাওয়ার জন্য মন ছটফট করতো। এদিক থেকে আমার স্বামীর সাপোর্টও পেতাম না। উনার সামনে প্রকাশ করলে বলতেন, “কেন? আমার সাথে থাকতে ভালো লাগে না?”
এমন প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে মন খারাপ করলে মন ভালো করার জন্য আবার বলেন,
“জানো, তোমাকে যেতে দিতে ইচ্ছে করে না কেন? কারণ, তোমাকে ছাড়া থাকতে আমার ভালো লাগে না।”
বেশ ভালোই বুঝতাম এ সবই মনভুলানো কথা। তবুও নিশ্চুপ থাকতাম বাবামায়ের দেওয়া আদর্শ ও সম্মানের কথা ভেবে। যেন একটা বাজে কথাও উচ্চারিত না হয় আমার বাবামায়ের নামে।
ভেবেছিলাম এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হবে না। কিন্তু তিনি সেই সুযোগ দিয়েছেন। সমস্ত খরচ নিজেই বহন করেছেন। দুএক দিনের জন্য বাবার বাড়িতেও নিয়ে যেতেন তিন-চার মাস পরপর। এসএসসির রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই হয়েছে। কিন্তু সেবছর আর কলেজে ভর্তি হতে পারিনি প্রেগন্যান্ট থাকায়। ভাবতেই অবাক লাগছে ক’দিন আগেও যাকে পিচ্চি বলতো সবাই আজ সে এক পিচ্চির মা হয়ে গেছে! আযব দুনিয়ার আযব খেলা। ভাগ্যে আবর্তিত হয় কত রঙের মেলা!
পরবর্তী বছর কলেজে ভর্তি হতে চাইলে তিনি নিষেধ করলেন, “বাচ্চা নিয়ে পড়াশোনা ঝামেলা। এতে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে। আর এতো পড়াশোনা করে কি হবে, তোমার তো চাকরি করার প্রয়োজন নেই। তারচেয়ে বরং বাচ্চাকে সময় দাও।”
সেদিন আমার খুব রাগ হয়েছিলো। আমি জেদ নিয়ে বলেছি, “আমার ভাগ্য খারাপ মেনে নিচ্ছি তাই বলে আমার সন্তানের ভাগ্যে এমনটা কিছুতেই মেনে নিবো না। আমার পড়াশোনা বন্ধ করার আগে কথা দিতে হবে যে সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন।”
তিনি নিরবে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “নাবালিকা ভাবলেও তুমি আসলে তা নও। তুমি কেবল এটা ভেবো না, সন্তানদের কেবল তাদের মা ই ভালোবাসে। এটাও ভেবো, বাবা দিনের পুরোটা সময় দূরে অবস্থান করলেও বাবার সকল প্রচেষ্টা সন্তানদের জন্যই থাকে। যা কেবল একজন বাবা ই বুঝে। শুধু দোয়া করো আল্লাহর কাছে, যেন তোমার সন্তানদের বাবাকে শক্তিসামর্থ্যযোগে হায়াত দান করে।”
কেন জানি এসময় এতো রাগের মধ্যেও তার কথা প্রাণ ছুয়ে গেছে এবং রাগকে মাটিচাপা দিয়ে আমি বরাবরের মতো নিশ্চুপ হয়ে গেছি।
এখন ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। আর আমি ডায়েরি লিখতে বসেছি। খুব মনে পড়ে দিনগুলো, মনে পড়ে বাবা-মা ও ভাইবোনকে। মাঝে মাঝে যাই দেখা করতে। একটা ফলের মধ্যে যেমন সকল ফলের স্বাদ পাওয়া যায় না, একটা মানুষের মধ্যেও তেমন সকল গুণ পাওয়া যায় না। আমার তিনি আমার কোনো কোনো ইচ্ছে কুক্ষিগত করে রাখলেও আমার সন্তানদের কোনোদিক থেকে অপূর্ণতায় রাখেন না। সাধ্যমতো সকল আনন্দ তাদের মুঠোয় এনে দেয়। আলহামদুলিল্লাহ, আমি এতেই খুশি। আর আমাকে তিনি ভালোবাসা দিলেও যেমন নিরবে লুপে নেই, কষ্ট দিলেও তা নিরবে মুছে নেই। তখনও নিশ্চুপ ছিলাম, এখনো আছি। সবার ভাগ্যে সফলতা শব্দটা জড়িত থাকে না। তাই বলে সে ব্যর্থ নয়। কেননা কোনো কোনো ব্যর্থতার মাঝেও সফলতার প্রশান্তি অনুভব করা যায়। আমি সেটা অনুভব করতে পারি। কারণ আমি ছোট থেকেই জীবনের সাথে নিরবে লড়াই করে এসেছি। হয়তো নিস্তব্ধতাই ভাগ্যের পরিহাস, আর সেই ভাগ্যই নামের ইতিহাস।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে