গল্পঃ কুরবানী_আর_কালু
কুরবানী ঈদের ৫ দিন আগে গরু কিনে নিয়ে এলাম। শ্রাবণী একবার আমায় দেখে আরেক বার গরু দেখে। শ্রাবণীর চেহারা দেখে মনে হলো ও প্রচন্ড রেগে গেছে। প্রেম করে বিয়ে করেছি তাই বউ বাদে কাউকে ভয় পাই না। আমি মুচকি হেসে ভয়ে ভয়ে শ্রাবণীকে বললাম,
–গরুটা দেখেছো কত কিউট, একদম তোমার মত।
কথাটা শেষ করার পর নিজের জিভে নিজে কামড় দিলাম। হাই হাই এ আমি কি বললাম..
শ্রাবণী তখন রাগে দাঁতের সাথে দাঁত চেপে বললো,
– গরুটা যেহেতু এত কিউট তাহলে এইগরুর সাথেই সংসার করো। গরুটাকে নিজের বেডরুমে নিয়ে রাখো আমি না হয় বাপের বাড়ি চলে যায়। পিয়াস তোমায় কতবার বলেছি ঈদের আগের দিন গরু কিনবে। তারপর কোন রকমে রাতটা পার করে সকালে জবাই করে ফেলবো। তা না করে ঈদের ৫ দিন আগে গরু কিনে ফেললে। এখন এই গরু রাখবে কোথায় ? বাড়িওয়ালা তো গ্যারেজে এতদিন রাখতে রাজি হবে? তার উপর এই ৫ দিন গরুটাকে কে দেখবে? কে খাওয়াবে?
গরুর সাথে থাকা লোকটা বললো,
~আপা, ঈদের আগ পর্যন্ত আমি না হয় কালুকে(গরুর নাম) দেখাশোনা করবো।
লোকটার কথা শুনে আমি খুশি হয়ে বললাম,
— তাহলে তো খুব ভালো হয়।
শ্রাবণী আমতা আমতা করে আমাকে বললো,
-লোকটা যে ৫দিন থাকবে ও রাতে ঘুমাবে কোথায়? আমি এই লোককে আমার ফ্ল্যাটে জায়গা দিতে পারবো না।
লোকটা মাথা নিচু করে বললো আমি কালুর সাথেই ঘুমাবো….
বাড়িওয়ালাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে রাজি করালাম। উনি অনুমতি দিলেন বাগানের পাশে রাখতে পারবো গরু। তবে বাগান নষ্ট করলে ক্ষতিপূরণ আমাকেই দিতে…
রাতে ঘুমানোর আগে মনে হলো চারদিকে যেভাবে ডেঙ্গু হচ্ছে এই লোকের আবার ডেঙ্গু হয়ে যায় কি না। একটা মশারি নিয়ে গিয়ে লোকটাকে বললাম, মশারি টানিয়ে ঘুমাতে। সকালে গিয়ে দেখি লোকটা নেই আর মশারিটা গরুটার উপর টানানো। এমন সময় বাড়িওয়ালা হাসতে হাসতে আমাকে বললো,
৩ হাজার টাকা দিয়েও আমি বাগানের আর বাসার আশে পাশের ঘাস গুলো পরিষ্কার করতে পারছিলাম না অথচ এই লোকটা বিনা টাকাতে আমার এইগুলো পরিষ্কার করে দিচ্ছে। লোকটার কাছে গিয়ে দেখি ঘাস গুলো ধুয়ে পরিষ্কার করছে। আমাকে দেখে বললো,
~কালু কাচা ঘাস খুব পছন্দ করে।
আমি লোকটাকে বললাম,
— আপনি রাতে মশারির নিচে ঘুমান নি?
লোকটা মুচকি হেসে বললো,
~ স্যার, আমি গরীব মানুষ আমার রক্ত মশা খেলে অসুবিধা নেই। কিন্তু আমি আমার কালুরে রাজকীয় ভাবে বড় করেছি। ও মশার কামড় সহ্য করতে পারবো না…
দুপুরের দিকে হঠাৎ লোকটা আমাদের ফ্ল্যাটে এসে শ্রাবণীকে বললো,
— আপা, ২০০ টাকা দিবেন? একটা শ্যাম্পুর বোতল আর নারিকেল তেলের বোতল কিনতাম। পরে না হয় আমার টাকা দেবার সময় ২০০ টাকা কম দিয়েন।
শ্রাবণী ২০০ টাকা দিলো। একটু পর গিয়ে দেখি লোকটা গরুর সাথে কি যেনো কথা বলছে আর শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাচ্ছে। গোসল করানো শেষে নিজের গামছা দিয়ে গরুর শরীরটা মুছে সারা শরীরে নারকেল তেল দিয়ে দিচ্ছে। আমাকে দেখেই লোকটা হাসি মুখে বললো,
~স্যার, আমি কোনদিন শ্যাম্পু মাথায় লাগিয়ে দেখি নি কেমন লাগে অথচ আমার কালু শ্যাম্পু বাদে গোসল করতে পারে না।
লোকটা ৪ দিন গরুটার সাথে ছিলো। এই ৪ দিনে দেখেছি লোকটাকে শুধু সারাক্ষণ গরুটার পাশেই থাকতে। ঈদের আগেরদিন লোকটাকে যখন টাকা দেয়। লোকটা টাকা গুনছিলো আর চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছিলো। হঠাৎ লোকটা আমায় বললো,
~ স্যার, দেখলেন আমি কত বড় খারাপ মানুষ। নিজের সন্তানকে বিক্রি করে সেই টাকা আবার গুনে নিচ্ছি। অভাব স্যার খুব খারাপ জিনিস। দয়া করে আমার কালুকে একটু কম কষ্ট দিয়ে জবাই করার চেষ্টা করবেন। আমার কালু মশা কামড় দিলে সেটা সহ্য করতে পারতো না। জানি না ছুড়ির আঘাতটা আমার কালু কিভাবে সহ্য করবে…
লোকটা চলে যাচ্ছে আর আমি ভাবছি, আসলেই কি আমাদের কুরবানীটা হয়। কুরবানী তো হয় ওদের, যারা নিজের সন্তানের মত প্রিয় বস্তুটাকে আল্লার রাস্তায় দিয়ে দেয়…
ঈদের দিন সন্ধ্যার সময় বাসার কলিংবেল বাজলো। আমি দরজা খুলে তাকিয়ে দেখি লোকটা। আমি দেখে অবাক হয়ে লোকটাকে বললাম,
— আপনি আপনার পরিবারের সাথে ঈদ করেন নি?
লোকটা আমার প্রশ্নের জবাব দিলো না।শুধু বললো,
~ স্যার, কোথায় আমার কালুকে জবাই করেছিলেন জায়গাটা একটু দেখাবেন?
আমি নিচে নেমে জায়গাটা দেখালাম। লোকটা জায়গায় বসে চিৎকার করে কান্না করতে করতে বললো,
কালুরে আমায় মাফ করে দিস। শেষ বিচারের দিন আল্লাহ কে বলিস, আমি কয়টা টাকার জন্য তরে এই কষ্টটা দিছি। আমায় যেনো তোর চেয়েও বেশি কষ্ট দেয়…
জানি না নিজের অজান্তাতে কখন চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। পিছনে তাকিয়ে দেখি শ্রাবণী অনবরত কাঁদছে..
#গল্পঃ কুরবানী_আর_কালু
#লেখাঃ আবুল_বাশার_পিয়াস