গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_নভেম্বর_২০২০
গল্পঃ অপূর্ণতায় প্রাপ্তি।
লেখাঃ ইসমাইল হোসেন
.
অ্যালুনিয়ামের জানালা ধরে নির্বাক তাকিয়ে থাকে অনীল। চিলেকোঠার এই জানালা থেকেই অনেক অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে তার। তার ব্যক্তিগত ভাবনা দ্বারা সে ধারণা করছে, পৃথিবী থেকে হয় মানুষ না হয় মানবতা দুটির একটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা দুটোই। আজকাল চারপাশের পরিচিতদের হাঁকডাক গুলোও আর মানুষের মতো লাগে না। সবার গলায় যেনো সূর্যের গলিত রশ্মি খেলা করে। সবাই চায় একে অন্যকে শাসন করতে। একটা মানুষকে বাঁচতে হলে শাসিত হওয়াটা প্রতিদিন গায়ে রোদ লাগানোর মতো ব্যাপার হয়ে গিয়েছে।
যেমন বাইরে বের হলে গায়ে রোদ লাগবেই, তেমনি সমাজে বাঁচতে হলে শাসিত হতে হবেই। হয়ত পরিবার না হয় প্রতিবেশী নাহলে সবথেকে পরিচিত দূরের মানুষ। আপনাকে হতে হবে তাদের কাছে দূর্বল। যেমনটা ক’বছর ধরে অনীলের সাথেই ঘটে চলছে।
.
অবন্তীদের চিলেকোঠাটা তার বেশ প্রিয়। অবন্তী আর তার মা শুধু এখানে থাকে। ভার্সিটি থেকে অবন্তীর সাথে অনীলের পরিচয়। না, অন্য কোনো সম্পর্ক নয় বন্ধুত্বেই বেশ সময় কেটে গেছে তাদের। এখনো কাটে। শুধু অবন্তীর কাজের দিনগুলো ছাড়া।
তবুও ক’দিন পর পর অবন্তীর সাথে কথা বলার দায়সারা স্বভাব নিয়ে অনীল অবন্তীর জন্য অপেক্ষা করে এই এ্যালুমিনিয়ামের জানালা চেপে।
.
এমন সময় দরজায় শব্দ! শাড়ীর আঁচলটা এলোমেলো। চোখে মুখে ক্লান্তি স্পষ্ট। যে চোখ একেঁ ভার্সিটির পুকুর পাড়ের সময়গুলো কেটে যেত তাদের, যে চোখে খেলা করতো ভবিষ্যতে অদেখা স্বপ্ন সেই চোখে এখন আগামী দিন আসার ভয়!
অনীল মনে মনে হাসে, এই মেয়েটিই নতুন চাকরি পাবার দু’সপ্তাহ পরই বলেছিলো আগামী দিনটা যেনো না আসে। কারণ ঐ একটাই, সে ক্লান্ত এবং ভীত। ছেলেদের মতো পরিবার চালানোর দায়িত্ব কি আর মেয়েদের স্বভাবে মানায়.?
.
– পেছনে শাড়িটা তো পুরো কাঁদা দিয়ে ভরে ফেলেছিস!
– তুই.? কখন এলি, নাস্তা পানি দিয়েছে?নাকি জানালা দিয়ে মেয়ে দেখে সময় পার করলি?
– তুই সামনে থাকতে অন্য কোনো মেয়ের দিকে চোখ যেতে পারে.?
– খুবই বাজে ছিলো এটা।
– তবুও তো হেসে গড়াগড়ি খেতি।
– তখন তো আর সারাদিন অফিস করে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে এই চিপা গলি দিয়ে কাঁদা ছিপছিপে রাস্তা পেরুতে হতো না।
– আর কি করার , তোর তো এই চিলেকোঠাই পছন্দ।
– তা যা বলেছিস, ফিরে এসে যখন চারপাশে তাকাই সমস্ত ক্লান্তি হাওয়া। আচ্ছা বোস, আমি পরিস্কার হয়ে আসছি। মা কোথায় রে.?
– দেখ নিজের ঘরেই আছে হয়ত। আসার পর একবার কথা হয়েছে মাত্র।
.
অবন্তীকে দেখে মাঝে মাঝে পরিবারের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে অনীলের। অবন্তীর সাথে তার বড্ড অমিল। সে নিজে চাচ্ছে পরিবার থেকে দূরে চলে যেতে আর অবন্তী চাচ্ছে পরিবারকে আগলে বাঁচতে।
সব মানুষের চিন্তা ধারা এক রকম হলে মন্দ হতো না।খারাপ চিন্তা হলে সবাই সবার সাথে খারাপ করতো তখন খারাপ বলতে কিছু থাকতো না সেটাই স্বাভাবিকতা হয়ে যেতো।আবার ভালো হলে তো ভালোই, সবাই বিবেককে নাড়িয়ে পূন্যের কাজ করে যেতো।
হয়ত তখন সেও অবন্তীর মতো পরিবারকে আগলে নিয়ে বাঁচতে চাইতো।
পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যকে মনে পড়ে তার। অথচ সেসব মানুষদের থেকেই দূরে থাকার চেষ্টা করে এসেছে সে সবসময়।
.
– কিরে কি ভাবছিস.?
– আচ্ছা বন্তী বল তো, একজন মানুষের জীবনে পরিবারের গুরুত্ব কি.?
– অনেক।
– যেমন.?
– দেখ নীল। আমার মতে ভদ্র, সুশৃঙ্খল, গোছানো, আত্ম উদ্যমী। তোর মধ্যে যে ভালো মন্দ মিশিয়ে তুই যে সত্ত্বাটা তার পুরোটাই তুই তোর পরিবার থেকে ছোট থেকেই আজ এ পর্যন্ত আসার শিক্ষা পেয়েছিস।
তুই পরিবার ছাড়া কারো দিকে তাকা, কেউ নেশা করে জীবন নষ্ট করছে অথবা কেউ রাস্তা ঘাটে মরে পড়ে থাকছে। আবার অনেকের পরিবার থাকতেও নেশা পানি খেয়ে মরে পড়ে থাকছে। কারন তো একটাই, কার পরিবার কাকে সঠিক ভাবে গড়ে তুলতে পারে। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে তোর পরিবার তোকে গড়তে সফল। শুধু তোর ইচ্ছেটা বাদে। আর তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই আর না কোনো নৈতিকতা । সর্বোপরি মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে গেলে তোর পরিবারটাই আগে দরকার। এখন সিদ্ধান্ত তোর তুই মানুষ হবি নাকি অমানুষের মতো উশৃঙ্খল জীবন বেছে নিবি।
– কিন্তু আমার পরিবারের জন্য আমার স্বপ্ন, ইচ্ছে নষ্ট হচ্ছিলো, হয়েছে।
– আবার সেই পুরোনো ঘটনা.?
– না, আমি এবার পরিবার থেকেই দূরে চলে এসেছি। এবার আমি আমার নিজের স্বপ্নের পেছনে ইচ্ছে মতো ছুটতে পারবো।
– বোস, চা আনছি।
.
অনীল থেমে যায়। তার ভেতরে এ মূহর্তে ঘূর্ণিঝড় চলছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে নিজের সমস্ত ব্যথা পৃথিবীর বাতাসের সাথে মিশিয়ে দিতে। মনের ভেতর প্রচন্ড ঝড় নিয়েই সে আজ পরিবার থেকে দূরে চলে এসেছে। তার স্বপ্ন বিলুপ্ত হবার আহাজারি সে মেনে নিতে চাইছিলোনা কোনোভাবেই।
.
– বাবা আমি চাকরি করতে চাই না।
– তো কি করবে.?
– আমার নিজের একটা ব্যবসা থাকবে।
– কত দিনে হবে.?
– জানি না, তবে কোনো একদিন।
– সেই কোনো একদিন পর্যন্ত আমি থাকবো কিনা তা তুমি বলতে পারো.?
– বাবা আমার স্বপ্ন, আমার ইচ্ছে সবকিছু এই ব্যাপারটিকে ঘিরে।
– আর আমার ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে.? তোমাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা কি ভুল হয়েছে আমার নাকি আমি অসফল তোমাকে মামুষ হিসেবে গড়তে.? তোমার জীবন যা আমি সেদিকেই তোমাকে যেতে বলছি। এখন জীবন কি সেটাও শিখতে হবে তোমার থেকে.? তুমি যাকে স্বপ্ন ভাবছো সেটা তোমার জন্য দুঃস্বপ্ন। যে বিষয়ে তুমি শিক্ষা পাওনি সে বিষয়ে তুমি অদক্ষ। অদক্ষ মানুষ কখনো কোনো কাজো সফল হয়না।
.
সেদিন বাবার প্রশ্নের কোনোটিরই উত্তর ছিলো না অনীলের কাছে। সে দেখেছে তার চারপাশে অনেককে, তাদের অনেকের বিভিন্ন ইচ্ছে, স্বপ্ন থাকা সত্ত্বেও পরিবারের জন্য সেসবকে আড়াল করে পরিবারের কথা মানতে হয়েছে। তাদের পথে হাটতে রাজি নয় অনীল। আবিরের মতো লেখক হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে গার্মেন্টসে ইনচার্জ হতে পারবে না সে কিংবা রাকিবের মতো গায়ক হওয়ার স্বপ্ন হারিয়ে পরিবারের জেলখানায় ফেঁসে দেশের বাইরে প্রবাসী হওয়ার ইচ্ছে নেই তার।
অনীল শুধু ভাবে আমি যা চাই আমাকে তা পেতে হবে। সারাজীবন পরিবারকে ঘৃণা করে বাঁচতে হবে তার। পরিবার তার কাছে শুধু মাত্র একটা শিকল।
.
– কীরে এতো কি ভাবছিস.?
– স্বপ্ন নাকি পরিবার.?
– আমার স্বপ্ন কি পূরণ হয়েছে.?
– তোর চিত্রশিল্পী হওয়ার ইচ্ছেটা.?
– জানিসই তো।
– কিন্তু তুই তো পরিস্থিতির শিকার। এমন সময় আঙ্কেলের কিছু না হলে,
– দায়টা কিসের বলতে পারবি.?
– এটা তোর দায়িত্ব। এ পর্যন্ত তোর পরিবার তোর সাথে ছিলো। তোকে মানুষ করার দায়িত্ব পালন করেছে তারা। এবার তোর উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানোর।
– শোন নীল, তুই কিন্তু সবই বুঝিস। দায়িত্ব না নিয়ে নিজের কথা কেন ভাবছিস.?
– মানে.?
– মানে, তুই কি চাস সেটা পরিবার কখনোই দেখবেনা কারণ তারা তোকে ভালো মন্দ শেখানোর দায়িত্বটাই নিয়েছে,তুই কি চাইবি সেই হিসেব কষতে নয়। কিন্তু তোকে দেখতে হবে পরিবার কি চায়৷ এবং তা পূরণ করতে হবে। কারণ তুই পরিবারের কাছে দায়বদ্ধ।
– তাহলে আমার স্বপ্ন, ইচ্ছে.?
– পরিবার ভালো থাকে, পরিবার সমর্থন করবে এমন স্বপ্ন দেখ। সাধ্যের বাইরে যেতে চাইছিস কেনো.?
– পরিসীমা বেঁধে দিলি।
– আগেই ছিলো, আমি শুধু দেখিয়ে দিলাম।
.
অনীল উঠে দাঁড়ায়, চিলে কোঠার জানলাটায় গিয়ে দাঁড়ায়। হয়ত এটাই শেষবার।
সে শেষবারের মতো দেখে নেয়, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বেলুন বিক্রি করছে ১৩ বছর বয়সী একটি ছেলে। ওর সময়টা এখন দৌড়ে বেড়াবার। ও কি তাহলে এখনি নিজের দায়িত্বটা কি তা বুঝে গিয়েছে.? ওদের মাঝে, আমার মাঝে, আমাদের মাঝেও কতটা অপূর্ণতা তাও ওরা, আমরা বেঁচে আছি বাঁচতে চাইছি। দিন শেষে আকাশের দিকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার সময়টাই আমাদের প্রাপ্তি।
.