গল্পঃ অদ্বিতীয়া

0
1588

গল্পঃ অদ্বিতীয়া

হাবিবা সরকার হিলা

সন্ধ্যায় মেয়েটির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।মায়ের ভাষ্যমতে মেয়ে সুন্দরী, পরিপাটি লক্ষীও বটে। আমি দেখছিলাম রেস্টুরেন্টে আমার মুখোমুখি চেয়ারে একটা পুতুল বসে আছে। ছোট্ট করে কফিতে চুমুক দিচ্ছে, কায়দা করে টিস্যুতে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে।সবকিছুই কেমন সাজানো। প্রশ্ন করলাম,

-প্রেম করেছেন কখনও?

মেয়েটা হাসল।

-আসলে সেভাবে সময় ও সুযোগ হয়ে উঠি নি। পড়াশোনা নিয়ে এত বিজি ছিলাম।

২৪ বছর বয়সী প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ পড়ুয়া মেয়ে কোনদিন প্রেমই করে নি! ওর বায়োডাটা পড়েছি এমন কোনো হাতি-ঘোড়া রেজাল্ট নয়। অথচ পড়াশোনা নিয়ে তিনি ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। ভালো একটা বর ধরতে হলে মেয়েদের কত অভিনয়ই না করতে হয়। চিকেন ফ্রাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।আমি পাশে না থাকলে হয়ত কপাকপ গিলে নিত। ঠোঁটে আলতো গরম স্যুপ ছুঁইয়ে ন্যাকা স্বরে বলতে হত না

-আসলে আমি খুব কম খাই।

বিল মিটিয়ে উঠে পড়লাম। মা বলেছিলেন অন্তত একঘণ্টা সময় কাটাতে। আমার ৪০ মিনিটের বেশি ধৈর্য্যে কুলাল না। ওকে সিএনজি ভাড়া করে দিয়ে সিগারেট ধরালাম। আশ্চর্য! আমিও ভান করেছিলাম নয়ত এতক্ষণ সিগারেটের তৃষ্ণা পাওয়ার পরও মেয়েটার সামনে সিগারেট ধরালাম না কেন! নবনী হলে ঠিক বুঝে ফেলত।

-বার বার পকেটে হাত ঢুকাচ্ছ কেন? বিড়ি খেতে মন চাইলে ধরিয়ে ফেলো।

সম্ভবত এজন্যই নবনীকে ভালো লাগত। ট্রিপিক্যাল ন্যাকামি করার চেয়ে বরং সহজ থাকত। দেখা হলে ফুচকা খাবার ভান ধরত না। জিজ্ঞেস করত,

-পকেটে ৫০০ টাকা হবে?

-কেন?

-আমার চেনাজানা এক রেস্টুরেন্ট ফাটাফাটি কাচ্চি বানায়। কাজলের বার্থডেতে খেয়েছিলাম এখনও মুখে লেগে আছে।

-চলো যাই।

তখন ইন্টার্নি করছি।জব হয় নি। বাড়ি থেকে যা টাকা পাই টেনেটুনে মাস কাটাতে হয় তারপরও ওর ছোটখাটো ইচ্ছাগুলো পূরণ করে তৃপ্তি পেতাম। বুকের ভেতর কেমন পূর্ণতার স্বাদ।খেয়েদেয়ে শাওন ধন্যবাদ জানাত,

-আবার ধন্যবাদ কেন? একে পেট ভরল দুই মিলের টাকা বাঁচালে।

নবনী খিটখিট করে হাসত। ঠোঁটে লিপস্টিকের রঙ নেই চোখে কাজলের বাহুল্য নেই সেই মেয়েটাকে আমি ভালোবাসতাম।আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে অসাধারণ মেয়ে অথবা নবনীও সাধারণ। সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে বসে।প্রেম করেছেন? প্রশ্নের জবাবে দুপাশে মাথা নাড়ে।

মায়ের ফোন। রিসিভ করলাম,

-হ্যালো,কই তুই?

-বাসায় আসছি।

-মারিয়াকে কেমন লাগল?

-মারিয়া কে?

– সেকি! তুই রেস্টুরেন্টে যাস নাই? মারিয়া কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছে।

-ওহ আচ্ছা।ওর সাথে কথা হয়েছে। বাড়ি এসে বাকিটা বলছি।

মায়ের ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।বয়স যখন ৩০ এর কোঠায় মায়ের ইচ্ছা হল তার ছেলের এবার বিয়ে থা করে সংসারী হওয়া দরকার। রোজ বাড়ি ফেরার পর মায়ের এক কথা।মস্তবড় ফ্ল্যাটে মায়ের একা একা লাগে। কাজের মেয়ে আছে, অনুর কলেজ সপ্তাহে দুদিন বন্ধ তারপরও ইদানীং মায়ের আরেকজন সঙ্গিনী প্রয়োজন। ৩ বছর ধরে মা রাত জেগে অপেক্ষা করেন কখন বাড়ি ফিরব,কখন টেবিলে খাবার রেডি করবেন।মায়ের বয়স হয়েছে দায়িত্ব ভাগাভাগিতে তাই আরেকজন চাই।

আমার কিন্তু বিছানার পাশের বালিশটায় আরেকজনের দরকার হচ্ছে না।ব্যস্তময় দিন শেষে বেডে গা এলিয়ে দেই। ফোনের স্কিনে কারো নামের পাশে সবুজ বাতিটা জ্বলজ্বল করে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। অথবা কিছু রাত জেগে থাকা হয়। তারপরও কাউকে ডেকে বলা হয় না,

-এই মেয়ে,

-আমার একটা নাম আছে।

-তো।

-নাম ধরে ডাকো।

-আচ্ছা।কি খবর তোমার?

কথা চলতে থাকে।

অথবা কেউ রাত চারটায় ফোন করে বলে না,

-খুব ব্যস্ত তুমি? সারারাত অপেক্ষা করেছিলাম।

এগুলো অন্য পৃথিবীর গল্প যে পৃথিবীতে আমার পাশে নবনী বাস করে।

মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় ছুটে ওর কাছে চলে যাই। হাতজোড় করে বলি,
-অনেক তো হল, এবার ফিরে আসো৷আর পারছি না আমি।

আবার ভয় হয়।ব্রেক আপ হয়ে গেছে দুই বছর। এতদিনে নবনী হাত যদি অন্য কারো হাতে হাত রেখেছে অথবা ওর নামের টাইটেল নবনী আফরোজ পাল্টে নবনী হাসান কিংবা নবনী চৌধুরী হয়ে গেছে। ভয় হয়, ভীষণ ভয় হয়। নবনীর কোনো বান্ধবীর সাথে দেখা হলে না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাই।বন্ধুবান্ধব মহলে কেউ নবনী নামটা ভুলেও মুখে নেয় না।নবনী চলে যাবার পর কয়েকমাস টানা অসুস্থ ছিলাম।ভাগ্যিস সে সময় মেসে থাকতাম নয়ত মায়ের নবনীর কথা অজানা থাকত না। অবশ্য জানলেই বেশ হত। প্রতি সপ্তাহে মেয়ে দেখার ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতাম।

বাড়ি ফিরে দেখি নাবিক বসে আছে। “দোস্ত”বলে জড়িয়ে ধরল, হাতে বিয়ের কার্ড। ১১ ই আগস্ট বিয়ে।নাবিক ভার্সিটিতে চুটিয়ে প্রেম করত অহনিকা নামের হিন্দু একটা মেয়ের সাথে। চার বছরের রিলেশন শেষে মেয়েটা বিয়ে করে নেয়। ক’দিন পর নাবিকেরও বিয়ে। জীবন জীবনের গতিতে চলতে থাকে। আমিই ভঙ্গুর তাই দুই বছর পরও হাহুতাশ করি।কথায় কথায় মা জানাল কোনো মেয়েই আমার পছন্দ হচ্ছে না।নাবিক বলল,

-আন্টি চিন্তা করবেন না,আমার সন্ধানে এমন মেয়ে আছে অয়ন না করতেই পারবে না।

তার কয়েকদিন পর অয়ন নক করল,

-এই শালা, কাল তোর জন্মদিন না?

-হু।

-কাল তোকে তোর জীবনের সেরা গিফ্ট দিব।

-কি?

-কালকই দেখতে পাবি।

নাবিক সকালেই চলে। খুশিতে চোখমুখ ডগমগ করে। বুঝলি তোর প্রোফাইল দেখে আমার কাজিন খুব পছন্দ করেছে।ফর্মাল ড্রেসে চল, মেয়ে কিন্তু হেব্বি জিনিয়াস।ফিজিক্সে ফার্স্টক্লাস।বিসিএসে রিটেনে টিকেছে,ভাইভাতে টিকলেই কেল্লাফতে। ম্যাজিস্ট্রেট বউ পাবি।

মেয়েটির নাম সুহা। শ্যামলা কিন্তু ভারী মিষ্টি দেখতে। কথাবার্তায় আন্তরিক। আমি আর ও কথা বলছিলাম কম। নাবিক প্রচুর কথা বলতে পারে। এক ফাঁকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করল,

-কীরে, কেমন লাগছে?

-ভালোই তো।

-বলেছিলাম না সুহাকে ভালো লাগতেই হবে।ও দারুণ মেয়ে।

লাঞ্চ এল। কথার প্রসঙ্গে সুহা জানাল ও চিংড়ি খায় না। নবনীরও চিংড়ি পছন্দ ছিল না

সুহাকে বিদায় দিয়ে দুই বন্ধুতে জম্পেশ আড্ডা হচ্ছিল।অনেকদিন পর ভেতরটা হালকা লাগছে। নাবিক ওর চাকরির প্রসঙ্গে কথা বলছিল, হবু স্ত্রীর প্রসঙ্গে। শুনছিলাম। ও জীবনটা সুন্দর গুছিয়ে নিয়েছে।দুজনের ঘরে ফেরার সময় হল । নাবিক বলল,

-দোস্ত,আমি তাহলে সুহার ফ্যামিলির সাথে বলি। তুইও বাড়ি গিয়ে আন্টিকে ভালোমন্দ জানা।

-দরকার নেই।

-কেন? এই না বললি তোর ওকে পছন্দ হয়েছে।

-সুহা সত্যিই ভালো মেয়ে।

-তাহলে কি সমস্যা?

-আমার… আমার আসলে নবনীকে চাই।

#গল্পঃ অদ্বিতীয়া

হাবিবা সরকার হিলা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে