গল্পঃশেষ নিঃশ্বাস শেষ পর্ব
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম স্তব্ধ হয়ে..
নাহ..আমি বেঁচে থাকতে পারবো না.।
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম বেশ…
হয়তো আজই আমার শেষ বারের মত নিঃশ্বাস নেওয়া হবে….
এই যন্ত্রণা একা ভোগ করে আমি বাঁচতে পারবো না..
বাবা,মা আর আবিরের কথা ভেবেই আমি এই একটা মাস প্রতিটা মুহুর্ত বেঁচে থাকার লড়াই করে গিয়েছি..
কিন্তু আজ যখন আমার বেঁচে থাকার কারণ টুকু শুণ্য মনে হচ্ছে তখন আর কিছুই আমার চোখে পড়ছে না..আমি ক্লান্ত..বড্ড ক্লান্ত..আর পারছি না..
কোন কিছুই না ভেবে আমি চেয়ারের উপর পা দয়ে দাঁড়ালাম..পুরো ঘরটাতে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলাম..চোখ বন্ধ করে বাবা মায়ের চেহারা মনে করে বললাম–
“বাবা,মা..আমাকে ভুল বুঝো না..আমাকে মাফ করে দিও..আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি…”
তারপর আবিরের চেহারা মনে করে বললাম-
“প্রিয় আবির,আমি তোমার অপ্রিয় কখনোই হতে চাইনি..আমি নষ্ট হয়ে যাইনি…”
শেষবার নিজেকে নিজেই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম..তারপর শক্ত হয়ে চোখ মুছে সিলিং এর সাথে ঝুলিয়ে রাখা ওড়নাটা ধরলাম..
আস্তে আস্তে মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে নিলাম..
এখন শুধু ফাঁস আটকে চেয়ার ফেলে দিলেই আমার প্রাণ চলে যাবে..আমি মারা যাবো…
ঠিক এই সময়ে আমার দরজায় খুব জোরে কড়া নড়লো..আমি কান দিলাম না শব্দে..তাহলে দুর্বল হয়ে যাবো তো..বুঝতেই পারছিলাম,আমার মা দরজা ধাক্কাচ্ছে..।।এভাবেই প্রায় তিন মিনিট সময় কেটে গেল…
আমি তড়িঘড়ি করে গলায় ওড়না আটকে দিলাম…
রুদ্ধশ্বাস সে মুহুর্ত.. দরজার ওপাশ থেকে একটা কাতর কণ্ঠে ডাক পড়লো—
“নীলা….নীলা….প্লিজ দরজা টা একটু খোল..”
কণ্ঠ টা শুনেই আমার বুকের ভেতর কেমন জানি ধাক্কা লাগলো..মনে হলো আবিরের কণ্ঠ…
আমি হতাশার হাসি দিয়ে উঠলাম ছোট করে..
আবির কোত্থেকে আসবে..!!আবির তো……
এবার খুব জোরে কড়া নেড়ে উঠলো..
আমি প্রায় এক প্রকার বিরক্ত হয়েই নেমে পড়লাম চেয়ার থেকে..নেমে গিয়ে দরজা একটু খানি খুলে দিতেই আমি প্রচণ্ড শক পেলাম..
দেখি আবির দাঁড়িয়ে আছে দরজায় হেলান দিয়ে..
আমাকে দেখতেই কেমন জানি করে উঠলো..
তারপর বললো,প্লিজ আমাকে একটু ঘরে ঢুকতে দিবে..??আমি জোর করেই না বলে উঠলাম..
আবির আমার বারণ শুনলো না..
দরজায় ধাক্কা দিয়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়লো..
ঘরে ঢুকতেই আবির আমার টাঙানো ঝুলন্ত ওড়নার দিকে হা করে তাকালো..চোখ দুটো বড়বড় করে গাল হা করে বিস্ময় ভাবে তাকিয়েই থাকলো কিছুক্ষণ.।
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম একটু দূরে..
শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলাম,কি বলবে আবির???
আবির কোন উত্তর দিলো না..।।
আমিও চুপ করে থাকলাম..তারপর হঠাৎ আমাকে চমকে আবির ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো…আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ও কেমন জানি আর্তনাদ করে উঠে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো–
“তু..মি…তুমি…আমাকে এতো বড় শাস্তি দিতে চেয়েছিলে নীলা???”
আমি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম..কোন উত্তর দিলাম না..আবির সে কি কান্না..আমাকে যতটা শক্ত করে ও ধরে রেখেছিলো তাতে ওর বুকের ভেতর যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম না…
ওর কান্নায় আমি আস্তে আস্তে নিজেকে একটু নমনীয় করলাম..আবির হুট করে হাটু ভেংগে বসে পড়লো আমার সামনে..আর থেমে থেমে বলতে লাগলো—
“আমি অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি নীলা…
আমি বুঝতে সময় নিয়ে ফেলেছি,আমি আমার নীলাকে ভুল বুঝে দূরে ঠেলতে শুরু করেছিলাম..আমার নীলা তো কোন অন্যায় করতে পারেনা..কোন এক জানোয়ারের অপরাধের কারণে আমার ভালোবাসার মানুষ টার এতো কষ্ট হয়েছে,তুমি এতোটা কষ্ট একা একা ভোগ করেছো.. আমি তোমার মানুষ হয়ে সেটাকে না কমিয়ে আরো বাড়িয়ে দিয়েছি..আমার ঘৃণা হচ্ছে ভীষণ,নীলা…আমাকে মাফ করে দাও… আমাকে মাফ করে দাও…..”
আবিরের অবস্থা দেখে আমার ভেতরটা একেবারে ভেঙেচুরে যাচ্ছিলো.।।আমি জলদি করে বসে পড়লাম ওর কাছে..ওর হাত দুটো ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম..আমার ভেতরটা হালকা হচ্ছিলো..মনে হচ্ছিলো,সব যন্ত্রণা যেন আমার আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে…আবিরও আমার হাতে ওর মাথা ঠেকিয়ে খুব কাঁদলো…
অনেক হয়েছে কান্না পর্ব…আমি আস্তে করে হাত দিয়ে আবিরের মাথা উঁচু করে ধরলাম..তারপর আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে আলতো করে আবিরের চোখ মুছে দিলাম আর বললাম–
“তুমি আর কিছু বলো না,আবির..
আমার কষ্ট কমে গিয়েছে..বিশ্বাস করো,আমি আমাকে নষ্ট হতে দেইনি…”
এই কথা বলার সাথে সাথে আবির আমার মুখে ওর হাত দিয়ে ঠেকিয়ে দিলো..এমন কথা কোনদিন আর আমার সামনে উচ্চারণ করবে না,নীলা….আমার ভালো থাকা তুমি..আমার শুধু তুমি থাকলেই হবে..ভালোবেসে পাশে থেকো..আমার আর কিছুই চাই না….
ওর মুখের তীব্র মায়াতে আমি শান্তির হাসি আঁকলাম ঠোঁটে…আমাদের ডাক পড়লো বাইরে থেকে…
আবির আমাকে বললো—
“বাবা, মা ফিরে এসেছে..তোমাকে নাকি কি দিতে ভুলে গেছে..সেটা দিতে..চলো…”
বলেই উঠে দাঁড়িয়ে আমার সামনে হাত এগিয়ে দিলো..আমি মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হাতটা ধরে নিলাম…আমিও দাঁড়াতেই আবির আমার চোখ মুখ মুছে, আঁচল টা টেনে আমার মাথায় কাপড় দিয়ে
বললো—-
“এখন ঠিক তোমাকে আবিরের বউয়ের মতন দেখাচ্ছে…”
আমি ফিক করে হেসে উঠলাম..দুজন মিলে একসাথে ঘর থেকে বের হবো তখন আবির আমার হাত টান দিয়ে বললো–
“কখনো, কোনদিন আমার কোন ভুল হলে ইচ্ছে মত শাস্তি দিবে…কিন্তু অভিমান কষ্ট নিয়ে আমাকে ছেড়ে সারাজীবনের জন্য হারাতে চাইবে না..তোমাকে আমার বড্ড প্রয়োজন,নীলা….. ”
আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে অসহ্য রকমের সুখ লাগছিলো তখন..আমি শুধু মাথা নাড়লাম..আর আবির আলতো করে আমার কপালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বললো–
“তুমি আমার ভীষণ দামী..”
আমি পরম সুখে একটু চোখের পানি ফেললাম..
আমার শেষ নিঃশ্বাস টা, দারূণ সুখের শ্বাস বইয়ে আনলো….
সমাপ্ত
গল্পঃশেষ নিঃশ্বাস
লেখাঃআফসানা জামান তুলতুলি