শেষ নিঃশ্বাস (পর্ব ১)

0
1969

গল্পঃশেষ নিঃশ্বাস (পর্ব ১)

লেখাঃআফসানা জামান তুলতুল

“সাদিক ভাই আমাকে জোর করে বিছানায় নিয়ে গিয়ে…..” কথাটা শেষ করতে পারলাম না..বেঞ্চের উপর ধপ করে বসে,কান্না শুরু করে দিলাম নিজের ওড়নায় মুখ লুকিয়ে…আমার গলা দিয়ে কান্নার শব্দ টুকুও বের হচ্ছে না..
আবির কিছু বললো না..কিছু সময় পর ধমকের সুরে বলে উঠলো—
“কান্না বাদ দিয়ে আমাকে সব খুলে বলো,নীলা…”

আমি ওর গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে কান্নার শব্দকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না..শব্দ করে কেঁদে উঠলাম..উত্তর তো পড়ে থাক,আমার গলাটা দিয়ে শ্বাস টুকুও বের হতে পারছে না যেন…
আমি নিজেই যেখানে নিজেকে প্রকাশ করতে পারছি না,আবির সেখানে কি করে বুঝবে আমাকে…!!
যে কথা কিনা নিজের কাছের কাউকেই বলা যায় না,সেই কথা গুলো আমি আমার ভালোবাসার মানুষ টাকে কিভাবে বলবো..!!আবিরকে হারানোর ভয়ের থেকে ও আমাকে ঘৃণা করবে এই ভয়েই আমি কিছু বলতে পারছিলাম না বোধ হয়…

এই কয়দিন আবিরের থেকে নিজেকে দূর করে রাখছিলাম বলেই,আবির আজ জোর করে আমার সাথে দেখা করতে এলো..
আমি কাঁদছি..সব কিছু আবিরের কাছে বলে দিতে ইচ্ছে করছে,কিন্তু কিছুতেই পারছি না..আবিরকে না পাই আমি,কিন্তু ও যদি আমাকে ঘৃণা করে বসে…
আমি তো বেঁচেই থাকতে পারবো না আর…

আবির আমার কাছে এসে যখন দাঁড়ালো..
আমি শুনতে পাচ্ছিলাম,ও হাঁপাচ্ছে….
নরম গলায় যখন আবির আমাকে বললো–
“আমার দিকে একবার তাকাও,নীলা..আমাকে সব বলো,প্লিজ….”

আমার বুকের ভেতরটা যেন ফেটে যাচ্ছিলো..
আমি ওকে অনুরোধ করে বললাম–
“আমার দিকে তাকিয়ো না প্লিজ,আবির..তাহলে আমি তোমাকে কিছু বলতে পারবো না..”
আবির কেমন জানি একটা শব্দ করে উঠলো..
আমি নিজেকে শক্ত করে,
চোখ বন্ধ করে বলতে লাগলাম–

গত মাসে যে আমি খালাদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম..চলে আসার আগের দিন রাতে,আমি তোমার সাথে কথা বলছিলাম ফোনে..ঠিক দেড়টা বাজে তখন..
ঐ সময় হটাৎ দরজায় নক করা শুনে কানে ফোন থাকা অবস্থাতেই আমি দরজা খুলতে গেলাম…

খালাম্মা ছাড়া এতো রাতে কেই বা আর হবে…!!
দরজা খুলেই দেখি আমার খালাতো ভাই সাদিক..
আমি বেশ চমকে গেলাম..ফোন টা কান থেকে নামিয়ে হাতে রেখে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম–
–এতো রাতে আপনি,ভাইয়া..??কোন দরকার??
ভাইয়া গম্ভীর গলায় বললো–
–হুম..তোমার ভাবীর একটু শরীর খারাপ লাগছে..
তোমার ঘরের আলমারীতে একটা বাটির ভেতর ওর ওষুধ রাখা আছে..সেটা নিতে এসেছি..

আমার কাছে কথাটা কেমন জানি মনের ভেতর খটকা লাগলো..
দরজার মুখে দাঁড়িয়েই আমি ভাইয়াকে একটু সহজ গলায় বললাম–
–ভাইয়া,তাহলে আপনি নিচে ভাবীর কাছে গিয়ে বসেন..আমি আলমারী থেকে ওষুধের বাটি নিয়ে নিচে আসছি….

কথাটা বলেই তার উত্তরের অপেক্ষা না করে,আমি দরজা আজড়ে দিতে গেলাম..সাদিক ভাইয়া হাত দিয়ে দরজা ঠেকিয়ে বললো–
–তুমি নতুন মানুষ..খুঁজে পাবে না ওষুধ কোথায় রাখা আছে..
বলেই দরজাটা ঠেলে খুলে দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেলো..আমি কি করবো বুঝতে না পেরে,ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলাম..
সাদিক ভাই বের হলে,তারপর ঘরে ঢুকবো…

সাদিক ভাই আলমারী খুলে কি জানি হাতড়ে নিচ্ছিলো..তারপর একটা ওষুধের বক্স বের করে সাথে আরো কি কি জানি বের করছিলো..আমাকে ডাকলো সেগুলো একটু ধরে দিতে..আমি ঘরে ঢুকে ভাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে সেগুলোকে ধরলাম….
সাদিক ভাই আলমারীটা বন্ধ করে আমার হাত থেকে সেগুলোকে নিয়ে দরজার দিকে গেলো….

তারপর হঠাৎ করেই সাদিক ভাই দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো..আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই সাদিক ভাই আমার মুখ চেপে ধরলো…..
আমি প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার করতে গিয়েও পারছিলাম না..আমি হাত পা ছুড়ছিলাম আর অনবরত কাঁদছিলাম….
জানোয়ারের মতন ব্যবহার করে সাদিক ভাই আমাকে বিছানায় নিয়ে গিয়েছিলো জোর করে….

এগুলো বলেই আমার গলা আটকে আসলো..
আমি ফুপিয়ে উঠলাম..সেই ভয়ংকর রাতের কথা মনে পড়তেই আমি কেঁপে উঠলাম..পাগলের মতন হাউমাউ করে কাঁদলাম..মনে হচ্ছিলো,মাটির সাথে মিশে যাচ্ছি…মরণের যন্ত্রণার মতন ভয়াবহ হয়ে গেলো সময়টা..শ্বাস নিতে পারছিলাম না মনে হচ্ছে..আবির টু শব্দও করছিলো না..যেটা আমাকে আরো বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে…..

 

বুঝতে পারছিলাম,আমার পুরো দুনিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে..
আমার ভয় সব সত্যি হচ্ছে..
যে আশা টুকু আমাকে এখন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছিলো,সেই আশা টুকুও আমার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে…জীবনের উপর প্রচণ্ড অভিমান হচ্ছিলো..কান্না বন্ধ করে দিলাম..বাকি কথা শেষ করার হয়তো আর প্রয়োজন নেই…কিভাবে নিজেকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে এসেছিলাম,কিভাবে একটা মাস প্রতিদিন নিজে একা বেঁচে থাকার লড়াই করে গেছি সেটা হয়তো আমার বেঁচে থাকা অনুপ্রেরণাকে জানানোর প্রয়োজন নেই…

আমি কোন রকম উঠতে গেলাম….
আর কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো মারা যেতে পারি..
অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম..

আবির তবুও কিছু বললো না…
আমার পা এগোচ্ছে না..শরীরে এতো টুকু শক্তি নেই..নিথর দেহ নিয়ে কোনরকম শ্বাস নিচ্ছিলাম…
তবুও আমাকে ঘরে ফিরতে চাই…আমি এক পা এগোলাম..আবির তবুও কথা বললো না..
দুই পা এগোলাম..আবির পিছু ডাকলো না..

আমার প্রাণ টা যেন বের হতে চাইছে,একবার আবির আমাকে ডেকে উঠুক..আমি তো কোন অন্যায় করিনি…..

চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিলো–
“আবির,আমার কোন দোষ ছিলো না..আমি কোন অন্যায় করিনি..আমাকে ঘৃণা করো না..আমার নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে..আমাকে একবার পুরোটুকু শুনে নাও…আমি খারাপ হয়ে যাইনি…..”

উহহ..
এ কি মরণ যন্ত্রণা..
ঠিক তখন,আবির আমাকে ডেকে উঠলো কাঁপা গলায়….

–নীলা……

ওর ডাক আমার বুকের একবারে ভেতরে গিয়ে লাগলো..আমি সাথে সাথে থেমে গেলাম..কষ্ট আর একটু আশার খুশি মিশ্রিত অনুভুতি কাজ করছিলো মনের ভেতর..ঠোঁট মুখ কাপছিলো ভীষণ..

পেছনে ফিরে তাকিয়েই দেখি………..

চলবে…..

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে