গল্পঃশেষ নিঃশ্বাস পর্বঃ৩
আবিরের মা,আমাকে মায়া ভরে তাকিয়ে আবিরের বাবার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো..
আমি উনার কাছে যেতেই উনি আমার হাত ধরলেন.
একটু মনোযোগ দিয়ে দেখে বললেন,
“ঘরের লক্ষী হবে তো,মা আমাদের..?”
আমার চোখে পানি চলে এলো..দম আটকে আসছিলো কান্না..ঠিক সেই মুহুর্তে আবিরের ফোন এলো ওর মায়ের কাছে..আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠলো..সবাই উনার দিকে খেয়াল করলো..
উনি শক খাওয়ার মতন আওয়াজ করে
উঠে দাঁড়ালেন.উনার চোখ মুখ শক্ত দেখাচ্ছিলো।।
উনি যখন কথা শেষ করা পর্যন্ত সবাই একভাবে তাকিয়ে ছিলো উনার দিকে..আমি সব বুঝতে পারছি..অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম..উনি কথা শেষ করতেই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলেন..
আবিরের বাবা চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,আবিরের মা কি হয়েছে??কি বললো আবির???
আবিরের মা খুব অস্থিরভাবে উত্তর দিলো,
“আবিরের শরীরটা নাকি একেবারেই ভালো লাগছে না..বাড়িতে কেউ নেই..এক্ষণি বাড়ি যেতে বলেছে..”
কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার মাথা নিচু করা থাকা অবস্থাতে চোখে পানি চলে এলো..আমি ভালো মত তাকাতে পারছিলাম না..আবিরের বাবা তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালো..সাথে আমার বাবা মাও..সবার মাঝেই উদ্বেগ কাজ করছিলো..আমার মা চিন্তিত অবস্থায় আবিরের কথা জিজ্ঞাসা করতেই আবিরের মা নরম গলায় বলে উঠলো–
“আপা,ইচ্ছে তো ছিলো..আরো কথা হবে,সাথে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা সেরে ফেলবো..কিন্তু আমার আবিরের অবস্থা শুনে আমার ভালো লাগছে না একেবারেই..বোঝেন ই তো,মায়ের মন..আমরা এক্ষণি বের হচ্ছি..খুব জলদি আবার আসবো…”
এরপর আমি কষ্টের এমন ঘোরে চলে গেলাম যে,তাদের ভেতর কি কথা হলো..আমি কিছুই শুনতে পারছিলাম না..আমার দেহে যেন কোন প্রাণ নেই,এমন অবস্থা নিয়ে দাঁড়িয়েই থাকলাম..
হুঁশ ফিরলো যখন আবিরের বাবা যাওয়ার আগে,
আমার মাথায় হাত রাখলেন আর বললেন–
“মা,আজকের মতন খালি হাতে ফিরে যাচ্ছি..
খুব শীঘ্রই আসবো,তোমাকে নিয়ে যেতে….”
আমি অনেক কষ্টে কান্না ঠেকিয়ে ছোট্ট করে হাসি দিয়ে উঠলাম..আর কিছু বললাম না..
উনারা চলে গেলেন…আমি এক দৌড় দিয়ে আমার ঘরে চলে গেলাম..গিয়েই দরজা দিয়ে বসে পড়লাম মেঝেতে..আছড়ে পড়ে কাঁদলাম..নিজের অস্তিত্ব কে ছোট হতে দেখার কষ্ট,বাবা মাকে ছোট হতে দেখার কষ্ট,নিজের সব কষ্ট আমাকে জেঁকে বসলো…
আমি কেঁদেই যাচ্ছি..
ঠিক সেই সময় আমার ফোনটা বেজে উঠলো..
আমি হাতে নিলাম না ফোন টা..বেজেই যাচ্ছিলো..
বিরক্ত হয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখি
“সাদিক ভাইয়ের নাম্বার থেকে কল”
আমি কান্না থামিয়ে চমকে উঠলাম..
জানোয়ার টা আমাকে ফোন দিয়েছে,কি কারণে..
ঘৃণায় যেন বমি চলে আসলো আমার..
ফোন ধরছি না দেখে,একটা টেক্সট পাঠালো দেখলাম..যেখানে লেখাঃ
“তুই যে আমার মাথায় আঘাত করেছিলি..এর প্রতিশোধ নিবো,আমি তোর বিয়ে কোথাও হতে দেবো না..আর কাউকে যদি কিছু বলিস,তাহলে আমি এমন অবস্থা করে দিবো তোর যে,আমাকে বিয়ে করা ছাড়া তোর কোন উপায় থাকবে না…”
এটা পড়ে আমার ভেতরে আরো অশান্তি ধরে গেল।
আমি ক্লান্ত.. বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেলাম…
সেদিন তো সাদিক ভাই আমাকে তেমন কিছু করতে পারেনি..আমার মুখ চেপে ধরে যখন আমাকে বিছানায় নিয়ে গিয়েছিলো..আমি তখন আমার শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত-পা ছুড়তে লাগলাম..।তারপর আমার জামাটা খোলার জন্য যখন জানোয়ারটা তার হাতটা ঢিলা দিলো অমনি আমি টেবিলের পাশে রাখা জলন্ত কয়েল হাতে নিয়ে জানোয়ার টার চোখের কোণায় ঠেকিয়ে দিলাম..আর ও চিৎকার করে সরে গেল আমার থেকে..আমি এক দৌড় দিয়ে নিচে ছুটে গিয়ে খালাম্মার ঘরে গিয়ে ছিটকিনি দিলাম…
আমি খালাম্মাকে ডাকতে পারিনি..দরজার কোণায় বসে, আমার মুখে কাপড় গুজে হুহু করে কেঁদেছিলাম..পরের দিন ভোর হতেই আমি নানান রকমের মিথ্যা কথা বানিয়ে বাড়ি ছুটে এসেছিলাম..
তারপর থেকেই আমি নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছিলাম..কাউকে কিছু বলতে না পারার কষ্ট,সেই ভয়ংকর রাতের যন্ত্রণা আমাকে প্রতিটা মুহুর্ত কুরে কুরে খাচ্ছিলো..আমি কারো সাথেই ঠিকমত কথা বলতাম না..আবিরের সাথেও না..
ও নিজেই আমাকে আজ জোর করে দেখা করে সবটা জানতে চাইলো…
যে মানুষটাকে বিশ্বাস করে আমি বললাম..সে মানুষ টা সব টা না জেনেই আমাকে ছুড়ে ফেলে দিলো…
এগুলো যতই মনে হচ্ছে ততই আমার ভেতরটা ছিড়ে কান্না আসছে…
আরেকটা টেক্সট এলো জানোয়ার টার–
“কিরে???তোর বিয়ে ভেঙেছে তো???
তোর মত নষ্ট মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না…”
আমি ফোনটা হাতে নিয়ে বন্ধ করে দিলাম..
আর পারছি না..ভালোবাসার মানুষটা পাশে থাকলো না,যে ক্ষতি করলো সেই কিনা এভাবে আমাকে জালিয়েই যাচ্ছে…!তার মানে আমাকে সারাজীবন এই আতংকের মাঝে একা একা মরতে হবে..!!
আমার বেঁচে থাকার কোন মানে নেই…তাই তো.।আমি তো নষ্ট মেয়ে…!!আমার তো বেঁচে থাকার দরকার নেই…আমি ক্লান্ত..প্রচণ্ড ক্লান্ত…
আমি এই জীবন রাখবো না…আমার লড়াই করার শক্তি নেই…এসব ভাবতেই আমি আমার পাগলের মত উঠে দাঁড়িয়ে আমার ওড়না খুঁজলাম হাতড়ে..
টেবিলের চেয়ার টা টেনে নিলাম সিলিং ফ্যানের সোজা করে…..
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম..
নাহ..আমি বেঁচে থাকতে পারবো না.।
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম বেশ…
হয়তো আজই আমার শেষ বারের মত নিঃশ্বাস নেওয়া হবে….
চলবে…..
গল্পঃশেষ নিঃশ্বাস (৩)
লেখাঃআফসানা জামান তুলতুলি