গর্ভধারিনী পর্ব-১২

0
828

#গর্ভধারিনী
পর্ব—১২
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

আব্বা মর্জিনা ফুপুকে কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখন সামনের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো।আম্মার মতো দেখতে সেই মহিলা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।সে এই দুজনের কথা সবটা শুনে নিয়েছে হয়তো।মর্জিনা ফুপু দৌড়ে এসে বললো।

—এইতো আদিবা ভাবি,কোথায় চলে গেছিলা তুমি?এতোক্ষণ কোথায় ছিলা শুনি?

সে কোনো কথা বললো না।চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

—এই বেডি,তুই কথা কইতে জানোস না কী?এতো ঢং করিস কেনো বে?

—আহা,কি মুখের ভাষা!এইভাবে বলেতেছো ক্যান ওরে,আমি কথা কইতেছি তো,তাছাড়া ও কথা না বলতে জানলে কেমনে উত্তর দেবে বলো।

—ও সব জানে,সব জানে ও?আমাগো সামনে নাটক করতেছে।

—তুমি চুপ করো এবার।আমি আদিবা ভাবিরে ঘরে নিয়া যাইতেছি।তুমি যাও এখান থেকে।




এদিকে আমি।বন্ধ করে আটকে থাকতে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।ভাবছি কিকরে এই ঘর থেকে বের হওয়া যায়।অনেক চেষ্টা করে কাচের জানলাটা ভেঙ্গে বাইরে বেরিয়ে পড়ি।বাড়ির গেট পেরিয়ে সোজা রাস্তায়।রাস্তায় দাঁড়িয়ে চারদিকটা তাকাতে লাগলাম।কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।আমি চেষ্টা করছি কিকরে নিজের বাড়িতে ফিরতে পারি।জানি না,এই মহিলার মতলব কি,প্রতিদিন ঘর বন্ধ করে কোথায় চলে যায়?
রাস্তার ওপর দিয়ে আমি হাঁটা শুরু করলাম।কোথায় যাচ্ছি নিজেও জানি না।শুধু এইটুকু জানি আমায় যেরকেই হোক বাড়িতে ফিরতে হবে।হঠাৎ পেছনে একটা গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম।

—এই যে বাবু,দাঁড়াও।

লোকটাকে দেখে আমি একটু অবাক হলাম।এতো সেই লোক,যে আমাকে জোর করে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলো।
আমি লোকটার কথায় উত্তর না দিয়ে সোজা সামনের দিকে দৌড় দিলাম।লোকটা আমার দিকে ধেয়ে আসতে আসতে বলতে লাগলো।

—আরে ভয় পেয়ো না,আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না।তোমায় তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেবো।

লোকটার কথা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না আমার কাছে।আবারো দৌঁড় দিলাম।কিন্তু লোকটা খানিক সময়ের ব্যবধানেই পাকরাও করে ফেললো আমায়।

—আরে তুমি এতো ভয় পাচ্ছো কেনো,আমি তোমাকেই খুঁজছিলাম।

—আমাকে খুচ্ছিলেন কেনো,আমার সাথে কি কাজ আপনার?

—তোমায় বাড়িতে পৌঁছে দেবো,চলো আমার সাথে।

—আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না।

—আচ্ছা তোমার মর্জিনা ফুপুকে বিশ্বাস করো তো?

—আপনি মর্জিনা ফুপুকে চিনলেন কিকরে?

—উনিই আমায় এই কাজটা দিয়েছেন।যেনো তোমায় খুঁজে তার কাছে পৌঁছে দেই।

লোকটার কথা শুনে তার প্রতি ভরসা হলো আমার।এরপর তার সাথে বাড়ির দিকে রওয়না হলাম।



মর্জিনা ফুপুর কথায় আব্বা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।মর্জিনা ফুপু তাকে নিয়ে আমাদের ঘরের ভেতরে যায়।ভেতরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।তারপর ফিসফিস করে বলতে লাগলো‌।

—উফফফ,আল্লাহ।বাঁচাইছে।ভালো হইছে তুমি মুখ খুলো নাই ভাবী।

—কিন্তু এইভাবে আর কতোদিন,আমি আর পারতেছি না মর্জিনা।

—দেখো আদিবা ভাবি আমি জানি তোমার কষ্ট হইতেছে,কিন্তু সত্যিটা জানতে আমাদের যে এইটুকু করতেই হবে!

—তোমায় একটা কথা বলবো বলেও বলা হয় নাই আমার।

—কি কথা বলো?

—আকাইদ আমার কাছেই আছে।তুমি ওরে নিয়া চিন্তা কইরো না।

–কি,কি বললা তুমি?আকাইদ তোমার কাছে,তুমি জানো ওর চিন্তায় আমি দুচোখের পাতা এক করতে পারি না।

—আমি ওরে রাস্তায় পাইছি।জানি না কিকরে ও এতো দূরে চলে গেলো।তবে আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে,আমার ছেলে আমার কাছেই গিয়ে পড়লো।

—আচ্ছা,ও কি জানে তুমি এই বাড়িতে আসতেছো লুকিয়ে লুকিয়ে?

—নাহ,ও কিছুই জানে না।আমি চাই না জীবনের চরম সত্যিটা ও জানতে পারুক।হ্যাঁ,এখন হয়তো অনেক কিছুই বুঝবে না।কিন্তু যখন বুঝতে পারবে এই যন্ত্রনা ছেলেটাকে আজীবন কুড়িয়ে পারবো।আমি এটা সহ্য করতে পারবো না মর্জিনা।

—ঠিক বলেছো।আমিও তাই ভাবছি।আমরা আগে আসল রহস্য উদঘাটন করি।তারপর না হয় আকাইদরে ফিরিয়ে আনা যাবে।

—আমি চাই না ও আর এই জাহান্নামে ফিরে আসুক।শুধু নিজের অজানা প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া আর অমানুষটাকে শাস্তি দিতে পারলেই আমার মুক্তি।ছেলেটাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।

—আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি তোমায়?

–হুমমম,বলো।

—তুমি বেঁচে ফিরলে কিকরে,আর তোমার লাশের জায়গায় অন্য কোনো মহিলার লাশ কিকরে এলো!

—লাশের ব্যপারে আমি নিজেও কিছু জানি না।শুধু এইটুকু মনে আছে আমার যখন জ্ঞান ফেরে একটা কথাই মনে হচ্ছিলো বারবার,কিভাবে হাসপাতাল থেকে বের হতে পারি।আমি কিকরে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরলাম একমাত্র আল্লাহই জানে।কখনো বুঝতে পারিনি আবার তোমাদের সাথে দেখা হবে,আমি আমার আকাইদকে ফিরে পাবো।

—তারপর কি হলো বলো?

—আমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়ি।ভাগ্যিস কেউ দেখতে পায়নি আমায়।তবে একজন নার্সের চোখের সামনে পড়েছিলাম এটা মনে আছে।সে আমায় দেখে ভয়ে পালিয়ে যায়।আমিও আমার নতুন ঠিকানায় চলে গেলাম।যেহেতু পড়াশুনা জানি ওটার সাহায্যেই নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করি।ভেবেছিলাম তোমাদের সবাইকে ছেড়ে যখন একবার চলে এসেছি,আর কোনো পিছুটান আমায় ফেরাতে পারবে না‌।কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস দেখো আমার ছেলে ঘটনাক্রমে সেই আমার কাছেই ফিরে গেলো।এরপর আমি আমার সিধান্ত বদলিয়ে ফেলি।আমাকে এখন আমার অতীতের রহস্য উদঘাটন করতেই হবে,অপরাধীকে উচিত শাস্তি দিতে হবে।এরপর ছেলের কাছে নিজেকে ধরা দেবো।

—বুঝলাম সবই।তুমি এতোকিছু আর একা করবে কিকরে?আমি তো সেটাই বুঝতে পারতেছি না।

—একা,কোথায় তুমি আছো না আমার সাথে?

—হ্যাঁ,আছি।বলো কি করতে হবে আমাদের।আর একটা কথা বলার আছে তোমায়?

—কি কথা?

—আমি আগেই জেনে গিয়েছিলাম দূরুত ভাইজান তোমাকে বিষ দিয়েছিলো।কিন্তু তার পেছনে যে কারণটা ভেবেছি সেটা সম্পূর্ণ ভুল।

—কি কারণ ভেবেছিলে তুমি?

—আমি ভেবেছি উনি আমার জন্য তোমায় নিজের পথ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো,জানো তো এই অপরাধবোধ এতোগুলো দিন শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি আমায়।

—অপরাধ বোধ,কিসের অপরাধ?
(অবাক দৃষ্টিতে আম্মার প্রশ্ন)

—আমি আজ তোমায় একটা সত্যি কথা বলছি।তুমি হয়তো ভুল বুঝবে আমায় কিন্তু বিশ্বাস করো ভাবি আমি তোমার কোনো ক্ষতি চাই নি।

—আরে কি হয়েছে বলবে তো?

—তোমাদের বিয়ের আগে দূরুত ভাইয়া আমাকে পছন্দ করতো।শুধু সে নয়,আমিও তাকে পছন্দ করতাম।দূরুত ভাইজানকে আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম।সেও কথা দিয়েছিলো আমায় বিয়ে করবে।কিন্তু হঠাৎ করে কি যে হয়ে গেলো জানি না,একদিন দেখি তুমি এই বাড়ির বৌ হয়ে এলে।সেইদিন থেকে আমি আমার সমস্ত স্বপ্ন বিসর্জন দেই।দূরুত ভাইজানের ওপর থেকে সমস্ত অধিকারবোধ ত্যাগ করি আমি।

—কিন্তু তুমি পরে বিয়ে করলে না কেনো,বিয়ে করতে পারতে তো?

—আমি চাইনি অন্য কাউকে ঠকাতে,কারণ বিয়ের আগেই দূরুত ভাইজানের হাতে আমি আমার ইজ্জত তুলে দিয়েছিলাম।আমাদের ভেতরে অনেকবার ঘনিষ্ঠতা হয়েছে।এমনকি তুমি চলে যাবার পরে আমি আবারও নিজেকে ওর কাছে ধরা দেই,কারণ আমি চেয়েছিলাম হয়তো এবার আমার এই বাড়ির বৌ হয়ে আসার স্বপ্নটা পূরণ হবে।কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি ফিরে আসাতে আমার বিন্দুমাত্র রাগ বা কষ্ট হচ্ছে না।আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছি।

—সে আমি বুঝতেই পারছি বোন।আর তুমি নিজেকে এতো ছোটো মনে করো না,জানো তো নিজের অন্যায় বা পাপ নিজের মুখে স্বীকারের থেকে বড়ো কাজ আর কিছু হয় না।তোমার মনটা সত্যিই খুব বড়ো,তাই তুমি এটা করতে পেরেছো।আমি তোমায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি।

—আচ্ছা।এবার তো কাজের কথা বলি আমরা…

—আমাদের আগে একটা জায়গায় যেতে হবে,সেখানে গেলেই মনের অনেকটা সন্দেহ দূর হবে।

—কোন জায়গারার কথা বলছো তুমি?

—দোয়াতের বাড়িতে….!

—দোয়াত!দোয়াত কে আবার?

—আগে আমার সাথে চলো।তারপর সবটা জানতে পারবে।আমার এই মূহুর্তে দোয়াতকে খুব প্রয়োজন।

—বুঝতে পারছি না,কে এই দোয়াত।এর নামও তো শুনিনি কখনো।

—আরেকটা অমানুষ!যার কারণে আজও আমি নিজের ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না।আমার জীবনটা এলোমেলো।আমায় আজ ওর মুখোমুখি হতেই হবে।

মর্জিনা ফুপু আম্মার কোনো কথাই বুঝতে পারলো না।কে এই দোয়াত,আম্মার সাথে কিসের সম্পর্ক তার?একটু পরে দুজনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।তারপর দোয়াতের ঠিকানার উদ্দেশ্যে!

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে