#গর্ভধারিণী
পর্ব—১১
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
—একি,আকাইদের মা তুমি….তুমি ফিরে আসলা কিকরে?
(মর্জিনা ফুপু অবাক বিস্ময়ে তাকে প্রশ্ন করে,আব্বা চোখ বড়ো করে হতবাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে!)
—কি হইলো,কথা কইতেছো না কেনো তুমি?
—মর্জিনা এইডা কি দেখতেছি আমি,আকাইদের মা ফিরে আসলো কেমনে,
—ক্যান ভাইজান,ক্যান ফিরে আসতে পারে না,তুমি সত্যি করে বলো তো আদিবা ভাবি কি আদৌ মারা গেছিলো?
—মানে কি কইতে চাস তুই…?
—আমরা কেউ কিন্তু ভাবীর মুখ দেখি নাই।তুমি সবাইরে বলছিলা গাড়ি থেকে পড়ে তার মুখটা থেতলে গেছে।আমরা তাই বিশ্বাস করছি।
—চুপ কর,আমি যা কইতেছি বিশ্বাস কর।আদিবা সত্যিই মা রা গেছে।
—তাই নাকি,তাইলে এইডা কেডা, আদিবা ভাবি র ভুত?
—আমি জানি না, কিচ্ছু জানি না আমি।
—দেখো ভাইজান,আমি ভালোই করেই জানি ঐডা আদিবা ভাবীর লাশ ছিলো না।
—মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর,আদিবার লাশ ছিলো না তো,কার লাশ ছিলো তাইলে?
–সেইটা তুমিই ভালো জানো,তবে তুমিই কোনো একটা ঘাপলা করছো আমি নিশ্চিত।
—বিশ্বাস কর মর্জিনা আমি কিছু করি নাই।
মর্জিনা ফুপু জানে আব্বা হয়তো এখন কিছু স্বীকার করবে না,নাকি সে সত্যিই কিছু জানে না।কে বলতে পারে?এদিকে আমার আম্মার মতো দেখতে সেই মহিলা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।তার মুখে কোনো কথা নেই।মর্জিনা ফুপু আবারো এগিয়ে গেলো তার দিকে।
—ঐ মাইয়া,কথা কইতেছি কানে ঢুকতেছে না নাকি,হায় আল্লাহ বোবা হইয়া গেলো না তো?
—দূরত ভাইজান ওরে ঘরে নিয়া চলো,
—তার আগে ওরে মুখ খুলতে বল,কিছুই তো কইতেছে না।
—আমার মনে হয় কোনো একটা সমস্যা হইছে।কথা বলার হইলে এতোক্ষণে ঠিক কইতো।আমরা আর চাপ না দেই ওরে।
মর্জিনা ফুপু আম্মার মতো দেখতে সেই মহিলাকে ঘরে নিয়ে গেলো।তার গায়ের কাপড়টা বেশ পুরনো আর ছেঁড়া।তাকে গোসল করিয়ে আম্মার একটা পুরনো শাড়ি পড়িয়ে দেওয়া হলো।আকাইদের আম্মা ফিরে এসেছে শুনে গ্রামের সকল মানুষ আমাদের বাড়িতে জড়ো হতে লাগলো।সবাই বিষ্ময়ে হতবাক।যে মানুষটাকে চোখের সামনে কবর দিতে দেখেছে সে আবারো বেঁচে ফিরে এলো,এটা শুনলে যেকোনো মানুষের পিলে চমকে উঠবে।সকাল হতেই বাড়িতে গ্রামের একদল মহিলা পুরুষ এসে হাজির হয়।
—-কই গেলা দূরত।কি শুনতেছি।তোমার বৌ নাকি ফিরে আইছে?
আব্বা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
—কে কইলো এইসব কথা তোমাগো।আমি কইছি?
—সবার মুখে তো শুনতেছি।
—হ একজন আইছে কাল সন্ধ্যায়।যারে দেখতে আকাইদের আম্মার মতো।তোমরাই বলো আকাইদের আম্মা তো মারা গেছে তাইলে ফিরে আসলো কেমনে?
—তাই তো কথা, তবে আমরাও কিন্তু আকাইদের আম্মার মুখ দেখি নাই।তুমি যাই কইছো তাই বিশ্বাস করছি।কি জানি কার মনে কি আছে।
—তোমারা যাতে দেখতে আইছো দেখে চইলা যাও।শুধু শুধু প্যাচাল পেরো না তো।
মর্জিনা ফুপু রাতে তাকে আম্মার ঘরেই রেখেছিলো।আম্মা তাই আম্মার ঘর দেখিয়ে দিলো সবাইকে।কিন্তু আম্মার ঘরে গিয়ে তারা কাউকে খুঁজে পেলো না।একজন মহিলা আব্বাকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে।
—একি,তুমি তো কইলা ঐ বেডি এইঘরে আছে।কোথায়, কেউ তো নাই?তুমি কি মশকরা করতেছো আমাগো লগে।
—তোমরা সকাল সকাল আমার মাথাটা না খেয়ে ছাড়বে না মনে হইতেছে।রাইতের বেলা মর্জিনা ওরে এইখানে রেখে গেলো।এখন কোথায় উধাও হয়ে যাইবো?
—সে আমরা কি জানি, তুমি এসে দেখো যাও!
ঘরে সেই মহিলাকে না পেয়ে আব্বাও সবার মতো বেশ অবাক হলো।মর্জিনা ফুপুকে ব্যপারটা জানানোর জন্য আব্বা তার বাড়িতে ছুটে গেলো।
–
–
–
–
–
এদিকে আমি।এখনো মনে হচ্ছে আম্মার মতো দেখতে সেই মহিলার হাত ধরে শুয়ে আছি।ঘুম ভাঙতেই দেখতে পাই আমার বুকের ভেতরে একটা ছোটো কোলবালিশ।তার মানে উনি এটা আমার কাছে রেখে চলে গিয়েছেন।আমি ঘুমের ঘোরে ভাবলাম উনিই হয়তো সারারাত আমার কাছে ছিলেন।কি বোকা আমি!সে আমার কাছে কেনো থাকতে যাবেন,সেতো আর আমার মা নয়।বিছানা থেকে উঠে ওনার ঘরের দিকে চলে গেলাম।কিন্তু উনি তার ঘরে নেই।অন্য ঘরগুলোতে ওনাকে খুঁজতে লাগলাম,কিন্তু কোথাও নেই!ওনাকে সারা ঘরেও না পেয়ে আমার কেনো জানি খুব ভয় হতে লাগলো।সামনের দরজাটা খুলে বাইরে বের হতে যাবো,তখন আরোও বেশী হতাশ হলাম।দরজাটা বাহির থেকেই তালা মেরে উনি চলে গিয়েছেন।এক প্রকার আমায় আটকে রেখেছেন আমায় ঘরের ভেতর।ভয়ের মাত্রা আরোও বাড়তে লাগলো আমার।কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।এই দরজাটা ছাড়া বের হবার অন্য কোনো রাস্তাও নেই।তাই বাধ্য হয়ে ঘরের ভেতরে বসে রইলাম।
কিছুক্ষণ পরে বাহির থেকে তালা খেলার শব্দ আমার কানে ভেসে আসে।উৎসাহের সাথে দরজার দিকে ছুটে গেলাম,অমনি সে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে।বেশ হন্তদন্ত হয়েই ঢুকলো।
—-একি,আপনি কোথায় চলে গিয়েছিলেন?
—একটু কাজ ছিলো বাইরে, তুমি ভয় পাওনি তো আবার?
—কি কাজ ছিলো,আর আপনি তালা মেরে গেলেন কেনো?
—এই কারণে যাতে তুমি বের হয়ে বাইরে না চলে যেতে পারো।
উনি বেশী কথা না বলে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন।এখনো বুঝতে পারছি না,কি এমন কাজ ছিলো এতো সকাল।রাতে উনি আদৌ বাসায় ছিলেন তো,নাকি অন্য কোথাও।একটা জিনিস প্রথম থেকেই খেয়াল করছি ওনায় অতিরিক্ত কোনো প্রশ্ন করলেই রেগে যান।তাই আমিও আর জোর করে কিছু বলানোর চেষ্টা করি না।একটু পরে খাবারের ঘর থেকে ওনার ডাক আসে।
—আকাইদ খেতে আসো,তোমার জন্য খাবার তৈরি করেছি।
আমি খাবারের ঘরের দিকে চলে গেলাম।
–
–
–
–
–
আব্বা ইতিমধ্যে মর্জিনা ফুপুর বাড়িতে পৌঁছে গেলো।ভেতরে ঢুকেই সে তাকে ডাকতে লাগলো।
—মর্জিনা,কই গেলি ?
—হ,বলো ভাইজান।
(মর্জিনা ফুপু বেরিয়ে এসে বললো)
—-একটা ঘটনা ঘটে গেছে তো,
—কি হইছে আবার?
—ঐ মেয়ের খুঁজে পাওয়া যাইতেছে না।
—কি কও, আমি নিজে ভাবীর ঘরে রেখে আসলাম।কোথায় চলে গেলো?
—আমি কেমনে কমু,দেখ আমার কিন্তু কিছুই ভালো ঠেকতেছে না।
—আশেপাশে খুঁজছিলা কোথাও?
—হ খুঁজছি, কোথাও নাই।একদিকে ভালোই হইছে আমি চাই ও যেনো আর না আসে।
—কি যে বলো না,আদিবা ভাবী এতোদিন পরে ফিরে আসলো,কোথায় চলে যাবে,চলো খুঁজে দেখি।
মর্জিনা ফুপু সামনের দিকে পা বাড়ালো ঠিক তখন আব্বা তার হাতটা টেনে ধরলো!
—আদিবা ফিরে আসলে তুই কি খুব খুশি হস?তোর তো এতো খুশি হবার কথা না,
—ছাড়ো আমায়, কেউ এসে দেখে ফেলবে,
—কি কথা ছিলো আমাগো,তোরে আমি বিয়া কইরা আমার ঘরে তুলমু,তোর তো কোনো গরজই দেখতেছি না এখন আর।
—হ, আদিবা ভাবি মারা যাবার পরে আমিও তাই ভাবছিলাম।তোমায় বিশ্বাস করে আমি আমার নিজের ইজ্জত পর্যন্ত নষ্ট করেছি।তবে তফাৎটা কী জানো,
—কি তফাৎ?
—তখন তোমার আসল রুপটা জানতাম না আমি,যা এখন জানি,
—কী জানোস তুই, কতটুকু জানোস, চল আজই বিয়ে করে নেই আমরা।
—আমার এখন এসব কথা বলতে ভালো লাগতেছে না, আদিবা ভাবিরে খুঁজতে হবে চলো,
—তার মানে বিয়া করবি না আমায়?
—না করবো না, কারণ আমি চাই না আমার ছেলেও কোনোদিন আমার পাতে বিষ তুলে দিক,যেরকম আকাইদ দিছিলো, তোমার কথায়,
এই বলে মর্জিনা ফুপু চলে গেলো,আব্বা হা করে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।তার বুঝতে বাকি রইলো না এগুলো আমিই বলেছি মর্জিনা ফুপুকে,নয়তো তার জানার কথা নয়।
–
–
–
–
–
বিকেল বেলা।খাওয়া দাওয়া শেষে উনি আমায় বাসার রেখে কোথায় একটা চলে গেলেন।বললেন ফিরতে নাকি একটু দেরী হবে।আর আমি যেনো কোথাও চলে না যাই।বার বার নিষেধ করে দিলেন।আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করতেও কোথায় যাচ্ছেন বললেন না।জানি না এভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য কোথায় চলে যান উনি!হতে পারে নিজের কোনো কাজের জন্যই গিয়েছেন।আমি টিভিটা চালিয়ে বসার ঘরে বসে রইলাম। আপাতত আর কিছু মাথায় নেই আমার।
–
–
–
–
–
সন্ধ্যাবেলা।সারাদিন আম্মাকে খুঁজেও আব্বা আর মর্জিনা ফুপু কোনো হদিস পেলো না।তারা নিরুপায় হয়ে বাড়িতে ফিরে আসে।
—-আমার মনে হয় মর্জিনা আর ফিরবে না ও,নিশ্চয়ই বদ কোনো উদ্দেশ্য নিয়া আসছিলো!
(আব্বা মর্জিনা ফুপুকে উদ্দেশ্য করে বলে)
—কেনো,না ফিরলেই খুশি হও বুঝি।
—হ খুশি হই,কারণ আমি জানি ঐটা আদিবা না।
—না হলে আর কি করার আছে,
—একটা কথা বলি, রাগ করবি না তো?
—কী কথা বলো!
—রাগ করবি না বল,
—আরে বলো না!
—আজ রাতে আয় না আরেকবার,দেখ কেউ নাই বাড়িতে এমনিতেও,
—তোমার ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাইতেছে না, এদিকে আরেক সমস্যা, তার ভেতরে এসব চিন্তা আসে কেমনে, আল্লাহ কি দিয়া বানাইছে তোমারে বলবা আমায়?
আব্বা মর্জিনা ফুপুকে কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক তখন সামনের দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো।আম্মার মতো দেখতে সেই মহিলা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।সে এই দুজনের কথা সবটা শুনে নিয়েছে হয়তো।মর্জিনা ফুপু দৌড়ে এসে বললো।
—এইতো আদিবা ভাবি,কোথায় চলে গেছিলা তুমি?এতোক্ষণ কোথায় ছিলা শুনি?
চলবে…