#গর্ভধারিণী
পর্ব—১০
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
—এতো আমার ছোটোবেলার ছবি।হুবহু এরকম একটা ছবি আমাদের বাড়িতেও আছে।এই মহিলা যদি সত্যিই আমার আম্মা না হয়ে থাকে তার ঘরে আমার ছবি কি করছে?
ছবিটার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম আমি।এরপর তার ওপরে হাত বুলাতে লাগলাম।হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছবিটা মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেলো।শব্দ পেয়ে তিনি তার ঘর থেকে ছুটে আসে।
—একি,এটা কি করলে তুমি?
—আমি বুঝতে পারি নি,একদম বুঝতে পারি নি।
—তুমি কেনো এসেছো এই ঘরে,আমি বলেছি তোমায়?
—এটা কার ছবি ছিলো,আপনার কি হয়?
—একই তো আমার ঘরের জিনিস ভেঙে ফেলেছো, আবার আমায় প্রশ্ন করছো।
বুঝতে পেরেছি ছবি ভাঙ্গাতে উনি আমার ওপরে খুব রেগে গিয়েছেন।তাই আমি আর কোনো কথা বললাম না।
—দেখো,আমাকে না বলে এরপর কোনো জিনিসে হাত দেবে না,বুঝতে পেরেছো।এবার চলো আমার সাথে।তোমার খাবারের ব্যবস্থা করেছি আমি।
বেশ স্বাভাবিক গলায় কথাগুলো বলে আমায় হাত ধরে খাবারের টেবিলে নিয়ে গেলেন।আমি একবার পিছনে ফিরে তাকালাম।ছবিটা মেঝের ওপরে পড়ে আর ভাঙা কাচগুলো চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।এক পলক দেখে আবারো মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।উনি আমায় নিয়ে খাবার টেবিলে বসালেন।একটা প্লেটে করে অনেকটা সাদা ভাত দিলেন,সাথে ডালের বড়া, কলা আর কাঁঠালের বিচির তরকারি।খাবারগুলো দেখে আমি অবাক না হয়ে পাড়লাম না।এগুলো তো সব আমার প্রিয় খাবার।এই মহিলা আমার প্রিয় খাবারের বিষয়ে জানলো কিকরে?আমি তাকে প্রশ্ন করি!
—-এগুলো সব আমার জন্য?
—হুমমম,তোমার জন্য রান্না করেছি!
—এতো তাড়াতাড়ি এগুলো জোগাড় করলেন কোথা থেকে?
—পাশের দোকান থেকে কিনে এনেছি।এখানে সব পাওয়া যায়।
—কিন্তু এগুলো তো সব আমার প্রিয় খাবার, আপনি জানলেন কিকরে?
—আমি জানি না তো, কে জানবে….
উনি কথাটা বলে নিজেকে সংবরণ করলেন।যেনো আরও কিছু বলার ছিলো তার,আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।
—আপনি জানবেন মানে, আপনি তো চেনেন না আমায়, কিকরে জানলেন এগুলো আমার প্রিয় খাবার বলুন।
—তুমি বড্ড কথা বলো।এখন চুপচাপ খাও তো।তোমার খাওয়া শেষ হলে আমিও খাবো।
—আপনিও বসুন না।
—নাহ, আগে তুমি খাও…
আমি হাত দিয়ে খাবারগুলো খেতে যাবো,কিন্তু হাতের কব্জিতে ব্যান্ডেজ থাকার কারণে ঠিকমত খেতে পারছিলাম না।তারপরেও খাওয়ার চেষ্টা করছি।এমনিতেই প্রচুর খিদে পেয়েছে।তার ওপরে এতো ভালো ভালো তরকারী।উনি আমার সমস্যটা বুঝতে পেরে হেসে বললেন।
—আচ্ছা ছাড়ো, আমি খাইয়ে দিচ্ছি!
–আপনি আমায় সত্যি খাইয়ে দেবেন?
–হ্যাঁ, দেবো বৈ কি,
—জানেন আমার আম্মাও আমায় রোজ নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন।
—তাই নাকি,আসলে সব মায়েরাই এমন হয়।শুধু তোমার মা নয়।
উনি নিজের হাতে ভাত মেখে আমায় খাইয়ে দিতে লাগলেন।যেনো অনেকদিন পরে নিজের মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছি।আমার আম্মার রান্না আর এনার রান্নার ভেতরে হুবহু মিল।পেট পুরে খেয়ে নিলাম।আম্মা মারা যাবার পরে এই প্রথম এতো তৃপ্তি সহকারে ভাত খেলাম।তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই,এরপর উনি খেতে বসেন।আমি কৌতুহলবশত দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম।দেখতে পাই উনি খাচ্ছেন আর কান্না করছেন।চোখ বেয়ে পানি ভাতের প্লেটে গড়িয়ে পড়ছে।একবার ভাবলাম ওনার কাছে যাবে,কিন্তু একটু আগের বকাবকির কথা মনে পড়তেই পিছপা হলাম।
–
–
–
–
–
এদিকে আমার গ্রামে।সেই লোকটা যে আমাকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলো সে চুপি চুপি একটা বাগানের বাঁশঝাড়ে এসে ঢুকে পড়ে।একটু পরেই মর্জিনা ফুপু সেই জায়গায় এসে হাজির হয়।
—কি হলো, তুমি সোজা গ্রামেই চলে এলে, কেনো ফোন করে কথা বলা যেতো না?
—আপনি কি আমায় গা ধা মনে করেন।এইসব কথা ফোনে বলা কতোটা রিস্কি জানেন?
—হ্যাঁ, জানি জানি।এবার কি বলতে আসছেন বলুন।
—একটা ঝামেলা হয়ে গেছে যে!
—ঝামেলা হয়েছে মানে, কি হয়েছে?ধরা পড়ে গিয়েছেন নাকি?
—ধরা পড়লে কি এখানে থাকতাম।অন্য কেস!
—হয়েছেটা কি?
—ছেলেটা তো পালিয়েছে!
—কি?পালিয়ে গেছে ছেলেটা, কিকরে পালালো?আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে এই কথাটা বলছেন কোন সাহসে?
—আরে এতো রেগে যাচ্ছেন কেনো,আমি তো পানিই দিতে গিয়েছিলাম।তারপর এমন এক কান্ড করলো বুঝতে পারছি না আমি কিছুই,
—কোথায় গেছে বা এখন কোথায় আছে কিছু জানতে পেরেছেন, ওর কোনো ক্ষতি হয়নি তো আবার?
—সে আমি কিকরে জানবো।
–আমি এতো কিছু জানি না।ঐ ছেলেকে আপনার জিম্মেদারিতে দিয়েছিলাম আমি, এখন যদি ওর কোনো ক্ষতি হয় আপনাকে ছেড়ে দেবো না।
—এখন কি করবো আমি, কিছু বলুন।
—খুঁজুন।বাচ্চা ছেলে কতদূর আর যাবে।আমি চাই না ও আবার ঘুরেফিরে এসে নিজের দজ্জাল বাপের হাতে পড়ুক।আপনি ওকে খুঁজে বের করে আমার সেই লোকের কাছে রেখে আসবেন।পরে আমি গিয়ে কথা বলবো ওর সাথে।
—আচ্ছা ঠিক আছে।আমি দেখছি কী করা যায়!এবার যাই আমি তাহলে।
—যান,আর কেউ যেনো কিছু জানতে না পারে।সাবধান।
—আচ্ছা যাবার আগে আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?
—বলুন,
—আমি বুঝতে পারছি আপনি ছেলেটার ক্ষতি করতে চান না।কিন্তু এরকম একটা কাজ কেনো করলেন,অন্যভাবেও ছেলেটাকে তো আপনার লোকের কাছে পাঠাতে পারতেন?
—না, আকাইদকে চিনি আমি।আমি ভালো মুখে বললে ও কখনোই বাড়ি থেকে পালাতো না।তাই আমি চেয়েছিলাম ওকে আমার এক পরিচিত মানুষের কাছে রেখে আসতে,আর ও যাতে ফিরে আসতে না পেরে সেই কারণেই ওকে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছিলো?
—হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি কিন্ত এখানে কে এমন ওর এতো বড়ো শত্রু যার জন্য আপনি এই কাজ করলেন?
—বললাম তো, ওর নিজের বাবা। আমি ওকে বিশ্বাস করি না। যখন তখন ছেলেটাকে মে রে ফেলতে পারে ও। যে নিজের বৌকে খুন করতে পারে তার পক্ষে সব সম্ভব।আমি চাইনা আকাইদ ওর বাবার মতো একটা মানুষের কাছে থাকুক।যাই হোক আপনাকে এতো কথা বলে কি লাভ।এখন তাড়াতাড়ি যান এখান থেকে।
এরপর লোকটা চলে গেলো।মর্জিনা ফুপু চারদিকে তাকাতে তাকাতে বাড়ির দিকে চলে যায়।
–
–
–
–
–
তখন অনেকটা রাত।খেয়ে দেয়ে আমি ঘুমাতে গেলাম।উনি এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে লাগলেন।জানি না আমি মায়ের হাত ভাবে ওনার হাতটা বুকের ভেতরে চেপে ধরলাম।উনি বসে রইলেন আমার পাশে।
–
–
–
–
–
মর্জিনা ফুপু লোকটাকে বিদায় করে সোজা আমাদের বাড়িতে আসে।এসে দেখতে পায় আব্বা উঠানে বেশ ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার সামনে ঘোমটা দেওয়া একজন মহিলা।মর্জিনা ফুপু আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বলে।
—দূরুত ভাইজান, কে এইটা?
—আমি জানি না মর্জিনা।তখন থেকে কথা বলতেছি কোনো সাড়াশব্দ দিতেছে না।
—এই যে কে আপনি, নিজের ঘোমটাটা সরান মাথা থেকে।ক্যান আসছেন এই বাড়িতে?
সে মর্জিনা ফুপুর কথার কোনো উত্তর দিলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
—আচ্ছা মুশকিল তো, বোবা নাকি, কথা কইতে জানে না নাকি?
—আমি পুরুষ মানুষ বইলা গায়ে হাত দিচ্ছি না, তুই একটু দেখ মর্জিনা।
মর্জিনা ফুপু মহিলাটার দিকে এগিয়ে আসে।ঘোমটাটা মাথা থেকে টেনে দিতেই দু’জন চমকে উঠলো।
—একি,আকাইদের মা তুমি….তুমি ফিরে আসলা কিকরে?
(মর্জিনা ফুপু অবাক বিস্ময়ে তাকে প্রশ্ন করে,আব্বা চোখ বড়ো করে হতবাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে!)
এদিকে আমি সেই মহিলার হাত বুকের ভেতরে নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে আছি!
চলবে…..