#গর্ভধারিণী
পর্ব—০৯
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
সে ভিড় ঠেলে কেউ একজন সামনে এগিয়ে আসতে লাগলো।তার দিকে চোখ পড়তেই আমি বিস্ময়ে হতবাক!যেনো জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি।মুখ ফুটে বলে উঠলাম।
—আম্মা,তুমি!
—আম্মা!কে তোমার আম্মা বাবু?
আম্মার কথা শুনে আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম।এটা কি বলছে আমার মা!
—আম্মা আমি আকাইদ,তোমার ছেলে?এই কয়দিনে ভুলে গেলে আমায়?
—বাবু তোমার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।আমি তোমার মা নই।
—আম্মায় মিথ্যা কেনো বলছো,আমি জানি তুমি আমার আম্মা,তুমি ছাড়া আর কে আমার মা হবে?
—আচ্ছা তুমি কোথা থেকে এসেছো,আর কেউ নেই তোমার সাথে?
আমি আম্মার কথার কোনো উত্তর দিলাম না, শুধু অবাক হয়ে চেয়ে আছি তার দিকে।জানিনা আম্মা আমায় চিনতে কেনো পারছে না।আমায় দেখতে পেয়ে তো এতোক্ষণে বুকে জড়িয়ে নেওয়ার কথা।
—কি হলো কথা বলছো না কেনো,ঠিক আছে ব্যপার না।তুমি বরং আমার সাথে চলো!
—কোথায় যাবো?
—আমার বাসায় যাবে,দেখো তুমি তো চোট পেয়েছো।তাই তোমার চিকিৎসা দরকার।
একটু পরে রাস্তাটা ভীড়শুন্য হতে থাকে।তারপর সে একটা রিকশা ডেকে আমায় রিকশায় তুলে তার পাশে বসালো।চেহারার মিল ছাড়া মায়ের আর কোনোকিছুই খুঁজে পাচ্ছি না এই মহিলার ভেতরে।কথাবার্তা,পোশাক কোনো কিছুতেই মিল নেই।আম্মা আগে কখনোই এতো শুদ্ধ করে কথা বলতো না,নাএইরকম চাদরের সাথে শাড়ি পড়তো।তবে ওনার মুখ আর কন্ঠের সাথে মায়ের হুবহু মিল।মানুষ চাইলেই নিজের কথাবার্তার ধরণ,পোশাক পাল্টে ফেলতে পারে কিন্তু যে জিনিসগুলো পাল্টানো সম্ভব নয় অদ্ভুতভাবে সেগুলোর সাথেই আমার মায়ের ভীষণ মিল।চলতে চলতে রিকশাটা রাস্তার একটা ছোটো খাদের ভেতরে পড়লো,অমনি সে আমাকে সামলে নেয়।তারপর আমায় প্রশ্ন করে।
—তোমার নাম কি বাবু?
—আকাইদ!
—পুরো নাম?
–আটাইদ হাসান।
—তুমি এই জায়গায় একা একা চলে আসলে কিকরে,পালিয়ে আসোনি তো বাড়ি থেকে?
—না,আমি পালাইনি।তবে ঐ লোকটা…
—কোন লোকটা?
—আমি তো চিনি না তাকে,তবে সে আমার সাথে খুব খারাপ কিছু করতে চেয়েছিলো!
—তুমি জানতে সে খারাপ কিছু করতে চেয়েছিলো,তাহলে তার সাথে এলো কেনো?
—আমি নিজে নিজে আসিনি,যখন ঘুম ভাঙলো দেখি একটা অন্ধকার বাক্সের ভেতরে আটকে আছি।তারপর ঐ লোকটা আমায় পানি খেতে দিলো,আমি তখন বুদ্ধি করে গাড়ি থেকে নেমে এসেছি!
—বাহহ,এটা খুব ভালো করেছো।তোমার বাবা মা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে হন্নে হয়ে খুঁজছে তোমায়?
—না,কেউ খুঁজছে না আমায়!
—খুঁজছে না মানে,কেনো?
—আমার মা নেই,আব্বা আছে শুধু।আব্বাই আমায় ঐ খারাপ লোকটার হাতে তুলে দিয়েছে।
—ধূর,এটা হয় নাকি আবার?
—হয়,আব্বার দেওয়া ঐ গজাগুলো খেয়ে আমার খুব ঘুম পায়।তারপর আর কিছু মনে নেই আমার।হয়তো আব্বাই চেয়েছিলো আমি যেনো আর ঐ বাড়িতে না থাকি…তাই আমায় খারাপ লোকটার হাতে তুলে দিয়েছিলো,
–ইসসস,বাবা এমন একটা কাজ কেনো করলো তোমার সাথে?
—আমিও জানি না,
—একটা কথা…তোমার কথাগুলো শুনে মনেই হচ্ছে না আমি বাচ্চার সাথে কথা বলছি।এরকম বড়োদের মতো কথা শিখলে কোথা থেকে?
—জানি না,আমি নিজেও জানি না।তবে অনেকেই বলে আম্মা চলে যাবার পরে নাকি আবার ভেতরে অনেক পরিবর্তন আসেছে।
—বুঝতে পেরেছি।আসলে এটা সত্যি পরিস্থিতি মানুষকে সময়ের থেকে অনেক বেশী ম্যাচিউর করে দেয়।তোমার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই ঘটেছে!
—ম্যাচিউর কি?
(আমি এই অদ্ভুত শব্দের সাথে পরিচিত নই,তাই তাকে প্রশ্ন করি)
—হাহাহা,ম্যাচিউরড হলো পরিপক্ক।মানে তুমি সবথেকে বুঝতে শিখে গেছো।
এরপর ওনার আর কোনো কথা হলো আমার।রিকশা আপন গতিতে এগিয়ে চলতে লাগলো।
–
–
–
–
এদিকে আমার বাড়িতে।
বিকেল বেলা আব্বা বাড়িতে ফিরে আসে।এসেই আমার নাম ধরে ডাকতে শুরু করলো।
—আকাইদ,আকাইদ কই গেলি রে?
আমার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আব্বা চারপাশটা খুঁজতে লাগলো।তারপর আমার ঘরের দিকে আসে।দরজা খুলে দেখতে পায় আমি নেই ভেতরে।সারা বাড়ি আমায় তন্ন তন্ন করে খুজেঁও কোনোরকম সন্ধান মিললো না।বেশ কিছুক্ষণ আমায় খুজে না পেয়ে মর্জিনা ফুপুর বাড়িতে গেলো।
—কি রে মর্জিনা, আকাইদ কোথায়?
—সে আমি কি জানি,
—তুই জানিস না মানে, ও তো বেশিরভাগ সময় তোর লগেই থাকে।
—হ,থাকতো।কিন্তু তুমি সকালবেলা আমায় নিষেধ করে দেবার পরে আর একবারেও যাইনি,না ও আসছে।
—তাহলে কোথায় গেলো ছেলেটা আমার?
—ক্যান বাড়িতে নেই ও?
—বাড়িতে থাকলে কি তোর কাছে আসতাম!
—ভালো করে খুঁজে দেখো,কোথায় আর যাবে..
—আমার কিছু মাথায় ঢুকতেছে না,কোথায় চলে যাবে ছেলেটা?
—আচ্ছা তুমি শেষবারের মতো কহন দেখছিলা ওরে?
—মনে আছে দুপুরবেলা তুই আমায় কিছু খাবার দিছিলি ওর জন্য,আমি ওগুলো নিয়াই দিছিলাম ওরে।আর এইটাও বলছিলাম যে খাবারগুলো আমি নিয়া আসছি।তুই দিয়েছিস বলি নাই,
—ক্যান বললা না?
—দেখ সকালে এমনিতেই ওর সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করছি, ভাবছি আমি আনছি শুনলে ও খুশি হইবো, মনটা হয়তো ভালো হইবো ছেলেটার।কি উল্টাপাল্টা সব হয়ে গেল বল তো,
—এ তো খুব চিন্তার বিষয়। আচ্ছা চলো আমিও গিয়ে খুঁজি তোমার সাথে।এইভাবে ও কোথায় চলে যাবে।আমার মনে হয় খুঁজলে ঠিক পাওয়া যাইবো,এতো চিন্তা কইরো না।
মর্জিনা ফুপু আর আব্বার সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো।তারপর আমায় খুঁজতে থাকে।
(পাঠকদের একটা বিষয় স্পষ্ট করে দেই, অনেকেই হয়তো ভাবছেন আকাইদ কিকরে জানলো ওর বাড়িতে কি ঘটছে?বস্তুত আকাইদ এখন একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক।সে নিজের সাথে ঘটা ঘটনাগুলো কোনো একজনের সাথে শেয়ার করছে যা ওর সবটা নখদর্পনে।এই নিয়ে কেউ দয়া করে বিভ্রান্ত হবেন না!)
—এই মর্জিনা তুই আমার ছেলের সাথে কিছু করিস নাই তো আবার?
—তুমি এসব কি কইতছো দূরুত ভাইজান,আমি আকাইদের ক্ষতি করমু ভাবলা কেমনে তুমি?
—আমি অনেক কিছু ভাবতে পারি অহন,তুই গজার সাথে কিছু….
—মানে,তুমি বলতে চাও।আমি কি এর আগে খাওয়াই নাই তোমাগো,দেখো একদম ঠিক হইতেছে না কিন্তু,আজেবাজে কথা বন্ধ করো।
—ঠিক আছে বলমুনা আর।আর শুনে রাখ ওর সাথে কেউ খারাপ কিছু করলে আমি কিন্তু ছাড়মু না তারে।
–আইজ মনে হয় ছেলের জন্য একটু বেশিই দরদ দেখাইতেছো,এতোদিন কোথায় ছিলো এতো ভালোবাসা?
–বাজে কথা বলিস না।পারলে আমার সাথে খোঁজ ওরে।
–
–
–
–
–
এদিকে আমি সেই মহিলার সাথে তার বাসায় আসলাম।উনি আমায় ওনার ঘরের সোফার ওপরে বসিয়ে ভেতরের ঘরে চলে গেল।একটু পরে কিছু ব্যান্ডেজ আর ডেটল নিয়ে ফিরে আসলো।
—ব্যথা কি কমেছে একটুও,
—হ্যাঁ,অনেক কমছে আগের থেকে
—হাতটা এদিকে বাড়াও ওষুধ লাগিয়ে দিচ্ছি।
আমি তার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম।বহুদিন পরে যেনো নিজের মায়ের পরশ পেলাম।দুটো মানুষের ভেতরে কিকরে এতো মিল থাকতে পারে!আমি শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে।
সে আমার ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো।তারপর আবারো ঘরের ভেতরে চলে যায়।আমি সোফা থেকে উঠে এদিক ওদিক তাকাতে থাকি।বসার ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলাম।হঠাৎ আমার চোখজোড়া দেয়ালের উপরে ঝুলানো একটা ছবির দিকে আটকে গেলো।
—এতো আমার ছোটোবেলার ছবি।হুবহু এরকম একটা ছবি আমাদের বাড়িতেও আছে।এই মহিলা যদি সত্যিই আমার আম্মা না হয়ে থাকে তার ঘরে আমার ছবি কি করছে?
চলবে……..