#গর্ভধারিণী
পর্ব—০৭
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
—কি বললেন,কি বললেন আপনি?আপনি জানেন উনি কোথায় গিয়েছেন?
—দেখুন উনি ঠিক কোথায় গিয়েছেন আমি তো বলতে পারবো না,তবে আমি এইটুকু দেখেছি উনি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ডান দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়েছেন।
—আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাদের সাহায্য করার জন্য।হয়তো এই সূত্র ধরেই আমরা ওর মাকে খুঁজে বের করতে পারবো।
আমি আর মর্জিনা ফুপু নার্সের থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি।নার্স যে জায়গায় আম্মাকে শেষবারের মতো দেখেছে সেই জায়গায় এসে দাঁড়ালাম।
—এইবার,কি করবো আমরা মর্জিনা ফুপু?
—সেইটা আমিও তো বুঝতে পারেতেছি না।আচ্ছা তোদের কেনো আত্মীয় বাড়ি আছে এইদিকে?হতে পারে তোর মা সেইখানেই গেছে।
—কই আমি তো জানি না।আমাদের এদিকে কোনো আত্মীয় বাড়ি নেই।
—দেখ আকাইদ,এভাবে হবে না।আমরা এইভাবে তোমার আম্মাকে খুঁজে পাবো না।
—তাইলে কেমনে খুঁজবো?
—এখন চল বাড়িতে যাই।অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে।তোর আব্বা যদি একবার জানতে পারে আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে এসব করছি আস্ত রাখবে না আমাদের।
—তাইলে আম্মারে আর পাওয়া হইবে না?
—কেনো হইবে না।আমরা ঠিক তোর আম্মাকে খুঁজে পাবো।এখন চল,বাড়িতে চল।এইভাবে আন্দাজে সারারাত খুঁজলেও কিচ্ছু হবে না।
আমরা পেছনের দিকে ঘুরবো ঠিক তখনই কেউ একটা আমাদের অতিক্রম করে চলে গেলো।এক মুহুর্তের জন্য হলেও মনে হলো আমি আমার মাকে দেখলাম।সামনে তাকাতেই দেখতে পাই একজন মহিলা ঘোমটা দিয়ে দৌঁড়ে এগিয়ে যাচ্ছে।মনের অজান্তেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো!
—আম্মা, আম্মা তুমি কোথায় যাচ্ছো?
—কি হলো আকাইদ,কোথায় তোর আম্মা?
—দেখো মর্জিনা ফুপু,আমি এইমাত্র আমার মাকে দেখলাম।ওটা আমার মা।
আমি আর মর্জিনা ফুপু মহিলাটার দিকে এগিয়ে যাই।সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই খপ করে হাতটা টেনে ধরলাম।
—আম্মা,কিছু না বলে এভাবে কোথায় যাচ্ছো তুমি?
—কি হলো,কে আপনি?এভাবে ঘোমটা দিয়ে আছেন কেনো,এইদিকে ঘুরে তাকান বলছি।(মর্জিনা ফুপু বললো)
মহিলা উল্টো তার ঘোমটাটা আরোও লম্বা করে টেনে দিলো।মর্জিনা ফুপু তার কাছাকাছি যেতেই যে এক ঝটকায় নিজেকে মুক্ত করে নেয়।তারপর চোখের পলকে কোথায় পালিয়ে গেলো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না আমরা।
—মর্জিনা ফুপু, আম্মা কোথায় চলে গেলো, এইমাত্র তো এখানেই ছিলো..
—তুই কি পাগল হয়ে গেছিস আকাইদ?কে তোর আম্মা?উনি তোর মা হইলে এইভাবে পালিয়ে যাবেন কেনো?
—না, ওটা আমার আম্মা!
—নাহ, আমাদের কোথাও একটা ভুল হইতেছে।ওটা আদিবা ভাবি হতেই পারে না।হয়তো অন্য কেউ,তাছাড়া চোর-টোরও হইতে পারে।তোর আম্মা হইলে এইভাবে পালিয়ে যাইতো না।চল আমরা বাড়িতে যাই।আর এটা নিয়ে এতো চিন্তা করিস না।
একরাশ হতাশা নিয়ে আমি আর মর্জিনা ফুপু বাড়িতে ফিরে আসলাম।এখনো বুঝতে পারছি না,কে ছিলো ওটা?এইভাবে পালিয়ে গেলো কেনো আমাদের দেখে,কেনো একটি বার নিজের মুখটা দেখালে কি এমন হতো!নাহ,আর কিছু ভাবতে পারছি না আমি।অনেকটা রাত হয়ে গেছে বলে মর্জিনা ফুপু তার বাড়িতে ঢুকে পড়লো।বাকি পথটুকু আমি নিজেই হেঁটে আসি।বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম।ঘরের সামনে যেতেই দেখি আব্বা সামনে বসে আছে।আমি ভয়ে ভয়ে সামনে এগোতে থাকি।
—কি ব্যপার,এতো রাতে কোথা থেইক্কা আসা হইলো?
—মর্জিনা ফুপুর সাথে একটু বাইরে গেছিলাম।
–তা,বাইরে টা কোথায় জানতে পারি?
আমি আব্বাকে কি বলবো কিছু বুঝতে পারছি না।যদি সত্যিটা বলে দেই হাসপাতালে গিয়েছিলাম এতে আব্বা আরোও বেশী রেগে যাবে।তাই কোনো কথা না বলে চুপ করে রইলাম।
—কি,আমি কি জিগাইতেছি।কানে যাইতেছে না বুঝি?
—তার আগে তুমি কও,তুমি আম্মারে বি’ষ খাওয়াইছো ক্যান।আমি এখন জানি বি’ষ খাইলে মানুষ মারা যায়,তোমার জন্য আমার আম্মা ম র ছে।
মুখ ফসকে আমার কথাগুলো বেরিয়েই গেলো।আমার কথা শুনে আব্বা হতবাক,যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
—এই,এই আকাইদ।তোর এসব কে শিখাইলো?বল আমারে।
—আমি বলমু না,তোমায় ক্যান বলমু।
—বাহ,বাবা বা!অনেক বড়ো হইছোস দেখছি।
–বড়ো হইবার কি আছে আব্বা।বলো আমি কি কিছু ভুল বলতেছি।আমি কিন্তু সবাইরে সবটা বলে দিমু যে তুমিই আমার আম্মারে মা র ছো
—তোর আম্মারে তো আমি মা রি নাই, মা র ছো স তুই!বল খাবারে কে বি’ষ মিশিয়ে দিছিলো?আমি দিছিলাম?
–হ আমি দিছিলাম,কারণ তুমি আমারে শিখাইয়া দিছিলা।আমি তো জানতামও বি’ষ খাইলে মানুষ ম রে,
—হ বি’ষ খাইলে মানুষ ম রে তুমি জানো না,আব্বার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া কিভাবে করতে হয় ঠিক জানো।
—আমি সবাইরে সব বলে দিমু,তুমি আমার আম্মারে মা র ছো!
আমার কথা শুনে আব্বা আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না।উঠে এসে আমাকে এক ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিলো।তারপর শাসিয়ে শাসিয়ে বলতে থাকে।
—আজ থেকে বাড়ির বাইরে পা রাখলে তোর ঠ্যাং ভেঙে দিমু আমি।
আব্বা আমায় ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো।তারপর আমাকে আমার ঘরের ভেতরে রেখে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।আব্বা ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়াতে হাঁটুর নিচে সামান্য কেটে গেছে।অথচ সেদিকটা খেয়ালই করলো না।মাঝে মাঝে ভীষণ সন্দেহ হয় আমার,এটা কি সত্যিই আমার আব্বা।বাবা হয়ে নিজের ছেলের সাথে এমন আচরণ করে কিকরে।অবশ্য যে নিজের স্ত্রীকে বি’ষ খাইয়ে মারতে পারে তার মতো মানুষের পক্ষে সব সম্ভব।সারা রাত প্রায় না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলাম।ভোররাতের দিকে চোখজোড়া অসম্ভব রকমের লেগে আসে।তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি ঠিক নেই।
–
–
–
–
–
সকাল বেলা আব্বা আর মর্জিনা ফুপুর গলার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো আমার।শুনতে পাচ্ছি দুজনেই বাইরে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় কথা বলছে।
—তুই আর আমার বাড়িতে আসবি না মর্জিনা,
—ক্যান, ক্যান আসমু না আমি?
—তুই আমার ছেলেডার মাথা চিবাইয়া খাইতেছোস,ওর মাথায় সব বদবুদ্ধি তুই ঢুকাইছো আমি জানি!
—কি আমি বদবুদ্ধি ঢুকাইছি?আর তুমি যেগুলো করেছো সেগুলা কি,খুব ভালো কাজ?
—তার মানে আমি যা সন্দেহ করেছিলাম তাই!ওই পোলা সব কইছে তোরে, আইজ তো ওরে আমি শেষ কইরা ফেলমু।
আমি দাঁড়িয়ে টিনের ফাঁক দিয়ে সবটা দেখছি।আব্বা আমার ঘরের দিকে তেড়ে আসতে চাইলে মর্জিনা ফুপু তার হাতটা চেপে ধরলো।
—দাঁড়াও,দূরুত ভাইজান।দাঁড়িয়ে যাও।
—আমায় ছাড় বলছি, ভালো হইতেছে না কিন্তু,
—এতো মাথা গরম কইরো না।দেখো যাই হইয়া যাউক না কেনো,দিনশেষে ও তো তোমারই ছেলে।এইরকম করো না ওর সাথে,
—কে আমার ছেলে….ও আমার কোনো ছেলে না,না আমি ওর বাপ….!
আব্বার মুখ থেকে কথা আমার কানে আসতেই দু পা পেছনে সরে গেলাম।যেনো বাজ পড়লো আমার মাথায়।এইটা কি বলতেছে আমার আব্বা!
—এই তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে,কি বলতেছো তুমি এসব?
আব্বার গলার আওয়াজ মুহুর্তেই নিচু হয়ে গেলো।যেনো অসাবধানতাবশত মুখ থেকে কথাটা বেড়িয়ে গেছে তার।
—দূরুত ভাইজান, কি হইছে তোমার?এমন করতেছো ক্যান?
এরপর আব্বা আমাকে আর মর্জিনা ফুপুকে অবাক করে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।তারপর কান্না জুড়ে দেয়।মর্জিনা ফুপুও আব্বার পাশে বসলো।
—দূরুত ভাইজান,কি শুরু করলে তুমি এসব, বলো তো?কি হইছে?
—মর্জিনা আমি যে কথাটা এতোদিন বুকের ভেতরে পাথরচাপা দিয়ে রাখছিলাম।আজ আর পারলাম না নিজেকে ধরে রাখতে…এইটা ক্যান বললাম আমি,কি করলাম আমি এইটা?
চলবে….