#খুশবু
#অন্তিম_পর্ব
হাইকোর্টের সময় অনুযায়ী রায় কার্যকর করার দিন চলে এসেছে।
“_সাথী পরানের বাড়ির লোকজনকে দেখছি না কেনো? আর পলাশ কোথায়?
মিস সাবরিনা এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে।
খানিক বাদে বিষন্ন মন নিয়ে একজন বৃদ্ধ হাইকোর্টে হাজির হলো।
নয়ন জোড়া অশ্রু সিক্ত। তার পিছন পিছন আরো একজন মহিলা এসেছেন। দুজনের চোখে মুখে শোকের ছাপ স্পষ্ট ভেসে উঠেছে।
একটু পরেই খুশবু লতা কে কোর্টে হাজির করা হলো । নিচের দিকে মাথা নামিয়ে ঘন ঘন দীর্ঘ শ্বাস ফেলছে মেয়েটা।
হঠাৎ আগন্তুক বৃদ্ধ জোর গলায় লতা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। খুশবুও পরিচিতি কন্ঠ সুনে সেদিক পানে নয়ন বিলিন করে।
বৃদ্ধ কে দেখে খুশবুর কালো দাগ পরা নয়ন হতে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো ।
কাছে গিয়ে মিস সাবরিনা বৃদ্ধকে পরিচয় জিজ্ঞেস করে।
ইনিই খুশবুর পিতা মোদন লাল বাবু আর পাশে খুশবুর মা জগস্বরী দেবী। হালকা সান্ত্বনা দিয়ে মিস সাবরিনা নিজ দায়িত্বে মনোনিবেশ করেন।
একটু পরেই হুর হুর করে এক যুবক কোর্টে ঢুকে পরে। হুম এটাই পলাশ ।
পলাশ হৃদয় জুড়ানো এক গাল হাসি দিয়ে বসে পরে। আদালতের কাজ শুরু হয়েছে।
নিজ সন্তানের হত্যা কারী কে ফাঁসির দাবি জানাচ্ছেন সুফিয়া বানু। সবার সাক্ষী কেনো জানি খুশবুর বিপরীত দিকে যাচ্ছে। পলাশ তো সোজা সাপটা উত্তর দিলো খুশবুর সাথে আগে তেমন কথায় বলে নি সে । খুশবু নির্বাক নয়নে পলাশের দিকে তাকিয়ে আছে।
সব শেষ বুঝি,পলাশ একমাত্র ভরসা ছিলো। সেও রূপ বদলিয়ে ফেলেছে।
মিস সাবরিনা আশাহত হয়ে পরল। জগস্বরী দেবী মোদন লাল বাবুর কোলে মাথা গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়েন। জজ রায় ঘোষণার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ এক আজব ঘটনা ঘটে।
জনসম্মুখে লাফিয়ে উঠে খুশবুর সতিন সিমলা। মেয়েটা গলা উঁচিয়ে বলে খুশবুর কোনো দোষ নেই। খুন হবার রাতে সে চাক্ষুষ করেছে সামনে থেকে।
“_পরান যহন ব্যাপারি বাড়ির ছেলেরে নিয়া খুশবুর ঘরে যাইতেছিলো । তহন আমি জানালা দিয়া দেইখা বাইরে আসি। পড়ে ঘরের মধ্যে নিজের বিয়া করা বউয়ের শরীর দিয়া ঋন মকুব করাইয়া নিচ্ছে। যদি ওই জায়গায় বুবু না হইয়া আমি হয়তাম । আমিও একই কাজ করতাম। আমি তোমার লগে খারাপ করছি বুবু মাফ কইরা দিও।
কথা গুলো শেষ করতেই সিমলা কান্নায় ভেঙে পড়ে। খুশবুর সাথে ঘটা সকল ঘটনা স্বীকার করে সুফিয়া বানু। তাদের সাজা দেওয়া হয়।
খুশবু তো খুন করেছে। বাংলাদেশ আইন ৯৬ ও ৯৯ ধারায় আত্ম*রক্ষা ও ধ*র্ষণের হাত থেকে বাঁচতে খুন করলে সাজা খুব কম হয় ।
হয়তো কয়েক বছর পড়েই খুশবু জেল থেকে খালাস পেয়ে যাবে ।
জেলে একা একা বসে আপন মনে কী যে চিন্তা করে মেয়েটা। সব কয়েদি থেকে আলাদা থাকে সে। চুপ চাপ এক কোনায় জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে।
মোহন লাল বাবু মেয়ের এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে দায় করছে বার বার। সে যদি ঠিকমতো মেয়ের খোঁজ খবর নিতো হয়তো এমন হতো না। জগস্বরী দেবী বার বার মেয়ের কথা মনে করেই কেঁদে বালিশ ভিজায়।
হঠাৎ একদিন রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে খুশবু। কেউ একজন তাকে ডাকছে। দরফরিয়ে উঠে বসে খুশবু।
মিস সাবরিনা ও সাথী দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে কী যেনো বলছে আর খুশবু কে ডাকছে।
খুশবু উঠে তাদের দিকে এগিয়ে যায়।
“_খুশবু তোর বাপ মা কারাগারের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আজ রাতেই তোরা ইন্ডায়াতে চলে যা।
মিস সাবরিনার এমন কথা শুনে চমকে উঠে খুশবু ।
আসলে মোদন লাল বাবু মেয়ের এমন দূরদশা দেখে মিস সাবরিনার কাছে এসেছিলো।
“_মা গো তুমি আমার মাইয়ার মতো। আমার খুশবু রে আমাগো কাছে ফিরায় দাও না।
মিস সাবরিনা মোদন লাল বাবুর আর্তনাদ ভরা কন্ঠ শুনে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। সে নিজেও চায় নির্দোষ খুশবু মুক্ত পাখির মত ঘুরে বেড়াক।
“_ আচ্ছা আমি সাহায্য করবো। কিন্তু এই রাতেই খুশবু কে নিয়ে আপনারা ইন্ডিয়াতে চলে যাবেন। সেখানে আবার নতুন করে জিবন শুরু করুন। যেখানে না থাকবে পরান না থাকবে পলাশ।
মোদন লাল বাবু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। কিছুক্ষণের নিরবতা কাটিয়ে রাজি হয়ে যায়।
সাথী চাবি দিয়ে সেলের তালা খুলে দেয়। সাথী তৎক্ষণাৎ ঘুমের ভান ধরে চেয়ারে শুয়ে পড়ে। মিস সাবরিনা খুশবুর হাত ধরে কারাগারের সদর দরজার ফাঁটকের কাছে নিয়ে আসে।
“_শোন ঐদিকে পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। আমি আগে গিয়ে ওদের অন্য দিকে পাঠাচ্ছি । আমার যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তুই আসবি।
বলেই মিস সাবরিনা খুশবুর হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। তার পুলিশ বাহিনী কে বিভ্রান্ত করে অন্য দিকে পাঠায়।
পা টিপে একটু পরেই খুশবু সেখানে পৌঁছে যায়।
মিস সাবরিনা তাকে বিদায় জানিয়ে সদর দরজা দিয়ে তাকে বের করে দেন ।
একটু দূরেই মোদন লাল বাবু ও জগস্বরী দেবী দাঁড়িয়ে আছেন । হঠাৎ বন্দুকের শব্দে কেঁপে উঠে পুরো এলাকা। মিস সাবরিনার বুক ভেদ করে চলে যায় প্রথম গুলিটা।
বিভ্রান্ত করা পুলিশ বাহিনী আগে থেকেই মিস সাবরিনা কে সন্দেহ করেছিল। তাই তারা না গিয়ে পাশেই ওত পেতে ছিলো। খুশবুর দিকে বন্দুক তাক করতেই মিস সাবরিনা নিজের বুক পেতে দিয়েছে তাকে বাঁচাতে।
খুশবু চমকে উঠে পিছনে ঘুরে দেখে মিস সাবরিনা মাটিতে পড়ে গেছে। হাত উঁচিয়ে বার বার বলছিল “_ খুশবু লতা ভেগে যা। এই পৃথিবীর মানুষজন তোর ভালো চায়না ।
রক্তাক্ত শরীরে মিস সাবরিনা চোখের পানি ফেলছে। খুশবু দৌড়ে মিস সাবরিনার কাছে আসে।
মুখ দিয়ে বার বার বলতে চাচ্ছে আমাকে বাঁচাতে কেনো এমন করলেন?
নিজের বলি কেনো দিলেন?
মিস সাবরিনা তখনও একটা কথায় বলছে।
“_ভেগে যা খুশবু লতা।
নিমিষেই নিথর হয়ে গেছে মিস সাবরিনার দেহ। এত কাছ থেকে মানুষের মরন দেখেছে সে। পরান যখন মরলো তখন তো খুশবু উন্মাদ ছিলো। কিন্তু এমন মরন প্রথম দেখলো সে।
হঠাৎ পুনরায় বন্দুকের শব্দ ।।
খুশবুর শরীর ভেদ করে চলে গেছে গুলিটা। চোখের কোনে সামান্য পানি জমে গেছে। ফর্সা গাল বেয়ে টপ টপ করে ঝরছে।
আকাশ পানে তাকিয়ে দেখে পরান তাকে ডাকছে। এই পরান আর সেই পরানের মধ্যে অনেক পার্থক্য।
পাশে মিস সাবরিনা হাসি মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে আসছে। এত ঘুম আগে কখনো আসে নাই খুশবুর। সাদা রঙের শাড়িটা লাল বর্ণ ধারণ করেছে। রক্তের গোসল! শ্বাস থাকতে এটাই বুঝি তার শেষ গোসল।
সেদিন পুরো কারাগারের কয়েদি সহ সবাই কেঁদেছিলো । দুটি তাজা প্রান ঝড়ে গেছে।
মোদন লাল বাবু দৌড়ে মেয়ের লাশ দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। জগস্বরী দেবী চেতনা হারাচ্ছেন বার বার।
“_ মেয়েটার পরিবারের লোকজন তো হিন্দু । কিন্তু মেয়েটা মুসলিম হয়েছে । তাকে জানাজা করা হবে নাকি দাহ করা হবে?
মেয়েটার শেষ ইচ্ছে ছিলো নিজ পতির কবরের পাশে দাফন করতে। সিমলা বার বার বলছে এই কথা।
মোদন লাল বাবু বাধা দিলেন না। নিজ মেয়ের শেষ ইচ্ছে।
আজ হারিয়ে গেছে মিস সাবরিনার অমর আত্মত্যাগ এই পৃথিবী থেকে। হারিয়ে গেছে খুশবু লতার মত ভালোবাসার পূর্ণতা।
সমাপ্ত ___