ক্লাস শেষে বন্ধুরা সবাই ঠিক করেছে বাইরে কোথাও একসাথে লাঞ্চ করবে। জনপ্রতি চাঁদা ৩০০ টাকা। চাঁদা নিয়ে কারোই আপত্তি নেই। রাসেলেরও কোন আপত্তি থাকতে নেই, কিন্তু সে যাবে না। একে একে সবাই জিজ্ঞেস করছে কেন যাবি না? চল, গেলে মজা হবে।
রাসেলের এক কথার উত্তর- বাবার শরীরটা ভাল না তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। “কি হয়েছে আংকেলের”?
কিছুদিন থেকে বেশ অসুস্থ। আচ্ছা তোরা থাক তাহলে, আমি যাই। বলে রাসেল হাঁটতে শুরু করল।
আনমনে হয়ে রাস্তায় হাঁটতে থাকে রাসেল।নানান চিন্তা মাথায় আসে।পাশের একটা আমড়াগাছের ডালপালা নেই।তবুও আমড়া ধরেছে বেশ।এই আমড়া গাছগুলার ক্ষেত্রে এমনই হয়। ডালপালা থাকেনা। পাতা ঝরে যায়।আমড়াগুলোও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকে।রাসেলের বেলায়ও তাই।অনেক অপ্রাপ্তির ঝুলি থাকলেও,যা তার আছে তা অনেক এই ভেবে সুখের স্বাদ নেয়।প্রচন্ড গরম পড়েছে।ঘেমে একাকার রাসেল।সিএনজিও খালি নেই।বাসায় যাবে।রিক্সা একটাকে ডেকে বললো,
এই মামা যাবেন?
কই?
গুলশানে।
না।যামুনা।
রিক্সা ড্রাইভার চলে গেল।
গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।মনে মনে চিন্তা করলো,রিক্সার ড্রাইভার না করেছে ভালোই হলো।হঠাৎ হঠাৎ মানুষের চিন্তা চেতনার পরিবর্তন হওয়াটা স্বাভাবিক বটে।তবে কিছু কিছু চিন্তা হুট করে আসায়,তা খারাপ হয় অনেক সময়।এই একটু আগে রাসেলের মাথায় চেপেছিলো,সে রিক্সায় বাসায় যাবে।এখন আবার মাইন্ডটা চেইঞ্জ হয়ে গেল।তাতে ভালোই হলো।রিক্সায় ভাড়া বেশী লাগতো।এখন সিএনজিতে গেলে কম লাগবে।
পরক্ষনেই একটা সিএনজি পেয়ে গেল রাসেল।উঠে বসলো সে।
সকালে ক্লাসে আসার সময়, ভাড়া চাইতেই রাসেলের মা বলল, বাবা আজ একটু চালিয়ে নিতে পারবি কি?
মার মুখের দিকে তাকিয়েই অনেক কিছু বুঝতে পেরেছিলো রাসেল, সেখানে অনেকগুলো চিত্র একসাথে ভাসছে- বাবার শরীরটা ভাল নেই, কদিন থেকে অফিসে যেতে পারছে না, মার হাতে টাকা নেই।
সকালে তরকারিতে কাঁচামরিচের যায়গায় শুকনা মরিচ, পেঁয়াজের কোন বালাই নেই দেখেই বুঝতে পেরেছিল, পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ শেষ, বাজারও প্রায় শেষের পথে।
গতকাল ক্লাসে যাবার সময় মা ১০০টাকার একটা নোট শাড়ীর আচল থেকে বের করে দিয়েছিল রাসেলকে, তা থেকে এখনও অবশিষ্ট ৪০টাকা মানিব্যাগের কোনে পরে আছে।
বাবার বয়স হয়েছে।
মাঝে মধ্যেই ক্লাস শেষে হেঁটে হেঁটে বাসায় চলে আসে রাসেল। হাটতে তার মন্দ লাগে না বরং নিত্য নতুন অনেক অনেক অভিজ্ঞতা মনের বাক্সে বন্দী হয়। যেমন চোখে কালো চশমা পরে বছরের পর বছর ঠিক একই যায়গাতে অন্ধ সেজে ভিক্ষা করতে থাকা লোকটা যে অন্ধ না, মাঝে মধ্যে হেটে হেটে না আসলে হয়তো আর জানাই হত না। হেটে আসার আরেকটা সুবিধা হচ্ছে এতে করে ২০ টাকার গাড়ি ভাড়া বেঁচে যায়। কাল ভাড়া চাইলে মা নিশ্চয়ই কারও কাছ থেকে ধার করে এনে দিবে, অথবা আজই এনে রেখে দিয়েছে কাল চাওয়ার সাথে সাথেই আচলের ভাঁজ থেকে বের করে দিবে।
বাসায় আসে রাসেল।মা দরজা খুলে দেন।মুখে হাসি এনে মাকে বললো,
কেমন আছ আম্মু?
ভালো।আজকে দেরী হলো কেন আসতে?
রাস্তায় জ্যাম ছিল।আর সিএনজি পেতেও অনেক সময় লেগেছে।
অহ।ঘেমে অবস্থা শেষ দেখছি।গোছল করে আয় আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।
আচ্ছা আম্মু আসছি।
মুখে আবার আরেকটা হাসি দিয়ে রাসেল তার রুমে চলে গেল।
একটু পরেই ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এসে বসলো রাসেল।রাসেলের মা পাশে বসা আছেন।
রাসেল বললো,
আম্মু খেয়েছ?
হ্যাঁ খেয়েছি।
খাবার টেবিলে খাবারের যে আয়োজন তাতে ছিল ডাল, আলুভর্তা আর ভাত।
রাসেলের মা গ্যাস্ট্রিকের রোগী।ডাল আর আলুভর্তা একদম খাননা।রাসেলের বুঝতে সামান্যতম অসুবিধা হয়নি যে মা খাননি।নিঃশ্বব্দে ভাত খেতে লাগলো রাসেল।
মাসের আজ ২৭ তারিখ। সন্ধ্যার পর টিউশনিতে যাবার সময় ভাবছিলো অগ্রিম বেতন চাইবে কিনা! কিন্তু কি করে চাইব? আন্টি প্রতিমাসের ২ তারিখে নিজেই একটা খামে টাকা ঢুকিয়ে দিয়ে যায়।
স্টুডেন্টকে পড়াতে গিয়ে বার বার মনে পরছিল, বাবা অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে আছে, মা নিশ্চয়ই কোন এক বাড়িতে গিয়ে ধার চেয়ে খালি হাতে ফিরে আসছে। ছোট বোনটার মায়াবী মুখ বার বার স্টুডেন্টের খাতায় ভেসে আসছে। ও নিশ্চয়ই মা’র কাছে আইসক্রিম, চিপস কিনে দেয়ার বায়না ধরছে।
রাসেল স্টুডেন্টকে জিজ্ঞাসা করল তোমার আম্মু কোথায়?
“বসার ঘরে টিভি দেখতেছে মনে হয়”।
লজ্জার মাথা খেয়ে বসার ঘরে গিয়ে রাসেল আন্টিকে বলল,
আন্টি, এইমাসের বেতনটা কি আজকে দেয়া যাবে? আন্টি বলল,
বেশি দরকার?
জি আন্টি।
আন্টি কিছুক্ষণ পর এসে একটা খাম দিয়ে গেল। এই খামটার ভেতরে অনেক গুলো অদৃশ্য সুখ বন্দী রয়েছে। অনেকগুলো চিন্তা থেকে মুক্ত হবার যাদু রয়েছে। আত্মতৃপ্তি আর ছোটবোনের মুখের হাসি বন্দী রয়েছে।
পড়ানো শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় বাজার করে নিয়ে এসে মাকে দিয়ে বললো, কারও কাছ থেকে ধার করতে যেও না। খামটা পকেট থেকে বের করে হাতে দিয়ে বললো, কাল সকালে ডিসের বিলটা দিয়ে দিও কেমন?
একটা খামের ভেতর এতগুলো সুখের প্রতিচ্ছবি।যেই সুখের ব্যাপ্তি অনেক।রাসেল নিজেও জানেনা,এই সুখ এই ধরনীর সবচাইতে পবিত্র।
রাসেল তার রোমে চলে গেল।পেছনে মা দাঁড়িয়ে রইলেন একটা খাম হাতে নিয়ে।
এক খাম ভর্তি সুখ নেমে এসেছে ধরায়।
আচমকা বৃষ্টি নেমে এলো।গোধূলিলগ্ন।আকাশের লালিমাটা অনেক দীর্ঘ দেখাচ্ছে।একটা আলোক রশ্নি,একটা খাম আর একজন মায়ের প্রতিচ্ছবি,সন্ধ্যাছায়ায় মূর্তিমতী রমনীর মতো মনে হচ্ছে।