ক্যালেন্ডার! পর্ব: ২৫ (শেষপর্ব!)

0
1073

গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ২৫ (শেষপর্ব!)
লেখক: তানভীর তুহিন!

ঠিকানাটা মুলত একটা রিসোর্টের ছিলো। রিসোর্টের সামনে এসে রিসোর্টের নামটা পড়ে অবাক হয়ে যায় মুবিন। রিসোর্টের নাম মিউব’স ড্রিমল্যান্ড। মুবিন যখন কানাডায় ছিলো তখন সেখানকার ফ্রেন্ড সার্কেল মুবিনকে মিউব বলে ডাকতো। তাহলে কী এই রিসোর্টের মালিক মিছিল? মনে আর কোনো প্রশ্ন বাসা বাধার আগেই মুবিন জিপ নিয়ে রিসোর্টের ভেতরে চলে যায়। জিপ পার্ক করে রিসোর্টে ঢুকতেই রিসোর্টের পুল সাইডে শাড়ি পরিহিতা এক মেয়েকে দেখতে পায় মুবিন। মুবিনের মতে এটা মিছিলই। আরেকটু নিশ্চিত হবার জন্য সামনের দিকে এগোয় মুবিন। সামনে এগিয়ে যেতেই স্পষ্ট হয় সামনে থাকা অবয়বটা। মুবিন বুকের ভেতরে একটা তীব্র সরু ব্যাথা অনুভব করে। মুবিন মিছিলের সামনে গিয়ে দাড়াতেই মিছিল চাপাকন্ঠে জিজ্ঞেস করে, ” কেমন আছো মুবিন? ”
ইতোমধ্যেই মুবিনের চোখে পানি চলে এসেছিলো। বহুদিন পরে মিছিলের কণ্ঠস্বর শুনে বুকটা কেন যেনো একদম বাজেভাবে থেতলে যায়। মুবিন চাপাশ্বাস ফেলে। মুবিনের বাকশক্তি যেনো হারিয়ে গেছে। তার মুখ থেকে কথাই বের হচ্ছে না। সামনে মিছিলও কাদছে। মিছিল একহাতে নিজের চোখের পানি মুছে কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলে, ” ভালো নেই জানি। আমার মতো একটা নিষ্টুর, প্রতারক, বিশ্বাসঘাতিনীকে ভালোবেসে কেউ ভালো থাকতে পারে নাকি? ” মিছিল কান্নায় ভেঙে পড়ে। চিৎকার করে কাদতে থাকে মিছিল। মুবিন নির্বাক, নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ। কান্না খানিক নিয়ন্ত্রনে এনে মিছিল আবার বলতে থাকে, ” আমি তো হতে চাইনি নিষ্ঠুর, আমি তো বিশ্বাসঘাতিনী প্রতারক হতে চাইনি, তাহলে খোদা কেনো করলো এটা? কেনো করলো এটা? কেনো? কেনো? ” আবারো কান্নার কারনে আটকে যায় মিছিলের কথা। কয়েকমুহূর্ত চুপ থেকে কান্না নিয়ন্ত্রনে এনে মিছিল বলে, ” আমি বিয়ে করে নিয়েছি মুবিন। ”
কথাটা কানে পৌছাতেই মুবিনের নিঃশ্বাস নিষ্টুরভাবে বুকের কোথাও একটা আটকে। বুকের ভেতরটা ভেঙেচুড়ে কয়েক হাজার কোটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মুবিন মুখটা হা করে জোরে জোরে শ্বাস নেবার চেষ্টা করে। শ্বাসটা টেনে তুলতেই পারছে না মুবিন। ব্যাখ্যা করা যাবে না এমন অসহ্য যন্ত্রনায় কুকড়ে মরছে মুবিন। একটু কান্নাও করতে পারছে না, কেমন একটা যেনো থেমে গেছে পুরো শরীর। মুবিন মিছিলের দিকে তাকিয়ে মুখ হা করে শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে। মিছিল অঝোরে কাদছে। কাদতে কাদতে মিছিল চিৎকার করে বলে, ” হ্যা! হ্যা! মুবিন আমি বিয়ে করে নিয়েছি। আমি এখন অন্যকারো, তোমার মিছিল আর তোমার নেই মুবিন। আমার বাবা মারা যাবার আগে তোমার থেকে কেড়ে নিয়েছে আমায়। বাবা মারা যাবার কয়েকঘন্টা আগে বাবা আমায় আমার কোনো প্রেমিক আছে নাকি সে ব্যাপারে জানতে চায়। আমি তোমার আর আমার কথা বলি। বাবা তোমার ফ্যামিলি স্বমন্ধে জানতে চায়। তোমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স এর কারনে বাবা অসম্মতি জানায় আমাদের সম্পর্কে। বলে যে ছেলে বাবা-মাকে পায়নি ছোটবেলায় সে আর কতটুকু মানুষ হয়েছে? আমি জানি আমার আয়ু ফুরিয়েছে। আমি মরার আগে আমার মেয়েকে কোনো ভুল মানুষের কাছে তুলে দিতে পারবো না। আমি অনেকবার বোঝাই কিন্তু বাবা আমার কোনো কথাই গায়ে মাখে না। বাবা মারা যাবার আগে আমায় অনুভবের সাথে পরিচয় করায়। অনুভব বাবার দুঃসম্পর্কের এক আত্মিয়র ছেলে। ও এতিম, ও অবশ্য এতিম হয়েছে বড় হবার। মারা যাবার আগে আমার স্বামি হিসেবে অনুভবকে ঠিক করে যায় বাবা। আমায় অনুভবকে বিয়ে করার কসম দিয়ে মারা যায় বাবা। আমি কী করতাম বলো? কী করার উচিৎ ছিলো আমার? আমি নিরুপায় ছিলাম। যে বাবা আমার জন্য এতো ত্যাগস্বীকার করেছিলো সে বাবার কসম কী করে অস্বীকার করতাম? আমি পারিনি অস্বীকার করতে। বাবার কসম রক্ষার্থে বিয়ে করে নিয়েছি অনুভবকে। বাবা মারা যাবার পরের দিনই আমি আমার সব প্রোপার্টি বিক্রি করে দিয়ে অনুভবকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে আসি। প্রোপার্টি বিক্রির টাকা দিয়ে একটা আবাসিক হোটেল আর এই রিসোর্টটা কিনি। তারপর সব প্রোমান লোপাট করে দেই। তুমি যাতে কোনোভাবেই আমার খোজ না পাও সেজন্য আমি আমার ইমিগ্রেশন রেকর্ডও ইমিগ্রেশন ডাটাবেজ হ্যাক করে ইরেজ করে দেই। আমি তোমার মুখোমুখি হতে চাইনি কোনোদিন। কারন তোমার মুখোমুখি হবার মুখ আমার ছিলোনা। আমি চাইনি তুমি জানো তোমার মিছিল অন্যকারো হয়ে গেছো, আমি চেয়েছিলাম তুমি এটা জেনে বেচে থাকো যে তোমার মিছিল তোমার থেকেই কোথাও হারিয়ে গেছে বা মারা গেছে। অথচ দেখো খোদার কী নিষ্ঠুর পরিহাস সেই আমাদের মুখোমুখি করেই দিলো। আর আমায় তোমার সামনে প্রতারকও প্রমান করে দিলো। ” মিছিল চিৎকার করে কাদতে থাকে।
মুবিন শ্বাস নিতে পারছে না, কথা বলতে পারছে না, চোখের পানিও ফেলতে পারছে না, শরীরটা ইঞ্চি পরিমান নাড়ানোর শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে মুবিন। বুকটা যেনো কোনো ভারী বড় বিশাল পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে মুবিনের। তার ফলেই হয়তো এই অসহনীয় বুকে ব্যাথা হচ্ছে তার। চোখের সামনে মিছিল অঝোরে কেদে যাচ্ছে। মুবিন চাপাশ্বাস ফেলে চাপাকন্ঠে বলে, ” তুমি প্রতারক নও মিছিল। এটা নিয়তি! ”
মিছিল চিৎকার করে কাদছে। কিন্তু মুবিন চিৎকারও করতে পারছে না। চিৎকার করে কাদা মুবিনের সামর্থ্যের বাইরে। মুবিন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, সে আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকে তার মিছিলের আর্ত্মনাদ শুনতে পারবে না।
মুবিন কান্নাজড়ানো অস্ফুট স্বরে বলে, ” আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা মিছিল। প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। ভালো থেকো! ” বলেই মুবিন সামনের দিকে হাটা ধরে। একটু এগিয়ে যেতেই দাঁড়িয়ে পড়ে মুবিন। পেছন ফিরে অস্ফুট স্বরে মুবিন মিছিলকে বলে, ” জানি অধিকার নেই। তবুও তোমার কপালে একটা চুমু খেতে দেবে মিছিল? ” কথাটা খানিকটা মুবিনের বুকেই আটকে থাকে।
মিছিল মুবিনের কাছে এসে মুবিনকে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে মুবিনের ঠোটে নিজের ঠোট চেপে ধরে। মুবিনও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিছিলকে। মুবিন মিছিলের কপালে লম্বা চুমু আকে। মুবিনের চোখের কয়েকফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে মিছিলের কপালে। মুবিন মিছিলের কপাল থেকে ঠোট সরিয়ে মিছিলের কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বলে, ” আজকের পর থেকে অনুভবকে নিয়ে ভালো থেকো। নিজেকে অপরাধী ভেবে নিজেকে দোষারোপ করিও না। তোমার কোনো দোষ নেই। সবটাই ভাগ্যের পরিহাস, ভালো থেকে মিছিল। ” কান্নার কারনে থেমে যায় মুবিন।
মুবিন আবার বলে, ” শেষবারের মতো বলছি। জীবনে হয়তো আর কোনোদিন বলতে পারবো না। তোমায় খুব বেশি ভালোবাসি মিছিল! ” কথাটা বলে শেষবারের মতো একপলক তাকিয়ে মিছিলকে দেখে নেয় মুবিন। তারপর হেটে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। একবারও আর পিছন ফিরে তাকায় না। মন তো খুব চাচ্ছে মিছিলকে আরেক পলক দেখার কিন্তু কিছু একটার জন্য মনের আকাঙ্ক্ষাটাকে চাইলেও স্বায় দিতে পারছে না মুবিন। মিছিল সেখানে বসেই চিৎকার করে কাদতে থাকে। যে চিৎকার ভাগ্যের কাছে হেরে যাওয়া এক অসহায়ের চিৎকার!

গাড়ি চালাচ্ছে আর অঝোরে কাদছে মুবিন। কাদছে আর ভাবছে মুবিন, সারাজীবনে সে আদৌ কী পেলো? কার ভালোবাসা সে সম্পুর্ন পেলো? কারোর ভালোবাসাই সে পায়নি? আর কিছু ভেবে উঠতে পারে না মুবিন। বুকটা খা! খা! করে ওঠে। মুখটা সরু হা করে শ্বাস নেবার চেষ্টা চালায় মুবিন। বুকের চাপা যন্ত্রনাটা যেনো শ্বাসই নিতে দিচ্ছে না তাকে। অবর্ণনীয় যন্ত্রনায় নিশ্চুপ মরন হচ্ছে মুবিনের। জিপের মিউজিক সিস্টেমে একটা গান চালায় মুবিন। গানটা হলো আদনান আশিফের ‘দেবী’। বাংলা গান তেমন না শুনলেও প্রায়ই এই গানটা কেনো যেনো শুনতো মুবিন। আজ এই গানটার সাথে নিজের জীবনের চরম সাদৃশ্য খুজে পাচ্ছে মুবিন…!

এই রাস্তা গুলো লাগে বড় অচেনা।
আকাশটার সাথে নাই জানাশোনা।
এই রাস্তা গুলো লাগে বড় অচেনা।
আকাশটার সাথে নাই জানাশোনা।

আমি তোর প্রেমেতে অন্ধ।
ছিলো চোখ কান সব বন্ধ।
থেমে গেছে জীবনের লেনাদেনা।

সেই পুরোনো রাস্তাটায়,
আজ একা একা হেটে যাই।
হচ্ছনা হিসাবের বনিবনা।

এখন এমনি করে ভালো ,
কেমনি করে বাসি অন্য কোনো পাখিকে।
তার চেয়ে ভালো ছিল তুই, নিজ হাতে খুন! করে.. যেতি আমাকে….!

কষে ব্রেক চাপে মুবিন। চোখের পানি মুছে গানটা বন্ধ করে দিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। সামনেই একটা বড় মোড়। মুবিন পারবে না আর বড় বিশাল পাহাড় সম ব্যাথা বুকে বয়ে বেচে থাকতে। গাড়িটা রিভার্স গিয়ারে ফেলে খানিক পেছনে চলে যায়। তারপর ফুল গিয়ার দিয়ে নিজের সমস্ত যন্ত্রনা, নিজের সমস্ত ব্যাথা দিয়ে এক্সেলেটর চেপে ধরে মুবিন। গাড়িটা দ্রুত গতিতে সাই সাই করে সামনের দিকে এগোতে থাকে, এগোতে এগোতে গাড়ি যখন মোড়ের কাছে আসে তখন মুবিন স্টিয়ারিং বামদিকে না ঘুরিয়ে স্টিয়ারিং থেকে হাত নামিয়ে নেয়। ব্যাস শেষ, সব শেষ, মুহুর্তের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় মুবিন, শেষ হয়ে যায় মুবিন শ্বাস নিতে না পাড়ার অসুখ, শেষ হয়ে যায় মুবিনের একবুক চাপা কষ্ট, শেষ হয়ে যায় মুবিন বড় বিশাল পাহাড় সম যন্ত্রনা, শেষ হয়ে যায় মুবিনের জীবন ক্যালেন্ডারের। শেষমেশ অবসান ঘটেই যায় মুবিনের দীর্ঘদিনের যন্ত্রনার স্মারকচিহ্ন ক্যালেন্ডার….!

লাইফ ইজ ভেরি আনপ্রেডিক্টেবল। বোধহয় আমি দার্শনিক নই তবুও দার্শনিক বনে একটা কথা বলছি, ” জীবনে কখনও কোনো বস্তু নিয়ে মনে আশা পুষবেন না। ” কোনো জিনিস নিয়ে আশা করে যখন সে আশা পুরন হয় না, যখন সে আশা ভেঙে যায় তখন পৃথীবির সবচেয়ে যন্ত্রনার অনুভুতি অনুভুব হয়ে বুকে। আশা কিংবা মন ভাঙার কোনো শব্দ হয় না, এই দুটো জিনিসের ভাঙন চোখে দেখাও যায় না। তবে যার আশা আর মন এই দুটো জিনিস ভাঙে সেই জানে বেচে থাকাটা ঠিক কতটা কষ্টের, ঠিক কতটা যন্ত্রনার।

সমাপ্ত!
#thetanvirtuhin

প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে!♥
” Tanvir’s Writings “

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে