গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ২৩!
লেখক: তানভীর তুহিন!
শাওন মুবিনকে শান্তনা দেবার মতো শব্দ খুজে পায়না নিজের নগন্য শব্দকোষে। অনেকদিন পরে চোখে কয়েকফোটা নোনাজল আবিষ্কার করে মুবিন। সেগুলো মুছে ফ্লোর ছেড়ে উঠে বেলকনির দিকে পা বাড়ায়। কিন্তু বেলকনি অবধি যেতে পারেনা সীমান্তর কথায় আটকে যায় পা।
সীমান্ত বলে, ” তুই আর শাওন আমার কাছে আলাদা না মুবিন। শাওন আমার মায়ের পেটের ভাই, হয়তো তুই আমার মায়ের পেটের না। কিন্তু বিশ্বাস কর তুই আমার কাছে অতোটাই যতোটা শাওন। কথাগুলো এজন্য বলছি যাতে তুই আমায় ভুল না বুঝিস। ভুল বুঝিস না ভাই। কিন্তু দেখ একটা মানুষ নিখোজ হওয়া এক জিনিস আর নিজের থেকে হারিয়ে যাওয়া আরেক জিনিস। আমি একটু অন্য দিক থেকে ব্যাপারটা ভেবেছি। ভুল বুঝিস না কিন্তু আমি তোর এই অবস্থা দেখে তোকে কথাটা না বলে পারছি না। আমার মনে হয় মিছিল নিজের ইচ্ছায় নিখোজ হয়েছে! ”
অবাক দৃষ্টিতে সীমান্তর দিকে তাকায় মুবিন। চোখে মুবিনের হাজারটা প্রশ্ন। সীমান্ত আবার বলে, ” দেখ যেরকম ভাবে সব ভার্চুয়াল ডাটা লোপাট করা হয়েছে তা শুধু মাত্র আমাদের মতো ঝানু হ্যাকাররাই পারবে। আর ডোন্ট ফরগেট মিছিল আমাদের ফিল্ডেরই মেয়ে। মিছিলও আইটি এক্সপার্ট, মিছিলও হ্যাকার। শুধু হ্যাকার বললে ভুল হবে গড লেভেলের হ্যাকার। মনে আছে ও একবার ফরেনের একটা টিভি চ্যানেল হ্যাক করেছিলো আমাদের সাথে দুষ্টামি করে বাজি ধরে? ”
মুবিনের মাথার তার ছিড়ে যাবার উপক্রম। মিছিল যে একজন প্রখর বুদ্ধিমতী লেডি হ্যাকার সেটা অস্বীকার করতে পারবে না মুবিন। কিন্তু তা বলে মিছিল মুবিনের কাছ থেকে পালিয়ে যাবে? কিন্তু কেনো? কোনো কারনই তো নেই নিখোজ হবার। সীমান্ত চুপ ছিলো। সীমান্ত আবার বলে, ” দেখ মুবিন যেভাবে সব যায়গার ডাটা ইরেজ করা হয়েছে তা একজন আইটি জিনিয়াস ছাড়া কেউ পারবে না। আর তোর কী মনে হয় মুবিনকে এমন কে কিডন্যাপ করতে পারে যে এরকম আইটি নলেজ রাখে? আমি ব্যাপারটা স্টাডি করেছি। এমন কোনো আইটি প্রোফেশনাল এর সাথে মিছিলের কোনো প্রকার যোগাযোগ ছিলো না। মিছিল এই অবধি ব্ল্যাকমার্কেটে কোনো হ্যাকিং অপারেশন করেনি তাই ওর হ্যাকার শত্রু তৈরী হবার কোনো চান্স নেই। তাহলে ও নিখোজ হলো কীভাবে? ভাবলাম কেউ কিডন্যাপ করেছে। কিন্তু কিডন্যাপ করলে এভাবে সব প্রোপার্টি কেনো বিক্রি করাবে? আর যদি কিডন্যাপার বিক্রি করায়ই তাহলে সব টাকা হাতানোর পরে তো মিছিলকে ছেড়ে দেবার কথা তাইনা? আচ্ছা বাদ দে যদি টাকার জন্যই কেউ মিছিলকে কিডন্যাপ করে আর সে যদি এতোই ইন্টেলিজেন্ট হয় তাহলে তার জানার কথা তুই মিছিলের বয়ফ্রেন্ড। কারন সে এটা জানতো যে তুই মিছিলের খোজে মরিয়া হয়ে উঠবি। সে জন্যই সে সব প্রোমান লোপাট করেছে। মিছিলকে যদি টাকার জন্যই কিডন্যাপ করা হতো তাহলে তোর কাছ থেকে টাকা চাওয়া হতো না? তোর কাছে কয়েকশ কোটি চাইলে তুই কয়েকশ কোটিই দিয়ে দিতি। তাহলে সে তোর কাছে চাইলো না কেনো? জাস্ট থিংক এবাউট ইট। ইমোশনাল ভাবে না ভেবে প্র্যাক্টিকাল ভাবে ভেবে দেখ মিছিল নিজেই নিখোজ হয়নি তো? ”
মুবিন নিজের অর্ধ উন্মাদ মস্তিষ্কের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। কারন খোজার জন্য। কিন্তু কোনো কারনই খুজে পায় না। মিছিল নিজ থেকে নিখোজ হতে যাবে কেনো? কিন্তু সীমান্তর যুক্তিগুলোও ফেলে দেবার মতো না। যেভাবে আইটির মারপ্যাঁচ হয়েছে তা মিছিল অনায়াসেই করতে পারবে। তাহলে কী মিছিল জেনেবুঝেই মুবিনের কাছ থেকে পালিয়ে নিখোজ হয়েছে?
মুবিনের মাথায় তেমন কোনো সন্দেহের অবকাশ কখনোই আসেনি। এখনও সে এই জিনিসটা বিশ্বাস করতে পারবে না। হ্যা বিশ্বাস করলে অবশ্য মিছিলকে ভুলে নতুন করে বাচতে পারবে। কিন্তু যদি তার মনগড়া বিশ্বাসটা ভুল হয়? ভুল হলে সে নিজেকে কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারবে না। তারচেয়ে এরকমভাবে মিছিলের জন্য অপেক্ষা করাটাই উত্তম। কোনো না কোনোদিন তো উপরওয়ালা মিছিলের খোজ দেবে, কোনো না কোনোদিন তো উপরওয়ালা এই জীবন ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন আনবে। সেই পরিবর্তিত দিনের অপেক্ষাই করবে মুবিন।
এতোক্ষন রুমের মধ্যে তিনজনই চুপচাপ ছিলো। একদমই নিশ্চুপ নিরব ছিলো পুরো রুম। নিরবতা পাশে ঠেলে শাওন দাঁড়িয়ে মুবিনকে বলে, ” যেজন্য এখন এখানে আসলাম। আমরা ২ সপ্তাহের জন্য বিজনেস সেমিনারে অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি। তুইও চল না! ”
– ” আমি যাবো না। ”
সীমান্ত এসে মুবিনের একটা হাত চেপে ধরে বলে, ” প্লিয চল না। বহুদিন হয় তিনজন একসাথে দেশের বাইরে যাওয়া হয়নি। দেশের বাইরে কী বহুদিন হয় তিনজন একসাথে বাইরে যাওয়া হয় না। প্লিয চল, তোর না পাহাড় পছন্দ? আমরা মাউন্টেন এরিয়ায় যাবো। প্লিয চল! ”
– ” তোরা যাচ্ছিস বিজনেস সেমিনারে। সেখানে আমি গিয়ে কী করবো? অযথাই তোরা আমায় নিয়ে চিন্তা করবি। আর আমি এমনিই তোদের সাথে গিয়ে তোদের বোর করতে চাইনা। ”
– ” ভাই প্লিয এভাবে বলিস না। একটাবার চল, দেখিস একটু ভালো লাগবে। ”
– ” প্লিয ফোর্স করিস না। ”
– ” যদি তোকে ফোর্স করলে তুই রাজি হস তাহলে ফোর্স করতে দোষ কোথায়? প্লিয ভাই বহুদিন হয় কোথাও আউটিং এ যাওয়া হয় না। ”
– ” ফ্লাইট কবে? ”
শাওন এগিয়ে এসে বলে, ” কবে টবে লাগবে না। তুই জাস্ট লাগেজ পেচিয়ে নে। আমি দেখি অস্ট্রেলিয়ার নেক্সট ফ্লাইট কয়টায়! ”
– ” আচ্ছা! ”
সীমান্ত মুবিনকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” থ্যাংকস ব্যাটা! ”
মুবিন একটু হাসে। শাওন পেছন থেকে মুবিনের ঘাড়ে চাপড় মেরে বলে, ” তোর মুখের এই জঙ্গল নিধন করতে হবে। চল সেলুনে চল! তোকে সেলুনে দিয়ে টিকেট কনফার্ম করে আমরা লাগেজ নিয়ে তোর ফ্ল্যাটে আসবো। তারপর এখান থেকেই এয়ারপোর্ট রওনা হবো।
শাওন-সীমান্ত মুবিনকে সেলুনে দিয়ে চলে যায়। মুবিন চুল কেটে ক্লীন সেভড হয়ে ফ্ল্যাটে চলে আসে। এসে গোসল করে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তারপর কিছুক্ষন আগের মানুষটা আর এখনকার মানুষটার মধ্যে তফাৎ খুজতে থাকে। বহু তফাৎ খুজে পায় মুবিন। তফাৎ পেয়ে খানিক হাসে। পরমুহুর্তেই চাপাকষ্টের দীর্ঘশ্বাসে বিলীন হয়ে যায় হাসিটা। মুবিন কিছু কাপড়চোপড় অগোছালো ভাবে সুটকেস বন্দি করে নেয়। এর মধ্যেই শাওন-সীমান্ত চলে আসে। শাওন এসেই বলে, ” অল সেট আমরা এখনই বের হবো। আর আঙ্কেলকে বলে দিয়েছি উনি খুবই খুশি হয়েছে তুই আমাদের সাথে যাবি শুনে। উনি বলেছে এয়ারপোর্টে তোকে সী-অফ করতে আসবে। ”
মুবিন এখনও রেডি হয়নি। একটা থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট পড়েই ব্যাগপ্যাক করছিলো। সীমান্ত মুবিনকে বলে, ” তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। আজকে তুই গাড়ি চালিয়ে আমাদের এয়ারপোর্ট নিয়ে যাবি তাও তোর গাড়িতে। আর শোন স্যুট পড়িস। তিনভাই একসাথে স্যুট পড়ে ফ্লাই করবো। প্লেনের এয়ারহস্টেজ সুন্দরি মেয়েরা দেখে ক্রাশ খাবে। ”
মুবিন একটু চওড়া হাসে।
রেডি হয়ে বের হয়েছে মুবিন। পড়নে একটা আকাশি কালারের স্যুট, ভেতরে ডার্ক ব্ল্যাক শার্ট, পায়ে ব্রাউন শু! পুরো স্যুটটাই মিছিল কিনেছিলো। স্যুট টা পড়ে নিজেই নিজের দিকে আয়নায় অসহায় অপলক তাকিয়ে আছে মুবিন। মুবিনকে স্যুটটায় বেশ মানিয়েছে তা দেখে খুব খুশি শাওন আর সীমান্ত। ওরা তারচেয়েও বেশি খুশি মুবিন কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে সেজন্য। নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনেই মুবিন বলে, ” মিছিল আমার অস্তিত্ব রে! আমার সবকিছু ও, অথচ দেখ ওর কোনো অস্তিত্বের হদিসই আমি পাচ্ছি না! ”
শাওন-সীমান্তের মুখের হাসিটা বিলীন হয়ে যায়। শাওন এগিয়ে এসে বলে, ” কী করবি রে ভাই? বহু গল্প এমন অপুর্নতায়ই ডুবে গেছে। কষ্ট হচ্ছে বলতে তবুও বলছি, হয়তো তোর গল্পটাও অপুর্নতায় ডুবে যাওয়া গল্পগুচ্ছের একটা গল্প! ”
মুবিন একটু চাপাশ্বাস ছাড়ে। চোখ দুটোতে পানি জমে দৃশ্যপট ঝাপসা হয়ে যায় মুবিনের। পাশ থেকে শাওন জড়িয়ে ধরে মুবিনকে, সীমান্তও এসে জড়িয়ে ধরে মুবিনকে। মুবিন ওদের কাধে হাত রেখে বলে, ” অনেক কেদেছিস আমার জন্য। আজকে আর না, চল যাওয়া যাক। ”
শাওন-সীমান্ত একসাথে বলে, ” হুম চল! ”
নিচে নেমে বহুদিন পরে নিজের গাড়িটাকে দেখতে পায় মুবিন। অনেক শখ করে কিনেছিলো গাড়িটা। আজ বহুদিন পরে দেখলো, গাড়িটাকে বোধহয় শাওন-সীমান্ত ওয়াশ করিয়েছে আজকে। গাড়িতে উঠে ড্রাইভিং সিটে বসে সিটবেল্ট বেধে স্টিয়ারিং এ হাত দিতেই গাড়ির ড্যাশবোর্ডের শোপিসটার দিকে চোখ পড়ে মুবিনের। প্রায় আড়াই বছর আগে একটা মেলায় গিয়েছিলো মুবিন আর মিছিল। তখনই মিছিল পছন্দ করে শোপিসটা কিনেছিলো। আজও শোপিসটা আছে অথচ মিছিল আছে কিনা সেটাও জানে না মুবিন। কতটা অদ্ভুত আর অসহায়ত্বের কথা তাইনা?
মুবিন ড্রাইভ করে এয়ারপোর্টে চলে আসে। এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকতেই লবিতে আহাদ শেখ আর আলেয়া শিকদারকে একসাথে দেখতে পায় মুবিন। বহুদিন পরে নিজের বাবা-মা কে একসাথে দেখতে পাচ্ছে মুবিন। কিন্তু তাতে তেমন কোনো আলাদা অনুভুতি অনুভব করছে না মুবিন। আহাদ শেখ মুবিনের দিকে এগিয়ে এসে বলে, ” শেভ করেছিস? অনেক ফ্রেশ লাগছে তোকে। খুব ইঞ্জয় করিস আব্বু, আর কিছু দরকার হলে সেক্রেটারিকে ফোন না করে সোজা আমায় ফোন দিস! ”
– ” আমি সাথে করে নিজের গাড়িটা নিয়ে এসেছি। ওটাকে ড্রাইভার দিয়ে আমার এপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিয়েন। ”
– ” আচ্ছা! আচ্ছা! তুই চিন্তা করিস না। ”
পাশ থেকে আলেয়া সিকদার বলে, ” আর এভাবে থেমে থাকিস না বাবা। একটু মুভ অন কর, আমরাও তো একসময় একে অপরের থেকে মুভ অন করেছিলাম। চাইলেই মুভ অন করা যায়, এভাবে কষ্ট পেয়ে নিজের উপর অন্যায় করিস না। ”
– ” আপনারা একটা সন্তান রেখে মুভ অন করেছিলেন নিজেদের স্বার্থে। নিজেদের যৌবনের জন্য। আপনাদের কাছে মুভ অন করার রিজন ছিলো, বাট আই ডোন্ট হ্যাভ। ”
আহাদ শেখ আর আলেয়া বেগম একসাথে মাথা নিচু করে ফেলে। মুবিন আবার বলে, ” মাথা নিচু করলেই তো আমার শৈশবটা ফিরে আসবে না। বাদ দিন! ”
আহাদ শেখ শাওনকে বলে, ” শাওন বাবা ওর একটু যত্ন করিস। বুঝছিসই তো অনেকদিন পর দেশের বাইরে যাচ্ছে। ”
– ” ডোন্ট ওয়ারি আঙ্কেল। আমরা দেখে রাখবো মুবিনিকে! ”
সীমান্ত পাশ থেকে বলে, ” চল। ফ্লাইট টেক অফ এর সময় হয়ে আসছে প্রায়। ”
মুবিন বলে, ” চল! ” বলে মুবিন সামনে এগিয়ে যায়। তারপর হঠাৎ করেই এসে একসাথে জড়িয়ে ধরে আহাদ শেখ আর আলেয়া বেগমকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বেশ চমকে যায় দুজনেই। কিন্তু পরক্ষনেই ব্যাপারটা উপলব্ধি করে আনন্দে ভরে ওঠে ওনাদের বুক। মুবিন নিজের বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” ছোটবেলায় তোমরা আমায় পর্যাপ্ত ভালোবাসা দেওনি। কিন্তু আমিও কখনও তোমাদের পর্যাপ্ত মর্যাদা, গুরুত্ব, ভালোবাসা দেইনি। একদিক থেকে আমিও সন্তান হিসেবে অপরাধি। ক্ষমা করে দিও আব্বু-আম্মু। ”
একসাথে হু! হু! করে কেদে ওঠে আহাদ শেখ আর আলেয়া শিকদার। মুবিনও কেদে দেয়। এভাবে কতক্ষন জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পরে ওনাদের ছেড়ে মুবিন বলে, ” আসচ্ছি আব্বু! আম্মু! ”
আহাদ শেখ আর আলেয়া বেগম কান্নার বেগে কথা বলতে পারে না। শুধু মাথা নাড়ে!
মুবিন মুচকি হেসে এগিয়ে যায়। মুবিন, শাওন, সীমান্ত অস্ট্রেলিয়ায় চলে আসে।
চলবে!
#thetanvirtuhin
প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে!♥
” Tanvir’s Writings “