গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ২২!
লেখক: তানভীর তুহিন!
একটা হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খোজার আর কোনো উপায় জানা নেই মুবিনের। আদৌ মিছিল কী কিডন্যাপ হয়েছে না কী হয়েছে তা স্বমন্ধে কিচ্ছুই জানা নেই মুবিনের। জানার তো বহু চেষ্টাই করেছে কিন্তু কোনো চেষ্টাতেই কোনো ফায়দা হয়নি। এভাবে একটা মানুষ যে ঠিক কীভাবে উধাও হয়ে যেতে পারে সেই গোলকধাঁধাটার উত্তরই খুজে পাচ্ছে না মুবিন। কোনো সুত্র তো সে ছাড়েনি। প্রত্যেকটা এঙ্গেল থেকে ইনভেস্টিগেট করেছে সে। তাহলে কী মিছিল আর বেচেই নেই? মরে গেছে এমন কোনো খোজও তো পায়নি সে। কী করা উচিৎ তার? কী করবে এখন? পুরো জীবনটাই যেনো চোখের পলকে বাজেভাবে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। চারদিকে শুধু অসীম অজানা। যে অজানায় একটা মানুষ প্রত্যেকটা মুহুর্তে দুমড়ে দুমড়ে মরে, যে অজানায় একজন মানুষের চিৎকার কেউ শুনতে পারে না নিজের আর্ত্মনাদের শব্দে নিজেই হাপিয়ে ওঠে। যে পরিস্থিতিতে প্রতিটা নিঃশ্বাসের মুল্য নিশ্চুপ মৃত্যু….!
দীর্ঘ নয় মাস পর….!
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন মুখভর্তি দাড়ি, আর মাথাভর্তি লম্বাচুলওয়ালা মানুষ। পুরো মুখটা যেনো দখল করে নিয়েছে এই চুলদাড়ি। স্পষ্টভাবে বোঝাই যাচ্ছে না চেহারার গঠন। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে চেনারই বৃথা চেষ্টা করছে মুবিন। চেষ্টা চালাতে চালাতেই হাতে থাকা মদের বোতলে আরেকটা চুমুক লাগায় মুবিন। গলার ভেতরটা যেনো মদের ঝাঝে ঝাঝে পুড়ে ঝলসে গেছে, পেটের ভেতরের সবকিছু যেনো মদে অভ্যস্থ হয়ে গেছে, আর মাথার ভেতরের? মাথার ভেতরের সমস্ত সব যেনো মদে মাতাল হয়ে উন্মাদ হয়ে আছে। গত নয়মাসে প্রায় অর্ধেক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে মুবিন। প্রায় সাতমাস যাবৎ বাইরের আলো গায়ে মাখে না মুবিন। দিনে একবার এসে মদ আর খাবার দিয়ে যায় আহাদ শেখ সাথে নিজের ছেলের এই করুন পরিস্থিতি দেখে ফুপিয়ে কেদেও যায় কতক্ষন। আলেয়া বেগমও আসে সপ্তাহে দু-তিন দিন নাড়ির টান যে, এসে এসব দেখে সেও না কেদে পারে না। শাওন-সীমান্ত দিনে প্রায় দুই-তিনবারই আসে। প্রতিদিন একবার সাইক্রিয়াটিস্ট এসে দেখে যায় মুবিনকে। এই কয়জনেরই যাতায়াত মুবিনের ফ্ল্যাটে।
বেলকনিতে বসে রেলিংয়ের বাইরে পা ঝুলিয়ে মদের সাথে ছোট ছোট প্রেমালাপ করছে মুবিন। মদের সাথে মুবিনের সম্পর্ক অনেক গাঢ়ো। কারন যার সাথে সম্পর্ক গাঢ়ো ছিলো সে তো বেপাত্তা। মাঝে মাঝেই মুবিনের মনে হয় আত্মহত্যা করে মরে যেতে। কিন্তু মিছিলের কারনে শান্তিতে মরতেও পারে না মুবিন। যখনই আত্মহত্যার চিন্তাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখনই মুবিনের মনে হয় মিছিল যদি কোনোদিন ফিরে আসে? সেদিন যদি এসে মিছিল মুবিনকে দেখতে না পায়? তাহলে তো মিছিল খুব কষ্ট পাবে। মিছিলকে সেই মরন যন্ত্রনার স্বাদ দিতে চায় না মুবিন। তাই নিজেই প্রত্যেকদিন জীবন্ত লাশের ন্যায় জীবনের যাপন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রায়ই আকাশের দিকে অবাক অনেক তাকিয়ে থাকে মুবিন। সেও তো এই আকাশের মতোই শূন্য। আজ একটু আকাশ দেখাও মুবিনের কপালে জুটছে না। সেই কখন থেকে সমানে মদ খাচ্ছে আর ঘাড় সটানে উপরের দিকে উঠিয়ে রেখেছে আকাশ দেখার জন্য। কিন্তু দেখতেই পারছে না। দেখবে কীভাবে? পুরো আকাশ যে কালো মেঘের বেনারসিতে পেচানো। এতক্ষন তাকিয়ে থেকেও আকাশ না দেখতে পেয়ে বিরক্তি তাচ্ছিল্যে মুবিন বলে, ” মিছিল, এই মেঘের নামে কারো কাছে নালিশ জানাতে হবে। আমায় আকাশই দেখতে দিচ্ছে না মেঘ! ” মুবিন আপনমনে বিড়বিড় করছিলো তখনই শাওন-সীমান্ত মুবিনের ফ্ল্যাটে ঢোকে। আর ঢুকে প্রত্যেকদিনের মতো মুবিনকে বেলকনির কার্নিশের পাশেই দেখতে পায় ওরা। শাওন মুবিনকে জিজ্ঞেস করে, ” কেমন আছিস মুবিন? ”
মুবিন পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে এক পলক শাওন-সীমান্তকে দেখে বলে, ” অনেক ভালো। তোদের কী খবর? ”
মুবিনকে এভাবে দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে গেছে শাওন। চনমনা মুবিনের এই করুন পরিস্থিতি দেখে দেখে যেনো তার চোখ কেদে মরে যায়। শাওন শক্ত গলায় বলে, ” দেখছিই তো খুব ভালো আছিস। এইতো একটু পরেই সাইক্রিয়াটিস্ট আসবে এসে বলবে কন্ডিশন আরো বিগড়ে যাচ্ছে। ভালো আছিস না? খুব ভালো আছিস! ”
সীমান্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পাশে থেকে। মুবিন কিছুই বলে না। মুবিনের ওপরে এরকম অধিকার খাটানোর অধিকার আছে শাওনের।
মুবিন যেনো প্রানই হারিয়ে ফেলেছে। আগে মুবিনের সাথে দেখা করলে আলাদা এক আনন্দ অনুভব হতো শাওন-সীমান্ত’র। এখন মনে হয় কোনো অপরিচিতর সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেছে। যাকে চেনেই না ওরা।
শাওন মুবিনকে জিজ্ঞেস করে, ” আর কতদিন এভাবে কাটাবি মুবিন? ”
সাথে সাথেই মুবিন জবাব দেয়। এমনভাবে জবাব দেয় যেনো এই প্রশ্নটার অপেক্ষাই সে করছিলো, আর এই প্রশ্নটার উত্তর যেনো সে অনেক যত্নেই তৈরী করেছে। মুবিন উত্তর দেয়, ” যতদিন বেচে আছি। যতদিন শ্বাস আছে! ”
– ” লাভ কী এতে? নয় মাস হয়ে গেছে মুবিন। নয় মাস!, কোনো ফাক-ফোকড় তো আমরা ছাড়িনি। গায়েব হয়েগেছে, উধাও হয়ে গেছে মিছিল। কোনোদিন তোর মিছিলের সাথে দেখাই হয়নি এটা ভেবে মুভ অন কর। জাস্ট ভুলে যা না ওকে, আর কতদিন মুবিন? জাস্ট গেট ড্যাম ফাকেন গ্রো আপ! ”
মুবিন কোনো উত্তর দেয় না। শাওনের কথা গায়েও মাখায় না। এভাবে চাইলেই কী ভুলে যাওয়া যায়? কোনোমতেই যায় না। মুবিনের নিশ্চুপ ব্যাবহারে শাওনের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। একটা ফুলদানি হাতে নিয়ে সজোরে ফ্লোরে ছুড়ে মারে। ফুলদানিটা গঠনের টান ছেড়ে মুহুর্তেই গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়। শাওন চিৎকার দিয়ে বলে, ” এভাবে দেখতে পারছি না তোকে। হয় মরে যা আর নাহয় বাচার মতো বাচ। এভাবে বেচে থাকার দরকার নেই তোর! ”
সীমান্ত শাওনের মুখ চেপে ধরে টেনে নিয়ে শাওনকে খাটে বসায়। কান্নায় ভেঙে পড়ে শাওন। মুবিন উঠে এসে শাওনের সামনে ফ্লোরে বসে বলে, ” আমি আসলেই এভাবে বাচতে চাই না রে! প্রত্যেকটা মুহুর্তে আমি নিশ্চুপভাবে মরে যাই। প্রত্যেকটা নিঃশ্বাসের ব্যাবধানে আমার মরন হয়। ভেতরটায় একদম অদ্ভুত একধরনের ব্যাথা হয়। পুরো শরীরটায় যেনো কেমন একধরনের নির্বাক যন্ত্রনায় হারিয়ে যায়। এই অসুখের নাম জানা নেই আমার, এই অসুখের ঔষধের খোজও নেই আমার কাছে। আমি কিচ্ছু চাই না বিশ্বাস কর, কিচ্ছু না। শুধু মিছিলের একটা খবর চাই আর এই জীবন ক্যালেন্ডারটা থেকে মুক্তি চাই। খোদার কাছে দোয়া কর হয় এই ক্যালেন্ডারের অবসান ঘটুক নাহয় আমার অস্তিত্বের অবসান ঘটুক! ” শ্বাস চেপে আসার ফলে কথা বুকে আটকে যায় মুবিনের।
চলবে!
#thetanvirtuhin
প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে!♥
” Tanvir’s Writings “