গল্প: ক্যালেন্ডার!
পর্ব: ১৬!
লেখক: তানভীর তুহিন!
রাত প্রায় তিনটা বাজে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে মুবিনের কল দেওয়ার অপেক্ষা করছে মিছিল। মুবিনের সাথে রাতে ফোনে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যাওয়া মিছিলের নিয়মিত অভ্যাস। আজ সে অভ্যাসের নড়চড় হচ্ছে বলে ভীষন অসুবিধা হচ্ছে মিছিলের।
মুবিন কল করছে না কেনো এখোনো? আমার সাথে কথা না বলে ও ঘুমিয়ে গেলো নাকি? আদৌ কী ও আমার সাথে কথা না বলে ঘুমিয়ে যেতে পারে? আচ্ছা আমিতো কল দিতে না করেছিলাম সেজন্য কল করছেনা নাকি? ধুর! ও এতো টিনি জিনিস নিয়ে মাইন্ড করবে নাকি? উফফ! ফোন করতেছে না কেনো ও? এরকম নানান প্রশ্নের উত্তর খোজাতে ব্যাস্ত মিছিল। নিজেকে প্রশ্ন করছে, আবার নিজের কাছ থেকেই আনুমানিক সঠিক উত্তর চাচ্ছে। কিন্তু এতে লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না বরং সময়ের আমুল লোকসান হচ্ছে। অবশেষে মিছিল সিদ্ধান্ত নিলো যে, সে ই ফোন করবে মুবিনকে। ভালোবাসার মানুষকে এতো ওভার ইগো দেখাতে নেই, কী হবে রাগ পুষে রেখে যখন মানুষটা নিজেরই, সম্পর্কে মনের সংকেত কে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। মিছিল নিজে নিজেকে এসব বোঝাতে বোঝাতে মুবিনের নাম্বারে ডায়াল করে।
কল দেবার পর টু….. শব্দ করে রিঙ পড়ার আগে কিছুক্ষন নিশ্চুপ থাকে না ফোনের স্পিকার? ঠিক ঐ মুহুর্তটায় মিছিলের ভেতরটাও নিশ্চুপ হয়ে যায়। কেমন যেনো এক অজানা অদ্ভুত অনুভুতিকে অনুভব করছে মিছিল। মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে, মুবিন ফোন রিসিভ করার পরে সে বলবো কী? ফোন দিলে না কেনো? এটা জিজ্ঞেস করবে নাকি প্রেম ফুরিয়ে গেছে সেটা জিজ্ঞেস করবে? রিঙ পড়ার আগের কিছু মুহুর্তে এমন নানান ধরনের প্রশ্ন উত্তর পর্ব চলতে থাকে মিছিলের মনে। সব প্রশ্নগুলোই বাজেভাবে হতাশ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যখন ওপাশ থেকে আওয়াজ শোনা যায়, ” আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন তা এই মুহুর্তে বন্ধ আছে! ”
মিছিল বেশ অবাক হয়। এই অবধি কখনও কোনোদিন মুবিনের নাম্বার বন্ধ পায়নি মিছিল। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে ফোনটার দিকে তাকায় মিছিল। মুবিনের নাম্বার বন্ধ কেনো? সে এখন ঘুমাবে কীভাবে? কিছুক্ষন চুপচাপ অসহায়ের মতো স্থিরদৃষ্টে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে মিছিল। হয়তো নেটওয়ার্ক ইস্যুর জন্য ফোন বন্ধ বলছে! এটা ভেবে মনে আশা নিয়ে আবার মুবিনের নাম্বার ডায়াল করে মিছিল।
রিঙ পড়বে নাকি পড়বে না? রিঙ পড়বে নাকি বন্ধ বলবে? নিস্তব্ধ নিশ্চুপ মুহুর্তে এই দুটো প্রশ্নের ফলে মিছিলের হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক আচরন শুরু করে, শরীরটাও যেনো আচমকা কেমন শীতল হয়ে আলতো কাপা শুরু করে দেয়। মিছিল চোখ দুটো বন্ধ করে খিটে, আঙুল ক্রস করে আছে, মনটা শুধু বলছে ” আল্লাহ নাম্বারটা যাতে খোলা থাকে, আল্লাহ নাম্বারটা যাতে খোলা থাকে। ” কিন্তু না! মিছিলকে আরো একবার হতাশ করে দিয়ে সিম কোম্পানির একজন তরুণী বলে, ” আপনি যে নাম্বারে কল করেছেন তা এই মুহুর্তে বন্ধ আছে! ”
মিছিল ফোনটা পাশে রেখে চুপচাপ কিছুক্ষন বসে থাকে। মুবিনের নাম্বার বন্ধ কেনো? মিছিলের মুবিনের ” আর কোনোদিন তোমার সামনে আসবো না। ” কথাটা মনে পড়ে যায়। মিছিলের বুকটা খানিক দুমড়ে-মুচড়ে ওঠে। তাহলে কী…? পরক্ষনেই মিছিল ডান দিক – বা দিক মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে, ” মুবিনের মতো ম্যাচিউড একটা ছেলে থোরাই এই টিনি জিনিস নিয়ে এমন করবে নাকি? যত্তসব ফালতু চিন্তাভাবনা আমার! ”
মিছিল আবার কিছুক্ষন নিশ্চুপভাবে বসে থাকে।
বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মিছিল। বাবার ডাকে সকাল ৯ টায় ঘুম ভাঙে মিছিলের। ঘুম থেকে উঠেই ফোন চেক করে মিছিল। প্রতিদিন সকালে মুবিন মিছিলকে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে ওঠায়, কিন্তু আশ্চর্য! আজ মুবিন ফোনই করেনি। মনখারাপের মেঘে ঢেকে যায় মিছিলের মন আকাশ। মুবিনের প্রতি প্রচন্ড রাগ আর ভীষন অভিমান জন্মেছে মিছিলের মনে। মিছিল ঠিক করে নেয় মুবিন আজ ভার্সিটিতে তার সাথে কথা বলতে এলে সে ইচ্ছেমতো ঝাড়বে আজ মুবিনকে।
তড়িঘড়ি করে তৈরী হয়ে ভার্সিটিতে চলে আসে মিছিল। আজ বহুদিন পরে স্কুটার চালিয়ে ভার্সিটি এসেছে মিছিল। কারন এখন মুবিনের গাড়িতেই ভার্সিটি থেকে বাসা আসা যাওয়া করে মিছিল। মুবিন কত কাঠখড় পুড়িয়ে যে মিছিলকে প্রতিদিন তার গাড়িতে করে ভার্সিটি আসার জন্য রাজি করিয়েছিলো তা শুধু মুবিনই জানে। অথচ সেই মুবিনই আজ মিছিলকে নিতে যায়নি, এমনকি সকালে কল করে ঘুম থেকেও ওঠায়নি, এমনকি রাতে কথা না বলে ঘুমিয়েছে। গত কয়েকঘন্টার এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আর অনিয়মিত ঘটনাগুলোতে মিছিল আশাহত। সে মুবিনের কাছ থেকে কখনই এরকমটা আশা করেনি।
ভার্সিটিতে ঢুকেই চমকে যায় মিছিল। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয় তার। ক্যাম্পাসে মুবিনের গাড়ি নেই যে? মুবিন কী আজ ভার্সিটি আসেনি? এই অবধি এমন কোনোদিনই হয়নি যেদিন মিছিল ভার্সিটি এসেছে অথচ মুবিন আসেনি। মিছিল চমকের ওপর চমক পাচ্ছে, এ যেনো চমক বর্ষণ। মিছিল ক্লাসে গিয়ে শাওন-সীমান্তকে জিজ্ঞেস করে মুবিন কোথায়? মিছিলের প্রশ্নে চরম অবাক হয় শাওন-সীমান্ত। শাওন বলে, ” ওর সাথে তো কাল সেই ক্যাম্পাসেই কথা হয়েছে। তুই ও তো ছিলি তখন। রাতে ফোন দিলাম, ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম। ভাবলাম হয়তো তোর সাথে কথা বলে বলে চার্জ খুইয়ে ফেলেছে। কিন্তু তুই এখন এসে জিজ্ঞেস করছিস মুবিন কোথায়? মানে? মানে কী? মুবিন কোথায় মানে কী? তুই এই কথা কেনো জিজ্ঞেস করবি? তোদের মধ্যে কী কিছু হয়েছে? ”
– ” আসলে! ”
মিছিল কথা বলতে যাবে তখনই চৈতি আসে। চৈতি এসে বলে, ” কীরে কিসের সভা পারিষদ করিতেছিস? আর মুবিন কোথায়? ”
সীমান্ত বলে, ” জানি না। ওটা নিয়েই কথা হচ্ছিলো। ”
মিছিল গতকালের সব ঘটনা খুলে বলে শাওন, সীমান্ত আর চৈতিকে। সবটা শোনার পর ওরা সবাই বেশ অবাক হয়। কারন মুবিনের মতো বিন্দাস স্বভাবের মানুষ এমন ছোট ব্যাপার নিয়ে বেপাত্তা হবে, এটা নিতান্তই অবিশ্বাস্য।
মিছিল বলে, ” আমি ক্লাস করবো না। আমি ওর ফ্ল্যাটে যাচ্ছি। আর গিয়ে ফ্ল্যাটে পাচ্ছি কী পাচ্ছি না সেটা ফোনে জানাবো তোদের। ”
শাওন উঠে বলে, ” আরে তুই যাচ্ছিস মানে? আমরাও যাবো তো। চল! ”
মিছিল, শাওন, চৈতি, সীমান্ত সবাই মুবিনের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে পড়ে।
মুবিনের এপার্টমেন্টের পার্কিং এ এসে মুবিনের গাড়ি দেখতে পায় ওরা। মুবিন তাহলে ফ্ল্যাটেই আছে ভেবে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। লিফটে করে সুরসুর করে উপরে উঠে যায় সবাই। উপরে উঠতেই বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খায় সবাই, সবার হুশ উড়ে যায়।
চলবে!
#thetanvirtuhin
প্রিয় গল্পপ্রেমিরা যুক্ত হয়ে যান পরিবারে!♥
” Tanvir’s Writings “