কোন সুতোয় বাঁধবো ঘর পর্ব-৩১ এবং শেষ পর্ব

0
795

#কোন_সুতোয়_বাঁধবো_ঘর
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৩১

আজ শুক্রবার আর কিছুক্ষণ, তারপরই জারিফের সেই কাঙ্খিত মূহুর্ত চলে আসবে। ইরহাকে রাজি করাতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি৷ অবশেষে শক্ত মনের মানবী তার হচ্ছে।জারিফের মনে হচ্ছে ওই গানটার মত, আমি পাথরেও ফুল ফোটাবো শুধু ভালোবাসা দিয়ে।অবশেষে সে পাথরে ফুল ফোটাতে পেরেছে। যেমন এক্সাইটেড তেমন মনে, মনে নার্ভাস। একটু সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলো সামনের কমিটি সেন্টারে বিয়ে। ছাদারে এক পাশে দাঁড়িয়ে ডেকোরেশনের কাজ দেখছিলো, হঠাৎ চোখ আটকে গেলো জারিফ ওয়েডস ইরহা লেখা ব্যানারে। সেখানে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,জীবনের কত বসন্ত একলা কাটিয়ে তোমায় পেতে চলেছি আমার বসন্তের পাখি। এবার থেকে আমার প্রতিদিন বসন্তের রঙে রাঙিয়ে দিও ।
রাতুল অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে, তার মন খারাপ কারণ নাদিম বলেছে বিয়ে এখন হবে না। লাবিবার এইচএসসির পরই বিয়ে। এখন শুধু জারিফের বিয়ে হবে।কিন্তু তার ইচ্ছে ছিলো দুই ভাই একসাথে বিয়েটা সেরে ফেলবে। ইচ্ছের কথা লজ্জায় মুখ ফুটে বলতেও পারেনি। নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে লাবিবাকে কল করল,লাবিবা রিসিভ করে বলে,কি হয়েছে বাবু।
‘জান চলো বিয়েটা আজ করে ফেলি।
‘আমি কখন মানা করলাম বাবু যাও ভাইয়াকে রাজি করাও।
‘তোমার ভাই এমন কেন হু একটু বিয়ের জন্য রাজি হলে কি হতো। আই নিড বিয়া।
‘আমাকে বলে কি হবে ভাইয়াকে বলো।আর বিয়ে না হচ্ছে তো কি আমরা প্রেম করতে থাকি। বিয়ে তো হবেই।
‘তোমার যে পানসা প্রেম, হাতটা পর্যন্ত ধরতে দাওনা। কিস করতে বললে একগাদা ইমোজি পাঠিয়ে দাও।
বিয়ে হলে তো আর এমন হবে না গো। তখন প্রেম হবে মাখোমাখো।
‘আহা গো বাবু তোমার মাখো মাখো প্রেমের জন্য আরো আটমাস ওয়েট করো। রাখো এখন সাজতে বসবো।
‘জান, ও জান শুনোনা৷
‘হ্যা বাবু বলে শুনছিতো
‘চলো আমরা কোর্ট ম্যারেজ করে নেই।
‘বাবু আমি এখন ব্যাস্ত বলেই লাবিবা কল কেটে ইরহার রুমে আসলো।

“ইরহা পার্লারে সাজবে না। কিন্তু নিশাত আর লাবিবা পার্লারে সাজার জন্য জোড় করছে৷
‘ইরহা বললো আমি পার্লারে সাজবো না, মানে না।
‘এমন করছিস কেন আপু! বিয়ে কি প্রতি বছর বছর হয় একবারই হবে। একটু সাজলে কি হবে?
‘ভুলে যাচ্ছিস নাকিে!এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে, দেখ লাবিবা তোরা যা আমি নিজের মত সেজে নেবো।
‘লাবিবা চলে গেলে নিশাত বলে,আপু জীবনে জোয়াড় ভাটা থাকবেই তাই বলে কি জীবন থেমে থাকবে? সে তো নিজের মত চলতেই থাকবে।মেয়েদের জীবন কচু পাতায় জমা পানির মত নড়বড়ে। অল্পতে মেয়েদের অপবাদ দেয়া যায়, স্বামীর সংসার না টিকলে দোষ মেয়েদের হয়। ধর্ষক ধর্ষন করলেও লোকে বলে,এমন ভাবে চলাফেরা করতো তাই ধর্ষণ হয়েছে। নয়তো আর কেউ হতে পারলো না। সমাজ সব সময় মেয়েদের কোনঠাসা করে দেয়। কখনো এটা কেউ বুঝতে চায় না, একটা মেয়ে নিজের সবটুকু দিয়ে সংসারের সুতো আগলে রাখতে চায়। যাতে সুতো ছিড়ে সে বাঁধন হারা না হয়ে যায়। কোন মেয়ে চায় না সে ধর্ষিতা হোক। দোষ তার না দোষ ধর্ষকের। তুমি যাদের কথা ভেবে সাজতে চাইছো না। ভাবছো সবাই বলবে, হচ্ছে দ্বিতীয় বিয়ে তাও কত রঙ ঢং। তুমি ভুলে যাচ্ছো তারা শুধু তোমার খারাপে আছে তারা তোমার ভালো তে নেই। তোমার ভালো শুধু তোমার। জারিফের কিন্তু এটা প্রথম বিয়ে তার মনে কিন্তু এটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন। আমার যা মনে হলো বললাম বাকিটা তোমার ইচ্ছে।
‘ইরহা রাজি হলো।
নিশাত ইরহাকে জড়িয়ে ধরে বলে,এবার থেকে তোমার সাথে সব ভালো হবে দেখে নিও।

ইরহাকে তিন ঘন্টা সময় নিয়ে পার্লারের মেয়েরা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। গাড়ো খয়েরী রঙের লেহেঙ্গা সাথে গোল্ডের জুয়েলারি। ইরহাকে পরির মত লাগছে।
নিশাত বলল,জারিফ ভাইয়া তোমাকে দেখে বেহুশ হয়ে যাবে নিশ্চিত।

দেখতে দেখতে বরযাত্রী চলে আসলো, ইরহা নওশাবাকে ঘুম পারিয়ে চুমু খেয়ে স্টেজে আসলো।
ইরহা আর জারিফের বিয়ে হচ্ছে।
সবাই আনন্দিত।
আহনাফ একপাশে দাঁড়িয়ে দেখছে, মনে মনে বলছে,কিছু মানুষ হৃদয়ে থাকে ভাগ্যে থাকে না।
অন্তরা আহনাফের হাতে নিজের হাত রাখলো। আস্তে করে বললো, তোমার জন্য আমি আছি তো।
‘একটা কঠিন সত্য কি জানো অন্তরা, আমরা পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করেও নির্মম ভাবে ভাগ্যের কাছে হেরে যাই। ভাগ্যের সাথে আমাদের লড়াই চলে না৷
‘এখন এসব কথা কেন বলছো।
‘আর বলবো না, তোমাকে নিয়ে বাকি জীবন সুখে কাটিয়ে দেবো৷

দেখতে দেখতে ইরহার বিদায়ের সময় চলে আসলো,জারিফ নওশাবাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নাদিম ইরহার হাত জারিফের হাতে দিয়ে বলে,আমি কিছু বলবো না শুধু চাই এই হাত দুটো একত্রে থাকুক সব সময়।
এদিকে রাতুল লাবিবার লেহেঙ্গার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
তুমি এমন করছো,মনে হচ্ছে আমি পালিয়ে যাচ্ছি। আরেহ বোকা আমাদের বিয়েও তো হবে।
‘চলো জান আজ বিয়ে করে নেই।
লাবিবা রাতুলের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,চোখ বন্ধ করো।
রাতুল চোখ বন্ধ করতে লাবিবা রাতুলের কানের কাছে মুখ এনে বলে,চোখ মেললেই দেখি তোমাকে, চোখ বুজলে পাই আরো কাছে….. ভালোবাসি বড় ভালোবাসি এর বেশি ভালোবাসা যায় না ও আমার প্রাণ পাখি ময়না। বলেই নিজের পা দুটো উঁচু করে রাতুলের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।রাতুল চোখ খোলার আগেই লাবিবা ফুড়ুৎ।
রাতুল মুচকি হেসে বলে, আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি।আমার হলদে রাঙা পাখি।

✨বাসর ঘরটা এতো সুন্দর করে সাজানো দেখে ইরহা বলে,এটা কি বেড রুম নাকি গার্ডেন?
‘আসলে এখানে আজকে থেকে আমার ফুল থাকবে তাই এটা আজ থেকে গার্ডেন। জারিফ ঘুমন্ত নওশাবাকে বেডের পাশের দোলনায় শুয়ে দিয়ে মশারী টানিয়ে দিলো। তারপর নিজের ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
জারিফ ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখে ইরহা রুমে নেই। সাথে সাথে দোলনা চেক করে দেখে নওশাবা আছে। নওশাবাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, তারমানে আশেপাশেই আসে। ইরহা একহাত ঘোমটা টেনে আস্তে আস্তে জারিফের সামনে এসে দাঁড়ালো। জারিফ ইরহার ঘোমটা তুলে বলে,আমি জানি আপনি। আর কিছু বলার আগেই চিৎকার করতে নেয়। ইরহা সাথে সাথে জারিফের মুখ চেপে রেখে বলে,গার্ডেনে শুধু ফুল না পেত্নী ও থাকে।
কিছুক্ষণ পর মুখ ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে ওয়াশরুমে চলে যায়। ইরহা চলে যেতেই জারিফ বলে….. বিয়ে জিনিসটা অতো একটা সুখকর বিষয় না, আবার যে দুঃখের তাও না। আসলে বিয়ে না করলে বুঝবেননা বিয়েটা আসলে কি?
জারিফ কি বউ তোর বাসর রাতে তোকে ভয় দেখিয়ে ছাড়লো।

ইরহা ওয়াশরুম থেকে বের হলো সামনের কিছু চুল ভেজা পরনে বাসন্তী রঙের জামদানী শাড়ী লাল পাড় খোলা এলোমেলো চুল কোন রকম প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই চেহারায়। কি স্নিগ্ধ লাগছে। চোখ সরছে না জারিফের। জারিফ ইরহার দিকে আগ্রসর হয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে ইরহাকে একটানে নিজের বাহুতো এনে ঘোড় লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইরহার দিকে।
ইরহা কিছু বলবে তার আগেই জারিফ ইরহার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলে,তোমার এই গোলাপের পাপড়ির মত দুটো ঠোঁট যখন নেড়ে কথা বলো, তখন আমার পুরো দুনিয়া তোমার ঠোঁটে আটকে যায়, হৃদয়ে তৃষ্ণা বাড়তে থাকে এই পাপড়ি ছুয়ে দেখার। তুমি আমার এতোদিনের অপেক্ষা পর আমার হওয়া বসন্তের ফুল। তুমি গোলাপ কিংবা রজনীগন্ধার অথবা বেলি নও, তুমি আমার মন বাগানের এক সাত রাঙা ফুল যার রঙে আজ থেকে আমি রঙিন হবো। জারিফ ইরহার কোমড় উঁচু করে ধরে বলে, তুমি আমার রঙিন প্রজাপতি, আর আমি তোমার শত ডানা। ইরহা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। তার শ্বাস বেড়ে গেছে হৃদয়ে কেমন ধুকপুক শব্দ করছে। জারিফ ইরহাকে নামিয়ে ইরহার কোমর ধরে নিজের একদম কাছে এনে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। মিনিট পাঁচেক পর ইরহার ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে ইরহাকে কোলে তুলে বারান্দায় নিয়ে আসে। ইরহাকে দাঁড় করিয়ে ইরহার পিছনে নিজে দাঁড়িয়ে বলে, আজকে থেকে তুমি আমার পৃথিবী। আর কখনো কোন কারণে কোন সময় ভুলেও তোমার অতীত টানবে না।তুমি আমার কাছে পবিত্র সদ্য ফোটা গোলাপের মত।
ইরহা ঘুরে জারিফকে জড়িয়ে ধরে বলে,একবার সম্পর্কে সুতো ছিড়ে যাওয়ার পর ভাবতাম #কোন_সুতোয়_বাঁধবো_ঘর? আজ মনে হচ্ছে আমি সঠিক সুতো পেলাম নিজেকে বেঁধে রাখার। কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?
‘কখনো না। তুমি আমার অনেক সখের।বলেই ইরহার কপালে চুমু দিলো। জারিফের বুকে মাথা রেখে ইরহা বলে,”জীবনের সব রঙ মুছে যখন ধূসর ছাই! সেই ছাই থেকেও জন্ম নিতে পারে এক সতেজ প্রাণ। দ্বিতীয়বার বলে কিছু নেই এই কথাটা ভুল, সঠিক মানুষ জীবনে আসলে তৃতীয়বারের জীবন হয় ফুল।

“জীবন গল্পের মত গোছানো হয়না, আবার কখনো, কখনো গল্পের চেয়েও সুন্দর হয়”!বাস্তবতা আর উপন্যাস ভিন্ন তাই উপন্যাসের পাতায় বাস্তবতা খুঁজতে যাবেননা।তবে উপন্যাস কাল্পনিক হলেও মাঝে, মাঝে সেখানে ফুটে ওঠে বাস্তব চিত্র।
“গল্প থেকে জীবন নয়, জীবন থেকে-ই গল্পের জন্ম হয়।

সমাপ্তি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে