সূচনা পর্ব
#কোন_সুতোয়_বাঁধবো_ঘর
#নুসাইবা_ইভানা
ছয় মাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করছে ইরহা। সাইন করার আগে একবার রবিনের দিকে দৃষ্টি দিলো।
সেই স্বামী নামক মানুষটা অন্য আরেকজনের হাত শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
শেষ বারের মত কিছু বলতে চেয়েও আটকে গেলো ইরহা। চোখের কার্ণিশ বেয়ে জলটুকু গড়িয়ে পরার আগেই সাইন করে দিলো৷ বাচ্চাটাকে আকড়ে ধরে কোর্ট থেকে বের হবে। তার আগে রবিন এসে বলে,দেখো ইরহা জোড় করে সব হলেও ভালোবাসা হয় না।তবে তুমি চাইলে ডিভোর্স না দিয়ে আমাদের বাসায় থাকতে পারতে। আমার মেয়েটা অনন্ত পিতৃহারা হতো না।তবে যাইহোক আমি আমার মেয়েকে নিজের পরিচয় দেবো। ওর যা লাগে সব খরচ আমিই বহন করবো। রবিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠাসসসসস করে একটা শব্দ হলো। সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ইরহার দিকে।যে মেয়ে কখনো কারো মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনি, সে কিনা গায়ে হাত তুলল!
রবিন নিজেও হতবুদ্ধি হয়ে গেলো।ইরহা বড্ড শান্ত মেজাজের মেয়ে। কখন উঁচু আওয়াজে কথাও বলেনি। কিন্তু আজ তার গায়ে হাত তুলল!
‘ লামা এসে বলে সাহস তো কম না আমার হ্যাসবেন্ডের গায়ে হাত তুলিস! ভুলে যাস না ওর সাথে তোর আর কোন সম্পর্ক নেই!
‘আমি ভুলে যাইনি। সম্পর্ক থাকলে সম্মান করতাম। কারণ স্বামীকে সম্মান করতে হয়। আজ সম্পর্ক শেষ তাই ছোট একটু প্রতিবাদ করে বুঝিয়ে দিলাম। চুপ করে ছিলাম বলে, আমি নিরীহ অবলা নারী নই। প্রতিবাদ আমিও করতে পারি।
‘এসব লেকচার রাখ আর বিদায় হ।
‘আপনার মত কাউকেই ও ডিজার্ভ করে। যে আরেকজনের স্বামী সংসার কেড়ে নিয়েও বুক ফুলিয়ে বাজে বিহেভিয়ার করতে পারে। আর হ্যা আরেকটা কথা,
‘আপনার হ্যাসবেন্ডকে সামলে রাখবেন৷ আমি তো সামলাতে পারলাম না। ছাড়া গরু ঘাস পেলেই মুখ দিবে। তাই মুখটা বেঁধে রাখার চেষ্টা করুন। আর হ্যা যাওয়ার সময় এতোটুকু তার প্রাপ্য ছিলো।
‘শেফালী বেগম বলে,কি মেয়ে দেখলি, সব সময় ভান ধরতো কিছু বুঝে না। ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে পারেনা৷ দেখলি আসল রুপ কালনাগিনী বিদায় হয়েছে ভালো হয়েছে।
‘ইরহা আর পিছু ফিরলো না। সোজ এসে রিকশায় উঠলো৷ নিজের বাচ্চা মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চোখের জলটুকু মুছে নিচ্ছে বারবার। এই তো সেদিেনের কথা তিন বছর আগেই কত স্বপ্ন নিয়ে রবিনের সাথে ঘর বেঁধেছিলো। সবাই কত আনন্দিত ছিলো৷ দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়েটা হয়েছিল।
একটা মেয়ে বুঝ হওয়ার পর থেকে নিজের একটা সংসারের স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নের ডানায় ভর করে কতশত রঙিন স্বপ্ন আরো বুনে। ছোট বেলায় পুতুল খেলা বা হাড়ি পাতিল নিয়ে বাচ্চামো সেই সাংসারিক খেলা।তারপর বুঝ হওয়ার পর থেকে একটু একটু করে মনের মধ্যে পুষে রাখা স্বপ্নগুলো ডানা ছড়াতে থাকে। কখন ভাবেনি সেই কল্প ডানাগুলো এতো,তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে যাবে! জীবনের কঠিন এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে তার কি করা উচিৎ ছিলো?
ইরহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, জীবনটা এমন না হলেও পারতো!
বিয়ের পর কখন মনে হয়নি রবিন নামের মানুষটা খারাপ। এ্যারেন্জম্যারেজ। দু’জনে দু’জনকে বুঝতে বুঝতে বছর খানিক পার হয়ে যায়। ইরহার বিয়েতে প্রথম দিকে মত না থাকলেও ধীরে ধীরে রবিনের ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে যায়। খুনসুটি ভালোবাসা পূর্ণ একটি সংসার। কত ভালোবাসা জড়ানো সংসারটা মূহুর্তে পাল্টে গেলো সেদিন সন্ধ্যায়। যখন প্রথমবার রবিনের ওয়ালেটে একটা মেয়ের ছবি দেখতে পায়৷ বেশ কিছু সময় ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে৷ রবিনকে কিছু না বলে ছবিটা নিজের কাছে রেখে দেয়। তখন ইরহা চারমাসের অন্তঃসত্ত্বা। তারপর কেটে যায় বেশ কিছুদিন। এরপর একদিন রাত বারোটায় রবিন কল করে বলে,ইরহা জান আমার কি করো?
‘এইতো তোমার অফিস থেকে ফেরার অপেক্ষা করছি৷
‘জান আজকে তো ফিরতে পারবো না। ফরেনারদের সাথে ডিল৷ মিড নাইট প্রেজেন্টেশন।
‘তারমানে আসবে না সত্যি।
‘কাজ করতে হবে তো জান! যে আসছে অন্তত তার জন্য এক্সট্রা কাজ করতে হবে। যাতে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিতে পারি। তুমি খেয়েছো তো ইরহু!
‘হুম খেয়েছি৷ তুমিও খেয়ে নিও।
‘আচ্ছা জান সাবধানে ঘুমিয়ো৷ হাত পা সাবধানে নড়াচড়া করবে।
‘মিস করবো তোমাকে অনেক।
‘জান আমার চেয়ে কম মিস করবা। এবার ঘুমিয়ে পরো রাখি৷
এরপর থেকে প্রায় রাতে অফিসের মিটিংয়ের নাম করে বাহিরে রাত কাটাতো।
ইরহার যখন আটমাস চলে,তখন চেক-আপের জন্য ক্লিনিকে গেলে সেখানে রবিনের কলিগের বউ রাবেয়ার সাথে দেখা হয়। কথায় কথায় ইরহা রাতের মিটিংয়ের কথা তুললে, রাবেয়া বলে, নাতো আপা এমন কোন মিটিংয়ে তো আপনার ভাই জয়েন করেনি৷ এমন কোন মিটিং হলে তো জানতাম।
ইরহা নিস্তব্ধ হয়ে গেলো, বিষয়টা নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করলো না৷ ক্লিনিক থেকে ফিরে আর এক মূহুর্তের জন্য স্থীর হতে পারলো না। সারাক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করে গেলো। রাত এগারোটায় রবিন বাসায় ফিরে আসলো। ইরহা রববিনকে বললো,তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার দিচ্ছি।
‘তোমাকে কষ্ট করতে হবে না।আজকে আমি ডিনার বাহিরে সেরে এসেছি। তুমি শুয়ে পর আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আর হ্যা মশারী আমি টাঙাবো। তোমার কষ্ট করতে হবে না। রবিন ওয়াশরুমে চলে যেতেই। ইরহা দ্রুত রবিনের ফোন হাতে নিলো। লক পাল্টে ফেলেছে। অনেক চেষ্টা করে লক খুলতে ব্যার্থ হয়ে ফোনটা জায়গা মত রেখে দিলো।
দু’জনেই পাশাপাশি শুয়ে আছে। কিন্তু কি অদ্ভুত মনে হচ্ছে শত জনমের দূরত্ব। রাত গভীর হচ্ছে একজান নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে আর একজনের চোখে ঘুম নেই। ঘন্টা দু’য়েক এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলো ইরহা খুব সর্তক ভাবে মোবাইলটা আমার নিয়ে রবিনের ফিঙ্গার লক খুলল। মোবাইল ঘেটে তেমন কিছুই পেলো না৷ হতাশ হয়ে মোবাইল রেখে দিলো। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ভাবছে,আমি কি মিছিমিছি সন্দেহ করছি? আসলে যেটা ভাবছি সেটা তো নাও হতে পারে! এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরেছে খেয়াল নেই ইরহার।
সকাল বেলা যখন ঘুম থেকে উঠে তখন বেলা ন’টা বাজে। রবিন ততক্ষণে অফিসে চলে গেছে। ইরহা ফ্রেশ হয়ে বাহিরে আসতেই।
শেফালী বেগম কর্কশ কন্ঠে বলে, আমরাও তো মা হয়েছি।তুমি একা তো মা হচ্ছ না। আমরা ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে ঘরের সব কাজ একলা হাতে করেছি। আমরা তোমাদের মতো এতো অজুহাত আর ঢং দেখাইনি। মনে হচ্ছে তুমি একাই পৃথিবীতে মা হচ্ছো।
‘আর এমন হবে না আম্মা।সারাদিনটা ভালোই কটলো।সন্ধ্যার দিকে রবিনকে অফিসের তিনজন স্টাফ এসে দিয়ে গেলো। হাত পায়ে ব্যান্ডেজ করা। জানা গেলো একটা ছোট এক্সিডেন্ট করেছে। কয়েকদিন রেস্ট নিলে সুস্থ হয়ে যাবে।
ইরহা খেয়াল করলো রবিন বেশিরভাগ সময় ফোনেই লেগে থাকে আবার ফিসফিস করে কথা বলে।কিন্তু ইরহা সামনে আসলেই চুপ হয়ে যায়। এভাবেই চলছিলো। ইরহার মনে সন্দেহ বাড়তে থাকে। এরমধ্যেই একদিন একজন মেয়ে আসে কিছু খাবার নিয়ে রবিনের সাথে দেখা করতে।
ইরহা প্রথমে বিষয়টি আমলে নেয়নি। আসতেই পারে অফিসে একসাথে কাজ করে। কিন্তু মেয়েটির চেহারা ভালো করে খেয়াল করার পর ইরহার বুকটা ধক করে উঠলো। সেইদিনের ছবির মেয়েটা আর এই মেয়েটা তো একজনই। হুট করে অজনা ভয় জেঁকে ধরলো ইরহাকে। সব হারানোর ভয়।
#চলবে