#কোন_এক_প্রণয়_প্রহরে
#পর্ব৩
#মহুয়া_আমরিন_বিন্দু
আজ সন্ধ্যাটা ভীষণ চমকপ্রদ। আকাশের বুকে ছড়িয়ে গেছে হলুদ কমলার মিশ্রনে অদ্ভুত এক রঙ।ফিহা গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে সে দিকে,নতুন গন্তব্যে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে তা সে জানে না।তবুও নতুন সূর্যের আগমনের প্রত্যাশা করছে।
বাড়ি পৌঁছে প্রত্যেয় ফিহার দিক তাকিয়ে বললো,
,,আলমারির ওই পাশটায় তোমার কাপড় রাখা আছে যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।
ফিহা চলে গেলো সেদিকে,প্রত্যেয় মোবাইল হাতে নিয়ে খাবার অর্ডার করলো।কাজের মহিলাটা কয়েকদিন ছুটি নিয়েছে,তপ্ত এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশের রুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
ভালোবাসার মানুষকে অতি কাছে পেয়েও যখন অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না,মন ভরে তার সাথে কথা বলা যায় না, মুগ্ধতা নিয়ে তাকানোর অধিকার থাকে না,তার মতো নিদারুণ যন্ত্র ণা আর কি হতে পারে।
ফিহা হলদে রঙের এক থ্রি পিস পড়ে বসে আছে,পিঠে ছড়িয়ে আছে তার অর্ধ ভেজা ছোট ছোট চুল।
তার মতো শ্যামলা গরনের মেয়েকে কেনো এতো কাঠখড় পুড়িয়ে বিয়ে করলো প্রত্যেয় নামক মানুষটা কি এতো প্রয়োজন পড়লো তার।পুরুষ প্রেমে পড়ে নারীর দীঘল কালো চুলে,মায়াভরা চোখ,ফর্সা গরনে তার গুনে।তার মাঝে তো প্রেমে পড়ার মতো আহামরি কিছু নেই। না আছে কাঙ্ক্ষিত কোনো রূপ লাবণ্য! তবে কেনো এতো জল ঘোলা করা হলো, এতো এতো নাটকিয়তা করা হলো,বিয়েতে নিজের মায়ের সম্মতি তাকে ভীষণ ভাবাচ্ছে,যখন জেনেছে মা তাকে বিশ্বাস করে নিজেকে অনেকটাই হালকা মনে হয়েছিলো, পৃথিবীতে এই একটা মানুষই তার অধিক আপন।ছোট থেকেই বুঝতে শিখেছে তার এতো বড় পরিবারে তার অবস্থান খুবই ঠুনকো,বাবা নামক মানুষটা কখনো স্নেহের হাত বাড়িয়ে দেয় নি ছোট ভাই বোন দুটিও কখনো তাকে আপন ভাবেনি,দাদি, ফুফু সব মানুষের মাঝে সে ছিলো অবহেলার পাত্র। সে তো এই পরিবারেরই তাহলে কেনো এতোটা দূরে দূরে ঠেলে দিতো সবাই।সেই ছোট থেকে ফিহার মন আক্ষেপ, অভিমান নিয়ে ভরপুর থেকেছে,সবার মাঝে থেকেও নিশ্চুপ একা একা নিজের একটি জগৎ গড়ে তুলেছে,তার জীবনে ভালোবাসার বড্ড বেশি অভাব।সেই ছোট থেকেই একটা প্রশ্ন মনে গেঁথে গেছে,আমাকে কেনো কেউ ভালোবাসে না?ভালোবাসা বুঝি অনেক দামি কিছু যা তার পাওয়ার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে?
যখন ভার্সিটিতে সাদাব কে দেখতো সেই ছোট মনটায় এই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়েছিলো, ভালোবাসে কি না জানে না তবে মনে হতো এ মানুষ টাকে দেখলে তার কিছুটা স্বস্তি হয়।হৃদয়ের হাহাকার কিছুটা কমে।কিন্তু দিন শেষে তার ভালোবাসার পাত্র শূণ্য সেই মানুষটাও তাকে ভালোবাসার ইঙ্গিত দিয়ে হাত ছেড়ে দিয়েছে।কেনো কেউ একবার ও তার হাত শক্ত করে ধরতে চায় না?সে কি এতোটাই অযোগ্য?
বারান্দার গ্রিল পেরিয়ে রাতের অন্ধকার আকাশ কে সে তার সব অভিযোগ তুলে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে কেউ নেই তার এই দুঃখের ভাগ নিতে।তাকে আশার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলার মতো কেউ নেই
“এই তো আমি আছি তোমার পাশে,শুধু মাত্র তোমার হয়ে”!
গাল বেয়ে দু ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো ফিহার চোখ বন্ধ করে মাথা ঠেকিয়ে দিলো লোহার শক্ত পোক্ত আবরনে।নিজের চিন্তায় বিভোর ফিহা দেখলো না বুঝলো না তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে। যে মানুষটির চোখে রয়েছে এক পশরা ভালোবাসা, মুগ্ধতা!
প্রত্যেয় খুব নরম সুরে ডাকলো
,,ফিহু!
ফিহা আনমনেই বললো
,,কি!
,,কি এতো দেখো ওই আকাশে?
ফিহা মৌন রইলো, কথা বলতে ইচ্ছে হলো না কেনো জানি।চুপচাপ তাকিয়ে দেখলো চাঁদ বিহীন আকাশ।
ফিহা ঘুরলো প্রত্যেয়ের দিকে ছেলেটি তার পেছনে দাড়িয়ে আছে বুকে হাত ভাজ করে।
ফিহা নিজের এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো
,,আমরা কি বন্ধুত্ব দিয়ে নিজেদের নতুন জীবনের সূচনা করতে পারি প্রত্যেয়?
প্রত্যেয় তাকালো সামনে থাকা রমনীর দিকে,মেয়েটির চোখের ভাষা এলোমেলো, চাহনি টলমলে।চোখে মুখে ফুটে উঠেছে এক মৃদু আকুলতা।
ফিহা বেশ কিছুক্ষণ হাত উঁচিয়ে রেখে নামিয়ে ফেললো,পর পর ফিচলে হেসে বললো
,,আমার হাত ধরতে সবাই এতো ভয় পায় কেনো বলতে পারেন?আপনি চাইলে কিন্তু ধরতে পারেন, সারাজীবন ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কেউ কেউ ছেড়ে গেছে।তাই আপনি কথা দিয়ে কথা না রাখলেও অবাক হবো না!
প্রত্যেয় শুধু তাকিয়ে আছে,ফিহার এবার বিরক্ত লাগলো লোকটা কথা বলছে না কেনো?এভাবে তাকিয়ে থেকে অস্বস্তিতে ফেলার কি দরকার।সে সরে যেতে চাইলো রুমের দিকে।
পেছন থেকে হাতটা আটকে দিলো প্রত্যেয়,নিজ থেকেই বলতে লাগলো
,,এখন আমায় না হয় ভালো নাই বাসলে,কখনো বাসবে কিনা তাও না হয় নাই বা জানালে।
তবে এই আজ আমি তোমার হাত ধরলাম, ছেড়ে দেবার জন্য নয়।
আমি এক দমে প্রতিশ্রুতি দিতে চাই না প্রতি দিন প্রতি পদে পদে তোমাকে বুঝাতে চাই আমি আছি তোমার পাশে থাকবো আমৃত্যু!
জানি না কবে আসবে সেই প্রহর।তবুও আমি আশায় থাকবো “কোনো এক প্রণয় প্রহরে” তুমি আমার হবে, ভালোবেসে নিজের করে নিবে!
ফিহা থামলো পর পর চোখ বন্ধ করে বুঝলো কথাটির গভীরতা।ছেলেটি কি তাকে ভালোবাসে?প্রশ্ন টি করা খুব জরুরি হবে।নাকি অপেক্ষা করবে প্রকাশ পাওয়ার।
ফিহা ফিরে তাকালো দৃষ্টি রাখলো প্রত্যেয়ের চোখে।
ফিহা হাসলো কিছুটা হাত টা আবার বাড়িয়ে বললো
,,ফ্রেন্ডস!
প্রত্যেয় হাত বাড়িয়ে দিলো।
——
সকাল সকাল মিতার ফোনে কল করেছে কেউ বার বার ফোনের রিং বাজছে, মেজাজ এখন তুঙ্গে তার।কোন ইডি*য়েট সকাল সকাল জ্বা লাতে এসেছে একবার হাতের কাছে পেলে লবন মরিচ ছাড়া ব্লেন্ড করে ফেলবে একদম।
মোবাইল হাতরে কোনো রকম রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো কিছু শব্দ
,,এই চিংড়ি মাছের মালাই কারি!
ভার্সিটি কে তুই তোর নিজের শ্বশুর বাড়ি পেয়েছিস?তিন দিন যাবৎ ক্লাসে আসিছ না তুই নাই তোর দেখা দেখি ফিহার বাচ্চাটাও উদাও হইয়া গেছে।শা*লার আমার জীবনটাই শেষ তোদের মতো দুইটা জ ন্তু মার্কা ফ্রেন্ড পাইয়া।আমি এক সহজ সরল পোলা!
মিতা ফোন হাতে উঠে বসে চেচিয়ে বললো
,,ওই হারা মি সকাল সকাল তুই এসব বলতে ফোন করেছিস তোকে না বলেছি বাসায় এসে নিয়ে যাইতে। এতো সকাল সকাল প্যান প্যান শুরু করলি কেন?
,,আশ্চর্য ভাই সহজ সরল পাইয়া তোরা সবাই কথা শুনাইয়া দেস কেন বুঝি না।ফিহাদের বাসার দারোয়ান তো ঢুকতেই দিলো না কইলো ফিহা নামক কোনো প্রাণী নাকি সেখানে থাকে না!
,, গা*জা পানি খাইয়া সকাল সকাল কার বাসায় ভুল করে ঢুকছছ তুই?ফিহার মতো ঘরকুনো মেয়ে আবার কই যাবে?নিশ্চিত তুই ভুল মানুষের বাড়িতে চলে গেছিলি!
,,বিশ্বাস কর তালতো বইন। আ’ম সিরিয়াস, সত্যি ফিহার বাসা থেকে এসে রিকশায় বসেছি আমার সত্যি টেনশন হচ্ছে ওর তো ফোন বন্ধ, ওর ওই দজ্জাল বাপ ওরে আবার এডপশনে দিয়া দেয় নাই তো!
,,কি বলোস উল্টা পাল্টা ফিহা কি বাচ্চা নাকি যে এডপশনে দিবে,বিয়ে দিছে বললেও মানা যাইতো!
,,তার মানে তুই কিছুই জানিস না দেখছি ওর না সাদাব ভাইয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো? তার পর থেকেই তো উদাও।
মিতা চিন্তায় পড়লো কিছুটা সৌরভ কে বললো তুই আয় বাসায় আমি রেডি হই ভার্সিটি গিয়ে দেখি খোঁজ পাওয়া যায় কিনা!
মিতা চিন্তায় মগ্ন সাদাবের সাথে বিয়ে হবে বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হওয়ার কথা থাকলেও ওকে দাওয়াত করেছিলো কিন্তু ও যেতে পারিনি। ভেবেছিলো মেয়েটা কে পরে সরি বলে মানিয়ে নিবে কিন্তু এখন তো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না।
মিতা তৈরি হয়ে ড্রয়িং রুমে আসলো খাবার দিলো ওর মা,তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো বুঝলো সৌরভ এসে পড়েছে দৌড়ে গিয়ে গেইট খুলে চেচিয়ে বললো
,,মা সৌরভ এসেছে আমি ভার্সিটি চলে যাচ্ছি।
ভেতর থেকে ব্যাস্ত কন্ঠে ডলি বেগম বললেন আরে ছেলেটাকে ভিতরে তো আসতে দে তোর খালামনি বললো বাসা থেকে নাকি খেয়ে আসেনি।
সৌরভ বললো
,, খালামনি তোমার হাতের রান্না খাবো বলেই তো খেয়ে আসিনি কিন্তু তোমার মেয়ে যে একটা ডাকা ত দেখো কিভাবে টানাটানি করছে, নিজেও খাবেনা আমাতেও খেতে দিবে না।
মিতা কটমট করতে করতে বললো
,,এই ব্যাটা জীবনে কি কোনো দিন আর খেতে পারবি না?টেনশনে টেনশনে আমার পেটে সুরসুরি শুরু হয়ে গেছে।চল বলছি ক্যান্টিনে খেয়ে নিবো।
সৌরভকে টানতে টানতে ভার্সিটে নিয়ে গেলো মিতা।
,,,
,,হ্যালো হ্যালো হ্যালো…….
কানের কাছে এমন শব্দ পেয়ে ধরফরিয়ে উঠলো ফিহা, খাটের পাশে দাড়িয়ে মিট মিট করে হাসছে প্রত্যেয়।ফিহা রাগে বলে উঠলো
,,এটা কি হলো?ঘুম থেকে ডেকে তোলা যেতো না?এভাবে কেউ চিল্লায় আল্লাহ আমার কান!
প্রত্যেয় ভ্রু কুঁচকে বললো
,,তোমাকে ডাকলে তুমি শোনতে পাও?
এপর্যন্ত চার বার ডেকেছি,ভার্সিটি যেতে চাও না নাকি আর,আমি তো অফিসে যাবো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে তাই উঠো জলদি, অলরেডি লেইট হয়ে যাচ্ছে।
ফিহা আর কথা বাড়ালো না সত্যি এতকিছুর মাঝে ভার্সিটির কথা ভুলতে বসেছিলো।
এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে তৈরি হয়ে আসলো,প্রত্যেয় তৈরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে ফিহা একবার তাকালো, প্রত্যেয় দেখতে কি সুন্দর!
ফিহা মনে মনে জিট কা টলো একবার ছি!ছি কি ভাবছে সকাল সকাল।চোখ নামিয়ে চুল আঁচড়াতে ব্যাস্ত হলো।
প্রত্যেয় ফিহার হাত থেকে চিরুনি কেঁড়ে নিলো,ফিহা তাকালো অবাক হয়ে,প্রত্যেয় ফিহার বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরালো, মিষ্টি কন্ঠে বললো
,,আমি আঁচড়ে দেই?
ফিহা চমকালো, ছেলেটি কি সুন্দর করে আবদার করলো ওর কি উচিত না করে দেওয়া?
ফিহার উত্তরের আশা করলো না প্রত্যেয় নিজেই চুলে চিরুনী চালালো।ড্রেসিং টেবিলের একটা ড্রয়ার টান মেরে খুললো,বেরিয়ে আসলো চকচকে কতোগুলো ক্লিপ,রাবার বেন্ড,চুলের কাটা!হতচকিত চোখে একবার সেদিকে দেখলো ফিহা, এই বাসায় তো কোনো মেয়ে নেই তো এগুলা কার জন্য কিনে এনে রেখেছে প্রত্যেয়?
ফিহার প্রশ্নসিক্ত চাহনি দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো প্রত্যেয়।ফিহাকে ঘুরিয়ে চুলে লাগিয়ে দিলো একটা বো ক্লিপ।
ফিহা তাকালো চোখ পিটপিট করে।প্রত্যেয় নিজের মুখ ওর কাঁধের কাছে আনতেই মৃদু কেঁপে উঠলো শরীর চেপে ধরলো কুর্তির দুই পাশ।প্রত্যেয় ফিসফিস করে বললো
,,কিউট!
চলবে….