#কোনো_এক_শ্রাবণ[তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৫৫)[প্রথম অংশ]
‘হেলমেট পরে রিকশায় উঠে কেডা?এটা কি কোনো হুন্ডা?’
আবাসিক এলাকার মধ্যে দিয়ে ধীর গতিতে চলমান রিকশার চালক অত্যন্ত বিরক্ত আর লটকানো মুখে মাথা ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে।কোঁচকানো চোখে পেছনের সিটে থাকা নর নারী দু’জনকে দেখে।
মেয়েটার পরনে মেরুন রঙের তাঁতের শাড়ি।আর ছেলেটার পরনে কালো টি-শার্ট।জামা কাপড় বেশ ভালো,পরিপাটি।তা নিয়ে চালকের কোনো সমস্যা নেই।তার সমস্যা ছেলেটার মাথার হেলমেট নিয়ে।এই দিনে দুপুরে হেলমেট পরে কে ঘুরে?তাও আবার রিকশাতে বসেছে হেলমেট পরে।মাথায় সমস্যা নাকি?
তার কথায় পেছনের সিটে থাকা ছেলেটা দ্বিগুন বিরক্ত হয়।দাঁতে দাঁত চেপে সে তিতিবিরক্ত মেজাজে জবাব দেয়,’তোর সমস্যা কি আমার মাথায় হেলমেট থাকলে?তুই তোর রিকশা চালা।আমার মাথায় আমি হিলটন টাওয়ার নিয়ে ঘুরলেও তোর সমস্যা কি?’
পাশে থাকা মেয়েটা তৎক্ষনাৎ তার হাত চেপে ধরে।চোখ পাকিয়ে ইশারায় বোঝায় এসব কথা বলা একদমই অনুচিত।সে কিছুটা শান্ত হয়,তবে বিরক্তিতে কুঁচকে ফেলা ললাট আর মসৃণ হয় না।কিছুক্ষণ এদিক সেদিক দেখে সে অবশেষে আলতো হাতে মেয়েটির একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।রোগা পাতলা গড়নের মেয়ে মানুষটি মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকায়।এই অতিমাত্রায় নিরীহ মেয়েটির প্রতি তার এক আকাশ মায়া।সে একদমই পারে না তাকে এড়িয়ে যেতে।তার ভালো লাগা,মন্দ লাগা সবকিছু নিয়ে তার মাথাব্যথা আছে।
আরহাম আর কথা বাড়াল না।তার শিরা উপশিরার ছুটতে থাকা রক্ত সামান্য একটু প্রশান্তির খোঁজে ব্যস্ত।যেই মেয়েটা কাছে এলো,ওমনি তার চটে যাওয়া মেজাজ শান্ত হলো।মাঝে মাঝে সে নিজেকেই বুঝে উঠতে পারে না।এই যে আজকে সে সমস্ত ব্যস্ততা কে একপাশে সরিয়ে এই মেয়েটির মন ভালো করার নিমিত্তে এমন ছুটে এসেছে তার কাছে।নিজের পরিচয় গোপন করতে তাকে সারাক্ষণ মাথার উপর এই ভারি হেলমেট পরে থাকতে হয়।অথচ তার কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে এই মেয়েটির ভালো থাকা,তার খুশি থাকা।প্রিয়তম’র সাথে একান্তে রিকশা ভ্রমণ তার ভীষণ পছন্দ।শুধুমাত্র তার পছন্দ বলেই প্রিয়তম দুইদিন পর পর তাকে নিয়ে এভাবে ঘুরতে বের হয়।
রবীন্দ্র সরোবরের সামনে এসে রিকশার চাকা থামল।আরহাম এক লাফে রিকশা থেকে নেমে ভাড়ার ঝামেলা মেটাল।নবনীতা নেমেই চোখ বুলিয়ে চারপাশ দেখল।কি সুন্দর মনোরম পরিবেশ!তাদেরই মতোন কপোত-কপোতীরা হাতে হাত রেখে হাঁটাহাঁটি করছে।কেউ আবার পাশাপাশি বসে গল্প করছে নিজেদের মতো।হঠাৎই তার চোখ গিয়ে থামে একেবারে উত্তর দিকের একটা সিঁড়িতে।দেখতে পায় চঞ্চল চপলা মেয়েটি আইসক্রিম খেতে খেতে একহাত নেড়ে অনর্গল কারো সাথে কথা বলে যাচ্ছে।নবনীতার কপালে ভাঁজ পড়ে।সে একহাতে আরহামের শার্ট টেনে কুঁচকানো মুখে প্রশ্ন করে,’এটা রিমি না আরহাম?’
আরহাম তার দৃষ্টি অনুসরন করে সামনে দেখল।দেখেই চওড়া গলায় বলল,’আরে আরে তাই তো।সাথে কে?ওয়াজিদ নাকি?’
___
বিয়ের আগে রিমি প্রায়ই নবনীতার সাথে রবীন্দ্র সরোবরে এসে গল্প করত।বিয়ের পর পুরো জীবনের রুটিনই পাল্টে গেছে।এই জীবনটাও অবশ্য রিমির খারাপ লাগে না।স্বামী সংসার সবকিছুই তার ভালো লাগে।ওয়াজিদ আজ বাড়ি ফিরে বলছিল সে আর রিমি কোথাও ঘন্টা দুয়েকের জন্য ঘুরতে গেলে ভালো হয়।ঢাকায় ঘুরাঘুরির জায়গার অভাব নাই।কিন্তু কয়েক ঘন্টায় ঘুরে আবার বাড়ি ফেরা যায়,এমন জায়গা আছে হাতে গোনা।হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান,নয়তো রমনা,নয়তো রবীন্দ্র সরোবর,চাইলে আবার ধানমন্ডি লেক।রিমি এদের মধ্যে রবীন্দ্র সরোবরই বেছে নিল।এখানে আসার পর তার মুখ আর বন্ধ নেই।একটার পর একটা খাবার খেয়েই যাচ্ছে।ওয়াজিদ মাথা নামিয়ে ফোন স্ক্রল করছে।রিমির সাথে ঘুরতে তার ভালোই লাগে।কিন্তু চারপাশে এতো মানুষের মাঝে তার কিছুটা অস্বস্তি হয়।সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক সংঘটনের সদস্য।ছাত্ররা প্রায় সবাই তাকে চেনে।বড় ভাই বউ নিয়ে রবীন্দ্র সরোবরে ঘুরাঘুরি করছে,এ বড় লজ্জার ব্যাপার।ওয়াজিদের অন্তত তাই মনে হয়।
আচমকা তাদের সম্মুখে একজন যুবক এসে দাঁড়াল।ওয়াজিদ চমকে মাথা তুলে তার মুখ দেখার চেষ্টা করে।সে মাথা তুলতেই ছেলেটা দুষ্টু হেসে বলল,’কিরে?কল দিলে ধরিস না কেন?সারাদিন বউ নিয়ে পড়ে থাকলে হবে?আমাদের কথাও তো ভাবতে হবে ব্রো।’
ওয়াজিদ থমথমে মুখে সামনে দেখে।সামনের যুবকটা কথা শেষ করতেই সে বরফ শীতল কন্ঠে জবাব দেয়,’তোর কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করছি না।যা এখান থেকে।’
‘যাবো মানে?আমার বন্ধুর কাছ থেকে আমি কেন যাব?’
বলেই সে একদম তার পাশ ঘেঁষে বসল।রিমি তার উপস্থিতি দেখতে পেয়েই সরে এলো।দ্রুত ডানে বামে দেখে অন্য কাউকে খোঁজার চেষ্টা করল।সে খুঁজে পাওয়ার আগেই নবনীতা কোথা থেকে ছুটে এসে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল।দীর্ঘদিন পর নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর জোরাল আলিঙ্গনে রিমি শব্দ করে হেসে ফেলল।খুশিতে তার চোখ ভরে গেছে।সে বিনিময়ে তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,’অনেক মিস করি তোকে।কোথায় থাকিস সারাদিন?ফোনটাও তো ধরিস না ঠিক মতো।’
‘আরশাদের জ্বর,তাসনুভার ঠান্ডা কাশি,আমার নিজের শরীর খারাপ।সব মিলিয়ে খুবই বাজে অবস্থায় আছি।একটু আগেও বমি করে বেসিন ভাসিয়েছি।শরীরটা এত্তো খারাপ লাগে! ভাবছি কালই ডাক্তার দেখাবো।’
রিমি আর নবনীতা আরো আধঘন্টার মতো নিজেরা নিজেরা কথা বলল।কতোগুলো দিন পর তাদের দেখা হয়েছে।জীবন কতো গতিময়! কতো দ্রুত সবকিছু পাল্টে যায়।রোজ রোজ যেই মুখ গুলোর সাথে আমাদের দেখা হতো,গ্র্যাজুয়েশনের পর সংসারের জালে জড়িয়ে গেলে সেভাবে আর ঘন ঘন দেখা করা সম্ভব হয় না।রিমিদেরও আর রোজ রোজ দেখা হয় না।অথচ একটু দেখা হতেই মনে হয় এভাবেই অহেতুক কথা বলে সারাজীবন কাটিয়ে দিলে মন্দ হয় না।
__
আরহাম আনমনে উদাসীন চোখে সামনে দেখে নিজ থেকে প্রশ্ন করে,’ভাই! তুই আমার উপর এখনো রাগ?’
ওয়াজিদের দৃষ্টি নত,চোখের ভাষা অস্পষ্ট।আরহামের কথার প্রেক্ষিতে তার মুখোভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।সে আগের মতোই নির্লিপ্ত,শান্ত।
আরহাম তার হাত ঝাকায়।ওয়াজিদ সেভাবেই মাথা নামানো অবস্থায় জবাব দেয়,’না,রাগ না।’
‘তাহলে আমার ফোন ধরিস না কেন?পার্টি অফিসে আসিস না কেন?’
‘ব্যস্ত থাকি।কাজ থাকে,তাই আসতে পারি না।’
‘মিথ্যা বলিস কেন?তুই আমার সাথে রাগ।’
ওয়াজিদ একট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার চোখের দিকে তাকালো।মুখে কোনোরকমে একটা বিষন্ন হাসি ফুটিয়ে বলল,’তোর জীবন,তোর সবকিছু।আমি কেন তোর সাথে রাগ হবো?তুই বলেছিস তোর ব্যাপারে কথা কম বলতে।তাই আমি কথা কম বলি।’
আরহাম উত্তর শুনেই নাক ছিটকায়।ওয়াজিদের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বিরক্ত হয়ে বলে,’উফ মন থেকে বলি নি।মাথা ঠিক ছিল না আমার।’
‘এখন আর মাথা ঠিক করতে হবে না।সেভাবেই থাক।’
‘ওয়াজিদ!’
মৃদু হুংকারেও তার কোনো ভাবোদয় হলো না।এক ঝাড়ার নিজের কাঁধ ছাড়িয়ে নিয়ে সে রাগত স্বরে বলে,’বিরক্ত লাগে।যা তো।’
আরহাম কয়েক পল তাকে দেখে।তারপর হঠাৎই সবার সামনে এক ঝাপ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।ওয়াজিদ তার এহেন আচরণে হকচকিয়ে উঠে চেঁচায়,’আরে হচ্ছে টা কি?ছাড় বলছি।’
‘না ছাড়ব না।’
‘আরহাম!বিরক্ত লাগছে।’
‘লাগুক।’
‘সমস্যা কি তোর?কি চাস তুই?’ বিক্ষিপ্ত মেজাজে প্রশ্ন ছুড়ে ওয়াজিদ।
আরহাম তাকে জড়িয়ে ধরেই অস্পষ্ট আওয়াজে বলল,’তোকে চাই।তুই আমার সাথে কথা বল,আমাকে জ্ঞান দিস,আমার ভুল ধরিয়ে সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করিস ,সেটা চাই।’
ওয়াজিদ নিরুত্তর।কেবল ডান হাতটা তুলে হালকা করে আরহামের পিঠে রাখল।
‘ওয়াজিদ!’
‘কি?’
‘সরি ভাই।প্লিজ এভাবে ইগনোর করিস না।’
‘আচ্ছা করব না।আগে কসম কাট তুই ওমনভাবে আর আমার সাথে কথা বলবি না।’
‘আচ্ছা যা কসম।তাও একটু ভালো করে কথা বল আমার সাথে।প্লিজ ভাই।’
.
.
.
.
‘প্রভা,প্রভা! দাঁড়াও একটু।’
প্রভাতি ঘুরে দাঁড়ায়।অবিশ্বাস্য চোখে সামনে দেখে বলে,’নিলয়! তুমি?’
দু’জনের দুরত্ব যখন দুই হাতের মতো,তখন নিলয় অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল,’আমি আজ তোমার সাথেই যাবো।’
‘আর তোমার ক্লাস?তোমার ক্লাস তো আজ আরো এক ঘন্টা পর শেষ হওয়ার কথা।’
‘ক্লাস একটা মিস দিয়েছি।করব না ঐটা।’
প্রভাতি তীক্ষ্ণ চোখে একনজর তাকে দেখল।তারপরই ভাবলেশহীন হয়ে বলল,’আচ্ছা।চলো তাহলে।’
নিলয় ঘাম মুছতে মুছতে সামনের দিকে পা বাড়ায়।সে সাধারণত ক্লাস মিস দেয় না।আজ কেন দিয়েছে সে জানে না।যেই শুনেছে প্রভাতির শেষ ক্লাসটা ক্যানসেল হয়ে গেছে,ওমনি সে নিজেও তার শেষ ক্লাসটা করেনি।গত কিছুদিন যাবত সে প্রভাতির সাথেই বাসে করে বাড়ি ফিরে।আজ প্রভাতি চলে গেলে তার একা ফিরতে হতো।শুধুমাত্র সফরসঙ্গী হিসেবে প্রভাতিকে পাওয়ার অভিপ্রায়ে সে ক্লাস মিস দিয়েছে।আজকাল নিলয়ের একাকিত্ব ভালো লাগে না।মনে হয় প্রভাতি নামের ট্যাপ রেকর্ডার সারাক্ষণ কানের কাছে প্যাক প্যাক করলে ভালোই লাগে।কেমন একটা খুশি খুশি লাগে সবকিছু।
প্রভাতি সামনে হাঁটতে হাঁটতে জানতে চায়,’ঐ বান্দর গুলা তোমাকে আর জ্বালাতন করেছে?’
‘না,করেনি।শুধু তাকায়।কিন্তু কিছু বলে না।’
‘বলবেও না।ভাইয়াকে দিয়ে ওয়াশ দিয়েছি তো।এখন আর কিছু বলবেও না।’
‘তোমাকে ধন্যবাদ। আমার কথা এতোটা ভাবার জন্য।’
প্রভাতি ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখল।রোদে ঘেমে ঘেমে তার অবস্থা খারাপ।সে নিজের মাথায় থাকা ঘোমটা ঠিক করতে করতে উৎসাহী গলায় বলল,’এসির ঠান্ডা বাতাস খেতে চাও?’
নিলয় বিস্ময়ে নেত্রযুগল প্রসারিত করে।
‘খেতে তো চাই।কিন্তু কিভাবে কি?’
প্রভাতি ঠোঁট টিপে হাসল।হাসির মাঝেই বলল,’দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমায়।’
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটু দূরেই কয়েকটা ব্র্যান্ডেড দোকানের শো রুম ছিল।প্রভাতি নিলয় কে নিয়ে সেগুলোর একটাতে গেল।নিলয় চমকে উঠে বলল,’এতো দামি দোকানে এসেছ! এখানে তো প্রচুর দাম জিনিসের।’
‘তো?আমি কি কিনতে এসেছি?আমি এসেছি ফ্রি তে এসির বাতাস খেতে।আধঘন্টা কাপড়গুলো নেড়ে চেড়ে দেখব।তারপর নাক ছিটকে বেরিয়ে আসব,যেন দেখে মনে হয় কোনো কাপড়ই আমাদের পছন্দ হয়নি।আইডিয়া টা ভালো না?’
নিঃসংকোচে জবাব দিলো প্রভাতি।নিলয় গোল গোল চোখে তার দিকে তাকায়।বিস্ময়ে তার চোয়াল ঝুলে গেছে।সে হতভম্ব হয়ে বলল,’কি সাংঘাতিক! এসির বাতাস খাওয়ার জন্য এতো কিছু?’
‘হ্যাঁ তো কি হয়েছে?নিজের তো এসিতে থাকার মুরদ নেই।তাই বলে কি এসির বাতাস খাবো না?শোন নিলয়,আমি মনে করি আমাদের সারাদিন অভাব অনটনের কেচ্ছা না শুনিয়ে অভাবের মধ্যেও ভালো থাকার উপায় খুঁজে নেওয়া উচিত।আমি সবসময় সেটাই করি।ইচ্ছে থাকলে আর্থিক সমস্যাকে এক পাশে সরিয়েও জীবন উপভোগ করা যায়।হয়তো সেই জীবন বিলাশবহুল হয়না বড়লোকদের মতো।কিন্তু আনন্দবহুল যে হয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
.
.
.
.
সারাদিনের ক্লান্তি আর বিগড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে আরহাম বাড়ি ফিরল রাত দশটা পঞ্চাশের দিকে।এসেই সে কতোক্ষণ টানা গালমন্দ করল।কাকে গালমন্দ করছে সে নিজেও জানে না।
আজ তার মেজাজ ভয়াবহ রকমের খারাপ।সে কালকে আবির আর দ্বীপকে নিলয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ঝাড়ি মেরেছে।একদিকে নবনীতার মন খারাপ,অন্যদিকে ওয়াজিদের উপদেশ,সাথে প্রভাতির বিশ্বাস ভরসা,সবকিছুর কথা একসাথে চিন্তা করে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে তার ছেলেদের সে অল্প স্বল্প শাসনের মধ্যে রাখবে।এটা একদমই হয় না যে সে একজন সংসদ সদস্য হয়ে এভাবে এদের অন্যায়কে লাই দিবে।একটুখানি এথিকস তো থাকা উচিত।আর সে নেতা হয়ে ঐসব ছেলেদের এমন মেনে চলবে কেন?তার কি কোনো ক্ষমতা নেই?এখন থেকে সে আর এসব মুখ বুজে সহ্য করবে না।যেই বিশ্বাস আর আস্থা নিয়ে প্রভা তার কাছে এসেছিল,সেই আস্থার সে সামান্য হলেও মূল্য দিবে।
কিন্তু তার এই মূল্য দেওয়াটা সম্ভবত কারো ভালো লাগছে না।জালালুর রহমান আজ দুই ঘন্টা তাকে জ্ঞান দিলেন।সে যা করছে সেটা নাকি তার জন্য ভালো হচ্ছে না,ভবিষ্যতে তাকে পচতাতে হবে।কেবল একটা মেয়ের বিচারের প্রেক্ষিতে ঐ ছেলেদের কিছু বলা তার একদমই উচিত হয়নি।সে বোকামি করছে,সে অবুঝের মতো কাজ করছে আরো কতো কি।আরহাম অনেকক্ষণ তার অহেতুক বকবক সহ্য করেছে।তারপর বিরক্ত হয়ে সবকিছু ফেলে চলে এসেছে।বিরক্তিতে বারবার তার মুখ কুঁচকে যাচ্ছে।এতো মানুষের এতো কথা,এতো পরামর্শে তার মাথা ঘুরায়।একজন বলে এটা ঠিক,আরেকটা বলে ঐটা ঠিক,আরহামের মনে হয় এরা দু’জনই ভুল,কেবল সেই ঠিক।এতো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে সে চলবে কেমন করে?
এখন তার পরীকে প্রয়োজন।সে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ধপ করে পরীর কোলে মাথা রাখবে।আর পরী তার কোমল হাত দু’টো দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে।তখন এই সমস্ত দিনের ক্লান্তি,মন খারাপ এক নিমিষেই ভালো হয়ে যাবে।সে আর কোনোদিকে না দেখে সোজা নিজের ঘরের দিকে ছুটলো।
ঘরের দরজা খোলা।আরহাম ভেতরে ঢুকেই চারপাশ দেখে বলল,’সেনোরিটা! কোথায় তুমি?আরশাদ কোথায়?’
পুরো ঘর নিস্তব্ধ।কোনো শব্দ নেই,কারো কোনো বিকার নেই।আরহাম কিছুটা চমকায়।এমন তো হওয়ার কথা না।এই সময়ে তাসনুভা আদি সবাই তার ঘরেই থাকে।ঘর আজ এতে খালি কেন?
হঠাৎই তার চোখ যায় বেড বক্সের উপর।যেখানে একটা কাগজ ভাজ করে রাখা।কাগজের উপর একটা পেপার ওয়েট।আরহাম কপালে ভাঁজ ফেলে সেদিকে এগিয়ে যায়।অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কাগজটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খোলে।দেখতে পায় কাগজের লিখাগুলো সব নবনীতার হাতে লিখা।
প্রিয় আরহাম,
সালাম নিবেন। সাথে নিবেন এই ব্যর্থ স্ত্রীর ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় আপনার হৃদয়ের কিয়দংশও পরিবর্তন হয়নি।আমি আপনাকে দোষ দিচ্ছি না,নিজেই দোষী হচ্ছি।আমিই সম্ভবত আপনাকে কোনোদিন আমার দিকটা বোঝাতে পারি নি।আমিই কোনোদিন বোঝাতে পারি নি আমি আসলে কি চাই।আপনি আমার অনুভূতি,আমার যন্ত্রনা গুলোকে এমন ভাবে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন যেন আমি রাস্তার ধারে পড়ে থাকা কোনো অসহায় জীব,যার কেউ নেই,কোথাও কেউ নেই।এই জীবের থেকে ভালোবাসা নেওয়া যায়,কিন্তু বিনিময়ে ভালোবাসা দেওয়া যায় না।
আপনি হয়তো জানেন,হয়তো জানেন না,কিন্তু আজ বলছি আমার বাবা আমার জীবনের প্রথম পুরুষ যাকে আমি আমার হৃদয়ের সর্বোচ্চ দিয়ে ভালোবেসেছি।আমার বাবা আমার শত অসুস্থতায় কোনোদিন নাক ছিটকায় নি।বাবা আমার কাছে কোনো গ্রিক পুরাণের নায়কের চেয়ে কম কিছু না।আমার বাবা মায়ের মৃত্যু আমার কাছে কতোটা যন্ত্রনার সেটা যদি আপনি জানতেন তাহলে কোনোদিন সেটাকে পুরোনো কাসুন্দি বলে দায়মুক্ত হতে পারতেন না।যাই হোক,ব্যর্থতা আমার।আমি বোঝাতে অক্ষম।আপনি আমার কসম খেয়ে বলেছিলেন আপনি রহমানের সাথে কথা বলবেন না।কিন্তু আপনি সেই কসমের তোয়াজ করেন নি।আপনি রোজ তার সাথে কথা বলেছেন,এমনকি আপনাদের অফিশিয়াল পেইজে গতকাল তার সাথে আপনার ছবিও আপলোড করা হয়েছে।আমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আপনার কাছে এতো ফিকে আরহাম?আপনার এই আচরণটা আমার বুকে লেগেছে ভীষণ।মনে হচ্ছে কলিজায় কেউ ছুরি দিয়ে আঁচড় কেটেছে।আপনি আমার কসম কেটেও দিব্যি সেটা ভেঙে আরামে আয়েসে আছেন।
আমার আত্মসম্মান ফুরিয়ে যায়নি আরহাম।শুধু সংসারে যেন কোনো ঝামেলা না হয়,সেজন্য অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করি।কারণ আমি অশান্তি চাইছিলাম না।এতো গুলো বছর পরে একটা নিজের ঘর পেয়ে আমি সবকিছু এড়িয়ে কেবল একটা শান্তির জীবন চাইছিলাম,কিন্তু সেটা অবশ্যই নিজের আত্মসম্মান বিকিয়ে না।যাই হোক,আপনার জীবনে আপনি সুখে থাকুন,ভালো থাকুন।কয়টা দিন আমাকে একা থাকতে দিন।আরশাদকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছি।তার ঘ্যান ঘ্যানানি,আমার জ্ঞান কোনোটাই এখন আর আপনাকে শুনতে হবে না।আপনি আরামে থাকুন।আমাকে ঘুমে রেখে এখন আর কষ্ট করে বারান্দায় গিয়ে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে হবে না।নিজের ঘরে,নিজের খাটে শুয়েই গলা ছেড়ে চিৎকার করে কথা বলুন,কেউ কিছু বলবে না।আর পারছি না এসব সহ্য করতে।সহ্যশক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে দিন দিন,অনুভূতি সব কেমন ভোঁতা ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে।কিছুতেই কিছু ভালো লাগে না আর।নবনীতা শান্তি চায়,দু’দন্ড শান্তিতে বাঁচতে চায়।একটা সত্যিকারের ভালোবাসা চায় যে ভালোবাসা কখনোই তার নামে মিথ্যা কসম কাটবে না।আরহাম আপনি ভালো থাকুন।আপনার প্রতি অভিযোগ রাখিনি।সমস্ত দোষ আমার নিজের।আমি পুরোদস্তুর ব্যর্থ অর্ধাঙ্গিনী।যার স্পর্শে আপনি নিজের স্বরূপ ত্যাগ করতে পারেন নি।যাকগে,ভুল তো আমারই।এতো বেশি আশা করছি কেন?এখনের রাজনীতিতে ভালো বলে কিছু নেই,এটাও তো মানতে হবে নাকি?
শাহরিয়ার আরহামকে তার রাজনৈতিক জীবনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।সে যেন ক্ষমতার দাপটে সত্যকে মিথ্যা,মিথ্যাকে সত্য,সবকিছু করতে পারে।দোয়া থাকবে,নবনীতার মতো ফালতু,প্যাচিলা আর অকারণে ঝামেলা করা মেয়েটির সাথে যেন কখনোই আর তার দেখা না হয়।
ইতি,
সবসময় জ্ঞান দিয়ে আপনাকে বিরক্ত করা মেয়ে,
আপনার স্ত্রী যার মিথ্যা কসম কাটতে আপনি ওস্তাদ।
চলবে-
#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৫৫)[দ্বিতীয় অংশ]
গাছের মগডালে শালিক দু’টো পাশাপাশি বসা,নিজেদের মধ্যে খুনশুটিতে ব্যস্ত।আচ্ছা শালিকদেরও কি প্রেম হয়?তারাও কি ভালোবাসা বুঝে?তাদেরও কি অভিমান হয় নিজেদের মধ্যে?যেমনটা নবনীতা আর আরহামের হয়েছে।অভিমানের পর তারা কি সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যায়?নবনীতা যেমন করে নিজের সংসার ছেড়েছে?
নবনীতা জানালা থেকে চোখ সরায়।তার আর্দ্র চোখ অন্যমনস্ক হয়ে চিত্রাকে খুঁজে।সে সম্ভবত মামির কাছে।সে আর তাকে ডাকল না।থাকুক।ঐখানেই থাকুক।নবনীতার একা থাকতেই ভালো লাগে।কাল রাতে সে এখানে এসেছে।আসার পরেই নিজের ঘরে গিয়ে কয়েকঘন্টা টানা ঘুমিয়েছে।মন খারাপ থাকলে ঘুম বেশি হয়।এই কথা সে আগেও শুনেছে।এখন বিশ্বাসও করে।এই যে তার মন খারাপ,অথচ সে দিব্যি ঘুমুচ্ছে,খাচ্ছে,যা মন চায় করছে।তার এখন কোনোকিছুই আর আগ্রহ লাগে না।
কতোক্ষণ জানালার ধারে থেকে সে আবার নিজের খাটে গিয়ে বসে।চারপাশ দেখেই সে বিদ্রুপ করে হাসল।আরহামের সাথে তেজ দেখিয়ে আবার আরহামের মালিকানাধীন এপার্টমেন্টেই এসেছে।কি হাস্যকর ব্যাপার! সে আলগোছে চোখ মুছে।আরহাম একটা ফোনও দেয়নি কাল।চিঠি নিশ্চয়ই পড়েছে।পড়েও যখন কোনো ফোন দেয়নি,তার মানে নবনীতার থাকা না থাকায় তার কিছু যায় আসে না।যায় আসার কথাও না।তার জীবনে রাজনীতি আর জালাল আঙ্কেল থাকলেই চলবে।
পরী?পরী যদি মরে লাশও হয়ে যায় তাতে তার কি?
নবনীতা আস্তে করে পালঙ্কে নিজের পিঠ ঠেকায়।দুর্বল শরীরটা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।ইদানিং এতো খারাপ লাগে কেন সে জানে না।সারাদিন শরীর ভার ভার লাগে,মনে হয় শরীরের ভারে এক্ষুনি মাথা ঘুরিয়ে সে মেঝেতে পড়ে যাবে।
হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা হাতে তুলে সে রিমিকে কল দেয়।দুইবার ডায়াল হতেই কল রিসিভ হয়।
‘কিরে নবনী! তুই?এই সময়ে?সব ঠিক আছে তো?’
অন্য পাশের মেয়েটির কন্ঠে উৎকন্ঠা ভীষণ।নবনীতা মলিন হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’আছি রে বোন।ঠিকই আছি।তুই কি বেশি ব্যস্ত।বাড়ি আয় না একটু।’
‘কোথায়?ধানমন্ডি?’
‘হু?’
রিমি অন্যপাশ থেকে আর কিছু জানতে চাইল না।জিজ্ঞেস করল না কেন নবনীতা গুলশান থেকে এখানে এসেছে।নবনীতার মনে হলো মেয়েটা বিয়ের পর হঠাৎই ভীষণ বুঝদার হয়ে উঠেছে।হবে না কেন?তার বর অত্যন্ত ম্যাচিউর।ওমন সঙ্গ পেলে বুঝদার না হয়ে উপায় আছে?
নবনীতা কথা ঘুরায়।রিমির সংসার জীবনের প্রসঙ্গ টেনে আরো কিছুক্ষণ তার সাথে কথা বলে।রিমির সাথে কথা বললে তার শান্তি লাগে।সে যেই মনস্তাত্ত্বিক পীড়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে,সেখান থেকে তাকে বোঝা শুভি কিংবা চিত্রর পক্ষে সম্ভব না।একমাত্র রিমিই আছে যে নবনীতার মনের অবস্থা একটু হলেও বুঝতে পারবে।
কথার ফাঁকেই হঠাৎ নবনীতা মৃদু স্বরে চিৎকার করে ফোনটা কানের কাছ থেকে সরিয়ে একটু দূরে ছুড়ে মারে।তারপর একহাত মুখে চেপে বাথরুমে গিয়ে গলগল করে আরেকদফা বমি করে।বমি করার পর তার মনে হলো দুর্বলতায় তার সমস্ত শরীর ভেঙে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে চেতনা হারাবে।মুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা দিয়ে সে নিজেকে ধাতস্থ করে।বেসিনে ভর দিয়ে কতোক্ষণ শ্বাস টানে।তারপর ধীর পায়ে হেঁটে খাটে গিয়ে বসে।
ফোনের অন্যপাশ থেকে রিমির কন্ঠের জোর আরো বাড়ে।
‘এ্যাই নবনী! তোর কি হয়েছে?কোথায় তুই?কিছু তো বল।হ্যালো?’
‘রিমি!’ কাঁপতে থাকা হাতে ফোনটা কানে চাপে সে।
‘কি হয়েছে তোর?’
‘জানি না।আবার বমি হয়েছে।’
কিছুক্ষণ নিরবতা।হয়ত দু’জনই কিছু একটা অনুমান করেছে।কিছুক্ষণ পর নবনীতা নিজ থেকেই কাঁপা স্বরে বলে উঠল,’আমার এই মাসে মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল মিস গিয়েছে রিমি।এখন গুনে দেখলাম দুই সপ্তাহ আগেই ডেট চলে গেছে।’
তার কম্পমান কন্ঠ কানে যেতেই রিমি নড়েচড়ে উঠল।অতি ক্ষীণ স্বরে ফিসফিস করে বলল,’ভাইয়া জানে না কিছু তোর অসুস্থতা নিয়ে?’
‘জানত।তবে আমরা ভেবেছিলাম ফুড পয়সনিং।’
নবনীতা আবার কিছুক্ষণ টেনে টেনে শ্বাস নেয়।রিমি ব্যস্ত গলায় বলে,’দাঁড়া।আমি আধ ঘন্টার ভেতরই আসছি।তারপর সব বিস্তারিত শুনবো।’
‘রিমি!’
ফোনটা কাটতে গিয়েও আর কাটা হলো না।পুনরায় সেটা কানে চেপে রিমি বিচলিত হয়ে জানতে চায়,’কি?আর কিছু বলবি?’
‘আসার সময় একটা কিট কিনে আনতে পারবি?’ বুজে আসা চোখে থেমে থেমে জানতে চায় নবনীতা।
‘পারব,পারব।তুই রেস্ট কর।’
নবনীতা ফোন কাটে।তারপর কি একটা ভেবে নিজের পেট স্পর্শ করে।তার কেমন এলোমেলো লাগছে সবকিছু।অনুভূতি গুলো কি সত্যিই ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে?
‘মা।মা।’
সে পেছন ফিরে।আরশাদের বড় বড় চোখের দৃষ্টি চোখে পড়তেই দ্রুত হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে নেয়।আরশাদ তার কোলে আসতেই নিজেকে কি সুন্দর গুটিয়ে নিল,ঠিক যেমন করে নীড়ে ফেরা পাখির বুকে তার ছানারা আশ্রয় খুঁজে নেয়।তার বুকের ওম গায়ে লাগতেই আরশাদ খুশিতে গাল ভর্তি হাসে।নিজেকে নবনীতার মাঝে ঘাপটি মেরে বসিয়ে সে আধো আধো বুলিতে ডাকে,’মাম মা মা।আদল আদল।’
নবনীতা হাসল।চটপট তার সমস্ত মুখে চুমু খেয়ে জড়ানো গলায় বলল,’আরশুকেও অনেক অনেক আদল।’
.
.
.
.
নীল রঙা ওড়নার এক মাথায় টান পড়তেই প্রভাতি চকিতে পেছন ফিরে।পেছন ফিরতেই সে দেখল তার ওড়না একটা শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দি।সে চোখ তুলে।সামনে থাকা ছেলেটাকে দেখেই কিছুটা মুখ খিঁচে বলে,’আপনি?’
আবির তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।থমথমে মুখে প্রশ্ন করে,’তুমি নাকি আরহাম ভাইয়ের কাছে আমার নামে বিচার দিয়েছ?’
প্রভাতি চোখ পাকিয়ে তাকে দেখে।বিরক্তি জড়ানো কন্ঠে উত্তর দেয়,’জ্বী না।আমি আমার কথা বলেছি।কারো নামে কোনো বিচার দেই নি।’
‘অবশ্যই দিয়েছ।তোমার বিচারের প্রেক্ষিতেই এতো কিছু হয়েছে।তুমি কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ো?’
‘জানি না।’
তার কাটকাট জবাব আবিরের পছন্দ হলো না।সে দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে,’ঐ মেয়ে।কথা কানে যায় না?কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ো?’
প্রভাতি কটমট চোখে তার দিকে তাকায়।ত্যাড়া গলায় জবাব দেয়,’বলব না।বলতে বাধ্য না।পথ ছাড়ুন।’
আবিরের রক্ত গরম হলো।এই মেয়ের ঔদ্ধত্য আচরণ তাকে অবাক করে।সে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে শক্ত করে প্রভাতির ডান হাতের কবজি চেপে ধরে।প্রভাতি তার স্পর্শ পেতেই এক লাফে দুই পা পিছিয়ে আসে,নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে জোর গলায় চেঁচায়,’হাত ছাড়ুন।এগুলো কেমন অসভ্যতা?’
আবির দমল না।উল্টো রাগে আরো বেশি রক্তিম হয়ে জবাব দিলো,’অসভ্যতা এখনো করিনি।কিন্তু এখন করব।তোর একটা শিক্ষা পাওয়ার দরকার আছে।’
প্রভাতি গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।সে যতো জোরে নিজেকে টেনে আনতে চায়,আবিরের হাতের বন্ধন তত বেশি জোরাল হয়।
নিলয় নিজের ক্লাস শেষে বেরিয়ে এসে এই দৃশ্য দেখতেই থমকে গেল।ভয়ে,আতঙ্কে তার কন্ঠ শুকিয়ে কাঠ।সে শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজায়।তারপর মলিন চোখে চারপাশ দেখে।স্টুডেন্ট রা জায়গায় জায়গায় জড়ো হয়ে আবির আর প্রভাতির কার্যকলাপ দেখছে।অথচ কেউ এগিয়ে এসে কিছু বলার মতো সাহস দেখাচ্ছে না।নিলয় কিছুক্ষণ পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।যখন সে বুঝল সে বাদে আর প্রভাতিকে আবির হাত থেকে ছাড়ানোর মতো কেউ নেই,তখনই সে আর কোনো কিছু না ভেবে ছুটে যায় তাদের দিকে।গিয়েই হাঁপাতে হাঁপাতে খানিকটা অনুযোগ করে বলে,’আবির ভাই প্লিজ।প্রভাতি কে ছেড়ে দেন।মেয়ে মানুষ ভাই।ওকে কিছু করবেন না।মানুষ সব দেখছে।’
আবির হাত ছাড়ল না।উল্টো চোখ ঘুরিয়ে একনজর তাকে দেখল।তারপরই তাচ্ছিল্য করে বলল,’দেখুক।আমার কি?তুই সর টিউবলাইট।’
সে কথা শেষ করেই বাঁকা চোখে প্রভাতির দিকে তাকায়।তার চাহনিতেই প্রভাতির সমস্ত শরীর গুলিয়ে আসে।নিলয় ব্যথিত চোখে তার মুখটা দেখে।দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের ক্রোধ সংবরণ করে।
প্রভাতি যথাসম্ভব নিজেকে শক্ত রাখল।নিজের চাহনিতে একমুহূর্তের জন্যও দুর্বলতা প্রকাশ করল না।কিন্তু যখনই আবির এতো গুলো মানুষের সামনে অবলীলায় তার ওড়না টেনে ধরল,তখন অপমানে,লজ্জায় তার দুই চোখ ছল ছল করে উঠল।সে ভেজা চোখে নিলয়ের দিকে তাকায়।আশেপাশের মানুষের নির্লিপ্ত আচরণ তার ভেতরের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে।সে বুঝতে পারছে তাকে বাঁচানোর মতোন কেউ এখানে নেই।নিলয় সে চোখের ভাষা বুঝল।তার হঠাৎ কি হলো সে জানে না,ছুটে গিয়ে সে কষিয়ে আবিরের ডান গালে পর পর দু’টো চড় বসাল।
প্রভাতি শব্দ শুনেই আঁতকে উঠল।ভয়ার্ত,অবিশ্বাস্য চোখে সামনে দেখে আবিষ্কার করল এই দুঃসাহসিক কাজ নিলয়ই করেছে।সে ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকায়।ক্যাম্পাস ভর্তি ছেলে মেয়েদের নজর তাদের দিকে।কি সর্বনাশ! ঘটনা এতো দূর পর্যন্ত যাক,সে কখনোই চায়নি।
নিলয় চড় মেরেই সঙ্গে সঙ্গে দুই কদম পিছিয়ে আসে।তারপরই বড় বড় চোখে নিজের হাত দেখে,তারপর দেখে আবিরের গাল।সে এটা কি করেছে?তার কি মাথা খারাপ?এতোগুলো মানুষের সামনে সে আবির কে চড় মেরেছে।নিজের আচরণে সে নিজেই হকচকায়।কাঁপা হাতে নিজের ঘাম মুছে আবিরের দিকে তাকায়।মুহুর্ত গড়াতেই একটানে প্রভাতির ওড়না তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সুন্দর করে সেটা প্রভাতির গায়ের উপর চাপায়।তারপর আর কোনোদিক না ভেবে,কোনোকিছু না দেখে খপ করে প্রভাতির একটা হাত চেপে ধরে দ্রুত সেখান থেকে সরে আসে।
সবার দৃষ্টির আড়াল হতেই নিলয় টেনে টেনে দুইবার শ্বাস নেয়।বুকের বা পাশে হাত রেখে নিজের হৃদস্পন্দন বোঝার চেষ্টা করে।হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,’বুকটা ফেটে যাবে মনে হচ্ছে।’
প্রভাতি তখনো সংকোচে,দ্বিধায় আড়ষ্ট।সে কেবল মাথা তুলে বলল,’এই কাজ কেন করলে?এখন তো তুমি আরো বেশি কালার হবে।’
‘হোক।আর কোনো উপায় ছিল আমার?দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখতাম?অসভ্যতা করছিল সবার সামনে।কি করার ছিল আমার?’
‘আমার সাথে অসভ্যতা করছিল।তুমি কেন গেলে?’
নিলয় চোখ মুখ শক্ত করে তাকে দেখল।চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’র্যাগ তো আমায় দিচ্ছিল।তুমি তোমার ভাইয়ের কাছে বিচার দিলে কেন?’
প্রভাতি চুপচাপ তাকে দেখে।নিরুত্তর হয়ে একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।অজানা আতঙ্কে তার ভেতর দুর দুর করছে।এতো গুলো মানুষের সামনে নিলয় আবিরকে চড় মেরেছে।আবির কি তাকে ছেড়ে দিবে?না,কখনো না।
***
তরুণী মেয়েটির মস্তক নোয়ানো।দৃষ্টি অস্থির,বারবার এখানে সেখানে ছুটে যাচ্ছে।চোখ দু’টো ভেজা।যতোবারই মুছে নিচ্ছে ততবারই আবার ভিজে যাচ্ছে।তার চোখ ঘুরে ফিরে তার কোলের উপর থাকা বস্তুর দিকে গিয়ে থামছে।
জ্বল জ্বল করতে থাকা দু’টো লাল দাগ।এটা কিসের প্রতীক?নবনীতার নতুন জীবনের?নবনীতার দাম্পত্যের?নাকি নবনীতার নারী হিসেবে পূর্ণতার?সে একমনে দাগ দু’টো দেখে,দেখতেই থাকে।
রিমি তার পাশাপাশি বসা।মাথা নুয়িয়ে সে নিজেও কিটটা দেখে।একহাত নবনীতার কাঁধে রেখে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে বলে,’নবনী! টেস্ট পজিটিভ এসেছে।তুই সত্যিই প্রেগন্যান্ট।আল্লাহ! কি আনন্দ হচ্ছে আমার।’
সে কথা শেষ করেই পাশ ফিরে।লক্ষ্য করে মেয়েটা অন্যদিনের তুলনায় আজ আরো বেশি শান্ত।চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ে তার কোল ভিজে যাচ্ছে,অথচ মুখ ফুটে সে এখনো কিছু বলে নি।রিমির কেমন অদ্ভুত লাগল।বাচ্চা পাগল মেয়েটা নিজের জীবনের এতো বড় একটা বিষয় জেনে সেটা নিয়ে খুশি হচ্ছে না?এটাও কি সম্ভব?তার তো এই মুহূর্তে খুশিতে পাগল হওয়ার কথা।অথচ সে একেবারেই শান্ত,খুব বেশি নির্লিপ্ত!
রিমি সামান্য ঝুকে তার মুখ দেখে।কোমল কিন্তু স্পষ্ট আওয়াজে জানতে চায়,’নবনী! তুই ঠিক আছিস?এমন চুপ মেরে বসে আছিস কেন?’
নবনীতা চোখ তুলল না।তবে আচমকাই কেমন ঠোঁট ভেঙে হু হু করে কেঁদে ফেলল।রিমি হতভম্ব হয়ে তার কান্না দেখে।নবনীতা এক নিমিষে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নার বেগ বাড়ায়।ক্রন্দনরত অবস্থাতেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,’রিমি।আমার তার কথা মনে পড়ছে খুব।উনি আমাকে তিন দিনে একবারো ফোন দেয়নি।মানুষ এমন কিভাবে হয় রিমি?এতোগুলো দিনের সংসার মানুষ এক নিমিষে কিভাবে ভুলে যায়?’
রিমি দুই হাতে তাকে সামলে নেয়।সে কি উত্তর দিবে?সম্পূর্ণ পারিবারিক আর ব্যক্তিগত বিষয়ে রিমির উত্তর দেওয়া কতোটা যুক্তিসঙ্গত?সে ঐসব কথায় যায় না।কেবল একটা হাত নবনীতার মাথায় ছোঁয়ায়।জড়ানো গলায় বলে,’কান্না করে না নবনী।তোর মতো বউ যে ধরে রাখতে পারেনি,তার মতো দুর্ভাগা এই দুনিয়াতে নেই।কান্না করিস না প্লিজ।তুই মা হচ্ছিস।একটু তো খুশি হ।’
নবনীতা তার হাতের বন্ধন আরো জোরাল করল।নাক টানতে টানতে নিজের ক্লান্ত মাথাটা রিমির কাঁধে ফেলে বলল,’খুশি হতে পারছি না রিমি।মানুষ এমন দায়সারা কীভাবে হয়?আমি চলে এলাম।সেও আমায় ফেলে দিলো।ব্যাস,আমাদের সব কথা ফুরিয়ে গেল?সব বোঝাপড়া শেষ আমাদের?আমি পাশে না থাকলে নাকি তার রাতে ঘুম হয় না।তাহলে এই সাতদিন কি সে জেগে ছিল একটানা?’
তার শেষ কথাটা শুনেই রিমি খিলখিল করে হেসে ফেলল।একটা হাত পেটে চেপে বলল,’সিরিয়াসলি নবনী! তুই এসব বাচ্চাদের মতো আচরণ করছিস?এগুলো কেমন বাচ্চামো শুনি।তুই নিজেই তো ছেড়ে এলি।’
‘তো?ছেড়ে এলাম আর সে ছেড়ে দিলো?একবার আসবে না?এসে কথা বলবে না?ছেড়ে এসেছি মন খারাপ করে।সে এমন ভাব করছে যেন আমরা সেপারেশনে চলে গেছি।’
রিমি পড়েছে মহা বিপাকে।কথায় আছে,মেয়েদের বুক ফাটে,কিন্তু মুখ ফুটে না।নবনীতার হয়েছে এই দশা।বরের জন্য বুক ফেটে যাচ্ছে,অথচ মুখ ফুটে কিছু বলতে তার ঘোর আপত্তি।সে কথা না বাড়িয়ে নবনীতার মাথায় হাত বুলায়।মেয়েটা কনসিভ করেছে।এই সময় তো এমনিতেই মন খারাপ থাকে।তার উপর আবার মান অভিমানের পালা তো চলছেই।নবনীতা হঠাৎই তার কাঁধ থেকে মাথা সরিয়ে বাথরুমের দিকে ছুটে যায়।রিমিও উৎকন্ঠায় অস্থির হয়ে তার পিছু পিছু ছুটে।দুই হাতে তার ভঙ্গুর শরীরটা আগলে ধরে ব্যস্ত হয়ে বলে,’নবনী! নবনী! তুই ঠিক আছিস?ডাক্তারের কাছে যাবি?’
.
.
.
.
নবনীতার জীবন হুট করেই কেমন ছন্নছাড়া হলো।কোনোকিছুতেই যেন আর আগ্রহ খুঁজে পায় না সে।চিত্র,শুভি,আরশাদ সবকিছুই ফিকে লাগে।মনে হয় জীবনের সিংহভাগ আনন্দই যেন গায়েব হয়ে যাচ্ছে।একটা মানুষ,তার একটা ফোনকল,তার একটু সুন্দর কথার অপেক্ষা কি কেউ এতো আকুল হয়ে করতে পারে?নবনীতা করছে।প্রতিটা মুহূর্তে,প্রতিটা সময়ে সে যন্ত্রনায় ছটফট করছে।এতো অচেনা মানুষ কেমন করে হয়।তার কি একবারও নবনীতার কথা মনে হয় না?একটা বারও এসে দেখল না নবনীতা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে?মানুষ এতো অদ্ভুত কেন?আমাদের ভালোবাসার মানুষরা এতো পাষাণ হয় কেন?
দুপুর গড়াতেই মিসেস রোকেয়া ভাতের প্লেট হাতে তার ঘরে এলেন।এই তিন বোনকে আজকাল তার আদর লাগে।বিশেষ করে চিত্র কে।মেয়েটা তাকে এত্তো ভালোবাসে! মিসেস রোকেয়া ভেবেই পান না তার মাঝে কি এমন আছে যার জন্য চিত্র তাকে এতোখানি পছন্দ করে।প্রথা তার সাথে একটু বোয়াদবি করলেই চিত্রা ক্ষেপাটে গলায় তার বিরোধিতা করে।মিসেস রোকেয়ার জন্য এতো টান কখনো কেউ দেখিয়েছে বলে তার মনে পড়ে না।তিন বোনকে ইদানিং তার মন্দ লাগে না।বরং এরা বাড়িতে থাকলে তার ভালোই লাগে।
তিনি চুপচাপ হেঁটে নবনীতার পাশাপাশি বসলেন।নবনীতা তাকে দেখেই একটু নড়েচড়ে উঠে।কিছু বলতে গিয়ে সে টের পায় তার কন্ঠ জমে গেছে।একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে সে ধিমি আওয়াজে বলল,’মামি,খাবো না আমি।খিদে নেই আমার।’
‘খেতে হবে।এই অবস্থায় একটু বেশি বেশি খেতে হয় পরী।’
চকিতে চোখ তুলে সে।স্তব্ধ হয়ে বলে,’মামি তুমি জানো?’
‘হুম,জানি।দুই দিন দেখেই বুঝেছি।এখন এসব ছাড়ো।এই নাও,মামি খাইয়ে দিচ্ছি।এই অবস্থায় একটু মন খারাপ হয়ই।এসব মন খারাপ এক পাশে সরিয়ে খেয়ে নাও।’
নবনীতা ভেজা চোখে তাকে দেখে।মাথা নিচু করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আচমকাই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয়।মিসেস রোকেয়া ভড়কে গেলেন।পরী কাঁদছে,তাও একেবারে প্রকাশ্যে।এমনটা আগে কখনো হয়নি।এতো দুর্বল মেয়ে সে কখনোই ছিল না।নিজের আবেগ অনুভূতি সে বেশ ভালোই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।অথচ মিসেস রোকেয়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন অত্যন্ত মজবুত চিত্তের অধিকারী মেয়েটা দিন দিন ক্রমশ ভেঙে পড়ছে,সে দুর্বল হচ্ছে ভীষণ।কার জন্য?নিজের স্বামীর জন্য?ফেলে আসা সংসারের জন্য?এই দুর্বলতা ভালো নাকি খারাপ তিনি জানেন না।কিন্তু এই দুর্বলতা পরীকে ভোগাবে,ভীষণ ভোগাবে।তাতে কোনো সন্দেহ নেই।মেয়েদের বেশি ভালোবাসতে নেই।বেশি ভালোবাসলে মেয়েরা একসময় নিজেদেরই হারিয়ে ফেলে।নবনীতা হারাচ্ছে।প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মেয়েটা সংসারের জালে জড়িয়ে নিজেকে হারাচ্ছে।মা হওয়ার খবর কানে আসতেই সে যেন আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে।মিসেস রোকেয়া কোনোরকমে তাকে কয়েক লোকমা খাইয়ে উঠে এলেন।যাওয়ার আগে একবার পেছন ফিরে দেখলেন মেয়েটার একহাত তার পেটে।চোখ দু’টো এখনো ভেজা।সে মা হচ্ছে।কি স্বচ্ছ আর চমৎকার সে অনুভূতি!তার গাঢ় বাদামি চোখ দু’টো একটু পর পর তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষের অনুপস্থিতি টের পেয়ে কেমন মলিন আর ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।আচ্ছা সে যেমন করে ঐ ছেলেটাকে ভালোবাসে,ছেলেটা কি কখনো তাকে তেমন করে ভালোবেসেছিল?ভালোবাসায় কেন কখনো দু’জনেই সমান সমান থাকা যায় না?কেন সবসময় একজন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি জড়িয়ে যায় সবকিছুতে?প্রেম হয় দু’জনের।অথচ যন্ত্রনা গুলো জমা হয় একজনের ঝুলিতে।
__
সেই রাতে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো।রাত এগারোটার দিকে ধানমন্ডির ছিমছাম এপার্টমেন্টে ছুটে এলো একটা ক্লান্ত,ভঙ্গুর শরীর।শুভ্রা দরজা খুলে তাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি মুখে বলল,’ভাইয়া তুমি?’
সে দুই কদম এগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।বরফ শীতল কন্ঠে জানতে চায়,’পরী কোথায়?’
‘আছে।রুমেই আছে।’
সে আর কথা না বাড়িয়ে সোজা তার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
নবনীতা আরশাদকে ঘুম পাড়িয়ে পুরো ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা খেলনা গুলো নিজের হাতে নেয়।দরজার কাছে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই সে সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ায়।দেখতে পায় একটা ছায়া খুবই সাবধানী পা ফেলে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।নবনীতা থমকায়।দু’জনের চোখাচোখি হতেই তার সমস্ত শরীর অবস হয়ে আসে,দুই চোখ ছাপিয়ে নোনা জল নেমে আসে গাল পর্যন্ত।
আরহাম রুমে প্রবেশ করা মাত্রই পেছন না ফিরে আন্দাজে দরজা বন্ধ করে।তারপর ধীর পায়ে হেঁটে নবনীতার মুখোমুখি দাঁড়ায়।বহুদিন নিজের রাগ ধরে রেখেছে সে।রাগ ধরে নিজেই নিজের সাথে জুলুম করেছে।প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত নিজের সাথে সংগ্রাম করার পর অবশেষে আরহাম নিজের পরাজয় স্বীকার করেছে।মেনে নিয়েছে পরীকে ছাড়া তার পক্ষে এভাবে চলা সম্ভব না।তার পরীকে প্রয়োজন,ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন।
কথা না বাড়িয়ে একটানে নবনীতাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল সে।জোরাল আলিঙ্গনে নবনীতাকে চেপে একেবারে বক্ষপিঞ্জরের মাঝে ঠাই দিলো,এতো শক্ত সে বন্ধন যেন ছেড়ে দিলেই নবনীতা পালিয়ে যাবে।
নবনীতা প্রথম এক মিনিট জড় পদার্থের মতো অনুভূতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।তারপর হুশ ফিরতেই নিজ থেকে দুই হাতে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।
‘আই মিসড ইউ পরী।আজ না আসলে দম বন্ধ হয়ে মরেই যেতাম।সরি! সরি পরী।এই কয়দিনের জন্য ভীষণ সরি।তুমি প্লিজ আর মন খারাপ করে থেকো না।’
সে কথা শেষ হতেই নবনীতার সমস্ত মুখে চুমু খায়।এতো বেশি চুমু যে নবনীতা ঠিক গুনে শেষ করতে পারল না।আদরে আদরে তার চোখ,গাল সবকিছু ভিজে উঠল।তার ভেজা চোখ আরো বেশি পানিতে টইটম্বুর হয়।পুরুষালি হাত জোড়া তাকে কাছে পেয়েই আরো বেশি লাগামছাড়া হয়।দীর্ঘদিনের বিরহ বিচ্ছেদ,তারপর হঠাৎই দু’জনের সাক্ষাৎ।প্রিয় নারীর স্পর্শ পেতেই আরহামের তপ্ত মরুর ন্যায় বক্ষপিঞ্জর ছটফটিয়ে উঠে।সে মন ভরে চুমু খায়।অথচ তার মনের অস্থিরতা দূর হয় না।সে একবার আড়চোখে আরশাদকে দেখে।তারপর আবার ডুব দেয় নবনীতার অধরের মাঝে,গলার ভাঁজে।তার ঘনিষ্ঠতা টের পেতেই নবনীতা ধড়ফড়িয়ে উঠে।সে যখন চূড়ান্ত রকমের লাগামছাড়া,তখনই তার শক্তপোক্ত শরীরের ভারে নুয়ে পড়া রমণী তার ঠোঁটে একহাত চেপে ছটফট করে বলে উঠল,’আ-আরহাম থামুন।আমি প্রেগন্যান্ট।’
চলবে-