#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
অন্তিম পর্ব
[প্রথম অংশ]
আজ তাসনুভার বিয়ে।বেশ আড়ম্বরের সাথে হই হুল্লোড় আর জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে তার বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হতে যাচ্ছে।বিয়ে পড়ানোর সময় নির্ধারণ করা হয়েছে আসরের ওয়াক্তের একটু পরে।
আদির পরিবার বলতে তার মা আর বাবা।তারা দেশে আসার পরেই নামকরা একটা রিসোর্টে বুকিং দিয়েছিলেন।আপাতত তিনজনের অবস্থান সেখানেই।বিয়ে নিয়ে সবার উৎসাহ উদ্দীপনার কমতি নেই,অথচ আদির অবস্থা সকাল থেকেই নাজেহাল।কিভাবে কি পরবে,প্রথমে কি করবে,সবকিছু কিভাবে সামলাবে এই নিয়ে তার চিন্তার শেষ নাই।তারা তিন বন্ধু পরিকল্পনা করেছিলো আদির বিয়েতে আরহাম আর ওয়াজিদই সব সামলাবে।অথচ ঘটনা এখন এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো যে আদির বিয়েতে তাদের দু’জনের কারো কাছেই অতো সময় নেই যে তারা আদিকে নিয়ে মাথা ঘামাবে।আরহাম নিজের বোনের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত।আর ওয়াজিদ ব্যস্ত ঐ বাড়ির সবকিছু নিয়ে।
আদির মেজাজ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে খারাপ হলো।সাথে মেজাজও বিগড়ালো কিছুটা।সবাই তাকে এমন অবহেলা করছে কেন?সব লেমলাইট তাসনুভার দিকে।আর তার দিকে কেউ তাকাচ্ছে পর্যন্ত না।
রাজিয়া তার ঘরে এসে তার বিরক্তি ধরা মুখটা দেখে বললেন,’কি হলো তোমার?এমন চেহারা বানিয়ে রেখেছো কেন?’
আদি চেহারা ঠিক করলো না।উল্টো আরো বেশি বিরক্ত হয়ে বলল,’আজকে আমার বিয়ে।অথচ একটা মানুষ আমার খোঁজ নিচ্ছে না।আমার রাগ হচ্ছে ভীষণ।’
রাজিয়া বললেন,’আহা! ওরা তো ঐ বাড়িতে ব্যস্ত।তোমাকে সময় দিবে কিভাবে বলো?’
‘একটা ফোনও বুঝি করা যায় না?’
হোটেলের একজন স্টাফ দরজায় একে নক করলো।জানালো কয়েকজন নাকি তার সাথে দেখা করার জন্য এসেছে।তারা সবাই লবিতে অপেক্ষা করছে।
রাজিয়া কিছু একটা চিন্তা করতে করতে বললেন,’তাসনুভার জন্য যে রিং অর্ডার করেছিলাম,সেটার ডেলিভারি দিতে এলো নাকি?’
আদি বিরক্ত হয়ে বলল,’রিং দিতে কয়েকজন আসবে?দাঁড়াও দেখে আসি।’
অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে আদি লবির দিকে এগিয়ে গেল।লবিতে পা রাখতেই তার চক্ষু চড়াক গাছ।ওয়াজিদ,রিমি,ওয়াসিফ,বিভা,ইজমা,ইফাজ আর শাহাদাত এসেছে।আদি তাদের দেখতেই চমকে উঠল।কতোক্ষণ হা হয়ে থেকে বলল,’তোরা?’
রিমি দাঁত বের করে বলল,’সারপ্রাইজ!!!’
আদি দ্রুত পায়ে তাদের দিকে এগিয়ে যায়।রিমি উৎসুক গলায় বলল,’আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি,আমরা বরযাত্রী হবো।তাই সব সেজেগুজে এখানে চলে এলাম।কেমন হয়েছে আমাদের আইডিয়া?’
আদি হতভম্ব চোখে কতোক্ষণ তাদের দিকে তাকায়।শেষে আনন্দিত হয়ে বলল,’দারুন আইডিয়া।ভীষণ মিস করছিলাম তোমাদের।একা একা লাগছিলো অনেক।’
ওয়াজিদ লবিতে থাকা একটা সোফাতে বসে পায়ের উপর পা তুলতে তুলতে বলল,’আমরা সবাই রেডি হয়ে এসেছি।তোর এই অবস্থা কেন?যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।’
আদি তক্ষুনি এক প্রকার লাফাতে লাফাতে ভেতরে চলে গেল।রিমি ওয়াসিফকে কোলে নিয়ে ওয়াজিদের কাছে এসে বলল,’একে ধরুন।আর পারছি না।বাপরে! এতো ভারি কেন?’
ওয়াজিদ চোখ পাকালো,
‘তোমার এধরনের কথা না বললে হয় না?দেখোই তো বাচ্চাটা কতো অসুস্থ থাকে।তুমি আবার ভারি ভারি করছো।চুপ থাকো।নিতে হবে না তোমার কোলে।’
বলেই সে ছোঁ মেরে ওয়াসিফ কে নিজের কোলে নিল।রিমি হাঁফ ছেড়ে বলল,’বাপরে! বাঁচা গেল।’
***
ইজমার দৃষ্টি ইফাজের দিকে যে কিনা করিমুল সাহেব সামনে আসার পরেই কিসমিসের মতো চুপসে গেছে।তারা লবিতে এতোটা সময় বেশ স্বাভাবিক ছিলো।যেই না করিম সাহেব সেখানে পা রেখেছেন,ওমনি ইফাজ নিজেকে লজ্জাবতী গাছের মতো গুটিয়ে নিল।এই ভদ্রলোকের চাহনি তার ভয় লাগে।মনে হয় একা পেলেই তিনি ইফাজকে কাঁচা গিলে ফেলবেন তার মেয়ের মন চুরির অপরাধে।ইফাজের অনুমান লোকটা তাকে ঠিক পছন্দ করে না।কেবল ভদ্রতার খাতিরে মুখের উপর কিছু বলে না এই যা।
ইজমা আজ মেজেন্টা রঙের শাড়ি পরেছে।ইফাজ পরেছে সাদা শার্ট।ইজমা অনেক বলার পরেও সে পাঞ্জাবি পরেনি।তার নাকি অস্বস্তি হয়।কি অদ্ভুত কথা! ঐ বাড়িতে যাওয়ার নাম নিলেই তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়।তার সমস্ত অস্বস্তি কেবল ঐ বাড়িতে যাওয়ার নাম নিলেই শুরু হয়।এক ঘন্টা জোর জবরদস্তির পর ইজমা তাকে মানাতে সক্ষম হয়েছে।
রাজিয়া আর ইফতেখার সাহেব লবিতে আসতেই ওয়াজিদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।কিছুটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,’আঙ্কেল-আন্টি! আপনারা রেডি?’
রাজিয়া শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে চোখ না তুলেই বললেন,’হ্যাঁ বাবা।ড্রাইভার কে ফোন দিয়ে বলো পার্কিং থেকে গাড়ি বের করতে।’
আদি আসলো সবার পরে,গায়ে একটা সুন্দর কালো পাঞ্জাবি জড়িয়ে।তার পাঞ্জাবিটা ভীষণ সাদামাটা।তাকে একদম ফর্মাল দেখাচ্ছে।ওয়াজিদ তাকে আগাগোড়া দেখে মুখ কুঁচকে বলল,’তুই যে আজ বিয়ে করতে যাচ্ছিস,এটা তোর জামা দেখলে কেউ বুঝবে না।বেশিই সিম্পল লাগছে তোকে।’
আদি দায়সারা হয়ে জবাব দিলো,’লাগুক।আমার কোনো সমস্যা নেই।আমাকে ঐসব শেরওয়ানিতে মানায় না।আমি পাঞ্জাবিতেই ঠিক আছি।’
ওয়াজিদ আর কথা বাড়ালো না।এগিয়ে যেতে যেতে বলল,’আচ্ছা হয়েছে।এবার আয়।দু’টো বাজে অলরেডি।’
.
.
.
.
“বর এসেছে,বর এসেছে।”
বাড়ির লোকজন সব যার যার কাজে ব্যস্ত ছিলো।এমন সময় নিচ থেকে কারো চঞ্চল কন্ঠের চিৎকার কানে যেতেই সব নড়েচড়ে উঠল।সে কন্ঠটা আগের মতো সুরে আবারো বলল,’বরের গাড়ি চলে এসেছে।সবাই নিচে নামো।’
নবনীতা তখন তাসনুভার ঘরে বসা।তাসনুভাকে পার্লার থেকে এসে একজন সাজিয়ে দিচ্ছিলো।নবনীতার অপলক দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ।সে আজ গাঢ় লাল বেনারসি শাড়ি পরেছে।বিয়ের বউ যদি বেনারসিই না পরে,তবে সে আর কিসের বউ?
তাসনুভাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে।এই কথা সে মানতে নারাজ।কেউ তার একটু প্রশংসা করলেই সে লজ্জা পেয়ে বলছে,’ধুর,মিথ্যা কথা।তোমরা সবাই আমাকে খুশি করার জন্য মিথ্যা বলছো।’
নবনীতা পেছন থেকে বলল,’তোমাকে পরীর মতো লাগছে সোনা।আজকের দিনের জন্য তুমিই পরী।’
তাসনুভা লাজুক হাসল।লজ্জা পাওয়া মুখেই বলল,’আর বানিয়ে বানিয়ে কথা বলো না তো।আমি জানি আমায় ভুতের মতো লাগছে।’
আরহাম পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে ঘরের ভেতর এলো।এসেই কিছু বলতে যাচ্ছিলো।কিন্তু তাসনুভার দিকে তাকানোর পর তার আর কিছু বলতে ইচ্ছে হলো না।সে একমনে,এক দৃষ্টিতে কতোক্ষণ তাকে দেখে গেল।কি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে!
আরহাম এগিয়ে গেল।এগিয়ে যেতে যেতে অনুভব করল তার পা জোড়া কেমন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।পা না,পুরো শরীরই হঠাৎ কেমন দুর্বল হয়ে পড়েছে।
সে ভঙ্গুর পায়ে এগিয়ে গেল।হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে ডাকলো,’তাস! তুই বিয়ে করছিস?’
তাসনুভার টলমলে চোখ।আরহাম নিচে বসতেই সে তার একটা হাত লুফে নিয়ে বলল,’এখন আর করতে ইচ্ছে করছে না।আমি সারাজীবন তোমাদের ঘাড়ে বসে খেতে চাই।’
আরহাম কিঞ্চিৎ হাসল।একেবারেই নিষ্প্রাণ হাসি।জমে আসা কন্ঠে ধীরে ধীরে বলল,’খুব ভালো থাকিস তাস।তুই ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকবো।আমার আর আরিশের চোখে তুই সবসময়ই বাচ্চা।’
বলে সে আর অপেক্ষা করলো না।উঠে দাঁড়িয়ে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়া যে কতো যন্ত্রনার বিষয়,সেটা সে এর আগে কখনো উপলব্ধি করেনি।
নবনীতা ঘরে গিয়েই প্রথম আরশাদকে খুঁজল।সে নেই,থাকার কথাও না।কাল থেকেই সে ছুটোছুটি আর চিৎকার চেঁচামেচিতে ব্যস্ত।
আরহাম খাটের এক কোণায় থম মেরে বসেছিল।নবনীতা গিয়েই তার সামনাসামনি দাঁড়ালো।ভ্রু কুঁচকে বলল,’কি হলো আপনার?এক্ষুনি তাদের গাড়ি চলে আসবে আর আপনি এখনো এমন চুপ মেরে বসে আছেন।যান,তাড়াতাড়ি নিচে যান।’
আরহাম ক্লান্ত কন্ঠে উত্তর দিলো,’যাও তো পরী।ভালো লাগছে না আমার।’
নবনীতা অবাক হলো।হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে তার চোখ মুখ দেখতে দেখতে বলল,’আয়হায়! হলো কি?কি সর্বনাশ! ঐ দিকে বোন,আর এদিকে আপনি।এতো টান হলে বিয়ে দিচ্ছেন কেন?’
আরহাম কটমট চোখে তার দিকে তাকালো।নবনীতা সেসবের পরোয়া না করে বলল,’শুনেন জনাব,এটা সব মেয়ের জীবনেরই করুণ সত্যি।আমাকেও এমন শুভি আর চিত্রকে ছেড়েই এখানে আসতে হয়েছিল।আপনি কি আমাকে চিরকাল মামা মামির সাথে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন?’
আরহাম আড়চোখে তাকে দেখে বলল,’তোমাকে তোমার মামি থেকে বেশি ভালো আমি রেখেছি।যদি সেই কথা স্বীকার না করো,তবে তুমি একটা বেঈমান।’
নবনীতা ঠোঁট উল্টে বলল,’আরে বাবারে! তো মামি কবে আমার গলা চেপে ধরেছিল শুনি?’
আরহামের গায়ে কথাটা ভীষণ বাজে ভাবে লাগলো।মনে হলো পরী তার শরীরে কথা দিয়ে ফোসকা ফেলে দিয়েছে।সে অন্যত্র মুখ ঘুরিয়ে চাপা কন্ঠে বলল,’দুঃখিত! এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত কীভাবে করতে হবে বলে দিও।তুমি যদি বলো তোমার পা ধরে বসে থাকতে হবে,তবে বসে থাকবো।তবুও এই খোঁটা আর দিও না।যাই হোক,আবারো দুঃখিত।’
নবনীতা চোখ কপালে তুলে বলল,’সেকি! আপনি এখনো রাগ করছেন?আমি কিন্তু খোঁচা মারতেই বলেছি।মন থেকে বলিনি।’
‘মনে ছিলো বলেই মুখে এসেছে।যাক বাদ দেও।’
নবনীতা অসহায় চোখে আরহামের দিকে তাকায়।তার খারাপ হওয়া মনটা নবনীতার কথায় আরো বেশি খারাপ হয়ে গেছে।তার চোখ মুখে অনুতাপ,নিদারুণ অনুশোচনা।সে মাথা নিচু করে বলল,’সরি পরী।আই ওয়াজ নেভার আ সুইট হাসবেন্ড।আই ডোন্ট ডিজার্ভ ইউ।’
নবনীতা তার মুখ চেপে ধরল।কড়া গলায় বলল,’হয়েছে?বাজে বকা শেষ হয়েছে?’
নবনীতা সামান্য উঁচু হয়ে আরহামের খোঁচা খোঁচা দাড়িভর্তি গালে চুমু খেল।সে তাল সামলাতে পারছিলো না দেখে আরহাম দ্রুত দুই হাতে তাকে আগলে নিল।নবনীতা প্রশান্তিতে চোখ বুজে তার উপরই সমস্ত ভর ছেড়ে দিলো।তার নাকে নাক ঘষে বলল,’আরহাম! আপনি এই আট বছরে আমার জীবনে আসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।এই আটবছরে কেউ আমাকে আপনার মতো বুঝেনি।কারো কাছে আমি এতো কান্না করিনি,যত কান্না আমি আপনার কাছে করেছি।আপনি আমার জান আরহাম।আমি আপনাকে কতো ভালোবাসি আমি নিজেও জানি না।’
আরিশ চেঁচাচে চেঁচাতে ঘরে এলো।
‘ভাবি!ও ভাবি! বরযাত্রী,,’
সে কথা শেষ করতে পারলো না।তার আগেই ঘরের ভিতরের দৃশ্য দেখে এক চিৎকার দিয়ে পেছন ঘুরে গেল।আরহাম থমথমে মুখে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করল,’শালা গর্দভ একটা!’
আরিশ তড়িঘড়ি করে বলল,’ভাবি বরযাত্রী এসে গেছে।আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি নিচে।তুমি নিচে এসো জলদি।এসব আদিখ্যেতা পরেও করা যাবে।’
বলেই সে এক প্রকার পালিয়ে চলে এলো সেখান থেকে।আরহাম মৃদু গর্জন করে বলল,’এ্যাই শালা! তুই শেষে এটা কি বললি?’
নবনীতা তাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।আয়নাতে একবার নিজের শাড়ি আর কুচি ঠিক আছে নাকি দেখে নিল।ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার আগে কেবল হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলল,’তাড়াতাড়ি নিচে আসুন।সবাই নিচে আছে।আমরা গেইট ধরব।’
আরহাম খেঁকিয়ে উঠল,’পাগল নাকি?তোমরা ধরো গেইট।এসব ক্রিঞ্জি এক্টিভিটিজে আমি নাই।’
নবনীতা ভেংচি কাটলো।
‘বাপরে! এসেছে গুলশানের পশকিড!’
***
আদি চোখ সরু করে সামনে তাকায়।রিমি তারই মতো চোখ সরু করে বলল,’এভাবে দেখে কোনো লাভ নেই।টাকা ছাড়া নো এনট্রি।’
আদি মুখ বাঁকা করে বলল,’সারা রাস্তা বরযাত্রী বরযাত্রী করে যেই না বান্ধবীকে দেখলে,ওমনি দল পাল্টে নিলে?’
রিমি দাঁত বের করে হাসল।আলতো করে নবনীতাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’আমি কোনো বরযাত্রী টরযাত্রী বুঝি না।যেই পক্ষে টাকা আছে,আমি ঐ পক্ষে।’
নবনীতা বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়েছিল।রিমির কথা শেষ না হতেই সে জোর গলায় বলল,’ওতো কিছু বুঝি না।যেটা চেয়েছি সেটা দিয়ে দেন।’
আদি সন্দিহান চোখে বলল,’ডিমান্ড কতো শুনি?’
নবনীতা নির্বিকার হয়ে বলল,’মাত্র পঞ্চাশ হাজার।কারণ আমরা জানি আপনি বেকার।’
আদি খ্যাক করে উঠল,
‘কি কি?কতো হাজার?’
আরিশ আবারো বললো,
‘পঞ্চাশ হাজার।ফিফটি থাউজ্যান্ড অনলি।’
আদি চোখ গোল গোল করে বলল,’আমাকে বেচলেও তো এতো টাকা আসবে না বাপ।’
শুভ্রা ভাবুক হয়ে বলল,’এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা।আপনার একটা কিডনির দামই এর চেয়ে বেশি।’
আদি পেটে হাত রেখে আতঙ্কিত হয়ে বলল,’কি সাংঘাতিক! এক গেইটের টাকার জন্য তুমি আমার কিডনি বেচে দিবে শুভ্রা?’
নবনীতা চোখ গরম করে বলল,’এতো কাহিনি বুঝি না।আমি জানি আপনার কাছে পঞ্চাশ হাজার আছে।বেশি কথা না বাড়িয়ে দ্রুত দিয়ে দিন টাকাটা।’
ওয়াজিদ দুই হাত বগলদাবা করে বলল,’না দিবো না।আমাদের পাত্র নিজেই তো একটা স্বর্ণের খনি।আমরা আবার আলাদা করে টাকা দিবো কেন শুনি?’
ইজমা তার সাথে সুর মিলিয়ে মাথা নেড়ে বলল,’তাই তো।আমাদের পাত্র হাজারে একটা।তাকে বর হিসেবে পাওয়াই তো এই জনমের ভাগ্য।’
রিমি মুখ বাঁকিয়ে বলল,’ওবাবা তাই নাকি?তোমাদের পাত্র তো হাজারে একটা।আর আমাদের পাত্রী লাখে একটা।’
নবনীতা দিরুক্তি করে বলল,’জ্বী না।আমাদের পাত্রী কোটিতে একটা।আপনাদের পাত্র যদি স্বর্ণের খনি হয়,আমাদের পাত্রী তবে হীরার খনি।’
ইজমা মুখ কুঁচকে বলল,’হীরা তো স্রেফ কাঁচের টুকরো।আমাদের ছেলে তো একেবারে নিখাঁদ।’
ব্যাস।ওমনি দুই পক্ষের মাঝে হই হুল্লোড় বেঁধে গেল।ইফাজ চোরা চোখে একবার করিমুল সাহেবকে দেখল।তার শান্ত আর ধাঁরালো দৃষ্টি ইফাজের দিকেই।ইফাজের গলা শুকিয়ে এলো।এতো ভয়ংকর কেন তার চাহনি?ইফাজ কি তার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে নাকি?
আদি বলল,’বেশি বাড়াবাড়ি করো না।পাঁচ হাজার দিচ্ছি।নিয়ে নাও।নয়তো এক টাকাও পাবে না।’
ওয়াজিদ তার কথায় সায় দিয়ে বলল,’একদম ঠিক।হয় পাঁচ হাজার রাখো,নয়তো রাস্তা ছাড়ো।এর বেশি এক পয়সাও দিবো না।’
‘কেন রাস্তা ছাড়বে?রাস্তা কি তোর বাপের যে তুই বললেই ছেড়ে দিবে?’
সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরল।পেছনে থাকা যুবককে দেখামাত্র সবার চোয়াল ঝুলে গেল।রিমি খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো,’ইয়েএএএ! ভাইয়া এসেছে।এবার মজা হবে।’
নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলল,’আপনি না বলেছেন,আপনি এসবে আসবেন না?’
আরহাম পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে এগিয়ে এলো।গম্ভীর গলায় বলল,’আমাকে ছাড়া তো কিছু করতেও পারছো না।তাই বাধ্য হয়ে আসতে হলো।’
সে কথা শেষ করেই আদি আর ওয়াজিদের দিকে তাকালো।কটমটে চোখে বলল,’কিরে! ছোট ছোট বাচ্চাদের একা পেয়ে যা খুশি করছিস তোরা?পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেইট পার করে ফেলবি?তাও আমার বাড়ির।এতো সোজা?’
ওয়াজিদ তেঁতেঁ উঠে বলল,’তুই কতো টাকা দিয়ে তোর বিয়ের গেইট পার করেছিস শুনি?এক টাকাও তো খরচ হয়নি তোর।’
তার কথা শুনেই আদি আর আরহাম সমস্বরে চেঁচালো,’শা’লা তুই নিজেও তো গেইটের টাকা না দিয়েই বিয়ে করেছিস।’
তিন বন্ধুর বাক বিতন্ডা বেঁধে গেল।আরহাম চেঁচিয়ে উঠল,’পঞ্চাশ হাজার দে।নয়তো বোন তো দেবোই না,সাথে ঠ্যাং দু’টো ভেঙে দিবো।’
‘আয় ভাঙ।দেখি তোর কতো সাহস।’
অনেক তর্কাতর্কির পর অবশেষে আরহাম গেইট পার করার মূল্য কিছুটা বাড়াতে সক্ষম হলো।ইফতেখার সাহেব বললেন,’আচ্ছা আচ্ছা যাও।দুই পক্ষের কথাই বিবেচনা করা হয়েছে।পঞ্চাশ হাজারো না,পাঁচ হাজারও না।আমরা পঁচিশ হাজার টাকা দিবো।ঠিক আছে?’
আরহাম কিছুটা ভেবে বলল,’ত্রিশ হাজার দিলে ভালো হয় না আঙ্কেল?একটা রাউন্ড ফিগারে থাকলো সব।’
ইফতেখার সাহেব হেসে ফেললেন।আরহাম নিজেও হাসল।নবনীতা বিস্ময় জড়জনো কন্ঠে বিড়বিড় করল,’আপনি টাকা নিয়ে এমন ছ্যাচড়ামি করেন।আগে তো জানতাম না।’
আরহাম নাক ছিটকে বলল,’তোমরা যা গর্দভ।আমি না এলে দশ হাজারও পেতে না।সব ক’টা বেকুব।’
***
কাজি এসেছে।এখন বিয়ে পড়ানোর পালা।তাসনুভা সামনে আসা মাত্রই আদি চোখ নামিয়ে নিল।তার জীবনে লজ্জার আবির্ভাব হয়েছে তাসনুভার সাথে তার প্রণয়ের পর থেকে।এর আগে লজ্জা বলতে তার কিছুই ছিলো না।যদিও তাসনুভার সাথে তার সম্পর্ককে সে এখনিই প্রণয়ের নাম দিতে পারে না।কারণ তাদের সম্পর্ক আদতে কোনো কপোত-কপোতীর মতো না।তারা দু’জন বিয়ে ঠিক হওয়ার পর দুই বারের মতো দেখা করেছে।দুইবারই দু’জন খাম্বার মতো বসেছিল।না তাসনুভা কিছু বলেছে,না সে কিছু বলেছে।বলবে কি?বলার মতো কিছু তো তাদের মাঝে নেই।তাসনুভা কথা বলতে গেলেই তাকে ভাইয়া ডেকে ফেলে,আর আদি তাকে বাচ্চা ডাকে।এর মাঝে বিয়ে শব্দটার ভার কিভাবে বইবে দু’জন?আদি জানে না,জানতে চায়ও না।শুধু এইটুক জানে,তারা পারবে।খুব সুন্দর করে সবকিছু গুছিয়ে তাসনুভা আর তার সংসার হবে।এই মিষ্টি মেয়েটাকে আদি ভালো রাখবে।যদি কোনোদিন তার মুখের এই স্নিগ্ধ হাসি মিলিয়ে যায়,তবে আদি বুঝে নিবে স্বামী হিসেবে সে পুরোপুরি ব্যর্থ।
তাসনুভা কবুল বলতে গিয়েই ছটফটিয়ে উঠল।চঞ্চল হয়ে বলল,’বড় ভাইয়া কোথায়?ভাইয়াকে ডাকো।’
আরহাম এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল।তাসনুভা তাকে ডাকতেই সে বড় বড় শ্বাস টেনে তার পাশে বসলো।
মা চলে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে বাবা মারা গেলো।এর কিছুদিন পর তাসনুভা সিঁড়ি থেকে পড়ে গেল।একটা সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে আজীবনের জন্য হুইল চেয়ারকে সঙ্গী করে নিল।তারপর আরহাম আনাড়ি হাতে তাকে বড় করলো।সে পরীর মতো যত্ন করে ভাই বোনদের মানুষ করেনি।কারণ সে নিজেই পরীর মতো গোছানো প্রকৃতির মানুষ না।সে নিজেই ভীষণ এলোমেলো গোছের ছেলে।এই এলোমেলোর ভেতর থেকেই সে তার ভাই বোনদের সর্বোচ্চ খেয়াল রেখেছে।সেই ছোট্ট তাসনুভা আজ বড় হয়ে বিয়ের আসরে বসেছে।বড় ভাই হিসেবে এই জিনিসটা তার মনে কিভাবে আঁচড় কাটছে,সেটা আরহাম কোনোদিন মুখে বলতে পারবে না।সে পাশে বসতেই তাসনুভা তার একটা হাত চেপে ধরল।সামনে ফিরে জড়ানো গলায় ডাকলো,’আরিশ ভাইয়া!’
শুভ্রা পাশ ফিরে আরিশের ফ্যাকাসে মুখ আর লাল হয়ে থাকা চোখ জোড়া দেখল।অবাক হয়ে বলল,’আপনি কাঁদছিলেন আরিশ?’
আরিশ সেই কথার জবাব না দিয়ে রোবটের মতো হেঁটে তাসনুভার অন্য পাশে গিয়ে বসল।তাসনুভা দুই হাতে দুই ভাইয়ের হাত চেপে ধরেই কবুল বলল।সে জানে না মায়ের ভালোবাসা কেমন,সে এটাও জানে না বাবার ভালোবাসা কেমন।কিন্তু সে জানে ভাইদের স্নেহ আর যত্ন কতোটা মধুর।তার জীবনে অভিভাবক বলতে সে তারা দুই ভাইকেই বুঝে।যারা ছেলে হওয়া স্বত্তেও তাসনুভাকে রাজকন্যাদের মতোন আদর যত্ন করে বড়ো করেছে।তাসনুভা জানে এই জীবনে এতো স্বচ্ছ আর নির্মল ভালোবাসা সে কোনোদিনও কারো কাছে পাবে না।
_____________________________________________
[দ্বিতীয় অংশ]
“সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।ছোট থেকেই এই প্রবাদ আমরা পড়ে আসছি।বয়স বাড়তেই আমরা নব্বই দশকের ছেলেমেয়েরা টের পেলাম এই কথা কতোখানি সত্য।সময় কতো দ্রুত চোখের পলকে এগিয়ে যায়,সেই সাথে আমাদের বয়স।পৃথিবীতে কতো কিছু ঘটে যায়।আর তারপর আমরা অবাক হয়ে আবিষ্কার করি,এসব কিছুতে আমাদের জীবন থেকে কতোটা সময় কেটে গেছে!
তাসনুভার বিয়ের ছয় মাস হতে যাচ্ছে।বিয়ের পর যেই ছোট্ট মিষ্টি মেয়েটার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল,সেই মেয়েটা এখন একটু একটু করে সংসার করছে।আরিশের গ্র্যাজুয়েশন শেষ।বিয়ের পর সারাদিন ছেলেটা কানের কাছে ভাবি ভাবি করে চেঁচাতো।এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে।চোখে মুখে একটা ভাবগাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে।যদিও আমার মাঝে মাঝে তাকে বলতে ইচ্ছে হয়,’তোকে এভাবে ভালো লাগে না আরিশ।তুই আগেই ভালো ছিলি।’
নওফেল মাঝে মাঝে ছুটিতে শাহাদাতের সাথে আমাদের বাড়িতে আসে।আরহাম কে সে ভীষণ পছন্দ করে।আরহামও আজকাল বেশ সময় নিয়ে তার সাথে আড্ডা দেয়।নওফেল খুব সাবধানতার সাথে নিজের বাড়ি,বিশেষ করে নিজের মায়ের বিষয় গুলো এড়িয়ে যায়।ছেলে ভীষণ ম্যাচিউর।বয়সের তুলনায় তার বুঝজ্ঞান অনেক বেশি।তাসলিমা তার তিন সন্তানের কাছে আর ফিরে আসেনি।তার তিন সন্তানও তাকে চায়নি।অলিখিতভাবে তাদের সম্পর্কেই ইতি অনেক আগেই ঘটে গেছে।
ওয়াসিফ এখন হাঁটতে জানে।তার দাঁত উঠেছে,তাও আবার চারটা।কামড় দিলে যা ব্যাথা লাগে! শুভ্রার প্রথম প্রফ শুরু হবে সামনের মাসে।তাকে ফোন দিলে আজকাল আর পাই না।কোনোরকমে ফোন রিসিভ করেই বলে,’আপাই! আমি পড়ছি।একটু অপেক্ষা করো।পরে ফোন দিচ্ছি।’
পরে আর তার ফোন দিতে মনে থাকে না।
চিত্রা ক্লাস টু তে উঠেছে।সে হয়েছে শুভ্রার উল্টো।তাকে একটু পড়াতে বসাতে গেলেই আমার শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়।তাকে পড়ানো,আর কোনো কিছু নিয়ে যুদ্ধ করা একই বিষয়।সে আমার নাগালের বাইরে।আরহাম একটু ধমকাধমকি করলে যা একটু পড়ে।
আরশাদের কথা আর কি বলবো।সে দিন দিন বাবার প্রেমে পাগল হয়ে যাচ্ছে।সে বাবা ছাড়া আর কিছু বুঝে না।কি অদ্ভুত! আমি তাকে বাচ্চা বয়সে বুকে নিয়ে নিয়ে ঘুম পাড়ালাম।সে যখন কাঁদতো,আরহাম তখন বিরক্ত হয়ে কানে বালিশ চাপা দিতো।আর যেই সে একটু বড়ো হলো,ওমনি বাবার ছেলে হয়ে গেল।এটা অন্যায়।ঘোরতোর অন্যায়।তাদের বাবা-ছেলের উপর আমার অভিমান জন্মেছে।
গত মাসে আরো একটা বিয়ের অনুষ্ঠান খেয়েছি।ইজমা আর ইফাজের বিয়ে।ইজমার বাবা অবশেষে রাজি হয়েছে বিয়ের জন্য।গত মাসেই খুব সুন্দর ভাবে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে।ইফাজ খুব ভালো ছেলে।ইজমা তার সাথে ভালোই থাকবে।শ্বাশুড়ি বাদে ইজমার শ্বশুরবাড়িতে সবই ভালো।তার শ্বাশুড়িকে কেন যেন আমার ভালোই লাগে না।
ধ্যাত! এসব আমি ডায়রি তে লিখছি কেন?কেউ পড়লে আমাকে কি না কি ভাববে।যাক,এসব কথা বাদ দেই।নিজের কথায় আসি।আমি খুব ভালো আছি।গত দুই মাস আগে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আমার চাকরি হয়েছে।পুরো চাকরিটাই ভার্চুয়াল।যা করার ঘরে বসেই করছি।ফ্রিল্যান্সার আর আমার মধ্যে পার্থক্য হলো আমি একটা নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করি।মাস শেষে সেটা বাড়েও না,কমেও না।চুক্তিবদ্ধ থাকা অবস্থায় আমি কেবল ঐ একটা কোম্পানির হয়েই চাকরি করবো।এখানে বেতনও যথেষ্ট ভালো।মান্থলি এক হাজার ইউএসডি।বাংলাদেশি টাকায় লাখ ছাড়ায়।শ্রমও অবশ্য দিতে হয়।দৈনিক আট নয় ঘন্টা সময় এসবের পেছনেই দিতে হয়।এতো ব্যস্ততায় ব্যবসা আর সামলানো হয় নি।সেটা প্রথাই সামলায়।ব্যবসায় মোটামুটি ভালোই লাভ হয়।প্রথা মাসে একবার বাসায় আসলে হাত ভরে এটা-সেটা নিয়ে আসে।আমার এতো বেশি বেতন দিয়ে আসলে করার মতো কিছু নেই।আরহাম তার সংসারে আমার থেকে কোনোরকম টাকা নেয় না।আমি কেবল জোর করে চিত্রার স্কুল ফি আর টিউশন ফি টা নিজ থেকে দেই।নয়তো আরহাম আমার থেকে কোনো খরচ নেয় না।তার মেল ইগো সে বরাবরই সবকিছুতে ধরে রাখতে চায়।আমি আর কিছু বলি না।গোড়া থেকে একটা মানুষ কে পাল্টে দিতে আমি ইচ্ছুক না।সে যেমন,আমি তাকে তেমন করেই মেনে নিয়েছি।
এই কয়েক মাসে সবচেয়ে চমৎকার যেই বিষয়টা হয়েছে তা হলো আমি কনসিভ করেছি।যদিও বা শুরুতে আমি আর আরহাম কেউই সেটা নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাই নি।তার কারণ আগের বারও দেড় মাসের মাথায় আমার মিস ক্যারেজ হয়েছিল।সেই হিসেবে আমরা ধরেই নিলাম এবারো এমন কিছুই হবে।কিন্তু আমি আরহামের মতো একেবারে শূন্য আশায় ছিলাম না।আমি লোভী বান্দার মতো আল্লাহর কাছে খুব চেয়েছি এবার যেন আগের বারের মতো কিছু না হয়।আমার স্রষ্টা আগেও বহুবার আমার ডাক শুনেছেন।আমার বিশ্বাস ছিলো এইবারও তিনি আমার ডাক শুনবেন।হয়েছেও তাই।আল্লাহ আমায় নিরাশ করে নি।তিন মাসেও যখন মিস ক্যারেজের মতো কোনো ঘটনা ঘটে নি,তখন গাইনোকোলজিস্ট নাসরিন সুলতানা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন,’আর চিন্তা নেই নবনীতা।আমার মনে হচ্ছে এইবার তোমার বাচ্চাটা সারভাইব করতে পারবে।’
ব্যাস,এইটুকু কথাতেই আমার পুরো জীবন পাল্টে গেল।আমি সেদিন পেটে হাত চেপে কয় ঘন্টা কেঁদেছি আমি নিজেও জানি না।আরহাম বলল,’বাকি ছয়মাস তোমাকে রোজ দু’টো করে ইঞ্জেকশন নিতে হবে।’
আমি বললাম,সমস্যা নেই আমার।
সে বলল,সপ্তাহে সপ্তাহে রক্ত নিতে হবে।
আমি আগের মতো করেই বললাম,সমস্যা নেই।
আরহাম শুরুতে এমন ভাব করলো যেন আমার এই কনসিভ করাতে সে একদমই খুশি না।কিন্তু যখনই ডাক্তার নাসরিন আমাকে জানালেন আমার বাচ্চাটা একদম সুস্থ আছে,আর সে সুস্থ ভাবেই পৃথিবীর আলো দেখবে,তখনই আরহাম পুরোপুরি পাল্টে গেল।সেদিন আমি উপলব্ধি করলাম,আমার চেয়ে একটা সন্তানের আক্ষেপ আরহামেরই বেশি ছিলো।কেবল আমি মূর্ছা যাবো ভেবে সে কোনোদিন নিজের যন্ত্রণা প্রকাশ করে নি।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বিষয় গুলোর একটি হলো প্রেমে পড়া পুরুষ মানুষ।আমার অন্তত তাই মনে হয়।আরহাম ভীষণ খুতখুতে স্বভাবের মানুষ।এই খুতখুত করা মানুষটাকেই এই কয় মাসে আমি কয় হাজার বার বমি করে ভাসিয়েছি,তার কোনো ইয়াত্তা নেই।আরহাম সেই সব বিনা কোনো শব্দে সহ্য করে নিয়েছে।এমনকি একটিবারের জন্যও কপাল কুঁচকায় নি।আরহাম আমার যেই পরিমান সেবা করেছে,আমি স্ত্রী হিসেবে কোনোদিন তার এতোখানি সেবা করেছি নাকি জানি না।রাত নেই,দিন নেই,আমি আমার উদ্ভট আবদারে তার জীবন নাজেহাল করে দিয়েছি।রাত তিনটায় শর্মা খেতে চাওয়ার ইচ্ছে থেকে শুরু করে গরমের দিনে ভাপা পিঠা খাওয়ার ইচ্ছে পর্যন্ত সব ইচ্ছেই সে আমার পূরণ করেছে।সেদিন সে আতঙ্কিত হয়ে বলল,’তুমি আবার কখনো বলো না যে তোমার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে।সেটা কিন্তু পূরণ করতে পারব না বাপ।’
আমি হাসি।আমার ভারি মিষ্টি লাগে তাকে।বাইরের লোক তাকে রুক্ষভাষী বলেই জানে।কিন্তু আমার তো তাকে বড্ড মিষ্টি লাগে।তার গায়ের ঘ্রাণ ছাড়া আমার ঘুম আসে না।সে আদর না দিলে আমার মন ভালো হয় না।এই যেমন এখন আমার মন ভালো নেই।সে তিনদিন ধরে আমার কাছে নেই।রাঙামাটি গিয়েছে,কিসব প্রজেক্টের কাজে।ফিরবে কাল রাতে।এতোটা সময় তাকে ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না।সে কাল সন্ধ্যায় আমাকে শেষবার কল দিয়েছিলো।তারপর থেকে সে লাপাত্তা।আর কোনো খরব নেই তার।আমার মন ভালো নেই,একদমই ভালো নেই।
আজ ত্রিশে শ্রাবণ।আমার তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী।অথচ আমার প্রাণপুরুষ আমার সাথে নেই।আজকের তারিখ যে সে বেমালুম ভুলে গেছে,তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আজকাল কেউই আমাকে ভালোবাসে না।শুধু ব্যস্ততা দেখায়।রিমিকে ফোন দিতেই সে তার কেচ্ছা শুরু করে-ওয়াসিফের জ্বর,ওয়াজিদ ভাইয়ের কাজ,তার পড়াশোনা হ্যান ত্যান কতো কিছু।
তাসনুভা পাসপোর্টের কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত।তারা সম্ভবত সামনের বছরেই আমেরিকা চলে যাচ্ছে।আরিশ ইদানিং ব্যবসার কাজে টুকটাক হাত দিয়েছে।তবে তার ইচ্ছা অন্য কোনো কোম্পানিতে জব করা।এই উদ্ভত ইচ্ছের কারণ কি সে নিজেও জানে না।শুভি দু’টো টিউশন করে।এক টিউশনেই নাকি পনেরো হাজার টাকা পায়।তাও আবার মাত্র এক ঘন্টা পড়িয়ে।শুনেই আমার মাথা ঘুরে গেল।মেডিকেল স্টুডেন্ট রা নাকি এমনই পায় টিউশন ফি।আমি হা হুতাশ করে বললাম ইঞ্চিনিয়ারিং এর প্রস্তুতি না নিয়ে মেডিকেলের প্রস্তুতি নিলেই তো ভালো হতো,এতোদিনে টাকার বালিশে ঘুমাতাম।চিত্রা এখন স্কুলে,আরশাদ নিচে রহিমার সাথে রান্নাঘরে।তার যে রান্নাবান্নার কি শখ! আমি তো বলেছি,’বাবারে! তোকে আমি মাস্টার শেফ বানাবো না।তোর এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হবে না।’
তবুও সে এমন রোজ রোজ কাঠি চামচ নিয়ে নাড়াচাড়া করে।এই ছেলে যে বড়ো হয়ে কি হবে,কে জানে।আমি আর তাকে আদর করব না।সে থাকুক তার বাবার সাথে।আমি আদর করবো আমার ছোট্ট মা কে।সে কখন আসবে আমাদের কাছে?আর অপেক্ষা হচ্ছে না।একদমই অপেক্ষা করতে পারছি না আমি।সে ছাড়া আর কেউ আমাকে ভালোবাসে না।পুরোন হয়ে গেছি বলে কেউ আর পাত্তা দেয় না।”
দরজায় এসে কেউ একজন ধাক্কা দিলো।নবনীতা নূরের দিনলিপি রচনায় ভাটা পড়লো।কলমটা ডায়রির উপর ফেলে সে উঠে দাঁড়ালো।দরজা খুলতেই দেখল দরজার সামনে রিমি।নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’তুই?এই সময়ে?’
রিমি কোনো প্রতিউত্তর করলো না।কেবল তার হাতে থাকা তাজা রক্তিম গোলাপটা নবনীতার সম্মুখে বাড়িয়ে দিলো।নবনীতা দ্বিধায় পড়ে সেটা হাতে নিল।দেখতে পেল ফুলের সাথে একটা চিরকুটও আছে।বিচলিত হয়ে সে সেটার ভাঁজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল।
“প্রিয় নবনী,
আমার জীবনে বান্ধবী বলতে আমি যা বুঝি,সেটা তুই।আমার কোনো ভাই বোন নেই।আমার কাছে তুই ই আমার বোন।তুই চিরকাল এমনই থাকবি নবনী।শুভি,চিত্র আর তাসনুভাকে আদর দেওয়ার পর তোর ঝুলিতে যেইটুকু আদর অবশিষ্ট থাকবে,সেটা তুই আমাকে দিস কেমন?
ইতি,
তোর একমাত্র সই রিমি।”
চিরকুটটা পড়া শেষ করতেই একটা রিনরিনে কন্ঠ তাকে ডাকল,’ভাবি।’
নবনীতা দ্রুত সেদিকে তাকায়।আশ্চর্য হয়ে সামনে এগিয়ে যায়।তাসনুভাও রিমির মতো করেই তার দিকে একটা ফুল সমেত চিরকুট বাড়িয়ে দিলো।নবনীতা আগের মতোই বিস্মিত হয়ে সেটা হাতে নেয়।চিরকুটে লিখা-
“ভাবি,
তোমার মতো আদর করে কেউ আমায় খাইয়ে দেয় নি।তুমি খুব সুন্দর করে মেখে মেখে ভাত খাওয়াও।তোমার কাছে খেতে বসলে আমি তিন প্লেটও খেয়ে ফেলতে পারি।তুমি আমার ভীষণ প্রিয়।আমি তোমাকে এক আকাশ ভালোবাসি ভাবি।পারলে তোমাকে লাগেজে পুরে আমেরিকা নিয়ে যেতাম।তোমাদের ছাড়া আমি থাকবো কেমন করে?
ইতি
তাসনুভা”
নবনীতার চোখ ভিজে আসে।বুকের ভেতর আচমকাই সমুদ্রের বিশালার স্রোত শব্দ করে আছড়ে পড়ে।এরা এতো সুন্দর করে ভালোবাসা প্রকাশ করছে কেন তার প্রতি?
একটু দূরেই আরিশ।সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়ানো।হাতে সেই গোলাপ সমেত চিরকুট।নবনীতার সমস্ত মনোযোগ সেই চিরকুটের দিকে।সেখানে লিখা-
“ভাবি,
ভাইয়ার সাথে বিয়ের পর তুমি খুব কেঁদেছো।তুমি যতোটা কেঁদেছো,আমি আর তাসনুভা ঠিক ততোটাই খুশি হয়েছি।কারণ আমরা একটা মিষ্টি পরীকে চিরকাল আমাদের বাড়িতে আমাদের বাড়ির সদস্য হিসেবে পেতে যাচ্ছিলাম।তুমি বিশ্বাস করবে নাকি জানি না।কিন্তু তুমি আসার পর আমাদের জীবন সত্যিই তারাবাজির আলোর মতো ঝলমল করে উঠেছিল।আমরা তোমায় খুব ভালোবাসি ভাবি।তোমার কানের কাছে প্রতি নিয়ত ‘ভাবি এটা দাও,সেটা দাও’ করে ঘ্যান ঘ্যান করা আমাদের ভীষণ প্রিয়।তুমি চিরকাল এমনই থেকো ভাবি।আমাদের ঘর একটা বাগান।আর তুমি সেখানে থাকা মিষ্টি একটা ফুল।
ইতি,
তোমার ভাই আরিশ[আমি নিজেকে ওসব দেবর টেবর বলে মানি না।আমি তোমার ভাই।]
নবনীতা চোখ মুছে তার দিকে তাকালো।ভাঙা কন্ঠে বলল,’তুই এসব লিখেছিস?’
আরিশ কেবল বিনিময়ে হাসিমুখে উপরনিচ মাথা নাড়ল।
সিঁড়ির একেবারে শেষ মাথা থেকে ডাক এলো,’আপাই!’
নবনীতা দ্রুত সেখানে তাকায়।আশ্চর্য হয়ে বলে,’শুভি তুই?’
শুভ্রার পাশে চিত্রাও দাঁড়িয়ে ছিলো।তার পরনে এখনো স্কুল ইউনিফর্ম।নবনীতা অবাক হয়ে নিচে নামতেই শুভ্রা তার দিকে তার হাতে থাকা চিরকুট টা বাড়িয়ে দিলো।পাশ থেকে চিত্রা বলল,’আমার লেখা বাজে।তাই শুভিই সব লিখেছে।’
নবনীতা কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলল।
“আপাই,
সবাই তোমাকে প্রিয় বলে।আমরা বলিনি।কারণ আমাদের আপাই যে আমাদের কতো প্রিয়,সেটা পুরো দুনিয়া জানে।তোমাকে আমরা ভীষণ ভালোবাসি আপাই।তোমার অবদান,তোমার ত্যাগ,তোমার ঋণ কোনোকিছুই আমরা শোধ করতে পারব না আপাই।তুমি সেদিন আমাদের ফেলে ঐ মেজরের সাথে বিয়ে করে সুখে থাকতে পারতে।অথচ নিজের সুখের ঊর্ধ্বে তুমি আমাদের ভালো থাকাকে বেছে নিয়েছিলে।মালিবাগের ঐ ছোট্ট ঘরটায় আমরা হয়তো আর্থিক অভাবে ছিলাম,কিন্তু ভালোবাসার অভাবে আমরা কখনোই ছিলাম না।যাদের জীবনে পরী আপাই আছে,তাদের জীবনে ভালোবাসার অভাব হয় কেমন করে?আমরা তোমায় কতোখানি ভালোবাসি সেটা লিখে বোঝানো সম্ভব হলে বেশ হতো।কিন্তু সত্যি এটাই যে পরী আপাইয়ের জন্য তার শুভি আর চিত্র যেই ভালোবাসা অনুভব করে,সেটা কাগজে কলমে ফুটিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব।তবুও একটা কথা বলি আপাই।জীবনের পরিক্রমায় অনেক বছর পরে যদি কখনো তোমার মনে হয়,কেউ তোমায় ভালোবাসে না,তবে মনে রাখবে চিত্র আর শুভি চিরকাল তোমায় ভালোবাসে।আমাদের কাছে আপাই আমাদের আস্ত একটা পৃথিবী।সেই পৃথিবী ভালো না থাকলে চিত্রা আর শুভি কেমন করে ভালো থাকবে?তুমি আমাদের এতো কেন ভালোবাসো আপাই?আমরা কেন কখনো ভালোবাসা দিয়ে তোমার ঋণ শোধ করতে পারি না?
ইতি,
তোমার দু’টো মিষ্টি ফুল,যাদের জন্য তুমি তোমার জীবনের সব আনন্দ বিসর্জন দিয়েছিলে”
নবনীতার হাত থেকে চিঠিটা খসে পড়ল।তার চোখের পানিতে তার গাল ভাসছে।বাচ্চাগুলো এতো সুন্দর করে তাকে চিঠি লিখেছে?এতো কেন ভালোবাসে তারা তাকে?সে তো খুব সাধারণ।খুব বেশি সাধারণ।সে দ্রুত মেঝে থেকে চিঠিটা তুলে বুকের সাথে চেপে ধরল।এই চিরকুট গুলো কেবলই কাগজের টুকরো না,নবনীতার জন্য এসব এক একটা ভালোবাসার ফোয়ারা।এতো ভালোবাসা সে কেন পাচ্ছে?সে বড্ড সাধারণ।একেবারেই সাধারণ একটা মেয়ে।
দরজা থেকে রাশভারি কন্ঠটা তাকে ডেকে উঠল,’সেনোরিটা! কেমন আছো?’
নবনীতা বোকা বোকা হয়ে সামনে তাকালো।আরহাম এসেছে।কি অদ্ভুত! তার তো কাল রাতে আসার কথা।সে সামনে দেখতেই আরহাম একগাল হেসে দুই হাত প্রসারিত করল।ভারি কন্ঠে বলল,’তৃতীয় বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা পরী।তিন থেকে ত্রিশ,ত্রিশ থেকে তিনশো হয়ে গেলেও যেন তুমি এমনই থাকো এই দোয়া করি।’
নবনীতা শব্দ করে কেঁদে ফেলল।তারপরই দিকবিদিক ভুলে সামনের দিকে ছুটে গেল।গিয়েই অতিকায় ঢেউয়ের ন্যায় আছড়ে পড়লো আরহামের শক্তপোক্ত বক্ষে।নাক টানতে টানতে বলল,’আপনি জানতেন আজ আমাদের এনিভার্সারি?’
‘অবশ্যই জানতাম।’
‘কাল রাতে জানান নি কেন?’
‘জানালে আজ তুমি এমন করে চমকাতে?’
‘এই সব প্ল্যান আপনার?’
‘হ্যাঁ।তোমার নাকি ভীষণ অভিযোগ যে কেউ তোমায় ভালোবাসে না।তাই তোমার অভিমান অভিযোগ সব ভেঙে দিয়েছি।’
নবনীতা তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,’আপনি আর আমাকে ছাড়া কোথাও যাবেন না।’
‘কেন?তুমি কি কচি খুকি?’
‘হ্যাঁ,খুকি।আপনার কোনো সমস্যা?’
আরহাম মুচকি হেসে বলল,’না আমার কোনো সমস্যা নেই।’
কথা শেষ করেই সে গলা ছেড়ে ডাকলো,’আরিশ!’
আরিশ সঙ্গে সঙ্গে দরজার পাশে ঝুলতে থাকা নাইলনের ফিতা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিলো।ওমনি শত শত গোলাপ ঝরঝর করে নবনীতা আর আরহামের উপর এসে পড়লো।আরশাদ ছুটে গেল তাদের দিকে।গিয়েই আরহামের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,’বাবা কোলে নাও।’
আরহাম তাকে হাসিমুখে কোলে তুলে নিল।নবনীতার দিকে দেখিয়ে বলল,’মা কে আই লাভ ইউ বলো তো বাবা।’
আরশাদ লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল,’আই লাভ ইউ মা।’
নবনীতা মন ভরে তার দুই গালে চুমু খেল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’আই লাভ ইউ টু বাবা।তুমি তো আমার জান বাচ্চা।’
আরহাম এক হাতে তাকে আগলে নিয়ে বলল,’এই এতো গুলো ফুলের মানে কি জানো?’
নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’কি?জানি না তো।’
‘এর মানে হলো এরা সবাই মিলে তোমায় যতখানি ভালোবাসে,আমি একাই তোমায় এর চেয়ে বেশি ভালোবাসি।’
নবনীতার চোখ আবারো ঝাপসা হয়ে এলো।সে আবারো গভীর ভালোবাসায় আরহামের ঘর্মাক্ত শার্ট জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রাখল।আরহাম বলল,’আমি ফ্রেশ হই আগে।গায়ে কতো ময়লা আমার ছি।’
‘হোক ময়লা।আমার কোনো সমস্যা নেই।’
‘তোমার সমস্যা নেই,কিন্তু আমার মেয়ের সমস্যা আছে।’
‘তারও কোনো সমস্যা নেই।সে তার বাবাকে ভালোবাসে।’
নবনীতা চুপচাপ তার বুকে নিজের মাথা চেপে ধরল।আরহাম আর কিছু বলল না। সে জানে এই পাগল মেয়েটা এখন আধঘন্টা ধরে অকারণে কাঁদবে।আরহাম তাকে থামাতে গেলে সে আরো কাঁদবে।সে এমনই।আরহাম সামনে এলেই তার কান্না বেড়ে যায়।জগতের সামনে সে নিজেকে বড্ড শক্ত চিত্তের অধিকারী বলে প্রমাণ করে।অথচ আরহাম সামনে আসতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করে জগতের সবচেয়ে অভিমানী আর স্পর্শকাতর মানবী রূপে।এই মেয়েটা তার প্রাণ ভোমরা।সে জানে নবনীতা ভালোবাসার কাঙাল।দিন শেষে পরীর এই বিত্ত বিভব,ধন সম্পদ কিছুই চাই না।পরীর চাই একটা ছোট্ট ঘর।যেই ঘরটা আদর ভালোবাসায় ভরে থাকবে।পরী কেবল একটু ভালোবাসা চায়।যেই ভালোবাসা সে ছয় বছর ধরে পায় নি।
ব্যাস।পরীর গল্প এইটুকুই।আঠারো বছর বয়সে বাবা মাকে হারানো কিশোরী মেয়েটা ছয় বছরের সংগ্রাম শেষে নিজের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছিল।তারপর মামা বাড়িতে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে গিয়ে পার্ট টাইম জব,টিউশন সবকিছুই করেছে সে।তার জীবনে তার দুই বোন ব্যাতীত আর কিছুই ছিলো না।যেই দুই বোনের সুন্দর ভবিষ্যত ছিলো পরীর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন।
তারপর শ্রাবণের এক মিষ্টি বর্ষণে পরীর জীবন পাল্টে গেল।পরী খুঁজে পেল তার প্রিয় পুরুষকে।যে তাকে আগলে নিয়েছে,ভালোবেসে আদর দিয়ে তার সমস্ত যন্ত্রনা মুছে দিয়েছে।রিমির মতো বন্ধু,আরিশ তাসনুভার মতো আদুরে আদুরে দু’টো মানুষ,আরশাদের মতো মিষ্টি একটা বাচ্চা,আর শুভ্রা আর চিত্রার মতো নিষ্পাপ দু’টো বোনকে নিয়ে নবনীতা নূরের জীবন আনন্দের উচ্ছ্বাসে ভরে উঠেছিল।
সমাজের নিদারুণ বাস্তবতায় আর টানাপোড়েনে জর্জরিত হয়ে যখনই পৃথিবীর প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা নবনীতাদের জেঁকে ধরে,ঠিক তখনই আরহামরা এগিয়ে এসে তাদের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে।একেবারে নিকৃষ্ট মানুষ দিয়ে পূর্ণ পৃথিবীতে পরীরা কেমন করে যেন তাদের একটা সুন্দর অস্তিত্ব পেয়ে যায়।শত শত নির্ঘুম রাতের শেষে তারা একটা প্রশস্ত নিরাপদ বক্ষ পায়,যেখানে তারা নিজেদের দুঃখ,কষ্ট যন্ত্রনা সব ঝেড়ে ফেলতে পারে।যখনই তাদের কাছে পৃথিবীকে অসহ্য বলে মনে হয়,তখনই আরহামরা এগিয়ে এসে গভীর ভালোবাসায় তাদের জড়িয়ে নেয়।পরীরা সেই ভালোবাসাতেই আটকায়।যেই ভালোবাসা ছিন্ন করে তারা আর কখনোই আসতে পারে না।ভালোবাসার রং কি?সাদা,কালো,লাল?নাকি ভালোবাসা রংহীন?কোনো সুনির্দিষ্ট মানুষের আগমন ছাড়া ভালোবাসা স্রেফ একটা বাংলা শব্দ।যখনই কেউ জীবনে এসে জীবনের ম্লান অধ্যায় গুলো রঙিন করে দেয়,ওমনি ভালোবাসা তার নিজস্ব অর্থ খুঁজে নেয়।
পরী ভালো থাকুক।সেই সাথে ভালো থাকুক তার দু’টো সুন্দর সুন্দর ফুল।সাথে ভালো থাকুক তাকে ঘিরে থাকা প্রতিটা সুন্দর প্রাণ,যাদের ভালোবাসা,আদর,যত্নে নূর আহমেদের তিন মেয়ের জীবন প্রজাপতির ডানার মতো রঙিন হয়ে উঠেছিল।
জগতের সমস্ত পরী ভালো থাকুক।দেয়ালে পিঠ ঠেকার আগেই আরহামরা তাদের ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে নিক।নবনীতা ভালো থাকলেই নবনীতার রচয়িতা ভালো থাকবে।এইবারের মতো এখানেই ইতি।তবে নবনীতাদের গল্প আরো অগণিত বার উঠে আসবে গল্পকারের কলমে।নবনীতারা ভালো থাকুক,খুব বেশি ভালো থাকুক।হেমন্তের ঠান্ডা বাতাসে মানুষ যেমন করে ভালো থাকে,ঠিক ততখানিই ভালো থাকুক।
*******সমাপ্ত*******