#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৭২)[প্রথম অংশ]
ওয়াজিদ ওটির সামনে বসেছিল।দুই হাতের আঙুল আড়াআড়ি করে রাখা।মাথাটা নিচের দিকে নুয়ানো।ওটির সামনে থাকা লাল রঙের বাল্বটি তখনো জ্বলছিলো।ওয়াজিদের মনে হলো এই বাল্বটা সাধারণ কোনো বাল্ব না।ওয়াজিদের হাসি কান্না সুখ দুঃখ সবকিছুর সাথে এই বাল্বের সম্পর্ক আছে।সে একটা হাত বুকে রেখে তার হৃদস্পন্দন অনুমান করার চেষ্টা করল।বুক ধড়ফড় করছে ভীষণ।মনে হচ্ছে বুকের ভেতর কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে এক মণ ভার চাপিয়ে দিয়েছে।সে এলোমেলো ভাবে চারপাশ দেখে।শীলা অনেকক্ষণ যাবত দোয়া পড়ছেন।ওয়াহিদ সাহেব হাঁটাহাঁটি করছেন এই মাথা থেকে ঐ মাথা।তার চোখ মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।ওয়াজিদ পুনরায় মাথা নামিয়ে নিল।চিন্তায় তো সে নিজেই আধম’রা হয়ে যাচ্ছে।
রিমিকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে।তার ডেট ছিলো তিনদিন পরে।কিন্তু হঠাৎই সন্ধ্যার পরে তার শরীর অন্যদিনের তুলনায় আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল।আধঘন্টাতেও যখন কিছুতেই ব্যাথা কমলো না,তখন সে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।গাইনোকোলজিস্ট রুমানা পারভিন তার চেক আপ করার পরেই ইমার্জেন্সি সিজারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।তারপরই মাত্র আধঘন্টার ব্যবধানে রিমিকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে।সব কিছু এতো দ্রুত হয়েছে যে ওয়াজিদ রিমির মা বাবাকেও বিষয়টা জানানোর সময় পায়নি।এই একটু আগে তাদের জানানো হয়েছে।তারা এখনো সম্ভবত রাস্তায়।
সবার আগে সেখানে পৌঁছুলো আরহাম আর নবনীতা।ওয়াজিদ তাদের ফোন দিয়েছিল কিছুক্ষণ আগে।খবর পেতেই তারা একপ্রকার ছুটে এখানে এসেছে।তাসনুভার চিঠিটা পড়ার পর আরহাম প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত ব্যক্ত করার সময় পেল না।এর মাঝেই আবার রিমির খবর শুনে সবকিছু ফেলে তারা এখানে এসেছে।নবনীতা আসার পরই ওয়াজিদকে দেখে দৌঁড়ে তার সামনে এলো।ভীষণ অস্থির হয়ে বলল,’কি হয়েছে ভাইয়া?ডাক্তার আর কিছু জানায়নি?’
ওয়াজিদ মাথা তুলে তার মুখটা একনজর দেখেই পুনরায় মাথা নামিয়ে বলল,’নাহ,এখনো কিছু জানায় নি।’
নবনীতার অস্থিরতা আরো বাড়লো।দুই হাত ডলতে ডলতে সে এ’মাথা ঐ’মাথা পায়চারি করল।আরহাম তার কাঁধ চেপে ধরে বলল,’বসো তুমি।এমন অস্থির অস্থির করছো কেন?’
নবনীতা বসলো না।ব্যাকুল হয়ে বলল,’ভয় লাগছে আমার।রিমিকে নিয়ে আমার খুব ভয় হয়।’
‘আচ্ছা তুমি বসো।বসে বসে ভয় পাবে না হয়।’
নবনীতা চোখ কটমট করে তার দিকে তাকালো।হনহন করে সামনে হেঁটে যেতে যেতে বলল,’সব সময় ফাইজলামি ভালো লাগে না।’
সে চুপচাপ একটা সিটে গিয়ে বসল।আরশাদ হেঁটে হেঁটে আরহামের পাশে এসে দাঁড়ালো।নিজের হাতের মুঠোয় ছোট্ট একটা হাত নিজের জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করছিলো।আরহাম সেটা টের পেতেই দ্রুত নিচে তাকায়।সে তাকাতেই আরশাদ লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে নিল।আরহাম মুচকি হাসল।হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে তার গালে হাত রেখে বলল,’কি বাবা?কিছু খাবে?’
আরশাদ মাথা তুলল না।নত মস্তকেই বাবার কাছে এগিয়ে এসে আস্তে করে তার কাঁধে মাথা রাখলো।আরহাম আলতো হাতে তার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল,’বাবারে আর কোলে নিতে পারবো না।পুরো রাস্তা তুমি আমাকে জ্বালাতন করেছো।’
আরশাদ তবুও তার গলা জড়িয়ে ধরল।অগত্যা বাধ্য হয়ে আরহাম তাকে কোলে তুলে নেয়।সে কোলে তুলতেই আরশাদ টুপ করে তার গালে একটা চুমু খেল।মিষ্টি গলায় বলল,থাঙ্কু বাবা।তুমাকে আদল।’
আরহাম হাসল।তাকে নিয়ে সামনে হেঁটে যেতে যেতে ভরাট গলায় বলল,’এসব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেই তো আমাকে বশ করেছিস দুষ্টু।’
সে থামে।আরশাদের দুই গালে মন মতো চুমু খেয়ে বলে,’আরশাদ তুমি কি জানো তুমি পৃথিবীর প্রথম ছেলে যাকে আমি এতো যত্ন করে বড় করছি?এর আগে কোনো ছেলেকে আমি এতো আদর করি নেই।পরীর মতো আমারও বলতে ইচ্ছে করে তুমি আমার লক্ষী সোনা বাচ্চা।’
.
.
.
.
ওটির লাল বাতি বন্ধ হলো হঠাৎ করে।সেটা দেখেই ওয়াজিদ এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।মন চাইছে এক ছুটে ওটির সামনে যেতে।কিন্তু তার পা চলছে না,শরীর জমে গেছে।হাত পা কেমন মৃ’ত মানুষের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে।রুমানা পারভিন ওটি থেকে বের হয়ে এলেন মিনিট দুয়েক বাদেই।তার কোলে তোয়ালে দিয়ে মুড়ানো ছোট্ট একটি নবজাতক।
ওয়াজিদ যদিও কিছুটা সামনে এগিয়ে এসেছিলো,রুমানার কোলে থাকা সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা ছোট্ট প্রাণটি কে দেখামাত্র পুনরায় ধপ করে বসে বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ল।তার হাত কাঁপছে।ঐ টুকু পথ যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।রুমানা নিজেই তার সামনে আসলেন।ওয়াজিদ তার উপস্থিতি টের পেতেই ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করল,’রিমি কেমন আছে?’
রুমানা পারভিন একগাল হেসে জবাব দিলেন,’রিমি ভালো আছে ওয়াজিদ।’
‘আমি দেখা করতে পারবো?’
‘আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো।এখনো তো জ্ঞান ফিরে নি,জ্ঞান ফিরতে দাও।এখন আপাতত ছেলেকে আদর করো।’
চমকে মাথা তুলে ওয়াজিদ।বোকা বোকা হয়ে বলে,’ছেলে হয়েছে?’
রুমানা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।দ্রুত হাত বাড়িয়ে নবজাতক শিশুটিকে তার বাবার নিকট এগিয়ে দিলেন।
ওয়াজিদ একটা শুকনো ঢোক গিলল।আতঙ্কিত গলায় বলল,’আমি বাচ্চা কোলে নিতে জানি না।আগে কখনো নেই নি।’
রুমানা শব্দ করে হেসে উঠে বললেন,’সমস্যা নেই।নিতে নিতেই অভ্যাস হবে।’
ওয়াজিদ ফ্যাকাশে মুখে বলল,’যদি ভুলে ফেলে দেই কোল থেকে?’
‘কক্ষনো না।তুমি বাবা।বাবারা কখনো বাচ্চাদের কোল থেকে ফেলে না।নাও ধরো।দুই হাতে ধরো।কিছু হবে না।’
ওয়াজিদ খুব ধীরে উঠে দাঁড়ালো।নিজে কোলে নেওয়ার আগেই রুমানার কোলে থাকা অবস্থায় ছোট্ট মুখটা দেখল।ছোট ছোট হাত দু’টো বুকের উপর ফেলা।সে ঘুমুচ্ছে,খুব আরামে ঘুমুচ্ছে।তাকে তার মায়ের মতো মিষ্টি দেখাচ্ছে।ওয়াজিদের বুক ধুকধুক করছে।কাঁপা হাতে সে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নেয়।
সঙ্গে সঙ্গে বাবা হওয়ার অপার্থিব আনন্দ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল।সে এক মনে একদৃষ্টিতে তার কোলে থাকা ছোট্ট শিশুটিকে দেখতেই থাকে।কি সুন্দর! কি সুন্দর! পৃথিবী এতো সুন্দর কেন?এতো আনন্দ ওয়াজিদের ঝুলিতে এসে জমা হচ্ছে কেন?ওয়াজিদ প্রশস্ত হাসল।মাথা নিচু করে আলতো করে সন্তানের গালে চুমু খেল।সে বাবা হয়েছে! কি আশ্চর্য বিষয়! জীবন হঠাৎ এতো পরিপূর্ণ হলো কেমন করে?
দূর থেকে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আরহাম পুরো দৃশ্য টুকু দেখে।সে অনুভব করল দৃশ্যটা ভীষণ সুন্দর।বাবা ছেলের এই মনোরম দৃশ্য তার দেখতে খুব ভালো লাগছে।নিজের সন্তানকে প্রথম কোলে নেওয়া,তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরা,দুই গালে মন ভরে চুমু খাওয়া-জগতের কোন ছেলে এই সুখ চায় না?বাবা হওয়ার যেই অনুভূতি,সেটা কি অন্য কিছু দিয়ে অনুভব করা যায়?সে জোরপূর্বক সামান্য হাসল।তার আশেপাশেই একটা মেয়ে আছে।সেই মেয়েটা যদি কোনোক্রমে বুঝতে পারে যে এই বিষয়টা নিয়ে আরহাম আফসোস করেছে,তবে টানা তিনদিন সে অনুতাপে ভুগতে ভুগতে শেষ হয়ে যাবে।আরহাম চায় না সে অনুতাপে ভুগুক।মেয়েটা এক জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।আরহাম চায় এখন সে ভালো থাকুক।খুব বেশি ভালো থাকুক।আরহামের মিষ্টি আলিঙ্গনে জড়িয়ে সে সর্বদা ফুলের মতো স্নিগ্ধ থাকুক।ব্যাস এইটুকুই চাই তার।
সবাই একে একে বাচ্চাটাকে কোলে নেওয়ার পর নবনীতা এলোমেলো পায়ে মিসেস শীলার দিকে এগিয়ে গেল।ওয়াজিদ একটু আগে ওটির ভেতর গিয়েছে।রিমির জ্ঞান ফিরেছে সবে।নবনীতা জড়ানো কন্ঠে খানিকটা অনুনয় করে বলল,’আমাকে একটু দিবেন আন্টি?আমি একটু কোলে নেই?’
শীলা আশ্চর্য হলেন ভীষণ।বিস্মিত কন্ঠে বললেন,’অবশ্যই কোলে নিবে।এতো অনুনয় করছো কেন?’
নবনীতা উদাস মুখে একটুখানি হাসি খুশি ভাব এনে জবাব দিলো,’ঐ তো।এমনিই বলছিলাম।প্লিজ আমাকে একটু দিন আন্টি।’
সে অতি সন্তর্পণে শীলার হাত থেকে বাচ্চাটি কে নিজের কোলে নেয়।তারপর প্রচন্ড আনন্দিত হয়ে তার মুখটা দেখে।রিমির একটা মিষ্টি ছেলে বাবু হয়েছে।কি সুন্দর দেখতে সে! রিমির মতো মিষ্টি,আর ওয়াজিদ ভাইয়ের মতো গম্ভীর।নবনীতার বুকে অনুভূতিরা সব আছড়ে পড়ে।বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্টিনে প্রথম রিমির সাথে তার দেখা।আর আজ এতো গুলো দিন পরে রিমির বাচ্চা সে নিজের কোলে নিচ্ছে।ঐ মিষ্টি মতো দেখতে,বাচ্চামো তে ভরা,অবুধ,চঞ্চল মেয়েটি মা হয়েছে।কি অদ্ভুত! সময় এতো দ্রুত চলে যায় কেন?
নবনীতার বুক ভারি হয়ে আসে।নিজের উপর তার নিজেরই রাগ উঠে।এমন খুশির দিনে মন খারাপ করতে আছে?আজ তো আনন্দের দিন।তবে কেন সে একটু পর পর অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে?
সাদা ইউনিফর্ম পরা নার্সটি তার দিকে এগিয়ে এলো।খানিকটা ব্যস্ত সুরে বলল,’ম্যাম।মিসেস রিমি তার বাচ্চাকে দেখতে চাইছেন।আমার এখন তাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে।’
নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’হ্যাঁ,হ্যাঁ শিওর।এই নিন।’
বাচ্চাটিকে হাতে পাওয়া মাত্র নার্সের পোশাকে থাকা মহিলাটি হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন।কেবল পেছনে পড়ে রইল নবনীতা আর তার সাথে অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস।নবনীতা ক্লান্ত হয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।অন্যমনস্ক হয়ে একটা হাত পেটে রাখে।তার কাছেও তো এমন একটা মিষ্টি বাচ্চা ছিলো।কিন্তু সে তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে পারে নি।এই এতো এতো পূর্ণতায় নবনীতার মনে পড়ে যায় সে আসলে অক্ষম,পুরোপুরি অক্ষম।এমন একটা দিন কখনোই তার আর আরহামের জীবনে আসবে না।নিজের সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে কোলে নেওয়ার যেই স্বর্গীয় তৃপ্তি,সেটা কখনোই আরহাম আর তার জীবনে আসবে না।
সে পিছিয়ে গেল আরো কিছুটা।পেছাতে পেছাতে একেবারে আরহামের কাছাকাছি গিয়ে বলল,’বাসায় চলুন।কাজ আছে আমার।’
গাড়িতে বসার পরেও নবনীতা কেমন থম মেরে রইল।আরহাম সন্দিহান চোখে তাকে আগাগোড়া পরোখ করে বলল,’তোমার হয়েছে টা কি বলো তো?’
‘কিছু না।এমনিই।’
আরহাম ক্লান্ত ভঙ্গিতে শ্বাস ছাড়ল।নবনীতার দিকে সামান্য ঝুকে কোমল কন্ঠে বলল,’পরী!এ্যাই পরী।’
নবনীতা তার দিকে না ফিরেই বলল,’কি?’
‘আই লাভ ইউ।’
নবনীতা নাক টানতে টানতে জবাব দিলো,’লাভ ইউ টু।এখন গাড়ি টানেন।বাড়ি যেতে হবে আমায়।’
‘না,টানবো না।’
‘কেন?’ নবনীতা অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়।
আরহাম সিটবেল্ট খুলে তার দিকে আরো খানিকটা ঝুকে তার গালে গাঢ় করে চুমু খেল।নবনীতা হকচকিয়ে গেল ভীষণ।আশ্চর্য হয়ে রাগী রাগী মুখ করে বলল,’হচ্ছে টা কি এসব?আরশাদ আছে না এদিকে?’
‘তো থাকলে?আরশাদ নিজেই তো তোমাকে সারাক্ষণ চুমু খায়।আরশাদের বাবা খেলেই দোষ?’
নবনীতা তার কথার ধরন শুনেই ফিক করে হেসে দিলো।আরহাম তাকে অবাক করে দিয়ে সত্যি সত্যি তাকে আরো কয়েক দফা চুমু খেল।শেষে আরশাদের গালে আদর দিয়ে বলল,’এ্যাই বাবা! মা কে একটু আদর করে দাও তো।’
আরশাদ তার কথা শুনেই এক লাফে নবনীতার কোলে উঠে দাঁড়ালো।ছোট্ট দুইটা হাত নবনীতার গালের দুই পাশে রেখে তার দুই গালে শব্দ করে চুমু খেল।নবনীতা থতমত খেয়ে বলল,’কি সর্বনাশ! সে আমার গাল ধরে চুমু খাচ্ছে কেন?’
আরশাদ মুখ ফুলিয়ে বলল,’বাবা তো এভাবেই খায়।’
উত্তর শুনেই নবনীতার চোয়াল ঝুলে গেল।একটু ধাতস্থ হয়ে সে অগ্নিচোখে আরহামের দিকে তাকায়।একহাতে তার কাঁধে পর পর দু’টো চড় মেরে তিতিবিরক্ত কন্ঠে বলে,’দেখুন।বাচ্চাদের সামনে এসব করলে কি হয় দেখুন।’
.
.
.
.
তাসনুভা বসে আছে খাটের এক কোণায়।তার এক পাশে নবনীতা,অন্য পাশে ইজমা।রিমি বসেছে তার থেকে খানিকটা দূরে।শুভ্রা,আরিশ আর চিত্রা সম্ভবত বসার ঘরে।বাকিদের খবর জানা নেই।
এই মুহূর্তে তারা সবাই ওয়াজিদদের বাড়িতে এসে জড়ো হয়েছে।রিমি কে গত পরশু ডিসচার্জ করা হয়েছে।এখন সে পুরোপুরি সুস্থ।সেই উপলক্ষে শীলা সবাইকে বাড়িতে দাওয়াত করেছেন।তারা সবাই প্রায় সকাল সকাল ওয়াজিদদের বাড়ি পৌঁছে গেছে।কেবল আদি ছাড়া।তার পাসপোর্টে একটা সমস্যা হয়েছে।সে সেটা ঠিক করাতে উত্তরা গিয়েছে।সবকিছু সমাধান করে তারপর সে এদিকে আসবে।
ওয়াজিদ ঘরে ঢুকতেই আরহাম ধাম করে দরজা বন্ধ করে দিলো।ঘরের অবস্থা এই মুহূর্তে গুমোট।নবনীতা চিন্তিত মুখে স্বামীর মতিগতি আর পরবর্তী পদক্ষেপ বোঝার চেষ্টা করছে।রিমি ভীতু দৃষ্টিতে আরহামের রগচটা মুখটা কয়েকবার দেখল।তার সমস্ত মুখ রাগে র’ক্তিম হয়ে আছে।তাকে কেমন ক্ষুদার্ত বা’ঘের মতোন দেখাচ্ছে।মনে হচ্ছে তাসনুভার ধর বিহীন মাথাই একমাত্র এই মুহুর্তে তার ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে।
সে চাপা গর্জন করে তিরিক্ষি মেজাজে চেঁচিয়ে উঠল,’এবার বল,এই বাল পাকনা মেয়ের আমি কি করব?’
তাসনুভা তার ভয়ংকর গর্জন শুনেই আরো বেশি মিইয়ে গেল।কেঁপে উঠে নবনীতার কাঁধ চেপে ধরে বেড়ালের মতো মিনমিনে গলায় বলল,’ভাবি প্লিজ কিছু একটা করো।বাঁচাও আমাকে।’
বলেই সে চোরা চোখে আরহামের দিকে তাকায়।তার সাথে চোখাচোখি হতেই আরহাম খেঁকিয়ে উঠল,’এই বেয়াদব! তুই প্রেমের কি বুঝিস রে?প্রেম কি?ভালোবাসা কি?কিভাবে হয় এসব?থাপ্পড় মে’রে যদি তোর প্রেমের ভূত না ছুটিয়েছি তো আমিও আরহাম না।’
তাসনুভা দ্রুত নিজেকে নবনীতার আড়ালে লুকিয়ে নিলো।কথায় আছে না?যেখানে বাঘের ভয়,সেখানে সন্ধ্যা হয়।তাসনুভার হয়েছে ঐ দশা।এতো কিছুর পর সে ধরা তো খেয়েছেই,তাও আবার বড় ভাইয়ার কাছে।কি পাপ করলে যে মানুষ এমনভাবে ফেঁসে যায় তাসনুভার জানা নেই।আপাতত কপাল চাপড়ানো আর ভাবির আঁচলে মুখ লুকানো ব্যতীত তার আর অন্য কোনো উপায় নেই।
আরহাম তার দিকে দুই কদম এগিয়ে এসে বলল,’এ্যাই তাস! এদিকে তাকা।তুই চিঠিতে এসব আলতু ফালতু কথা কেন লিখেছিস?তোর বয়স কতো?তুই ভালোবাসা বুঝিস?’
তার গলায় আওয়াজ শুনেই আরিশ ছুটে এলো।লক ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে বলল,’কি হয়েছে?তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেন?’
আরহাম তাকে দেখেই আরো বেশি জোর গলায় বলল,’এ্যাই তাস! আরিশকে দেখ।তোর মতো বাল পাকনামি করে সে?তোর চেয়ে তো বয়সেও বড়।কোনোদিন শুনেছিস এমন প্রেম পিরিত করতে?’
তাসনুভা এতোটা সময় বেড়ালের মতোন মিনমিন করছিল।যেই না আরিশের নাম শুনলো,ওমনি খেঁকিয়ে উঠে বলল,’কি?আরিশ ভাই প্রেম পিরিত করে না?’
আরহাম চোখ রাঙিয়ে বলল,’না,আমার ভাই এসব ফালতু কাজ করে না।কি রে আরিশ?তুই প্রেম করিস?’
আরিশ থতমত খেল।বেকুবের মতো দুই দিকে মাথা নেড়ে বলল,’না ভাইয়া।আমি এসব করি না ছিহ।’
তাসনুভা মুখ হা করে বলল,’কি?ভাইয়ার সামনে সাধু হচ্ছো তুমি?কীর্তি সব ফাঁস করে দেই?’
আরিশ ধমকে উঠল,’এক চড় মারব ফাজিল কোথাকার! আমি এসব প্রেম টেম করি না।আমি ভালো ছেলে।’
শুভ্রা দরজার কাছে এসে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।কৌতুহলী হয়ে বলল,’আপনারা কি নিয়ে কথা বলছেন?’
আরিশ তাকে দেখতেই জায়গা ছেড়ে দিলো।শুভ্রা ভেতরে যেতেই আরহাম আরো এক দফা চেঁচালো,’দেখ! শুভ্রা কে দেখ।আরিশ তাকে স্নেহ করে।এখন কি শুভ্রা তোর মতো পাকনামি করে বলবে যে সে তাকে ভালোবাসে?থাপ্পড় মে’রে তোর দাঁত ভেঙে দেওয়া উচিত বোয়াদব।তোর ভালোবাসার আমি গুষ্টি মারি।খ্যাতাপুরি তোর ভালোবাসার!’
শুভ্রা বিষম খেল।অসহায় চোখে একবার আরিশ,একবার আরহামের দিকে তাকালো।আরিশ গলার কাছে হাত দিয়ে ছু’রি চালানোর অভিনয় করে ম’রার ভান ধরল।মিনমিনে গলায় বলল,’শেষ শেষ!ভাইয়া তার দুই ভাই বোনের প্রেমের পিন্ডি চড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে।’
চলবে-
#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৭২)[দ্বিতীয় অংশ]
চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েই আরহাম বাইরের দৃশ্য দেখল।বাগানের একটা গাছের মগডালে একটা কাক বসে তখন থেকে ডাকছে।আরহাম বিরক্ত হয়ে বলল,’আহা! যা না রে শালা।আর কতো ডাকবি?’
নবনীতা ঘরের ভেতর থেকেই শব্দ করে হেসে ফেলল।এগিয়ে এসে বলল,’কাক কে এভাবে বললে সে বুঝবে না।কা কা করে বলুন।তাহলে বুঝবে।’
আরহাম বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়।মাথা চুলকে বলে,’এর চেয়ে ফাহাদের গলা আরো ভালো ছিলো।অনেক দিন হলো নিমকহারাম টার সাথে দেখা হয় না।’
নবনীতা তার পাশে থাকা ইজি চেয়ারে বসে বলল,’আর দেখা হওয়ার দরকারও নাই।যেমন আছে সব,সেভাবেই ভালো আছে।’
আরহাম উত্তরে কেবল সামান্য হাসলো।নবনীতা তার হাতে থাকা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,’আপনি কি আপনার রাজনৈতিক জীবন খুব বেশি মিস করেন?’
আরহাম মাথা নাড়ল।নিচু স্বরে বলল,’খুব একটা না।তবে আজকাল বাবার কথা খুব মনে পড়ে।ডেস্ক ক্যালেন্ডার দেখলে ভয় লাগে।কতো দ্রুত যায় সময়! তোমার আর আমার বিয়ের দুই বছর হয়ে যাচ্ছে।কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে সবকিছু।’
নবনীতা গালের নিচে হাত রেখে জানতে চাইলো,’কেমন স্বপ্ন?ভালো স্বপ্ন নাকি দুঃস্বপ্ন?’
আরহাম হাতে থাকা চায়ের কাপ টা গোলাকার টিপয়ের ওপর রাখল।এক হাতে নবনীতার একটা হাত চেপে ধরে গাঢ় স্বরে বলল,’শ্রাবণের সেই বিকেলে তুমি পার্টি অফিসে আসার পর থেকে যা কিছু হয়েছে,পুরোটাই আমার কাছে একটা সুন্দর স্বপ্নের মতো।’
নবনীতা আলতো করে তার কাঁধে মাথা রাখল।জড়ানো স্বরে বলল,’একটা কথা বলি আপনাকে?’
‘হুম বলো।’
‘আমি মা হতে চাই।’
‘তুমি অলরেডি আরশাদের মা।’
‘আমি আরো একবার মা হতে চাই।নয় মাস একটা সন্তানকে নিজের ভেতর ধারণ করার পর যে মা হয়,আমি সেই মা হতে চাই।’
আরহাম বাইরে থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে ফিরল।মোলায়েম কন্ঠে বলল,’আমি একটা সময় আরশাদ কে নিয়ে অনেক ভালো মন্দ বলেছি।কিন্তু পরে এসে আমি তাকে মেনে নিয়েছি।সত্যি সত্যি আমি তাকে নিজের সন্তানের মতোই ভালোবাসি।আরশাদ বাচ্চাটা ভীষণ আদুরে।আমার খুব আদর লাগে তাকে।তোমার অসুস্থতার বিষয়টা জানার পর আমার আর কখনোই ঐসব বাবা হওয়ার ইচ্ছে জাগে নি।আমি তোমাকে,আরশাদকে,আরিশ আর তাসনুভাকে নিয়ে একটা নির্বিঘ্নে সংসার চেয়েছি।আমার এইটুকুই চাই।আর কতো তুমি এসব নিয়ে মন খারাপ করবে পরী?প্লিজ।স্টপ দিস।’
নবনীতা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না গিলে বলল,’কিন্তু আমি তো এই না পাওয়ার অনুভূতি টা সহ্য করতে পারছি না।কাউকে বললে সে নিশ্চয়ই আমাকে খারাপ ভাববে।কিন্তু সত্য এটাই যে ওয়াসিফকে যখন ওয়াজিদ ভাইয়া আদর করে,মাথায় তুলে পুরো ঘর ঘুরে বেড়ায়,তখন যন্ত্রণায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে আরহাম।আমি পারছি না।কিছুতেই পারছি না।’
আরহামের মায়া হলো ভীষণ।নবনীতা কথা শেষ করার আগেই দুই হাত মুখের উপর চেপে ধরল।রিমির একটা স্বপ্নের মতো সুন্দর সংসার হয়েছে।নবনীতা খুশী।খুব বেশি খুশী।রিমির জীবনটা এতো সুখের হয়েছে,ভাবলেই তার আনন্দ হয়।তার কোনো কষ্ট নেই।সে চায় রিমি আরো বেশি ভালো থাকুক।তার কেবল আক্ষেপ হয়।নিজেকে নিয়ে আক্ষেপ হয়।আল্লাহ তাকে সব দিয়েছেন।সবকিছুর শেষে কি তাকে মা হওয়ার মতো চমৎকার অনুভূতি টুকু দিবেন না?নবনীতা খুব চায় তার কোল আলো করে একটা ছোট্ট পরী আসুক।এই জীবনে সে অনেক পেয়েছে।পেতে পেতে তার লোভ বেড়েছে।সে এখন লোভী হয়ে আরো একটা জিনিস চায়।সে মা হতে চায়।আর কিচ্ছু না,কিচ্ছু চাই না তার।
আরহাম আচমকাই তার গালে হাত রেখে ব্যস্ত হয়ে বলল,’এ্যাই পরী!চট্টগ্রাম যাবে?’
.
.
.
.
ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম,তারপর সেখান থেকে সোজা নাসিরাবাদ।কালো রঙের গাড়িটা মোট সাড়ে পাঁচ ঘন্টার ভ্রমণ শেষে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে এসে পৌঁছুলো।তারা যাত্রা শুরু করেছিল রাত আটটার দিকে।এখন ঘড়িতে সময় রাত একটা চল্লিশ।
গাড়ি থেকে সবার আগে নেমে এলো আদি।নামার পরেই চোখ ঘুরিয়ে সে আশপাশ দেখল।গলার স্বর সামান্য চওড়া করে বলল,’বাপরে! কতো বড়ো বাড়ি!’
আরিশ নামলো তার পেছন পেছন।নেমেই সে ভালো মতো চোখ মেলে সামনে থাকা বিশালাকার বাড়িটা দেখল।বিড়বিড় করে বলল,’আমার হবু শ্বশুরবাড়ি।’
আদি পেছন ফিরে চোখ কপালে তুলে বলল,’কি কি?কি বললে তুমি?’
আরিশ দ্রুত মাথা নাড়ল।দায়সারা হয়ে বলল,’কে?আমি?না তো।কিছু বলি নি তো।’
শুভ্রা ট্রাভেল ব্যাগটা একহাতে নিয় অন্য হাতে আরশাদের হাত ধরে বের হলো।বের হতেই সবার প্রথমে বাড়ির মূল দরজায় তার নজর গেল।সেখানে বড়ো করে একটা তালা ঝুলছে।বাড়ির দরজা টা দেখতেই তার মস্তিষ্কে আবছা কিছু স্মৃতি ভেসে উঠল।এই বাড়ি,এই বাড়ির চৌকাঠ তার কাছে ভীষণ চেনা।তারা দুই বোন এই চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করতো।বাবা কেমন ছিলো?শুভ্রার একটু একটু মনে পড়ে তার মুখটা।বাবা বাড়ি এলেই আপাই দৌড়ে যেত তার কাছে।কতোটা প্রাণবন্ত আর দুরন্ত ছিলো সেসময় আপাই! তারপর ছয়টা বছর আপাই নিস্তব্ধতায় কাটিয়েছে।এরপর বিয়ের পর আটমাস আপাই সেই দুরন্তপনা আর চঞ্চলতায় শেষ করেছে।তারপর কি যেন হয়ে গেল আপাইয়ের সাথে।আরহাম ভাইয়ের বাড়ি ছেড়ে চলে আসা,মিস ক্যারেজ,আরহাম ভাইয়ের মামলা মোকদ্দমা,এসব কিছু শেষ হওয়ার পর আপাই আবার তার সেই নিস্তব্ধত রূপে ফিরে গেল।শুভ্রা জানে আপাই ভালো নেই।এটা তার মুখোশ।ছয় বছর ধরে আপাই যে ভালো থাকার মুখোশ পরে রাখতো,এখনো সে সেই মুখোশই পরে আছে।
সবাই একে একে গাড়ি থেকে নামতেই নবনীতা ধীর পায়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।আরহাম গাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ি লক করতেই আরশাদ শুভ্রার হাত ছেড়ে তার কাছে ছুটে গেল।গিয়েই দুই হাত উপরে তুলে বলল,’কুলে নাও।’
আরহাম অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।পরক্ষণেই আবার একটানে তাকে কোলে নিয়ে বলল,’বাবারে! তোর যন্ত্রণায় আমি অতিষ্ঠ।প্রথমে আমার কোলেই আসতো না,এখন আর কোল থেকে নামে না।যাও না,মায়ের কোলে যাও।দেখো,মা পাঁচ ঘন্টা ধরে ম’রার মতো ঘুমিয়েছে।মা কোলে নিবে যাও।’
আরশাদ সে কথায় কর্ণপাত করলো না।উল্টো আলতো করে মাথাটা আরহামের কাঁধে রেখে চোখ বুজলো।এই শক্ত পোক্ত লোকটার প্রশস্ত বক্ষে আরশাদ খুব আরাম পায়।মা তো আরশাদকে এতো শক্ত করে চেপে ধরে না।মায়ের কোলে এতো মজা করে থাকা যায় না।আরশাদের তো বাবার কোলই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে।
নবনীতা ঝাপসা চোখে বিশালাকার বাড়িটা চোখ ভরে দেখে।এই বাড়িটা তার,এই বাড়িটা শুভ্রার,এই বাড়িটা চিত্রার,এই বাড়িটা তাদের সবার।এই বাড়ির আনাচে কানাচে তার শৈশব আর কৈশোর জড়িয়ে আছে।এই পুরো বাড়িটা তার।
আবেগ অনুভূতির ঝড়ে তোলপাড় হতে হতে নবনী সামনের দিকে পা বাড়ায়।দরজার ঝুলানো তালাটা চাবি ঘুরিয়ে খুলতেই ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে কপাট দু’টো নিজ থেকেই দুই পাশে সরে গেল।নবনীতা শ্বাস বন্ধ করে দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।তার পা একটু একটু কাঁপছে।চোখ এতো বেশি ঝাপসা যে সে সামনেও দেখতে পারছে না ভালো মতো।নবনীতা ভঙ্গুর পায়ে সামনে এগিয়ে যায়।সে পড়বে না,হোঁচটও খাবে না।এই বাড়ির প্রতিটা বিন্দু তার চেনা।সে চাইলে চোখ বন্ধ করেও এখানে হাঁটতে পারবে।
সে চোখ মেলে চারদিক দেখে।তারা এলোমেলো দৃষ্টিতে অজস্র স্মৃতি পালাক্রমে ধরা পড়ে।তার মনে হলো এই বাড়িটা নিরব না,এখানে অনেক অনেক মানুষ গলা ছেড়ে কথা বলছে।নবনীতা সেই কথার শব্দ,সেই হাসির ঝংকার সবটা শুনতে পারছে।ঐ যে বসার ঘরের টিপয়,বাবা বসে বসে চা খাচ্ছে আর পেপার পড়ছে।ঐ তো রান্নাঘরের দরজা দেখা যাচ্ছে।মা সেখান থেকে বের হয়ে গলা ছেড়ে ডাকছে,’পরী!এ্যাই পরী! নাস্তা খেতে আসো।কলেজের সময় হচ্ছে।আর কতো ঘুমুবে?’
তার আওয়াজে দোতলার পূর্ব দিকের ঘরে থাকা মেয়েটা ভীষণ বিরক্ত।মা সাতটা বাজতেই এমন শুরু করে কেন?তার কলেজ তো দশটায়।সে তিতিবিরক্ত মেজাজে শখের ঘুম ভেঙে খাট ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো।গলা উঁচু করে চেঁচালো,’মা! মাত্র সাতটা বাজে।সব সময় এমন করো কেন?’
অমনি মা মেয়ের ঝগড়া বেঁধে যেত।বাবা হাত তুলে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলতো,’আহা! হয়েছে তো।এসো পরী।বাবা খাইয়ে দিবো তোমাকে।’
ব্যাস।ওমনি তার মন ভালো হয়ে যেত।সব বিরক্তি একপাশে সরিয়ে সে ছুটে যেত বাবার কাছে।গিয়েই বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী হয়ে বলল,’আচ্ছা,তাহলে তুমি খাইয়ে দাও।’
নিজের পরিবর্তনে নিজেরই হাসি পায় তার।কতো আহ্লাদী স্বভাবের মেয়ে ছিলো সে।ঐ কি যেন বলে?ওহ হ্যাঁ,বাবার রাজকন্যা।কতো অল্পতেই অভিমান করতো সে! তারপর কি থেকে কি হলো,নবনীতার জীবনের সমস্ত আনন্দ ধূলোয় মিশে গেল।নবনীতা নিজেও নিষ্প্রাণ,ছন্নছাড়া আর দিশাহীন মানবীতে রূপ নিলো।জীবন তাকে ছয় বছর যেই নরকে রেখেছিল,সেই নরকের কথা ভাবলেই নবনীতার বুক ভার হয়ে আসে।
সে এলোমেলো পায়ে সামনে হেঁটে যায়।বাড়ির মানুষের কথার শব্দ,হাসির ঝংকার সবকিছু তার কর্ণকুহরে এসে বারি খায়।সে জানে তারা কেউ নেই,তবুও তাদের অস্তিত্ব,তাদের উপস্থিতি সে টের পায়।এই তো বাবা এখানে,ঐ তো মা দাঁড়িয়ে আছে টেবিল ঘেঁষে।নবনীতা তো সত্যি সত্যি এদের দেখতে পায়।
সে ধীর পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে গেল।ঘরের দরজা আগে থেকেই খোলা ছিলো।নিশ্চয়ই তারা আসার আগেই আরহাম সবকিছু লোক দিয়ে পরিষ্কার করিয়েছে।
নবনীতা মনোযোগ দিয়ে তার ঘরটা দেখল।অনেক আসবাবপত্রে পরিবর্তন এসেছে।তবে খাট টা আগের মতোই আছে।খাটের পাশের ঐ ইজিচেয়ার টাও অবিকল আগের মতোই আছে।সে ভঙ্গুর পায়ে হেঁটে ইজিচেয়ার পর্যন্ত গেল।আজকের দিনটা তার জীবনের অন্যতম সেরা দিন হওয়ার কথা।অথচ বাড়িতে পা রাখার পর তার মনে হলো এদিকে তার না আসাটাই ভালো ছিলো।এখানে সে যতোক্ষণ থাকবে,ততক্ষণ বাবা মায়ের স্মৃতি তাকে কুড়ে কুড়ে খাবে।নবনীতা ক্লান্ত,ভীষণ ভীষণ ক্লান্ত।
হঠাৎ পায়ের কাছে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই নবনীতা নড়ে উঠলো সামান্য।চোখ নামিয়ে দেখল আরহাম দুই হাঁটু ভাঁজ করে ফ্লোরে বসেছে।সে সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো।ব্যস্ত হয়ে বলল,’আরে কি করছেন কি?ফ্লোরে বসেছেন কেন?আসুন চেয়ারে বসুন।’
আরহাম জবাব দিলো না।কেবল তার একটা হাত টেনে পুনরায় তাকে ইজিচেয়ারে বসিয়ে দিলো।ঠান্ডা গলায় বলল,’বসো।বেশি কথা বলো না।’
নবনীতা বসলো।তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি আরহামের দিকে নিবদ্ধ।আরহাম আস্তে করে দেয়ালের সাথে পিঠ হেলান দিয়ে বলল,’তোমার কি মন খারাপ হয়েছে?’
নবনীতা দ্রুত মাথা নাড়ল।
‘মন খারাপ হয় নি।তবে বাবার কথা খুব মনে পড়ছে।’
‘ঐ এক ই কথা।মন খারাপই হচ্ছে।’
নবনীতা চোখ বুজে বলল,’বাবা আমায় ভীষণ আদর করতো।’
‘জানি।’
‘বাবার মতো করে আমায় কেউ ভালোবাসে নি।মাও না।’
আরহাম নিশ্চুপ।তার নিরবতা অনুভব করতেই নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলল।ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তার মুখোভঙ্গি দেখে নিল।সে শান্ত,একেবারে থমকে যাওয়া নদীর মতো শান্ত।নবনীতা পুনরায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।ঠিক তার মুখোমুখি হাঁটু মুড়ে বসলো।আরহাম চোখ বন্ধ রেখেই বলল,’ফ্লোর ঠান্ডা।খাটে গিয়ে বসো।’
নবনীতা সেই কথা শুনল না।উল্টো এক হাত বাড়িয়ে আরহামের গালে আলতো করে স্পর্শ করে জড়ানো কন্ঠে বলল,’আমাকে আপনার মতো করেও কেউ ভালোবাসেনি।আপনি আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র পুরুষ।এর আগে নবনীতা কাউকে ভালোবাসেনি,এরপরেও বাসবে না।’
আরহাম জবাবে কেবল স্মিত হাসল।নবনীতা তার মাথা আরহামের বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,’এমন চুপ হয়ে আছেন কেন?কিছু বলুন।’
আরহাম হালকা করে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,’তুমি যতোই বলো,আমি জানি আমি তোমাকে তোমার বাবার মতো ভালোবাসতে পারিনি।কিন্তু তুমি আমাকে যতখানি ভালোবেসেছো,অতোখানি ভালো কেউ আমাকে বাসেনি।আই অ্যাম লাকি।’
নবনীতা জেদি গলায় বলল,’আমিও লাকি।’
নবনীতা সেই রাতে ঘন্টার পর ঘন্টা তার বরের সাথে গল্প করল।তার শৈশবের গল্প,তার কৈশোরের গল্প,তার স্কুল জীবনের গল্প,কলেজ জীবনের গল্প-এক কথায় সব।আরহাম হঠাৎই কথার মাঝে বলল,’তোমার কলেজ জীবনে কোনো প্রেমিক টেমিক ছিলো না?’
নবনীতা ভড়কে গিয়ে বলল,’মানে?’
‘মানে ঐ ইফাজ আর মেজরের মতো আরকি।এক দেখাতেই তোমার প্রেমে পড়ে গেছে এমন।’
নবনীতা শব্দ করে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতেই বলল,’জানি না।এতোকিছু কখনো খেয়াল করি নি।’
‘খেয়াল করলে দেখতা সবাই তোমাকে পছন্দ করে,চোখ ঘুরিয়ে শুধু তোমাকেই দেখে।ধুর,ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে আমার।কতো পরে আমাদের দেখা হলো।এর আগে সবাই তোমাকে দেখে নিয়েছে।’
নবনীতা আরেক দফা হাসল।আরহামকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে লাজুক হয়ে বলল,’জ্বী না জনাব।আপনি যতখানি দেখেছেন,অতোখানি আমায় আর কেউ দেখেনি।’
বলেই সে আরহামের বুকে মুখ লুকালো।আরহাম হঠাৎই লাফিয়ে উঠে বসল।একনজর নবনীতার মিইয়ে যাওয়া মুখটা দেখেই বলল,’আমার একটা কথা মনে পড়েছে পরী।’
নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’কি?’
আরহাম গমগমে স্বরে বলল,’শ্বশুরবাড়িতে এখন পর্যন্ত আমাদের বাসর হয় নি।’
নবনীতা বিষম খেল।ফ্যালফ্যাল চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে বলল,’কি?কি হয় নি?’
আরহাম জানে উত্তরটা সে ভালো মতোই শুনেছে।এক কথার দুইবার উত্তর দেওয়া তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ।সে উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।সামান্য ঝুকে একটানে নবনীতাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিল।নবনীতা ছটফটিয়ে উঠে বলল,’আরে আরে।কি করছেন কি?’
আরহাম তাকে খাটে নামাতেই সে এক লাফে খাটের কোণায় গিয়ে বসল।চোখ গরম করে বলল,’আরশাদ এখনো ঘুমায়নি।শুভি একটু পরেই তাকে এখানে নিয়ে আসবে।’
আরহাম একটানে তাকে নিজের কাছে আনলো।তার গলার ভাঁজে মুখ গুজে বলল,’আসুক।আরশাদ আজকে শুভি খালামণির সাথে ঘুমাবে।’
নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল,’উফফ না।শুভি ওকে রাখতে পারবে না।শুভি নিজেই,,
সে কথা শেষ না করতেই আরহাম তার পেটে দুই আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিলো।নবনীতা লাফিয়ে উঠে বলল,’এই না না প্লিজ।’
হাসতে হাসতে তার চোখ ভরে উঠল।সে হাসির দমকে কাঁপতে কাঁপতে দুই হাত জোড় করে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।আর কিছু বলব না।আমি রাজি।ছাড়ুন এবার।আল্লাহ রে! মরে যাবো আরহাম হাসতে হাসতে।প্লিজ ছাড়েন।’
.
.
.
.
আদি মাথা তুলে তারা ভর্তি আকাশটা দেখেই বিমুগ্ধ হয়ে বলল,’কি চমৎকার আজকের আকাশ! আসলে এই বাড়িটাই চমৎকার।আই জাস্ট লাভড ইট।’
বলেই সে মাথা নামিয়ে পাশে দেখল।তাসনুভা হুইলচেয়ারে বসে আছে,খুবই বিষন্ন মুখে।আদি কয়েকদিন যাবত লক্ষ্য করছে তার মন খারাপ।কোনো কিছু নিয়ে সে ভীষণ এলোমেলো।অথচ জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে যায়।
আদি হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসল।চঞ্চল গলায় বলল,’তোমার কি হয়েছে বলবে?’
তাসনুভা অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল।মিনমিনে গলায় বলল,’কিছু না।’
আদি অধৈর্য হয়ে বলল,’প্লিজ বলো না।আমার অনেক জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।তোমার মন খারাপ কেন বলো না।তুমি তো এমন মেয়ে নও।তাহলে সারাক্ষণ এমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকো কেন?’
তাসনুভা হালকা করে জবাব দেয়,’জানি না আমি।’
আদি রাগ হলো খানিকটা।অভিমান করে বলল,’আচ্ছা থাক বলতে হবে না।ভালো থাকো তুমি।আমি গেলাম।’
বলেই সে হনহন করে ছাদের দরজার দিকে হাঁটা ধরল।
তাসনুভা হকচকিয়ে গেল খানিকটা।পরমুহূর্তেই আবার নিজেকে সামলে নিল।আদি যখন একেবারে ছাদ থেকে বেরিয়ে যাবে বলে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে,ঠিক তখনই সে পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল,’আমি একজন কে ভালোবাসি।’
আদির কদম থমকালো।মনে হলো পুরো শরীর মিনিটের জন্য জমে গেছে।সে পেছন ফিরে চূড়ান্ত রকমের বিস্ময় নিয়ে তাসনুভার কাছে এগিয়ে গেল।ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি?তুমি কাউকে ভালোবাসো?’
তাসনুভা স্পষ্ট করে বলল,’হ্যাঁ,বাসি।’
আদি ভ্র উঁচু করে বলল,’তুমি এইটুকু মেয়ে ভালোবাসা বোঝো?’
‘হ্যাঁ।বুঝি।’
‘কচু বোঝো।’ গজরাতে গজরাতে উত্তর দিলো আদি।
তাসনুভা তাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,’আমি তাকে ভালোবাসি,অথচ এই কথাটা আমি লজ্জায় তার সামনে বলতে পারছি না।আমার ভালো লাগছে না কিছু।আমি কিভাবে তাকে সব বুঝিয়ে বলবো?আমার তাকে ঐসব কথা বলতে ভীষণ আনইজি লাগে।’
আদি চোখ গোল গোল করে তার কথা শুনল।সে থামতেই একেবারে ঠান্ডা গলায় বলল,’তুমি সত্যিই কাউকে ভালোবাসো?’
তাসনুভা মাথা নেড়ে বলল,’হ্যাঁ বাসি।কিন্তু কিভাবে তাকে জানাবো,সেটা বুঝতে পারছি না।’
আদি ধপ করে ফ্লোরে গিয়ে বসল।তাসনুভা কাউকে পছন্দ করে,এই কথা হজম করতে তার কষ্ট হচ্ছে।মেয়েটাকে সে যথেষ্ট স্নেহ করে।অথচ তার মুখে এই কথা শুনে তার রাগ হচ্ছে।এইটুকু মেয়ে কাউকে পছন্দ করে মানে?এইটুকু বাচ্চা মেয়ের আবার কিসের পছন্দ?আদির মন চাইছে তাকে একটা জোরেশোরে ধমক দিতে।কিন্তু সে এমন কিছুই করল না।কেবল মাথাটা পেছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে গাঢ় গলায় বলল,’তুমি তাহলে এক কাজ করো।তুমি এতো কথা না বলে তাকে ফুল দিয়ে দাও।সে যদি বুদ্ধিমান হয়,তবে ফুল দেখেই সবটা বুঝে যাবে।’
বলেই সে আর অপেক্ষা করল না।দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেল।সে টের পেল আচমকাই তার মন খারাপ হয়ে গেছে।কিন্তু কেন হয়েছে সেটাও সে জানে না।কি অদ্ভুত! সি অদ্ভুত!
সে চলে যেতেই তাসনুভা এক গাল হাসল।আকাশ দেখতে দেখতে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।ফুলই দিবো তাকে।’
***
আদি তার জন্য নির্ধারিত ঘরে এসেই ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়ল।এগুলো কেমন ধরনের কথা বার্তা?এইটুকু মেয়ে প্রেম করে?আদি তো তাকে কখনো কারো সাথে অতিরিক্ত কথাও বলতে দেখেনি।এমনকি সে মোবাইলও ঘাটে না তেমন একটা।সারাক্ষণ তো তাদের সাথেই থাকে।তাহলে তার এই ভালোবাসাটা হলো কখন?
তার মন খারাপ হলো ভীষণ।সে নিজেও জানে না তার কেন এতো খারাপ লাগছে।শুধু একটুক জানে তাসনুভা নামের মিষ্টি মেয়েটার উপর তার খুব বেশি রাগ হচ্ছে।রাগে তাকে দু’টো চড় মারতে ইচ্ছে হচ্ছে।কিন্তু এসবের কিছুই সে করতে পারবে না।সে বরাবরই ভীষণ শান্তিপ্রিয় স্বভাবের মানুষ।অকারণে পরিস্থিতি খারাপ করা তার চরিত্রের সাথে যায় না।
আচমকা দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো।আদি বিগড়ে যাওয়া মেজাজে বলল,’কে আবার?’
অন্যপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না।একেবারে বিক্ষিপ্ত,চূড়ান্ত রকমের বিগড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে আদি দরজা খুলল।দরজা খুলতেই দেখলো দরজার অন্য পাশে তাসনুভা।আদি তাকে দেখতেই তব্দা খেল।সে আরো বেশি আশ্চর্য হলো যখন দেখল তাসনুভার হাতে একটি লাল গোলাপ।গোলাপটা তেমন তাজা না।দেখে মনে হচ্ছে আর একটু সময় দেরি হলেই গাছ থেকে ঝরে পড়তো।
সে দরজা খুলতেই তাসনুভা নত মস্তকে আন্দাজে তার দিকে ফুলটা বাড়িয়ে দিলো।একেবারে নিচু হয়ে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে যেতে কোনোরকমে বলল,’নাও এটা তোমার জন্য।’
চলবে-