কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৭১

0
9

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৭১)

চায়ের কাপটা অনেকক্ষণ ধরে সেভাবেই পড়ে আছে।বিষয়টা চোখে পড়তেই সানাউল হক বললেন,’আরে কি হলো?চা টা নাও না।ঠান্ডা হচ্ছে তো।’

আরহাম একবার কাপটার দিকে দেখে।তারপর হাত কচলে বলল,’না আঙ্কেল।আজ খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’

সানাউল আর তাকে জোর করলেন না।নিজের কাপটায় একটা চুমুক বসিয়ে বললেন,’তো এবার খুলে বলো সেদিন কি হয়েছিল?’

সোফার একটা কুশন কোলের উপর রেখে আরহাম ঠান্ডা গলায় বলল,’সেদিন গাড়িতে আমিও ছিলাম।কিন্তু এক্সিডেন্টের সময় গাড়িতে ছয় জন না,সাতজন ছিলো।আমরা কাশিমপুরে যাওয়ার পথে একজন হাবিলদারের দেখা পাই।তার গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো বলে সেও আমাদের গাড়িতে চড়ে বসল।এর মাঝে রাস্তায় একবার গাড়ি থামানো হয়েছিল।গাড়ির নাকি কিসব রিপেয়ারিং করানো লাগতো।তখন সেসব বুঝি নি।তবে যখন আমাদের ড্রাইভার কিছুতেই আর ব্রেক কষতে পারছিলো না,তখন বুঝলাম গাড়িটা ব্রেকফেল হয়ে গেছে।আর ঐ মেকানিক নিশ্চিত শফিকদের পাঠানো লোকই ছিল।আমি গাড়ির সবাইকে বললাম,’আপনারা গাড়ি থেকে ঝাপ দিন।বসে থাকলে নির্ঘাত মারা যাবেন।’
অথচ কেউ সেই সাহস দেখালো না।একমাত্র জিতেন্দ্র নামের একজন সাব ইন্সপেক্টর বলল,’জ্বী স্যার।আমি রাজি আছি ঝাপ দিতে।’
গাড়িটা যখন পথ হারিয়ে একটা বিশালাকার গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার জোগাড়,ঠিক তখনই আমি আর জিতেন্দ্র কোনো কিছু না দেখে গাড়ি থেকে ঝাপ দিলাম।’

‘আর তোমার হাত?হ্যান্ডকাফ পরেই ঝাপ দিয়েছিলে?’

‘নাহ।গাড়ি ব্রেকফেল হওয়ার পর জিতেন্দ্র নিজেই আমার হ্যান্ডকাফ খুলে দিয়েছিল।আমি যে নির্দোষ এটা অনেকেই জানতো।অমন কঠিন পরিস্থিতিতে দায়িত্বের তুলনায় অনুভূতিদেরই বেশি প্রশ্রয় দিয়েছিল তারা।’

সানাউল হক সামান্য ঝুঁকে গম্ভীর গলায় বললেন,’জিতেন্দ্র বাঁচে নি?’

আরহাম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়,’নাহ।’

‘জঙ্গলে যেই লাশ পাওয়া গিয়েছিলো,ঐটা তার ছিল?’

‘হুম।আমি পড়ে যাওয়ার পরেই একটা গাছের ডাল চেপে ধরেছিলাম।জিতেন্দ্র ছিটকে একেবারে নিচে গিয়ে পড়ল।আমার ধারণা সেখানেই তার মৃ’ত্যু হয়েছে।’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সানাউল হক।চায়ের কাপে আরো একটা চুমুক বসিয়ে বললেন,’তারপর তুমি এতো গুলো দিন প্রভাতির ওখানেই ছিলে?’

‘হুম।প্রভার সাথে থেকেই সব প্ল্যান করেছি।আমি জানতাম প্রভার উপর কেউ নজর রাখবে না।সুতরাং তার বাড়ির মতো সেফ আর কোনো জায়গাই হতে পারে না।তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম,যতোক্ষণ না সবকিছু সত্যি প্রমাণ হচ্ছে,আমি ওখানেই থাকবো।প্রভাকে আপনার এড্রেসও আমিই দিয়েছিলাম।’

‘সেটা অবশ্য আমি বুঝেছি।মেয়েটা যখন আমার কাছে এসে বলল তুমি বেঁচে আছো,আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না।যাক,জেনে খুব খুশি হলাম,এখন দেখা করে আরো ভালো লাগছে।তোমার ওয়াইফ ভীষণ ভেঙে পড়েছিল এই কয়দিন!’

আরহাম মাথা নামিয়ে অল্প হাসল।গাঢ় গলায় বলল,’পরী এমনই।ভীষণ টেনশন করে সবকিছু নিয়ে।’

‘এখন কেমন আছে নবনীতা?’

‘আলহামদুলিল্লাহ।ভালো আছে আঙ্কেল।’

সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।সানাউল হক কিছু একটা মনে পড়তেই বললেন,’খবর শুনেছো?সেদিন নাকি ডিস্ট্রিক্ট ক্লাবে জালাল আর শফিকের কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল।পরে একজন অন্যজনকে ছু’রি মে’রে খু’ন করেছে।কি বিভৎস দৃশ্য! লা’শ গুলো যদি একবার দেখতে!’

আরহাম তার কথা শুনেই অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর হয়ে গেল।মুখের হাসি বিলীন হলো সহসা।একটু কেশে নিয়ে তারপর সে ঠান্ডা গলায় বলল,’এসবে আমি আর মাথা ঘামাই না।রাজনীতি আর রাজনীতির সাথে যুক্ত বিষয়াদি এখন আর আমাকে টানে না।’

সানাউল হক ভাবুক হয়ে বললেন,’সত্যি সত্যি রাজনীতি ছেড়ে দিচ্ছো?’

‘হুম।’

‘তুমি তো নির্দোষ প্রমাণ হয়েছো।তুমি চাইলে এখনো ক্ষমতায় থাকতে পারো।’

আরহাম কিছুটা ক্লান্ত হয়ে বলল,’থেকে লাভ কি?এই সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে চলতে গেলে আমাকে ঐসব নোংরামি ডাইজেস্ট করেই চলতে হবে।’

‘এতোদিন তো সেভাবেই ছিলে।’

‘সেভাবে থেকেই টের পেয়েছি এই সিস্টেম টা কতো বাজে।এখানে আমার স্বকীয়তা বলতে কিছু নেই।দলের মেজরিটি যা বলে,তাই হবে।আমার মতামতের ধার কেউ ধারবে না।এই রাজনীতি করা মানে তাদের সমস্ত অন্যায়ে মৌন সম্মতি দিয়ে তাদের পাশে থাকা।যেটা আর আমার পক্ষে সম্ভব না।না আমি এসব ডাইজেস্ট করতে পারছি,আর না আমি এদের বিরোধিতা করার মতো সাহসী হতে পারছি।আই অ্যাম অ্যাফরেইড অব লুজিং মাই পিপল।আমি কোনো শেকড়হীন মানুষ না যে আমি বুক ভরা সাহস নিয়ে পুরো সিস্টেমের বিরোধিতা করব।আই হ্যাভ রুটস।আমার শেকড় আছে,আমার একটা পরিবার আছে।আমি আমার কারণে তাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না।তারা আমার কাছে খুব মূল্যবান।আমি তাদের নিয়ে খুব বেশি প্রোটেক্টিভ।আমি এদের জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে পারব না।’

সানাউল হক গম্ভীর হয়ে বললেন,’কিন্তু তুমি যদি সাহস করে সিস্টেমের বিরোধিতা করো,তবে মানুষ তোমায় ভীষণ ভালোবাসা দিবে।’

আরহাম হাসল।একেবারে তাচ্ছিল্যের হাসি।
‘রিয়েলি?মানুষ ভালোবাসা দিয়ে আমার জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে?একটা কথা বলি আঙ্কেল?কিছু মনে করবেন না।আমার মনে হয় বাঙালিদের মতো আবেগী আর ভুলোমনা জাতি পুরো পৃথিবীতে আর দু’টো নেই।আপনি খেয়াল করে দেখেন নিলয়ের মৃ’ত্যুর পর মানুষ প্রথম এক সপ্তাহ কি পরিমান প্রোটেস্ট করল।কি না হলো দেশে!এরপর?এরপর সব এমনভাবে শান্ত হলো যেন নিলয় নামের কেউ এই দুনিয়ায় এক্সিস্টই করতো না।বাঙালি এমনই।এরা মাথায় তুলতেও সময় নেয় না,আবার মাথা থেকে নামিয়ে আছাড় দিতেও সময় নেয় না।আপনি মানুষকে খুশি করার জন্য কখনো কিছু করবেন না।যেটা আপনার ভালো লাগে,যেটা করলে আপনি খুশি থাকবেন সেটাই করবেন।দিনশেষে আপনার খুশি থাকাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।মানুষকে খুশি করা দিয়ে কিছু যায় না।নিজে খুশি থাকলেই হলো।আমি অন্তত এমনটাই ভাবি।আমি যা করেছি,নিজের আত্মতুষ্টির জন্য করেছি।মানুষের কাছে হিরো হওয়ার জন্য করিনি।আরহাম নিজের চোখেই হিরো হতে বেশি ভালোবাসে।আমার গল্পে আমিই মহানায়ক।’
.
.
.
.
পদত্যাগ পত্রটি হাতে নিয়েই আরহাম বিষন্ন হাসল।চোখ বন্ধ করলেই অসংখ্য দৃশ্য মনসপটে ভেসে উঠে।ফাহাদের সাথে তার রেষারেষি,দু’জনের দ্বন্দ্ব,এই একটা আসনের ক্ষমতা লাভের জন্য কতো কতো ছলনা,কতো কতো ষড়যন্ত্র! আর সবকিছুর পরিশেষে এই পদত্যাগ পত্র।

শাহরিয়ার আরহাম,রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রায় বছর পাঁচেকের মতো সক্রিয় থাকার পর আচমকাই সিদ্ধান্ত নিলো সে পদত্যাগ করবে।জনগণ তাকে ভীষণ চায়,দল থেকেও সেরকম ভাবে কোনো চাপ তাকে দেওয়া হয়নি।সবই স্বাভাবিক।তবুও আরহাম সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে পদত্যাগ করবে।নির্বাচিত হওয়ার দেড় বছরেরও বেশি সময়ে সে অনুধাবন করেছে এই দেশে রাজনীতি করা আর জীবন নিয়ে জুয়া খেলার ভেতর কোনো ফারাক নেই।আরহাম অতোটা দুঃসাহসী না।জীবন নিয়ে অন্তত সে দুঃসাহস দেখায় না।

সে সাক্ষর করার পর পদত্যাগ পত্রটি যাবে স্পিকারের কাছে।স্পিকার যদি সেটা গ্রহণ করে,তবে সংসদে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে তাকে সংসদ সদস্যের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।

আরহাম ঘন ঘন শ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসল।একটি সই,তারপর চিরতরে আরহাম রাজনীতির অঙ্গন থেকে ছিটকে যাবে।আর কখনো ভিআইপি ট্রানজিট ব্যবহার করা হবে না।আর কিছু না হোক,এটা নিয়ে তার ভীষণ দুঃখ হবে।কতো মজা লাগতো যখন সব গাড়ি দাঁড় করিয়ে তার গাড়িটা সাঁই সাঁই করে এগিয়ে যেত।এখন তো আবার সেই বিজয় স্মরণির সিগনালে বসে ম’রতে হবে।

নিজের চিন্তায় নিজেরই হাসি পেল তার।নিজেকে ভীষণ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে সে।অথচ ভেতর থেকে তার অসহ্য রকম অনুভূতি হচ্ছে।সে বাবার পথ ধরে হাঁটতে চেয়েছিল।সেটা সম্ভব হয়নি।তার পুরো পেশা পাল্টে যাচ্ছে।এই পার্টি অফিস,এই জনগন,এই অল্পবয়স্ক ছেলেদের দল আর তাকে ঘিরে ধরবে না,আর কখনোই আরহাম সমাবেশ করবে না,অনেক গুলো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিবে না।জীবন কতো বিচিত্র!কতো অদ্ভুত! আরহামের গলার কাছে কেমন দলা পাকায় সবকিছু।কাঁপা হাতে কলমটা তুলে নেয় সে।

এই দেশ কি কখনো সুস্থ রাজনীতির মুখ দেখতে পারবে?এই খেটে খাওয়া মানুষরা কি কোনোদিন ইনসাফের দেখা পাবে?রাজনীতির ভয়াল থাবায় যাদের প্রাণ উজাড় হয়েছে,তারা কি আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে?আলোচিত সেই সাগর-রুনি হত্যার এগারো বছর শেষেও কি কোনো বিচার হয়েছে?এই যে পৃথিবী থেকে প্রায় বারোটা বছর চলে যাচ্ছে,অথচ মেঘ কি তার চোখের সামনে তার মা বাবার খু’নীদের বিচারকার্য দেখতে পেরেছে?যেই দেশে একশোবারের মতো রায় ঘোষণার দিন পেছানো হয়,সেই দেশে কি আদৌ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? যেই দেশে তনুরা ধ’র্ষণ হওয়ার পরেও সেটা স্বাভাবিক মৃ’ত্যুর কাতারে ফেলে দেওয়া হয়,সে দেশে কি বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা সম্ভব?তনু,ত্বকী,আবরার ফাহাদ,এমন অগণিত আত্মার আর্তচিৎকার মিশে থাকা রাষ্ট্রে সুদিন ফেরানো সম্ভব কি?বছরের পর বছর পচতে থাকা সিস্টেমে সুবাস ছড়ানো কি বত্রিশ বছরের এই যুবকের পক্ষে সম্ভব?নাকি এই পচে যাওয়া সিস্টেমে থাকলে সে নিজেই একসময় কলুষিত হবে।

আরহাম জানে এই দেশে আদালতের মাধ্যমে ন্যায় বিচার পাওয়া কোনোদিনই সম্ভব না।বেশ জানা আছে তার।এই স্বল্প দিনের রাজনৈতিক জীবনে অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ করেছে সে।এই দেশে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে মামলা করাই কঠিন ব্যাপার,বিচার হওয়া তো পরের বিষয়।রাজনীতির যা কিছু আরহাম দেখেছে,যতোটা বুঝেছে,তা থেকে উপলব্ধি করেছে এখানে খুব বেশি ভালো নেতা হওয়ার শর্ত খুব বেশি নির্দয় হওয়া।এসব সস্তা মায়া ভেতরে নিয়ে ভালো নেতা হওয়া যায় না।বিশেষ করে আরহামের মতো পরিবার কেন্দ্রিক লোকজনের তো নেতা হওয়ার যোগ্যতাই নেই।আরহাম চাইলেই ক্ষমতা হাতে রেখে সেটার স্বদব্যবহার করতে পারে না।সে সরকারের হাতের পুতুল মাত্র।এমনভাবে পুতুল হয়ে থাকার চেয়ে এই লুপ হোল থেকে মুক্তি পাওয়াটাই বেশি আনন্দের।

কিন্তু তবুও এতো ভাবনা চিন্তার পরেও সই করার সময় আপনাআপনি তার হাত কেঁপে উঠল।সে ঘন ঘন শ্বাস ছেড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল।তারপর মনস্থির করে একদম স্বাভাবিক ভাবে কাগজে সই করল।সই করার পরেই সে তোফায়েল কে দেখে মলিন হাসল।আক্ষেপ করে বলল,’তোফায়েল! আমি আর কোনোদিন পার্টি অফিসে বসবো না।এই তোদের কে আমি খুব মিস করব।সপ্তাহে একবার বাড়ি আসবি সময় করে।তোরা বাড়ি এলে আমি মিছেমিছি ভন্ড নেতা সাজবো।নেতা হওয়া আমার খুব বড়ো শখ।’

তোফায়েল একদম শান্ত হয়ে তার কথা শুনল।সে থামার পরেও নিজ থেকে কোনো জবাব দিলো না।তার সমস্ত মনোযোগ ভাইয়ের চোখের দিকে।যেই চোখ একটু পর পর নোনা জলে চিকচিক করছে।ভাই প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার।কিন্তু অবাধ্য অনুভূতিরা কিছুতেই নিষেধ মানছে না।আরহাম দ্রুত উঠে দাঁড়ালো।এক প্রকার ছুটতে ছুটতে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল।এখানে আর এক মুহূর্তও না।

বাড়িতে গিয়েই সে তার ঘরে এসে ধপ করে নবনীতার কোলে মাথা রাখল।নবনীতা মাত্রই আরশাদ কে ঘুম পাড়িয়েছে।আরহাম মাথা রাখতেই সে হকচকিয়ে গেল।অবাক হয়ে বলল,’কি ব্যাপার?আপনি হঠাৎ বাড়ি এসেই সাথে সাথে শুয়ে পড়লেন! হাত মুখ ধুবেন না?’

আরহাম সেই প্রশ্নের উত্তর দিলো না।কেবল মুখটা আরো বেশি তার শাড়ির কুচির ভাঁজে চেপে ধরে ধরা গলায় বলল,’রেজিগনেশন লেটারে সাইন করে দিয়েছি পরী।’

বলেই কেমন অদ্ভুত ভাবে শ্বাস ফেলল।নবনীতা নরম হাতে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,’আপনার খুব খারাপ লাগছে তাই না?’

‘উমম,এতো বেশি না।ঐ আরকি।অনেকদিনের স্মৃতি।’

নবনীতা বলল,’শরীর খারাপ করছে নাকি?হাত পা টিপে দিবো?’

আরহাম হাসল।শক্ত করে তার একটা হাত চেপে ধরে বলল,’জ্বী না।তার কোনো প্রয়োজন নেই।তুমি চুপচাপ আমার পাশে বসে থাকো।তাতেই হবে।’

সে আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ তার এলোমেলো চুলে হাত ছোঁয়ায়।আরহাম অন্যমনস্ক হয়ে গুনে কতো গুলো দিন,কতো গুলো সময় সে শেষ করেছে রাজনীতির পেছনে।
.
.
.
.
তাসনুভার ইদানিং কেমন অসহ্য অনুভূতি হচ্ছে।সে জানে না কেন এসব হচ্ছে।এসবের প্রতিকার কি সেটাও সে জানে না।শুধু এইটুক জানে যা কিছু হচ্ছে সেটা স্বাভাবিক না।

আদি তাকে ভীষণ স্নেহ করে।এই জীবনে বাড়ির মানুষের পর তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে আদি।সেই হিসেবে আদির প্রতি তার কৃতজ্ঞতা কিংবা ভালোবাসা থাকতেই পারে।এতে মন্দ কিছু নেই।কিন্তু তাসনুভা হঠাৎই টের পাচ্ছে,এই ভালো লাগা সম্পূর্ণ আলাদা।যেই ভালোবাসার কথা তাসনুভা বড় ভাইয়ার সামনে মুখেও আনতে পারবে না,আদিকে সে তেমন করেই ভালোবাসে।

এক বিকেলে ইজমা তার কাছে এলো।তার গাল টেনে বলল,’কি ব্যাপার?তুমি এতো মন মরা কেন?’

তাসনুভা মলিন মুখে বলল,’তেমন কিছু না।এভাবেই।’

‘আহা বলো না।কয়েকদিন ধরে দেখছি তুমি কেমন উদাসীন।সবসময় কি যেন ভাবো,মন খারাপ করে থাকো।কি হয়েছে বলো না।’

তাসনুভা একটু দম নিলো।ধিমি গলায় বলল,’আমার খুব বাজে একটা সমস্যা হচ্ছে আপু।আমি খুব লজ্জিত,একই সাথে কনফিউজড।’

ইজমা বোধ হয় বুঝলো কিছুটা।সে কথা শেষ করতেই মোলায়েল গলায় বলল,’আপুকে বলতে পারো কি সমস্যা।যদি কোনো আপত্তি না থাকে তোমার।’

তাসনুভা দুইহাত মুখে চেপে বলল,’বিষয় টা আপত্তির না আপু।বিষয়টা লজ্জার।’

ইজমা কিছুক্ষণ ভাবলো।তারপর আদুরে গলায় বলল,’আচ্ছা যাও।তোমায় মুখে বলতে হবে না।আমি নবনীতার ঘর থেকে একটু ঘুরে আসি।তুমি একটা কাগজে তোমার মনের অবস্থা সব লিখে দাও।যাওয়ার সময় তোমার লিখাটা আমি সাথে করে নিয়ে যাবো।পরে বাসায় গিয়ে পড়ব কেমন?’

এই প্রস্তাব তাসনুভার পছন্দ হলো।সে সাথে সাথেই খুশি হয়ে হাততালি দিয়ে বলল,’হ্যাঁ হ্যাঁ।এটা দারুণ হবে।প্লিজ তুমি এখন বাইরে যাও।’

বলেই সে ইজমাকে দরজার দিকে ঠেলে দিলো।ইজমা অবাক হয়ে বলল,’আরে আরে দাঁড়াও।যাচ্ছি তো।এমন করে কেউ বের করে দেয়?আদি ঠিকই বলে,তুমি একটা বাচ্চা।’

তাসনুভা চেঁচায়,’আপু প্লিজ যাও তুমি।’

‘আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছি।আর টমেটোর মতো লাল হতে হবে না।’

তাসনুভা তবুও টমেটোর মতো লাল হলো।ইজমা চলে যেতেই সে দরজা ভিরিয়ে দিয়ে টেবিল থেকে একটা কাগজ হাতে নিলো।তারপর খাট থেকে একটা বালিশ কোলে নিয়ে তার উপর কাগজটা রেখে লিখতে শুরু করলো।

কি লিখা যায়?কি সম্বোধন দেওয়া যায়?কিভাবে শুরু করতে পারে সে?
তাসনুভা কলম চালায়।প্রথমে কেমন খচখচ করছিল,কিন্তু একবার শুরু করার পর সে আর থামলো না।লিখে গেলো,তো লিখেই গেল।

***

সন্ধ্যায় পায়েসের বাটি হাতে তাসনুভার ঘরের সামনে এসেই আরহাম কপাল কুঁচকায়।দরজা লাগানো কেন?তাসনুভা তো কখনো দরজা বন্ধ করে না।সে এক হাতে দরজায় ধাক্কা দেয়,’তাস! এ্যাই তাস! দরজা খোল।’

দুইবার কোনো সাড়া না পেয়ে বিরক্ত হয়ে দরজার লক ঘোরাতেই আরহাম টের পেল দরজা খোলা,কেবল ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে।সে ভেতরে উঁকি দিলো।দেখল তাসনুভা হুইলচেয়ারেই বসে বসে ঘুমুচ্ছে।

মুখ দিয়ে চ-কারান্ত শব্দ করে আরহাম ঘরে ঢুকল।মেয়েটা এতো উদাসীন কেন?কাউকে ডাকলেই তো হতো।এভাবে হুইলচেয়ারে বসে ঝিমানুর কি দরকার?খাটে আরাম করে শুয়ে গেলেই তো হয়।

সে বিরক্তিতে সামনে এগিয়ে যায়।এগিয়ে যেতেই সবার প্রথমে তার চোখে পড়ে তাসনুভার কোলে একটা বালিশ,বালিশের উপর একটা কাগজ।কাগজের অনেকটা অংশ জুড়ে লিখা,বাকিটা এখনো লিখা হয় নি।এর আগেই সে ঘুমিয়ে গেছে।

আরহাম একটানে কাগজটা নিজের হাতে নেয়।প্রথমে সম্বোধন দেখেই বুঝে এটা একটা চিঠি।কিন্তু প্রাপক বাড়িতে থাকা অবস্থাতেই তাসনুভা কেন তাকে চিঠি লিখছে সে জানে না।সে আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করল।সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা-

“ইজমা আপু,
তোমাকে কিভাবে সব বলব জানি না।বলার পর তুমি আমাকে কি ভাববা সেটাও জানি না।তবুও বলছি।আদি ভাইয়াকে আমি ভীষণ পছন্দ করি।এতে অবাক হওয়ার কিছু নাই।তাকে সবাই পছন্দ করে।কিন্তু আমি একটু বেশিই পছন্দ করি।সে যদি তোমার সাথে একদিন দেখা না করে,তবে কি তোমার রাগ হয়?কিন্তু আমার হয়।আমার মন খারাপ হয় ভীষণ।সে একদিন আমার সাথে মিষ্টি করে কথা না বললে আমার কেমন অসহ্য লাগে সব।তার প্রতি আমি যা অনুভব করি,তা মুখে বলতেও আমার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে।কিন্তু সত্য এটাই যে আমি এমনটাই অনুভব করি।

আপু।সেদিন পার্কে যখন সে আমায় বলল ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’ তখন অজানা আনন্দে আমার মন ভরে উঠেছিল।জানি সে আমায় স্নেহ করে কথাটা বলেছে।কিন্তু আমার মন তো এখন আর তার আর আমার ব্যাপারটা স্নেহ হিসেবে দেখে না।সে যখন ঐদিন আমায় বলল আমি মোটেও অক্ষম না,বরং আল্লাহ আমাকে ততটুকুই দিয়েছে যতোটুকু আমার প্রয়োজন,,এটা শুনেও আমার চোখ ছলছল করে উঠেছিল।আমাকে কখনো অমন করে কেউ কোনোদিন বোঝায় নাই।কেউ কখনো এমন করে আমাকে ভালোবাসে নি।হুইলচেয়ারে থাকাকে আমি সবসময়ই সমাজের কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের বিষয় হিসেবে দেখেছি।একমাত্র আদি ভাইয়াই এমন একজন যে আমার পরিবারের মানুষের মতো আমাকে একেবারে স্বাভাবিক আর পুর্নাঙ্গ মানুষ হিসেবে দেখে আসছে।তার সেই আদর স্নেহ পুরোটাই আমার হৃদয় জুড়ে আছে।তার মতো আমারও বলতে ইচ্ছে হয়,’আমিও আপনাকে ভালোবাসি।’

দয়া করে তুমি এই কথা কাউকে বলো না।প্লিজ আপু।ভীষণ ঝামেলা বেঁধে যাবে যদি এই কথা জানাজানি হয় তবে।বড় ভাইয়ার কানে যদি একবার এই কথা যায়! না না আমি আর ভাবতেই পারছি না।বড় ভাইয়া আমাকে জ্যান্ত ক’ব’র দিবে,নয়তো কে’টে টুকরো টুকরো করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিবে।অথবা রান্নাঘরের ব’টি এনে ডিরেক্ট জ’বা’ই করে দিবে।আমি তাকে চিনি।”

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে