#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৭০)[প্রথম অংশ]
[প্রচন্ড ক্লান্তিতে লিখেছি।টাইপিং মিস্টেক হওয়ার চান্স খুব বেশি]
প্রাণপ্রিয় প্রিয়তম,
আকাশের ঠিকানায় এটা আমার একশতো আটাশ তম চিঠি।যেই চিঠি হয়তো কোনোদিনই তার প্রাপকের কাছে পৌঁছুবে না।তবুও আমি লিখি।রোজ রোজ লিখি।কারণ আমার আর মনের কথা ব্যক্ত করার মতো জায়গা নেই।এই কাগজের টুকরোই একমাত্র মাধ্যমে যেখানে আমি প্রাণ খুলে,মন উজাড় করে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি।এখনো আমি স্বপ্ন দেখি আপনি ফিরে আসবেন।কোনো এক অলৌকিক শক্তিবলে আপনি ফিরে আসবেন।আমাদের আমার দেখা হবে,তাও আবার এই ধরণীর বুকেই।আমার বিশ্বাস আপনি বেঁচে আছেন।আমার খুব কাছেই আছেন।যেই বাতাসে আমি শ্বাস নেই,ঐ বাতাসে আপনারও অস্তিত্ব আছে।সেদিন ক্ষণিকের জন্য আমি যেই মানুষটার দেখা পেয়েছিলাম,সেটা আপনিই।আপনি বাদে এমন নিঃসংকোচে কেউ আমায় ছুঁতে পারে না।আমি জানি সেটা আপনি।প্রতিটা মুহূর্ত আমি আপনার ফিরে আসার অপেক্ষায় বেঁচে আছি।পৃথিবী কেমন করে চলছে,দিন দুনিয়ার খবর কি-এসব কিছুই আমি জানি না।জানতে ইচ্ছেও হয় না।
ব্যবসার দিকেও আজকাল মনে বসে না।ঐতো টুকটাক একটু দেখি।প্রথা আর মামিই সব করে।চিত্রার মিডটার্ম শেষ হলো কিছুদিন আগে।ইদানিং আমি তাকে পড়াতেও বসাই না।সে পড়ল কি না পড়লো,এসবে আমার কোনো খেয়াল নাই।চেষ্টা তো করি স্বাভাবিক হওয়ার।কিন্তু কিছুতেই পারছি না আরহাম।দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।শাস্তি হিসেবে সাময়িক বিচ্ছেদ হলেও তো হতো।এমন অনন্ত কালের বিচ্ছেদ যন্ত্রণা কেন সহ্য করতে হচ্ছে আমায়?
এই কিছুদিন আগে একটা ঘটনা ঘটেছে।ডিস্ট্রিক্ট ক্লাবে শফিক আর রহমানের লা’শ পাওয়া গেছে।পুরো ঘটনা আমি বিস্তারিত জানি না।ওয়াজিদ ভাইয়া ফোন দিয়েছিল।কিন্তু আমি মন দিয়ে শুনিনি।আমি ইদানিং কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারি না।এই অসুখ আমার নতুন যোগ হয়েছে।আমি কিছুতেই ফোকাস করতে পারি না বেশিক্ষণ।ভাসা ভাসা যা কিছু ওয়াজিদ ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি,তা থেকে জানলাম তাদের লাশ নাকি ক্লাবের কমন রুমে পাওয়া গেছে।দু’জনের হাতেই ছু’রি ছিলো।কথা কাটাকাটি হয়ে নাকি একজনই আরেকজনকে মে’রে ফেলেছে।কি ভয়াবহ ব্যাপার! ওয়াজিদ ভাইয়া বলল লাশ গুলোর দিকে নাকি তাকানো যাচ্ছিলো না,এতো জঘন্য ভাবে মেরেছে একজন আরেকজনকে।বিষয়টা দুঃখজনক,কিন্তু আমি শান্তি পেয়েছি।ভীষণ শান্তি পেয়েছি।এদের এমন মৃ’ত্যুই প্রাপ্য।সজীব খন্দকারকে তো এরা এভাবেই মে’রেছিল।এদের সাথে যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে।এদের জন্য আমার একদমই কষ্ট হয় না।
আরহাম! ও আরহাম!
আপনি কি আমায় শুনতে পান?আপনি কি একটু আমার জন্য দোয়া করবেন?মনে আছে গতবার রোজার ঈদে আপনি আমায় দুই হাজার টাকা সালামি দিয়েছিলেন?এবারও রোজা চলে আসছে।আপনি কি এবার আমায় সালামি দিবেন না?আমি কি এই রমজানে আপনাকে আর কাছে পাবো না?ঈদের নামাজের পর আপনি আমার হাতে বানানো পায়েস খাবেন না?এই এত্তো বড় পৃথিবীতে বাকি জীবন আমায় একাই থাকতে হবে?এটাও কি সম্ভব?দয়া করে আমায় এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন আরহাম।আমি আর পারছি না।এতো এতো মৃ’ত্যুর মিছিলে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা।আপন মানুষরা কাছে এসে তাদের ভালোবাসায় আমাদের জীবনটা ভরিয়ে দেয়।তারপর যখন আমরা তাদের অস্তিত্ব ছাড়া নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না,তখনই তারা হুট করে গায়েব হয়ে যায়।এমন কেন হয়?সবাই কেন আমায় ছেড়ে চলে যায়?আমি কেন সবাইকে ছেড়ে যেতে পারছি না?এই ভয়াবহ একাকিত্বের মাঝে কিভাবে আমি আমার বাকি জীবন কাটাবো?আরহাম,,আপনি কি আরেকবার আমাকে ‘ভালোবাসি’ বলবেন?আরেকবার আমায় এই বলে স্বান্তনা দিবেন যে আমাদের খুব দ্রুতই দেখা হবে?আমি আপাতত সেই স্বান্তনাতেই বেঁচে থাকতে চাই।’
নবনীতা বলপয়েন্ট কলমটা বন্ধ করে দুই হাত টেবিলের উপর রেখে সেখানে মাথা ঠেকায়।আর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না।কেমন ক্লান্ত ক্লান্ত লাগছে।এক গ্লাস শরবত খেতে পারলে ভালো হতো।চিত্র একটু পর স্কুল থেকে আসবে।তাসনুভা দুইদিন যাবত অনেকবার ফোন দিচ্ছে ঐ বাড়িতে যাওয়ার জন্য।নবনীতা যাচ্ছে না।যেতে ইচ্ছে করে না তার।ঐ বাড়িটা দেখলেই সে কান্নায় ভেঙে যাবে।ঐ বাড়ি তার কাছে আর মানসিক শান্তির জায়গা না।ঐ বাড়িতে পা রাখলেই নবনীতা সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবে।বাড়ির আনাচে কানাচে তার সংসার জীবনের স্মৃতি।নবনীতা ঐ স্মৃতিদের এড়িয়ে যাবে কেমন করে?’
সময় গড়ায়।নবনীতা একের পর এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসে থাকলো।শরৎ শেষে হেমন্ত এসে যাচ্ছে।অথচ তার প্রিয়তম এখনো আসছে না।সে একটা হাত গালের নিচে রেখে ছোট্ট শিশুদের মতো বিড়বিড় করল,’আকাশে মেঘের ভেলা ভাসতে শুরু করেছে।আপনি কবে আসবেন আরহাম?’
.
.
.
.
রিমি টুলের উপর দাঁড়িয়ে আলমারির উপরে থাকা জুয়েলারি বক্সটা হাতে নেওয়ার চেষ্টা করছিল।অথচ বক্সটা এতো উঁচুতে,যে সে নাগালই পাচ্ছিল না সেটার।সে দুই পা আরো উঁচু করল।বিরক্ত হয়ে একটা গালি দিলো,’ধুর বাল! ধরতেই তো পারছি না।’
ওয়াজিদ ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখেই চেঁচিয়ে উঠল।দৌড়ে এসে বলল,
‘রিমি! করছো কি তুমি?নামো নামো।এক্ষুনি নামো।’
রিমি ভড়কে গেল ভীষণ।তব্দা খেয়ে বলল,’কেন?কেন?কি হয়েছে?’
ওয়াজিদ সেই কথার জবাব দিলো না।শক্ত করে তার একটা হাত চেপে ধরে ব্যস্ত গলায় বলল,’প্রশ্ন পরে করবে।এখন নামো এখান থেকে।’
রিমি বিচলিত হয়ে ওয়াজিদের হাত ধরে নিচে নেমে এলো।কপাল কুঁচকে বলল,’সমস্যা কি?এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন?’
ওয়াজিদ চোখ রাঙিয়ে বলল,’কি?আমি অদ্ভুত আচরণ করছি?তুমি এই অবস্থায় এমন টুলের উপর উঠেছো কোন সাহসে?’
রিমি গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’কেমন অবস্থা?আমার কি হয়েছে?’
ওয়াজিদ মুখ হা করে উপরনিচ তাকে দেখে।তারপর ডান হাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে তার পেট বরাবর আলতো করে চাপ দিয়ে বলে,’তোমার কি হয়েছে জানো না?এই যে এটার কথা কি সবসময় ভুলে যাও?’
রিমি হাসল।মাথা চুলকে বলল,’এটা এতো সিরিয়াস কিছু না।আমি সাবধানেই সব কাজ করি।’
ওয়াজিদ থমথমে মুখে কয়েক সেকেন্ড তাকে দেখল।তারপর দুই হাত জোড় করে মাথা নামিয়ে বলল,’থাক হয়েছে।অনেক সাবধান তুমি।সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?দয়া করে আর এইসবে উঠতে যাবে না।আল্লাহ! কতো বড়ো সাহস এই মেয়ের!’
শীলা আনারের রস ভর্তি গ্লাস হাতে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,’কি হয়েছে?কি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে?’
ওয়াজিদ যেন তাকে দেখতেই নতুন করে শক্তি পেল।সে কন্ঠ চওড়া করে বলল,’মা জানো?রিমি আজ একা ঘরে টুলের উপর উঠে জিনিস নামানোর চেষ্টা করিলো।’
মিসেস শীলা চোখ বড় বড় করে বললেন,’কি?এই অবস্থায় সে টুলে উঠেছে?’
‘হ্যাঁ।চিন্তা করো একবার।’
শীলা কপালে হাত রাখলেন।বিস্মিত ভঙ্গিতে বললেন,’আল্লাহ! এতো সাহস তোমার রিমি! যদি পড়ে যেতে?’
রিমি কপাল চাপড়ায়।আশাহত আর ক্লান্ত গলায় উত্তর দেয়,’এতো ভয় পাওয়ার কি আছে এটাতে?’
‘তো ভয় পাবো না?’
‘না পাবে না।এটা খুব নরমাল।তোমরা এমন আচরণ করো যে আমার মন হয় এই দুনিয়ায় আমিই প্রথম মা হচ্ছি।এর আগে সবার বাচ্চা আকাশ থেকে পড়তো।’
শীলা ভ্রু কুঁচকে বললেন,’বাকিদের টা জানি না।তবে আমাদের ঘরে তুমিই প্রথম মা হচ্ছো।’
রিমি গোল গোল চোখে বলল,’তো আপনি হন নি মা?’
শীলা মৃদু হেসে তার এক গালে হাত রেখে বললেন,’আমার হিসেব আলাদা।তুমি বাচ্চা মেয়ে।তোমাকে একটু বেশিই যত্ন রাখতে হবে।’
হাতে থাকা আনারের রস পুরোটা রিমিকে খাইয়ে তবেই দম নিলেন শীলা।সে পুরোটা শেষ করতেই তিনি খালি গ্লাস হাতে তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।চুলায় যে তরকারি বসানো,এই কথা তার এখন মনে পড়েছে।
তিনি যেতেই ওয়াজিদ রিমির পাশ ঘেঁষে বসলো।রিমি ক্লান্ত হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’আর ভালো লাগে না।বড্ড ভার ভার লাগে শরীর।’
সে তার মাথাটা ওয়াজিদের কাঁধে ফেলল।শ্বাস টেনে বলল,’আপনি জানেন?আমার হাত পা ফুলে যাচ্ছে।বড্ড কুৎসিত হয়ে যাচ্ছি আমি আজকাল!’
ওয়াজিদের কথাটা পছন্দ হয়নি তেমন।সে চোখ গরম করে পাশ ফিরে বলল,’কি?কি হয়েছো তুমি?’
‘কুৎসিত,কুৎসিত।আগলি হয়েছি আমি।পেত্তিনিদের মতো দেখায় আমাকে।’
ওয়াজিদ একটা ভয়ংকর কাজ করল হঠাৎ।রিমি থামতেই সে খানিকটা এগিয়ে এসে তার ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরল।রিমি নিশ্বাস নেওয়ার পাশাপাশি পলক ফেলাও ভুলে গেল।এক মিনিটের মতো চুমু খেয়ে ওয়াজিদ তাকে ছেড়ে দিলো।আগে যেখানে বসা ছিল,সোজা হয়ে আবার সেখানে গিয়ে বসলো।
রিমির মুখ তখনো হা।তব্দা খেয়ে কতোক্ষণ সে সেভাবেই বসে রইল।শেষে দরজার দিকে দেখে আঁতকে উঠে বলল,’আল্লাহ! দরজা খোলা ছিলো ওয়াজিদ।’
ওয়াজিদ ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল,’তো কি হয়েছে?আরেক বেটার বউকে চুমু খেয়েছি নাকি আমি?নিজেরই তো বউ।সমস্যা কি?’
একেবারে দায়সারা জবাব।রিমির চোখের বিস্ময় কাটে না।সে হতবাক হয়ে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে।অস্ফুটস্বরে বলে,’আপনি ওয়াজিদ?কথায় কথায় মুখ কুঁচকে ফেলা লোকটাই আপনি?’
ওয়াজিদ শব্দ করে হেসে ফেলল।একবার দরজার দিকে দেখে পুনরায় রিমির অধরে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,’জ্বী।আমিই সেই ওয়াজিদ।কোনো সন্দেহ?’
রিমি গোল গোল চোখ করে বলল,’আপনি যে এমন সেটা আমি বিয়ের আগে একদমই বুঝি নাই।’
বলতে বলতেই লজ্জায় সে নিজেকে একটু গুটিয়ে নিল।ওয়াজিদ তার আরো কাছাকাছি এসে ফিসফিস করে বলল,’কেন কেন?আমি কেমন?খুব বেশি রোমান্টিক?খুব বেশি জ্বালাতন করি তোমাকে?’
রিমি মাথা নামিয়ে চোখ মুখ খিঁচে ধরল।মিনমিনে স্বরে বলল,’চুপ করুন।আর শুনতে চাই না।’
‘কেন শুনতে চাও না?বলো না আমি কেমন?অনেক বেশি গা ঘেঁষা?রোজ রোজ তোমায় জ্বালাতন করি?এই দেখো,কতো মাস হলো তোমায় একটুও জ্বালাচ্ছি না।’
রিমির কান ঝা ঝা করে উঠে।মনে হচ্ছে এখনই কান থেকে ধোঁয়া বের হবে।সে মাথাটা আরো বেশি নিচু করে বলল,’চুপ করুন প্লিজ।দরজা খোলা।মা একটু পর পর আসে।এসব শুনলে কি বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হবে!’
ওয়াজিদ কপাল কুঁচকে বলল,’কেন?বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে কেন?তাদের সময় কি তারা কম করেছে নাকি?’
রিমি হা হয়ে তার দিকে তাকালো।মুহূর্তেই খিলখিল করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।তার হাসির ঝংকার দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো।সে হাসতে হাসতেই কোনোরকমে বলল,’ইসস! কি বাজে কথা।’
ওয়াজিদ বিমুগ্ধ নয়নে তার হাসি দেখল।এই হাসি,এই মেয়ে,এই ঘর,এই সংসার-সবকিছুই তার চমৎকার লাগে।রোজ রোজ সমস্ত ক্লান্তির শেষে এই ঘরটা তাকে শান্তি দেয়।সে সুখী,অনেক বেশি সুখী।রিমি তাকে জগতের সেরা সুখী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।এর বেশি তার আর কিছুই চাই না।
রিমি তার বুকে মাথা রেখে ডাকল,’ওয়াজিদ!শুনছেন?’
ওয়াজিদ তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জবাব দেয়,’হুম।বলো।’
‘আপনি কি চান?আমাদের ছেলে হোক না মেয়ে?’
ওয়াজিদ একটু ভাবল।শেষে গাঢ় গলায় বলল,’যেটাই হোক।আমি চাই যেন ছোট্ট একটা রিমি হোক।আর কিছু চাই না আমার।’
.
.
.
.
‘শুভ্রানী! তোমার সাথে দেখা করতে কে যেন এসেছে।’
শুভ্রা খুব মন দিয়ে পড়ছিল।রিতার কন্ঠ কানে যেতেই সে এক লাফে উঠে দাঁড়ালো।খুশিতে গদ গদ হয়ে বলল,’কে?আমার আপাই?’
রিতা মাথা নেড়ে বলল,’না না।একটা ছেলে।আগে একবার এসেছিল বোধ হয়।যা গিয়ে দেখা করে এসো।’
শুভ্রা কপাল কুঁচকে নিল।
‘ছেলে এসেছে?’
সে কালো রঙের সুতির ওড়না মাথায় পেঁচিয়ে হোস্টেলের নিচে নেমে এলো।সে যা ভেবেছিল,তাই।আরিশ এসেছে।পরনে একটা নীল শার্ট।শুভ্রাকে দেখতেই সে স্মিত হাসল।জবাবে শুভ্রাও তাকে একগাল হাসি উপহার দিলো।
শুভ্রা কাছে এসে বলল,’আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।কেমন আছেন?’
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম শুভ্রা।আমি ভালো আছি।তোমার কি অবস্থা?’
শুভ্রা জবাব দিলো,’আমিও ভালো আছি।’
আরিশ একটু খচখচ করছিল শুরুতে।শেষে সমস্ত জড়তা কাটিয়ে সে তার হাতে থাকা প্যাকেটটা ছিঁড়ে সেখান থেকে হাফ পাউন্ডের একটা ছোট্ট কেক বের করে শুভ্রাকে দেখে বলল,’হ্যাপি বার্থডে শুভ্রা।জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোমায়।’
সমুদ্রের বিশালাকার ঢেউ তীরে এসে আঁছড়ে পড়লে যেমন অনুভূতি হয়,শুভ্রার ঠিক তেমনই অনুভূত হলো।সে ফ্যালফ্যাল চোখে কতোক্ষণ আরিশের হাতে থাকা কেকটার দিকে তাকিয়ে রইল।আজ তার জন্মদিন?অথচ এই কথা সে দিব্যি ভুলে গিয়েছিল।অন্যান্য বার আপাই তার জন্মদিনে বাসায় কেক বানাতো।অথচ এইবার আপাই ঠিক মতো নিজের নামই মনে রাখতে পারে না,শুভ্রার জন্মদিন মনে রাখবে কেমন করে?অথচ আরিশ তার জন্মদিন মনে রেখেছে।ঢাকা থেকে এই পর্যন্ত এসেছে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে।
তার চোখ ভরে উঠল।সে দ্রুত মাথা নামিয়ে ভেজা চোখ আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে বলল,’অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।আপনি কি করে জানেন আজ আমার জন্মদিন?’
আরিশ নরম গলায় বলল,’ভাবি একবার বলেছিল।তখন মনে রেখেছিলাম।’
‘আপনি ঢাকা থেকে এসেছেন?’
‘হুম।আজ আমার মিড ছিলো।ঐটা শেষ করে তারপর আসলাম।তাই একটু দেরি হয়ে গেল।’
শুভ্রা আর জবাব দিলো না।কেবল জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে যেই মানুষ পরীক্ষার মাঝে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ ছুটে এসেছে,তাকে শুভ্রা কি বলবে?কি বলে শুভ্রা তার কৃতজ্ঞতা আদায় করবে?আদৌ কি কৃতজ্ঞতা আদায় করা সম্ভব?
আরিশ ডানদিকে দেখে বলল,’চলো ঐখানে গিয়ে বসি।’
শুভ্রা পুতুলের মতোন তার পিছু পিছু হেঁটে গেল।দু’জন চুপচাপ একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল। আরিশ কেক কাটার পর নিজেই শুভ্রাকে খাওয়ালো।খাওয়াতে গিয়েই সে টের পেল মেয়েটা কান্না চেপে রেখেছে।তার দুই চোখ একটু পর পর পানিতে ভরে উঠছে।সে কিছু জানতে চাইল না।শুধু নিচু স্বরে বলল,’আবারো জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা শুভ্রা।অনেক বড়ো ডাক্তার হও এই দোয়া করি।’
শুভ্রা দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরল।কোনোরকমে মাথা নেড়ে বুঝালো সে খুব ভালো ডাক্তার হবে।মিনিট দশেক বাদেই আরিশ উঠে দাঁড়ালো।সামান্য হেসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে বলল,’আমি তাহলে আসি শুভ্রা।নিজের খেয়াল রেখো।পরে কোনোদিন দেখা হবে আবার।’
মুখে সেই অমায়িক হাসি ধরে রেখেই আরিশ সামনের দিকে এগিয়ে গেল।মেয়েটার আজ জন্মদিন।অথচ কেউ একবার তাকে উইশ করলো না! তার জন্য আরিশের মায়া হয়।শুধু কি মায়া?আরিশ জানে এই মেয়েটাকে সে ভালোবাসে।একেবারে নিরীহ,শান্ত আর ঘরকুনো একটা মেয়ে! ভালো না বাসার মতো কোনো কিছু আদৌ পুষ্পিতা নূরের মাঝে নেই।
‘আরিশ!’
পেছনে থাকা নারী কন্ঠটি অকস্মাৎ উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠল।আরিশের কদম থমকে গেল।সে অবাক হয়ে পেছন ফিরল।
সে ঘুরে দাঁড়াতেই শুভ্রা দিকবিদিক ভুলে তার দিকে ছুটে গেল।
গুনে গুনে ছয় সেকেন্ড পর শুভ্রা তীব্র বেগে ছুটে এসে তার প্রশস্ত বুকটায় আছড়ে পড়ল,শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তার পিঠ।
আরিশ প্রথম কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।ঘটনাটা মস্তিষ্কে জায়গা করে নিতে বেশ সময় লাগলো তার।কিন্তু যখন শুভ্রার হেঁচকি তোলা কান্নার শব্দ তার কর্ণকুহরে এসে ধাক্কা খেল,তখনই সে সম্বিৎ ফিরে পেল।ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি হয়েছে শুভ্রা?এভাবে কাঁদছো কেন?’
শুভ্রা তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।একেবারে তার শরীরের সাথে মিশে যেতে যেতে ধরা গলায় বলল,’জানি না।কিচ্ছু জানি না।আপনি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকুন।প্লিজ কিছুক্ষণ এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকুন।’
আরিশ সত্যি সত্যিই কিছুক্ষণ মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল।শেষে কোনোরকমে একটা হাত তুলে শুভ্রার পিঠে রাখল,একটু পরে আরেকটা।টের পেল সে হাত রেখতেই মেয়েটা আরো জোরে ফুপিয়ে উঠল।
এক পশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো আরিশের সমস্ত শরীর,সঙ্গে ভেজাল তার বুকের সাথে প্রগাঢ় ভাবে মিশে থাকা মেয়ে টি কে।আরিশ তাকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।আনত স্বরে বলল,’কাঁদে না শুভ্রা।জন্মদিনের দিন কাঁদতে নেই।’
শুভ্রা তবুও তার কথা শুনলো না।কান্নার ফাঁকেই একহাতে তার শার্ট খাঁমচে ধরল।বাচ্চাদের মতোন নাক টানতে টানতে ভাঙা গলায় বলল,’আমি কাঁদবো।আপনার সমস্যা কি?আপনি শুধু আমার ধরে রাখুন।আর কিছু চাই না আমার।’
চলবে-
#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৭০)[দ্বিতীয় অংশ]
মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়েছে একটু আগে।পশ্চিম আকাশের রক্তিম আভা ঢাকা পড়েছে রাতের আঁধারে।পাখিরা সব নীড়ে ফিরে যাচ্ছে,ছানারা অপেক্ষায় আছে তাদের মায়ের ঘরে ফেরার।
নবনীতার ট্যাক্সি আজিজ ভিলায় এসে পৌঁছুলো রাত সাড়ে আটটা নাগাদ।গাড়িটা মূল ফটক অব্দি আসতেই নবনীতা ক্লান্তিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।দুপুর তিনটায় সে গাড়িতে উঠেছে,অথচ এইটুকু রাস্তা আসতে তার এতোক্ষণ সময় লেগেছে।সে গাড়ি থেকে নেমে আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,’পেছনের সিটে তোর ব্যাগ আছে শুভি।মনে করে নামিয়ে নিস।’
কথা শেষ করেই সে শান্ত চোখে বাড়ির মূল দরজা দেখে।ঐতো সেদিন কালো রঙের একটা গাড়িতে করে সে প্রথম এই বাড়িতে এসেছিল।এই চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কত কত দিন সে তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষের অপেক্ষা করেছিল! নবনীতা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল।সবই এখন স্মৃতি।স্মৃতির জঞ্জালে জড়িয়ে পড়ে সে এখন পরিস্থিতি বাজে করতে চায় না।সে তার অস্বাভাবিক আচরণ থেকে মুক্তি চায়।
নিজের চিন্তায় নিজেরই হাসি পেল তার।জঞ্জাল?নিজের সংসারের স্মৃতি কি কারো কাছে জঞ্জাল মনে হতে পারে?এই যে এতো শখে একটু একটু করে গড়ে তোলা সংসার,এই সংসার তো নবনীতার বড্ড আদরের! কতো যত্নে সে আর আরহাম মিলে একটা একটা ইট গেঁথে এই সংসারের ভিত তৈরি করেছিল।এই বাড়িরের দেয়ালে দেয়ালে তাদের আনন্দ,দুঃখ,বিরহ,হতাশা মান-অভিমান সব আটকে আছে।সে কাছে গেলেই সেসবের ঘ্রাণ পায়।
নবনীতা চোখ বন্ধ করে শাড়ির দুই পাশ চেপে ধরল।আর না।আর এসব ভাববে না সে।ভাবলেই উল্টা যন্ত্রণা বাড়ে।বড় করে একটা শ্বাস টেনে সে বাড়ির ভেতর পা রাখল।যেমন করে প্রথমবার পা রেখেছিল,সঙ্গে একটা মানুষ ছিলো।তার হাতটা ঐ মানুষের হাতের মুঠোয়ই ছিলো।
নবনীতা চোখ ঘুরিয়ে পুরো বাড়ি দেখে।ঐ যে দূরে ডায়নিং টেবিলটা একটুখানি দেখা যাচ্ছে।একেবারে সামনের চেয়ারে বসে নবনীতা অপেক্ষা করতো তার জন্য।এই যে কি সুন্দর বসার ঘর! এখানের সোফা গুলোতে বসে নবনীতা কতো মুখ ফুলিয়েছে,অভিমান করেছে,রাগ ঝেড়েছে! এই তো ঝকঝকে,তকতকে মেঝে।মাঝে মাঝে হুট করেই দু’জনের উপর পাগলামি ভর করতো।মাঝরাতে কোনো ছাড়াই দু’জন হাতে হাত রেখে নাচতো।কোনো স্টেপ নাই,গান নাই,কেবল এমনিই হাত পায়ের নাড়াচাড়া।নবনীতা হাসল।চোখ মোছার প্রয়োজনবোধ করল না।
সে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়।বাড়ি ফেরার পর নিচ থেকে ভারি গলায় সেই মানুষটা ডাকতো,’পরী! এ্যাই পরী! এক্ষুনি নিচে নেমে এসো।’
তখন নবনীতা দৌড়ে দৌড়ে এই সিঁড়ির ধাপ পার করতো।এই বাড়িটা তার খুব প্রিয়।বাড়ির আনাচে কানাচে সে শুধু তার বিবাহিত জীবনের স্মৃতি খুঁজে পায়।
অবশেষে সে কাঁপা হাতে লক ঘুরিয়ে তার ঘরের দরজা খুলল।ভেতরটা একদম অন্ধকার,আলো জ্বালানো হয় নি।কেমন গুমোট লাগছে সবকিছু।সুইচ চেপে লাইট জ্বালানো দরকার।কিন্তু নবনীতা বাতি জ্বালালো না।আবছা আলোতেই ঘরের যতোখানি দেখা যায়,ততখানি দেখলো।
একেবারে ধীর পায়ে,শম্বুক গতিতে হেঁটে ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো।এটা তার ঘর,তার আর আরহামের সুন্দর গোছানো সংসার।সে আনমনে হাত বাড়িয়ে বেড শীটের কভার ছোঁয়।সেদিন তার জ্বর হলো।আরহাম সারারাত তার শিয়রে বসে তার সেবা করল।ব্যক্তি আরহামকে না হয় নবনীতা প্রায়শই কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করাতে পারে।কিন্তু স্বামী আরহামকে সে কেমন করে বিচার করবে?সে অনুভব করল এই সম্পর্কে ভালোবাসার দৌড়ে আরহাম তাকে অনেক আগেই পেছনে ফেলে দিয়েছে।সে কখনোই অমন করে তাকে ভালোবাসতে পারে নি,যেমন করে আরহাম তাকে ভালোবেসেছে।তার আফসোস হয়,অনুতাপ বাড়ে।আর যদি কখনো সুযোগ হয়,তবে অনেক অনেক ভালোবেসে সে আরহামকে হারিয়ে দিবে।
সে চুপচাপ গিয়ে খাঁটের সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসল।দুই হাঁটু ভাঁজ করে তার মাঝে মুখ গুজল।আবার শরীর ভার ভার লাগছে,মাথা ঘুরছে ভীষণ।আসার সময় অন্তত পাখাটা চালু করে আসা উচিত ছিলো।সে আর উঠল না।সেই অবস্থাতেই কতোক্ষণ টাইলস বেছানো মেঝেতে বসে থাকল।
‘পরী! ফ্লোরে বসেছো কেন?কতো ঠান্ডা ফ্লোর! উঠে এসো এখনি।’
নবনীতা আস্তে করে মাথা তুলল।মৃদু হেসে বলল,’আসবো না।আসলেই আপনি আবার নাই হয়ে যাবেন।’
বলে সে আরো একবার হাসল।সে জানে সে হ্যালুসিনেট করছে।এই ঘটনা রোজ রোজ ঘটছে।সে দেখে আরহাম এসেছে,কিন্তু সে তার কাছে গেলেই আবার নাই হয়ে যায়।এখন এই ভ্রমটাও তার কাছে ভালো লাগছে।এতে ক্ষণিকের জন্য ভালো থাকা যায়,সুখে থাকা যায়।এতে মন্দ কি?
সে খাটের এক কোণায় মাথা রেখে একমনে তাকে দেখল।সামনে দাঁড়ানো পুরুষালি অবয়বটা আবারো অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল,’নিজের ব্যাপারে বড্ড উদাসীন তুমি।’
‘কারণ আপনি আমার ব্যাপারে খুব বেশি যত্নশীল।’
একটুও কালক্ষেপন না করে উত্তর দিলো নবনীতা।
অবয়বটা আরো এক ধাপ এগিয়ে আসে।হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে তার চোখে চোখ রাখে।নবনীতা চমকায় খানিকটা।এতো কাছাকাছি তো কখনো সে আসেনি তার।এই মুখ,এই চোখ,এই ধাঁরালো চোখের দৃষ্টি-আগে তো এতো স্পষ্ট ঠেকায় নি তার কাছে।
তার ঠান্ডা হাতে কিছু একটা অনুভব হতেই সে লাফিয়ে উঠল।দেখল তার একটা হাত সামনে থাকা মানুষটার উষ্ণ,খড়খড়ে হাতের ভাঁজে বন্দি।নবনীতা চূড়ান্ত রকমের আশ্চর্য হয়।তব্দা খেয়ে বলে,’আপনি সত্যিই আমায় ধরেছেন?’
আরহামের হাসি পেল ভীষণ।সে অন্যহাতে ভর দিয়ে সামান্য এগিয়ে এসে নবনীতার গালে আর্দ্র চুমু খেয়ে বলল,’না,আমি তোমায় চুমু খেয়েছি সেনোরিটা।’
নবনীতার চোখ ছলছল করে উঠল।বুক ধড়ফড় করে উঠে সহসা।সে অবিশ্বাস্য চোখে সামনে তাকায়।নিশ্চিত হয়,তার সামনে থাকা মানুষটা কোনো ভ্রম না আর সেই মানুষটা তারই স্বামী আরহাম।
নবনীতা আর এক মুহুর্তও দেরি করল না।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঝাপিয়ে পড়ে আরহামকে জড়িয়ে ধরল সে।আরহামের বুকের সাথে একপ্রকার মিশে যেতে যেতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল,’আমি জানতাম আপনি আসবেন।আমি জানতাম।’
আরহাম তার মাথায় হাত বুলায়,পর পর অসংখ্য বার কপালে চুমু খায়,এলোমেলো চুলগুলো খুব যত্নে তার কানের পেছনে গুঁজে দেয়।চাপা কন্ঠে আদুরে গলায় বলে,’তোমায় ভীষণ মিস করেছি মেয়ে।প্রতিদিন তোমার কথা মনে পড়েছে আমার।’
‘মনে পড়লে এতোদিন সামনে আসেন নি কেন?’
‘কি করে আসতাম?যেই ঝামেলা গুলো শুরু হয়েছিল,সেসবের সমাধান না করে কেমন করে আসতাম?’
নবনীতা নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নিয়ে বলল,’সবাই বলেছে আপনি নাকি নেই।’
বলতে গিয়েই তার গলা ভেঙে আসে।আরহাম বলল,’সবাই বলেছে?আর তুমি বলো নি?’
‘না,আমি বলিনি।’
‘বিশ্বাস তো করেছো।’
নবনীতা মাথা তুলল।ভেজা চোখে তাকে দেখে হঠাৎই তার চুল টেনে ধরল।
চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’কি বিচ্ছিরি একটা চিঠি দিয়েছেন আপনি আমাকে! ঐটা পড়ার পর আমার কি করা উচিত ছিলো?’
আরহাম নিজের চুল ছাড়িয়ে নিয়ে একগাল হেসে বলল,’সুন্দর ছিলো না চিঠিটা?অনেক সময় খরচা করে লিখেছি।’
‘সুন্দর না,বাল।ঘোড়ার আন্ডা ছিলো ঐ চিঠি।যত্তসব আজগুবি কথা।তুমি যখন চিঠি পাবে,আমি তখন অনেক দূরে।ফালতু চিঠি একটা।’
বলতে বলতেই তার রাগ ধরে গেল।আরহাম হো হো করে হেসে উঠে বলল,’কি সর্বনাশ!তুমি গালি দিচ্ছো?”
‘চিঠিই লিখেছেন এমন গালি খাওয়ার মতো।’
‘আর সেই চিঠি পড়তে পড়তেই নাকি তুমি আধপাগল হয়েছো?’
‘চুপ করেন।বড্ড বেশি বকবক করেন আপনি!’
নবনীতা একেবারে তার বুক বরাবর মাথা রাখল।আরহাম শীতল কন্ঠে বলল,’বড্ড উদাসীন থাকো তুমি আজকাল।শরীরের অবস্থা তো শোচনীয়।’
নবনীতা মুচকি হাসল।বলল,’আপনি তো এসেছেন।এখন যত্ন করে আবার সব ঠিক করে দিন।’
সে তার বন্ধন আরো গাঢ় করে।কান্না থামিয়ে কোনো রকমে বলে,’বিশ্বাস হচ্ছে না আমার আপনি এসেছেন।আমি একটু কাঁদি আপনার বুকে মাথা রেখে?’
একেবারে করুণ সুরে আবেদন।আরহাম জবাব দিলো,’আচ্ছা ঠিক আছে।কাঁদো।’
সে সত্যি সত্যিই কাঁদলো।কতোটা সময় সে নিজেও জানে না।সে একটু শান্ত হতেই আরহাম বলল,’হয়েছে কান্না?’
নবনীতা মাথা তুলে চোখ রাঙিয়ে বলল,’আপনি আদর দিচ্ছেন না কেন আমাকে?অন্য সময় আমি কান্না করলে আপনি আদর করেন।’
আরহাম লটকানো মুখে তাকে দেখে।মাথায় হাত রেখে বলে,’উফফ সরি! ভুলে গিয়েছিলাম ডার্লিং।তোমার তো আবার আদর দিয়ে দুঃখ শুষে নিতে হয়।’
নবনীতা হাসল সামান্য।আরহাম তার সমস্ত মুখে অজস্র চুমু খেল।শেষে আদুরে গলায় বলল,’চলো,এখন নিচে যাই।সবাই আমাদের অপেক্ষা করছে।’
নবনীতা তাকে আরো শক্ত করে জাপ্টে ধরল।জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’না না।কোথাও যাবেন না আপনি।এখানেই থাকুন।’
‘এখানে কি করব?’
‘আদর করবেন আমাকে,ভালোবাসবেন।’
আরহাম কপাল কুঁচকে বলল,’আদর তো করলাম।’
‘আবার করবেন,একশোবার করবেন।’
‘আচ্ছা করব।এখন আগে খেয়ে আসি চলো।’
‘না আমি যাবো না।’
আরহাম ভ্রু উঁচু করে বলল,’তুমি খাবে না?’
‘হুম।খাবো।’
‘তো নিচে না গেলে কি করে খাবে?’
‘এখানেই খাবো।আদর খাবো আমি।’
আরহাম হা হয়ে তার কথা শুনলো।শেষে শব্দ করে হেসে উঠে বলল,’সিরিয়াসলি! তোমার বয়স কতো পরী?কিসব বাচ্চা বাচ্চা কথা বলছো!’
‘বয়স দিয়ে আপনার কি কাজ?জামাইয়ের সাথে আহ্লাদ করার কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই।আমি সত্তর বছরের বুড়ি হলেও এমন আহ্লাদ করব।আপনার কোনো সমস্যা?’
‘না,আমার সমস্যা নাই।কিন্তু তোমার যখন সত্তর বছর হবে তখন আমি তোমার আহ্লাদ পূরণ করার অবস্থায় থাকবো বলে মনে হচ্ছে না।দেহটা থাকবে মাটিতে,আর রূহ টা আসমানে।’
নবনীতা মাথা তুলল।চোখ কটমট করে বলল,’বেশি কথা বলেন আপনি।চুপ থাকেন একটু।’
আরহাম চুপ হলো।একটু পরেই আবার দুষ্টুমি করে বলল,’সারা রাত আদর করতে হবে?’
‘হ্যাঁ।রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা।’
‘আচ্ছা,তাহলে দরজা লক করে আসি দাঁড়াও।’
নবনীতা আলতো করে তার বুকে একটা ঘুষি মেরে বলল,’ইসসস ছি! ঐসব কিছু বলিনি।’
‘আমি ঐসবই বুঝেছি।’
‘আপনার মাইন্ড নোংরা।’
‘আরে বাবা! তোমার মাইন্ড কতো ভালো! জামাই এতোদিন পর সামনে এসেছে! কোথায় তুমি তার সেবা যত্ন করবে,তার তোষামদ করবে,তার জন্য রান্নাবান্না করবে,,তা না,তুমি পড়ে আছো নিজের আদর খাওয়া নিয়ে।বেয়াদব কি আর সাধে বলি?’
নবনীতা তার বুকের সাথে মিশে থেকেই মুচকি হাসল।বড় করে একটা শ্বাস টেনে বলল,’আমি বোয়াদবই ভালো।’
চলবে-