#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৬৯)
তাসনুভা মুচকি হেসে এদিক সেদিক দেখছিলো।আদি কপাল কুঁচকে বলল,’অদ্ভুত তো! তুমি এমন হাসছো কেন?একটু আগেও তো কাঁদছিলে।’
তাসনুভা সাথে সাথেই হাসি থামায় না।বরং আরো কিছুক্ষণ দুই ঠোঁটে সেই হাসি ধরে রেখে জবাব দেয়,’হাসছি কারণ এখন আমার মন ভালো হয়েছে।তোমার কোনো সমস্যা?’
‘নাহ,আমার কোনো সমস্যা না।তুমি খুশি হলেই আমি খুশি।’
তাসনুভা বিনিময়ে আরো ঝকঝকে একগাল হাসি উপহার দেয়।তার মন আজ ভীষণ ভালো।সে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা পেয়েছে।একেবারে অল্প সময়ের জন্য হলেও পেয়েছে।এখন আর তার কোনো দুঃখ নেই।সে আসতে দুঃখরা সব জীবন ছেড়ে পালিয়েছে।
ইজমা বলল,’তোমাকে এমন হাসি খুশি দেখতে খুব ভালো লাগছে।সবসময় এমনই থাকবে।’
তাসনুভা দাঁত কেলিয়ে বলল,’আচ্ছা থাকব নে।’
একটা বল গড়াতে গড়াতে তার পা পর্যন্ত এসে থামলো।তাসনুভা মাথা নামিয়ে সেই বলটা দেখল।একটা বাচ্চা দৌড়ে দৌড়ে তার সামনে এলো।দৌড়ঝাপে তার শ্বাস উঠে গেছে।তাসনুভা হাসিমুখে বলল,’তোমার বল এটা?’
সে ক্লান্ত হয়ে মাথা নাড়ল।কিছু বলার মতো জোর তার আর অবশিষ্ট নেই।তাসনুভা বলল,’অনেক সুন্দর তো বলটা।আমিও তোমার সাথে খেলতে চাই।আমাকে নিবে?’
বাচ্চাটা গভীর চোখে তাকে পরোখ করল।খুটিয়ে খুটিয়ে তার সমস্ত কিছু দেখল।তার মূল মনোযোগ তাসনুভার হুইলচেয়ারের দিকে।সে গোল গোল চোখে কিছুক্ষণ তাকে পরোখ করে আশাহত ভঙ্গিতে বলল,’তুমি কীভাবে খেলবে?তুমি তো হাঁটতেই পারো না।দৌড়াবে কি করে?’
মুহূর্তেই তাসনুভার দুই ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল।দুই চোখ ভিজে উঠল নোনা জলে।দৃষ্টি ঘোলাটে হলো আচমকা।ঝাপসা চোখে সে দেখল,বাচ্চাটা কথা শেষ করেই তার পায়ের কাছে থাকা বলটা তুলে নিয়েছে।সে উঠে দাঁড়াতেই আদি বলল,’কেন?সে খেলতে পারবে না কেন?অবশ্যই সে খেলতে পারবে।তুমি দেখতে চাও?’
তাসনুভা তার কথার প্রেক্ষিতে কোনো জবাব দিলো না।তার কৌতূহলও জাগছে না মনে।সে জানে এগুলো সব আদির মিথ্যে স্বান্তনা।এসব কথায় ঐ বাচ্চার কথা ভুল হয়ে যাবে না।সে তো ঠিকই বলেছে।তাসনুভা তো হাঁটতেই পারে না,দৌড়াবে কেমন করে?’
আদি তার কাছ থেকে বলটা টেনে নিজের হাতে নিল।সেটাকে দুইবার মাটিতে বাউন্স করিয়ে পুনরায় হাতে তুলে তাসনুভার দিকে দেখে বলল,’চলো বাচ্চা।আমরাও বল দেখল।’
তাসনুভা ক্ষীণ গলায় বলল,’কোনো দরকার নেই।আমি খেলব না।’
‘কেন?কেন খেলবে না তুমি?’ চওড়া গলায় জানতে চাইল সে।
তাসনুভার রাগ হলো।সে মুখ তুলে বিরক্ত হয়ে বলল,’কারণ আমি ল্যাংড়া।ল্যাংড়া রা ফুটবল খেলবে কিভাবে?ফুট থাকলে তবে তো খেলতাম!’
‘চুপ! বড্ড বেশি কথা বলো তুমি! ল্যাংড়ার মানে বোঝো তুমি?যত্তসব আজগুবি কথা!’
বড়সড় ধমকটা খেয়েও তাসনুভা কোনো উত্তর দিলো না।কেবল টলমল চোখে আদির থেকে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।আদির মায়া হলো ভীষণ।সে হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসল।দুই হাতে তাসনুভার কোলের উপর ফেলে রাখা দু’টো হাত মুঠ করে ধরল।মোলায়েম কন্ঠে ডাকল,’বাচ্চা! এ্যাই বাচ্চা!’
তাসনুভা উত্তর দিলো না।মুখ খিঁচে আগে যেভাবে ছিল,সেভাবেই পড়ে রইল।আদি আবার ডাকল,’তাসনুভা! এদিকে তাকাও তাসনুভা।ডাকছি যে কানে যাচ্ছে না?’
সে সাথে সাথে পাশ ফিরল।এই প্রথম আদি তাকে এমন নাম ধরে ডেকেছে।তার অবাক চোখজোড়া এক নজর দেখেই আদি বলল,’পাকিস্তানী বক্তা মুনিবা মাজারী কে চেনো?’
সে দুইদিকে মাথা নাড়ল।আদি বলল,’অবসর সময়ে তার ভিডিও দেখবে।সেও তোমার মতো মিষ্টি একটা মেয়ে,তোমার মতোন হুইলচেয়ারে করেই চলে।তবে কখনো তোমার মতো নিজেকে হেয় করে না।সময় হলে কখনো তার জীবনের গল্প শুনবে।তখন মনে হবে নিজের জীবনই ঢের ভালো।’
তাসনুভা নাক টেনে টেনে কোনোরকমে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।’তার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে গাল পর্যন্ত নেমে এসেছে।আদি হাত বাড়িয়ে সেটা মুছে দিলো।আশ্চর্য বিষয়! মেয়েটা কাঁদছে,অথচ তার ভেতরে যন্ত্রনা হচ্ছে।সে একটা শ্বাস ছেড়ে গাঢ় স্বরে বলল,’একটা গ্লাস যার অর্ধেক অংশে পানি আছে,সেটা একেকজনের কাছে একেক অর্থ বহন করে।কেউ মনে করে গ্লাসটা অর্ধেক খালি।কেউ আবার মনে করে গ্লাসটা অর্ধেক পূর্ণ।তুমি তার কোনোটাই মনে করবে না।তুমি মনে করবে গ্লাসটা ঠিক অতোটুকুই পূর্ণ যতোটুকু পূর্ণ হলে তুমি তোমার পিপাসা মেটাতে পারো।এর বেশি তোমার প্রয়োজন নেই।’
তাসনুভা ঠোঁট কা’মড়ে ধরে তার কথা শুনল।আদি স্মিত হেসে বলল,’তুমিও অপূর্ণ না তাসনুভা।আল্লাহ তোমাকে অতোখানি পূর্ণতাই দিয়েছে,যতখানি তোমার চলার জন্য যথেষ্ট।তুমি কতো মিষ্টি একটা মেয়ে! আল্লাহ কি সবাইকে তোমার মতো সুন্দর করে বানায়?’
তাসনুভা নাক টানলো।অভিমানী সুরে বলল,’আমায় কেউ ভালোবাসে না।’
আদি অবাক হয়ে বলল,’সে কি! এত্তো বড় মিথ্যা কথা!’
‘মিথ্যা না।সত্যি।স্কুলেও সবাই আমাকে ভয় পেত।’
‘ঐ গুলা সব গাধা।এতো সুন্দর কিউট একটা মানুষ কে কেউ ভয় পায়?’
তাসনুভা ফিক করে হেসে দিলো।ঠোঁট চেপে বলল,’আমি কিউট?’
আদি তার গাল টেনে বলল,’অবশ্যই।অবশ্যই কিউট।এই যে দেখো আমি একটু পর পর তোমার গাল টানি।ইজমার গাল টানি এমন করে?কেন টানি না?কারণ ঐটার গাল শক্ত।কোনো কিউটনেস নাই চেহারার ভেতর।’
তাসনুভা খিলখিল করে হেসে উঠল।ইজমা আদির পা বরাবর ল্যাং মেরে বলল,’নাহ,কিউটনেস তো সব তুই আর তোর বাচ্চা কিনে রেখেছিস।আমরা কিউট হবো কোথা থেকে?’
‘ইয়েস! আই ডু এগ্রি উইথ দিস।কিউট মানেই আমরা,আমরা মানেই কিউট।তুই আর তোর ইফাজ হচ্ছিস নবিতা আর সিজুকা।’
তাসনুভা আরেক দফা হেসে কুটি কুটি হলো।আদি প্রসন্ন হয়ে তার হাসি দেখল।সে থামতেই শান্ত গলায় বলল,’আমি তোমাকে ভালোবাসি বাচ্চা।খুব বড় হও জীবনে।চারপাশের মানুষদের ভালোবাসা তোমায় আজীবন মুড়িয়ে রাখুক,এটাই চাই।’
তাসনুভা লাজুক হাসল।মাথা নামিয়ে নিজের পা জোড়া দেখতে দেখতে বলল,’থ্যাংক ইউ।’
ইজমা নাক ছিটকায়।আই লাভ ইউ এর জবাবে থ্যাংক ইউ কে বলে?সে মনে মনে বিড়বিড় করে,’থ্যাংক ইউ না রে বোকা,আই লাভ ইউ টু বল।’
.
.
.
.
নবনীতা বাজারে গিয়েছিল।গত সপ্তাহে তরকারি কেনা হয় নি,আজ কিনতে হবে।খুব বেশি কিছু কিনলো না সে।যেগুলো একদম না হলেই নয়,কেবল সেগুলোই কিনলো।
ফিরে আসার পথে একটা গাড়ি পুরোপুরি তার পাশ ঘেঁষে গেল।নবনীতা আঁতকে উঠল।তাল সামলাতে না পেরে ধপ করে রাস্তার এক মাথায় গিয়ে পড়ল।তার হাতে থাকা আলুর প্যাকেট থেকে কয়েকটা আলু গড়িয়ে রাস্তায় পড়েছে।সে বিরক্ত,ভীষণ ভীষণ বিরক্ত।কুঁচকানো মুখে একবার গাড়িটাকে দেখে আলুগুলো পুনরায় প্যাকেটে নিল।সবকিছু গুছিয়ে উঠতে গিয়ে সে টের পেল একা একা উঠা তার পক্ষে সম্ভব না।একহাতে এতোগুলো ব্যাগ নিয়ে সে নিজ থেকে উঠে দাঁড়াতে পারবে না।
তখনই একটি বাইক তার থেকে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।বাইকে থাকা ব্যক্তিটা গা ঝাড়তে ঝাড়তে তার দিকে এগিয়ে এলো।এসেই খপ করে তার এক হাতের কবজি চেপে ধরল।নবনীতা বিষম খেল।এমন অনুমতি না নিয়ে কেউ কাউকে ছোঁয়?
একটানে লোকটা তাকে তুলে দাঁড় করালো।তারপর মাটির দিকে ঝুঁকে তার ব্যাগটা তুলে তার হাতে দিলো।নবনীতা শুরুতে খানিকটা অন্যমনস্ক ছিলো।কিন্তু হঠাৎই তার চোখ পড়ল তার হেলমেটে আবৃত মুখের উপর।মুহুর্তেই ইন্দ্রিয় সমূহ সচেতন হলো তার।ঝড়ের আগে প্রকৃতি যেমন থমথমে রূপ ধারণ করে,এমনি থমথমে মুখে সে তার সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখল।
এমন শরীরের গঠন,এমন হেলমেট দিয়ে আড়াল করে রাখা মুখ,এই জোরাল হাতের বন্ধন-এগুলো তো নতুন কিছু না।নবনীতা এসবের সাথে পূর্বপরিচিত।শুধু একজনই তো আছে এই পৃথিবীতে যে তাকে এমন অবলীলায় যখন খুশি তখন ছুঁয়ে দিতে পারে।
সে নিষ্পলক চোখ। সামনে দেখতে দেখতে কাঁপা কন্ঠে বলল,’আপনি কি?’
বলেই সে আর অপেক্ষা করল না।একহাত বাড়িয়ে লোকটার হেলমেট স্পর্শ করতে চাইল।সাথে সাথে এক ঝাড়ায় নবনীতার হাত সরিয়ে দিলো সে।তার সাথে নিজের দূরত্ব বাড়িয়ে দ্রুত বাইকে চেপে বসল সে।আর এক মুহূর্তও এখানে থাকা যাবে না।নিজের আবেগের ঠেলায় সে বার বার ধরা খাচ্ছে।প্রথমে তাস,এখন এই পরী।এই মেয়ে গুলো এতো অদ্ভুত কেন?অবয়ব দেখেই তারা তাকে চিনে ফেলছে কেমন করে?নাহ,আর এখানে থেকে আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।তার মূল কাজ এখনো শেষ হয়নি।সেই কাজ করার আগে সে যে বেঁচে আছে,এই কথা এখনই কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না।
সে দ্রুত বাইক স্টার্ট দেয়।নবনীতা চমকে উঠে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।গলার স্বর চওড়া করে বলল,’প্লিজ!যাবেন না।দাঁড়ান আপনি।আমি আপনার মুখ দেখতে চাই।’
সে থামলো না।উল্টো স্পিড বাড়িয়ে উল্কার বেগে বাইকটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।পেছন থেকে নবনীতার আওয়াজ ক্ষীণ হতে হতে একসময় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।সে টের পেল মেয়েটা প্রাণপণ ছুটছে তার বাইকের পেছনে।প্রচন্ড রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়।সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’এবার যদি আরেকটা উস্টা খাস,তো আর সেধে সেধে তোকে তুলতে যাবো না।রাস্তায় পড়ে থাক বেয়াদব।’
সে বাইক থামালো একেবারে ‘সুবাস মিত্র লেন’ এ এসে।খুবই আটসাট একটা গলি।চারপাশের বাড়ি গুলোর দেয়ালের রং খসে খসে পড়ছে।কেমন স্যাত স্যাতে একটা এলাকা।সামনে একটা চাপকল আছে।সেখান থেকে দিনের একটা সময় ওয়াসার পানি পাওয়া যায়।
সে আড়চোখে চারদিক দেখতে দেখতে একেবারে পূর্ব দিকের বাড়িটির দরজা ধাক্কায়।দুইবার কড়াঘাত করতেই প্রভাতি ছুটে এসে দরজা খুলল।তাকে দেখতেই বলল,’এতো দ্রুত চলে এসেছো?’
সে হেলমেট টা খুলে একটা পাশে রাখল।হাত পা ছড়িয়ে মেঝেতে বিছিয়ে রাখা তোষকে বসতে বসতে বলল,’বাইরে গেলেই ধরা পড়ে যাচ্ছি।তাই আপাতত এখানেই ঠিক আছি।’
প্রভাতি একটা লেবু কেটে সেটা গ্লাসের উপর ধরে চাপতে চাপতে বলল,’তো তুমি এমন লুকিয়ে আছো কেন?জালাল আর শফিক কে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে।তুমি এবার সবার সামনে চলে এলেই পারো।’
এই প্রস্তাব তার পছন্দ হলো না।সে মুখ কুঁচকে বলল,’নেভার।জালাল আর শফিকের কেচ্ছা খতম করার আগ পর্যন্ত আমি কারো সামনে আসছি না।’প্রভাতি গ্লাসের ভেতর পানি ঢালতে ঢালতে বলল,’তুমি কি করে তাদের কেচ্ছা খতম করবে?জেলে যাবে তুমি?’
শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে সে বাঁকা হেসে বলল,’তোর কি মনে হচ্ছে তারা এতোদিন জেলে থাকবে?তাদের আদৌ কোনো শাস্তি হবে?’
প্রভাতি চোখ বাঁকা করে বলল,’হবে না বলছো?’
‘উমম।নেভার।’
প্রভাতি শরবতে চিনি গুলিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলো।বলল,’এতো কিছু জানি না।কিন্তু নবনীতা আপুকে দেখলে ভীষণ কষ্ট হয় আমার।তোমার অন্তত তাকে জানানো উচিত ছিলো।’
পুরোটা শরবত একটানে শেষ করে সে ঘন ঘন দুইবার শ্বাস ছাড়ল।ভারি গলায় বলল,’কোনো প্রয়োজন নেই।তার সাথে কথা বললেই আমি বাকিদের নজরে আসবো।আমার ফ্যামিলি মেম্বারদের উপর এমনিতেই চব্বিশ ঘন্টা মানুষের নজর থাকে।’
সে হাঁসফাঁস করতে করতে শার্টের একটা বোতাম খুলল।প্রচন্ড ক্লান্ত গলায় বলল,’স্ট্যান্ড ফ্যান টা চালু কর প্রভা।গরমে ম’রে যাচ্ছি।’
প্রভা দ্রুত সুইচ টিপে ফ্যান চালু করল।এমনভাবে পাখাটা সেট করল যেন শুধু সেই বাতাস পায়।স্ট্যান্ড ফ্যানের ঠান্ডা হাওয়ায় আরামে চোখ বুজতে বুজতে সে বলল,’এসব ঝামেলা মিটলে তোকে একটা সিলিং ফ্যান কিনে দিব।কিসব স্ট্যান্ড ফ্যান ইউজ করিস তুই! গরমে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।’
***
কারাগারের সামনে নেতা কর্মীদের ভীড় জমেছে।অল্প বয়সী ছেলে থেকে শুরু করে মাঝবয়সী লোক,সবাই এসেছে কাশিমপুর কারাগারে,তাদের প্রিয় নেতাদের মুক্তির আনন্দে।
বেলা এগারোটা নাগাদ নত মস্তকে কারাগারের খুপরি আকৃতির লোহার গেইট অতিক্রম করে বেরিয়ে এলো জালালুর রহমান আর শফিক সিকদার।সঙ্গে সঙ্গে দলের নেতা কর্মীরা সব তাদের ঘিরে ধরল,ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নিল তাদের প্রিয় নেতাদের।শফিক আর জালালের জামিন মঞ্জুর হয়েছে।আদালত তাদের জামিন মঞ্জুর করেছে।এতো এতো সাক্ষ্য প্রমাণের পরেও তাদের মুক্তি হয়েছে।হবে নাই বা কেন?তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতা।তাদের দল ক্ষমতায় বসে আছে।সাক্ষ্য প্রমাণ আর তথাকথিত বিচারব্যবস্থার থোড়াই পরোয়া করে তারা।একটা মানুষকে নি’র্মম ভাবে হত্যা করার পরেও বেশ ঢাক ঢোল পিটিয়ে বরণ করা হলো জালাল আর শফিককে।এই দেশে সুবিচার বলতে কোনো শব্দ নেই।ক্ষমতা যার হাতে,রায়ের পাল্লাও তার দিকেই খানিকটা ঝুকে থাকে।তার জন্য সবকিছুতেই বিশেষ ছাড় আছে।
রাতে ডিসট্রিক্ট ক্লাবে জমকালো আয়োজন করা হলো।জালাল,শফিকসহ আরো ডজন খানেক নেতা মদ খেয়ে টাল হলো।নর্তকীদের সাথে নাচ গান,একটার পর একটা মদের বোতল শেষ করতে করতে রাত গভীর হলো।ক্লাব ধীরে ধীরে হালকা হতে শুরু করেছে।উচ্ছনে যাওয়া নরপ’শুরা তাদের পুরোনো খেলায় মেতে উঠেছে।মদ খেয়ে তাল হারিয়ে যার তার গায়ে গিয়ে পড়ছে।চারদিকে হাই ভলিউমে চলছে গানের শব্দ।নিস্তব্ধ রাতে সেই শব্দ কানে তালা দেওয়ার মতোন অবস্থার সৃষ্টি করে।
ক্লাবের কর্মচারীরা তখন সারাদিনের হিসেব মেলাতে ব্যস্ত।আর পঞ্চাশ ছাড়িয়ে যাওয়া আধবুড়ো লোকজন তখন ব্যস্ত নারী শরীরের ভাঁজে নিজেদের কৈশোর খুঁজে নিতে।
রুম নম্বর টু টুয়েন্টি থ্রি।তিন বারের মতো হুইস্কি গলাঃধকরণ করে জালালুর রহমান তখন ঢুলছিলেন।এলোমেলো কদম,এখুনি পড়ে যাবে যাবে করে পরে আর পড়লো না।তার ঘরের একেবারে মাঝটায় দাঁড়িয়ে আছে একটি নারী কায়া।জালালুর রহমান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজান।লোভাতুর নজরে একনজর দেখেন ঘরে উপস্থিত সেই রমনীর দেহ অবয়ব।শরীরে নিষিদ্ধ বাসনা জেগে উঠে,সেই বাসনা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র গাত্রে,শিরা থেকে উপশিরায়,ধমনী থেকে কৈশিক জালিকায়।নিজের পুরোনো নেশায় মত্ত হওয়ার অভিপ্রায়ে জালাল এক পা এক পা করে তার দিকে এগিয়ে গেলেন।কামুক বাসনা পূরণের নিমিত্তে হাত বাড়িয়ে শক্ত করে টেনে ধরলেন মেয়েটা হাত।
সহসা মাথার উপর চাপানো ঘোমটা ফেলে সরাসরি তার দিকে চোখ তুলে তাকালো মেয়েটি।জালালুর রহমান সেই অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বল জ্বল করতে থাকা নেত্রযুগল দেখে থমকে গেলেন।তার চোখে যেই ক্রোধ আর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঠিকরে ঠিকরে পড়ছিল,সেই আগুনের লেলিহান শিখায় ভ’স্ম হলেন জালালুর রহমান।আচমকাই মেয়েটি দাঁতে দাঁত চেপে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে তাকে চড় মারল।এক চড়েই জালালুর রহমান ঢুলতে ঢুলতে মাটিতে গিয়ে আছড়ে পড়লেন।তার কপাল গিয়ে ঠেকল টাইলস বিছানো শক্ত মেঝেতে।ঘোলা চোখে তিনি একহাতে কপালে ছোঁয়ালেন।নাহ,আজ মদ একটু বেশি খাওয়া হয়ে গেছে।দুই হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে তিনি কোনোরকমে মাথা তুলে সামনে দেখার চেষ্টা করলেন।
প্রথমে দরজায় লক ঘোরানোর শব্দ হলো।তারপর খটখট শব্দে মূল দরজা খুলে গেল।বুট জুতা পরিহিত পা জোড়া ঠক ঠক শব্দ করে ভেতরে প্রবেশ করল।জালাল কেবল তার পা জোড়াই দেখল।তার চোখ ধীরে ধীরে তার পা ছাড়িয়ে একটু একটু করে উপরে উঠে গেল।হঠাৎই তার হাতে থাকা ধাতব বস্তুটা দেখে তার বুক ধড়াস করে উঠল।ডিম লাইটের মৃদু আলোতে ধাতব আর সূচালো বস্তুটি চকচক করে উঠল।জালালুর রহমান আঁতকে উঠে খানিকটা সরে গেলেন।ফ্লোরেই হামাগুড়ি দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে যেতে চাইলেন।
ছেলেটা নির্বিকার হয়ে সামান্য ঝুকল।একবার জালালের রক্তশূন্য,নীল হয়ে যাওয়া মুখটা,,আর একবার নিজের হাতে থাকা ধারালোর ছু’রিটা গভীর চোখে দেখল।জালাল থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীরে কিঞ্চিৎ শক্তি জুড়িয়ে বললেন,’এ-এ্যাই তুই কে?’
সে আরো সামান্য ঝুকল।নিয়ন আলোয় ডুবে থাকা নিস্তব্ধ ঘরটার সমস্ত নিরবতা ছাপিয়ে গম্ভীর হাস্কি স্বরে বলল,’আমি তোর যম।’
চলবে-