#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৬৭)
আমার পরী,
চিঠিটা যখন তুমি পড়বে,তখন আমি তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে।যেই দুরত্ব স্কেল দিয়ে মাপা সম্ভব না,ঠিক অতোখানি দূরে।কারা প্রকোষ্ঠের অন্ধকারে ডুবে ডুবে তোমাকে এই পত্রখানা লিখছি।যখন এই পত্র তোমার সম্মুখে,তখন এর প্রেরক তোমার থেকে হাজার হাজার ক্রোশ দূরে।
শ্রাবণের এক পড়ন্ত বিকেলে আমার পার্টি অফিসে একটি মেয়ের আগমনের মধ্য দিয়ে আমাদের গল্পের সূচনা হয়েছিল।মেয়েটির নাম নবনীতা।কাছের মানুষরা তাকে ভালোবেসে ডাকতো পরী।পরীর একটা আলাদা পৃথিবী ছিলো।সেই পৃথিবীতে দু’টো সুন্দর ফুল ছিলো।একজন অসহায় মামা ছিলো,কথায় কথায় খোঁটা দেওয়ার মতো একটা মামি ছিলো,আর ছিলো এতো এতো দায়িত্বের ভার।সেই পরীর পৃথিবীতে আগমন হয়েছিল একটা বদ লোকের।’বিউটি এন্ড দ্য বিস্ট’ গল্পের নাম শুনেছো?অসম্ভব সুন্দরী একটি মেয়ের সাথে কদাকার রূপী এক জন্তুর ভালোবাসার গল্প।সেই জন্তু বাইরে থেকে কদাকার ছিলো,অথচ পরীর জীবনে আসা সেই মানুষটা ছিল ভেতর থেকে কুৎসিত।পরী তার শুভ্রতা দিয়ে যদিও বা তাকে কিছুটা সংশোধন করতে পেরেছিল,তবে গোড়া থেকে তার পরিবর্তন পরীর দ্বারা সম্ভব হয়ে উঠে নি।এরপরের ঘটনা তোমার জানা।সেসব এখানে লিখে নিজের অনুতাপ আর যন্ত্রণা বাড়াতে চাই না আমি।
কারাগারে আজ আমার চতুর্থ দিন।রোজ রাতে যখন পুরো কারাগার সুনশান নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে,তখন আমার তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ে।তুমি বলতে তোমার কোলে মাথা রেখে দুঃখ ঝেড়ে নিলে নাকি মন ভালো হয়।আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার কোলে মাথা রাখতে,কিন্তু সেটা সম্ভব না।আসামিদের সব ইচ্ছে পূরণ হয় না।আমারও হবে না।এই মুহূর্তে তাসনুভার কথা মনে পড়ছে।তার কথা মনে পড়লেই আমি বেলি ফুলের ঘ্রাণ পাই।তুমি বিশ্বাস করবে নাকি জানি না,কিন্তু আমি পাই।মেয়েটা বড্ড অবুধ,কথায় কথায় তার ঠোঁট ভেঙে আসে।মেয়েটাকে তুমি তোমার অসীম ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখো।তোমায় বড্ড ভালোবাসে সে।
মর্ত্যলোকের পিশাচদের মাঝে হেঁটে বেড়ানো মিষ্টি পরী,
জগতের সবার জন্য তোমার ভালোবাসা আছে তাই না?তবে এই অধমের কাছ থেকে এমন পালিয়ে বেড়াও কেনো?তোমার সাথে প্রথম দিকের সাক্ষাৎ গুলো যদিও বা সুখকর ছিলো না,কিন্তু সেদিন কাঁধে বুলেট লাগার পর যেই গভীর মমতায় তুমি আমাকে আগলে নিয়েছিলে,সেদিনের পর তোমাকে উপেক্ষা করা কিংবা তোমার সাথে রুক্ষ আচরণ করা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিলো।আমি একটু একটু করে দুর্বল হলাম।পড়বো না পড়বো না করেও একেবারে বাজে ভাবে তোমার প্রেমে পড়লাম।তুমি হয়তো কোনোদিন অনুধাবনও করতে পারবে না আমি তোমায় কি পরিমান ভালোবেসেছি।তুমি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে,তখন রাতের পর রাত আমি ফ্লোরে শুয়ে ছটফট করেছি।তোমার একটু যত্ন,একটু স্নেহ,একটু ভালোবাসার অভাবে আমি সদ্য জ*বা*ই*কৃত পশুর মতো তড়পাচ্ছিলাম।আমি দুঃখিত।সেদিন কথার আঘাতে তোমায় চুর্ণ বিচুর্ণ করেছি।তুমি অবশ্যই অবশ্যই আমাকে ক্ষমা করবে।
আমি তোমাকে নিয়ে ভীষণ পজেসিভ।আবার সুর পাল্টে বলতে গেলে বলবো আমি তোমাকে নিয়ে ভীষণ ভীতু।আমার সবসময় তোমাকে নিয়ে ভয় হতো।দোষটা তোমার না,দোষটা আমার নিজের।আমার বারবার মনে হতো আমার মতো লোকের সাথে কোনো মেয়ের নির্বিঘ্নে সংসার করা সম্ভব না।সেই কারণেই তোমাকে এতো চোখে চোখে রাখতাম।তোমার ব্যাপারে আমি চূড়ান্ত রকমের স্বার্থপর।একটা মজার কথা শুনবে?
ওয়াজিদ তোমায় পছন্দ করতো।সেটাও আবার আমি পছন্দ করার আগে থেকে।এই কথা আমি শুরু থেকেই জানতাম।ওয়াজিদ ভাবতো আমি এসব ব্যাপারে বড্ড উদাসীন।কিন্তু সে জানে না পরীর ব্যাপারে আমি সবসময়ই ভীষণ সিরিয়াস।আমি এক সপ্তাহের ভেতরই বুঝে যাই যে সে তোমায় পছন্দ করে।কিন্তু কোনোদিন এই ব্যাপারে সরাসরি তার সাথে কোনো কথা বলিনি।কারণ একটাই।আমার ভয় হতো।ওয়াজিদের জন্য আমি সব করতে পারি।কিন্তু তোমাকে নিয়ে বোঝাপড়া! অসম্ভব! আমি তোমায় ভালোবাসি,আমি তোমার সাথে ঘর করব,এটাই গুরুত্বপূর্ণ কথা।বাদ বাকি কোনো কিছু আমি জানি না।আচ্ছা শোনো,এসব পড়ার পর আবার তুমি ওয়াজিদকে দেখে আনইজি ফিল করো না।সে বড্ড ভালো ছেলে।তোমাকে সে পছন্দ করতো,রিমিকে সে ভালোবাসে।শব্দ দু’টোর মাঝে বিশাল পার্থক্য আছে।তুমি তার সাথে সেভাবেই কথা বলবে যেভাবে আগে বলতে।
তোমার নতুন বিজনেস নিয়ে আমি ভীষণ এক্সাইটেড।চুপি চুপি ভুলভাল এড্রেসে তোমার পেইজ থেকে জিনিসও অর্ডার করেছিলাম।চমৎকার আর্ট সেন্স তোমার! ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছো,অথচ হ্যান্ড ক্রাফ্টস দেখে মনে হচ্ছিল চারুকলার স্টুডেন্ট তুমি।
ঐ দেখো! আজে বাজে কথা লিখে চিঠির সৌন্দর্য নষ্ট করছি।শুরুতে চিঠিটা বড্ড গোছানো ছিল।এখন এলোমেলো হচ্ছে।তার কারণ আমি নিজে সময়ের সাথে সাথে খুব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি পরী।এখন সময় কতো আমার কোনো ধারণা নেই।পাশ থেকে একটা মানুষের হেঁটে যাওয়ার শব্দ পর্যন্ত পাচ্ছি না।এতো নিস্তব্ধ কেন এই কারাগার?
এবার মূল কথায় আসি।সজীব কে আমি মা’রিনি।যেদিন সে খু*ন হয়,সেদিন তার ইমেইল থেকে আমার পারসোনাল ইমেইলে একটা মেসেজ আসে।মেসেজটা এমন যে সে আমায় জরুরি কিছু বলতে চায়,আমি যেন তার সাথে দেখা করি।যেহেতু সে গোপনে আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছে,তাই আমি গোপনীয়তা রক্ষা করেই তার সাথে দেখা করতে গেলাম।আমি যখন তার লিভিং রুমে পা দিলাম,তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।গেস হোয়াট?হি ওয়াজ অলরেডি ডেড।তার বুকে একটা ছু’রি ঢোকানো ছিলো,দুই চোখ খোলা,মুখ হা হয়ে আছে,হাত দু’টো দুই পাশে ছড়ানো।তার রক্ত আমার পা পর্যন্ত গড়িয়ে এলো।আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠে যখন আমি তার এই বিভৎস অবস্থা দেখি।আমি হাঁটু মুড়ে তার সামনে বসলাম।আমার মায়া হলো।তাই একটানে তার বুক থেকে ছু’রিটা বের করলাম।তখনও বুঝিনি ইটস আ ট্র্যাপ।একজনকে ফাঁসানোর জন্য যে অন্য একজন কে এভাবে নি’র্মম ভাবে মারা যায়,সেটা আমার কল্পনাতীত ছিলো।তুমি কি জানো,যে সজীবকে মে’রেছে তার সজীবের সাথে কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নেই।শুধু আমাকে ফাঁসানোর জন্য সে এই জ’ঘন্য কাজ করেছে।তোমার কি আমার কেসটা আর আট দশটা কেসের মতোই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?একটু খেয়াল করলেই দেখবে আমার কেস-এ ডেট গুলো কেমন পর পর বাসানো হচ্ছে।সাধারণত এই প্রক্রিয়ায় সময় একটু বেশি লাগে।কিন্তু আমার কেসে আপিল হিয়ারিং এবং চূড়ান্ত রায় সবকিছুই অনেক দ্রুত গতিতে শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছিল।কেমন একটা ঘাপলা ঘাপলা লাগছে না সবকিছু?
যাই হোক।তোমায় এসব বলে তোমার মন খারাপ করছি কেন?তুমি ঐসব চিন্তা বাদ দাও।
চোখ মুছো পরী।কাঁদতে কাঁদতে তো বুক ভাসাচ্ছ নিশ্চয়ই।এতো কাঁদতে জানো তুমি! আমি কিন্তু এই নেকু পরীকে বিয়ে করিনি।বড্ড বেশি কান্না করো তুমি ইদানিং! শোনো পরী,আমার মৃ’ত্যু অবধারিত।যেই লুপ হোলে আমি আটকা পড়েছিলাম,সেই লুপ হোল থেকে বেরিয়ে নিজের খেয়ালখুশি মতো আচরণ করা আর নিজেই নিজের বিপর্যয় ডেকে আনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।আমি একটা নির্দিষ্ট দলের সদস্য হয়ে যখন ঐ দলেরই নেতাদের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করি,তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই ঐ দলে আমার আর কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।তারা আর আমাকে ক্ষমতায় চায় না।এখন যত দ্রুত সম্ভব যেকোনো উপায়ে আমাকে মে’রে ফেললেই তাদের শান্তি।কারণ আমি এখন তাদের কাছে পথের কাঁটা ব্যতীত আর কিছুই না।আমি জানি আমি খুব দ্রুত মৃ’ত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।এই মুহূর্তে আমার বাঁচার কোনো পথ আর অবশিষ্ট নেই।
আমার সমস্ত সম্পদের নমিনি আমি তোমায় করে যাচ্ছি।তুমি সেগুলো আরিশ আর তাসনুভার মাঝে সঠিক উপায়ে বন্টন করে দিবে।আরিশের যদি অনুমতি থাকে,তবে তাসনুভাকে তার সমান সমান সবকিছু দিবে।তাসনুভার ব্যাপারে আমি বরাবরই পক্ষপাতদুষ্ট।সে আমার জান,আমার লক্ষী সোনা বোন।মেয়ে মানুষ এতো আদুরে হয় কেন?জীবনের খারাপ সময় গুলোতে ঘুরে ফিরে শুধু তাদের কথাই মনে হয়।আমার একবারো মনে হচ্ছে না আমি না থাকলে আরিশ কিভাবে থাকবে।কারণ আমি জানি আরিশ নিজেকে গুছিয়ে নিবে।কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে,আমার তাসনুভা কিভাবে থাকবে আমাকে ছাড়া?তুমি চলে যাওয়ার পর সে সারাক্ষণ আমার সাথে মুখ ফুলিয়ে রাখতো।অথচ রাতে যখন আমি ঘুমাতাম,তখন চুপটি করে আমার ঘরে এসে দাঁড়াতো।চোখ বুজেই আমি তার হুইলচেয়ারের চাকা ঘোরানোর শব্দ পেতাম।তাকে আমি খুব বেশি ভালোবাসি পরী।তুমি তাকে সেভাবেই ভালোবেসো।
চিত্রা কে আমার ভালোবাসা দিবে।সে যে আমায় আরাম ভাই না বলে আরহাম ভাই বলছে,এতে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।আমি তার কাছে চিরকাল আরাম ভাই ই থাকতে চেয়েছিলাম।আমি কোলে নিলেই দেখি আজকাল সে লজ্জা পায় ভীষণ।চিত্র এতো বড়ো হলো কবে বলো তো?ওহ হ্যাঁ,তাকে মনে করে বলবে আমি মোটেও এমনটা ভাবি না যে সে চিপস আর চকোলেটের লোভে আমায় ভালোবাসে।আমি জানি আমার চিত্র মন থেকেই আমাকে ভালোবাসে।
আমার আধার জীবনে আলো হয়ে আসা পরী,
আমাকে ভালোবেসে তোমার জীবনটা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল তাই না?অবেলায় তোমার জীবনে এসে তোমার জীবনটা জাস্ট নষ্ট করে দিলাম আমি।ভালোই তো ছিলে তুমি আমায় ছাড়া।তবে কেন তোমায় নিজের সাথে জড়িয়ে তোমার সবকিছু এলোমেলো করে দিলাম?তুমি মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে উড়তে চেয়েছিলে,অথচ আমার সাথে বিয়ের পর তুমি নীড়হারা পাখিদের মতো ছন্নছাড়া হয়ে গেলে।আমি তোমার গোছানো জীবনটা নষ্ট করেছি পরী।আমার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে তোমার মতো নিষ্পাপ আর মাসুম স্বত্বার মিলন কোনোভাবেই যায় না।তুমি আমায় ক্ষমা করবে।
এই মুহুর্তেও কি আমি স্বার্থপরের মতো তোমার কাছে একটা জিনিস চাইতে পারি?তুমি প্লিজ অন্য কাউকে নিজের জীবনে আনবে না পরী।আমি চাই না সারাদিনের শত শত ব্যস্ততা শেষে তুমি ক্লান্ত হয়ে যেই বুকে মাথা রাখবে,সেই বুকটা আমি বাদে অন্য কারো হোক।আমি এটা সহ্য করতে পারব না।ভাবছো মৃ’ত মানুষ আবার সহ্য করে কীভাবে?অতো উত্তর আমার কাছে নেই।শুধু জানি সহ্য করতে পারব না।তুমি আমার সব হারানো জীবনের একমাত্র পাওয়া।আমি তোমায় অর্জন করেছি পরী।একটু একটু করে অর্জন করেছি।আমি থাকি বা না থাকি,তুমি চিরকাল আমারই থেকো।
ফজরের আযান দিচ্ছে।লিখতে লিখতে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।সবগুলো অক্ষর কেমন দুইবার দুইবার করে দেখছি।তুমি নিশ্চয়ই এই পর্যন্ত এসে হেঁচকি তোলা শুরু করেছো।থাক আর বেশি কিছু লিখবো না।শুধু বলবো,ভালো থেকো।সবাইকে ভালো রেখো।আমি বেঁচে থাকবো তোমার অলস দুপুরে,ক্লান্ত বিকেলে।যখনই তোমার মন খারাপ হবে,ঐ মন খারাপে আমি বেঁচে থাকবো।বিদায়।
ওহ,তুমি তো স্বান্তনা পেতে ভালোবাসো।ঠিক আছে।দিলাম স্বান্তনা-
“আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি পরী।আমাদের আবারো দেখা হবে।যেদিন নীল আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াবে,সেদিন আমাদের আবার দেখা হবে।মেঘের দেশে আমাদের আবার সাক্ষাৎ হবে।
ইতি,
তোমার প্রিয়তম,যাকে ভালোবেসে তোমার গোটা জীবন ছাড়খাড় হয়ে গেছে।
***
একশত পাঁচবারের মতো চিঠিটা পড়ে মেয়েটা শক্ত করে সেটা বুকের সাথে চেপে ধরল।মুহুর্তেই তার ঠোঁট ভাঙা কান্নায় কেবিনের পরিবেশ ভারি হলো।
আজ আশ্বিনের ছয় তারিখ।আরহামের দুর্ঘটনার প্রায় একমাস গড়িয়েছে।সেদিন স্পটে যাওয়ার পর মিসিং বাকি তিনজনের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল।দুইজন গাড়ির ভেতরেই চাপা পড়েছিল।আর একজনের লা’শ পাওয়া গিয়েছিল জঙ্গলের ভেতর।বন্য পশুরা তার দুই হাত আগেই খেয়ে নিয়েছে।নবনীতা সেই দৃশ্য দেখেই মুখ ভরে বমি করল।মৃ’ত্যু অনিবার্য,তাই বলে এতো করুণ মৃ’ত্যু!
সেই ঘটনার পর দশদিন সে মৃ’তের মতো ছিল।তার জীবন কোনোদিন এমন পর্যায়ে যাবে,সে কল্পনাও করেনি।আত্মহত্যা মহাপাপ না হলে নবনীতা সেই কবেই বাড়ির ছাদ থেকে ঝাপ দিতো।জীবন এখন আর তার কাছে রঙিন বলে মনে হয় না।মনে হয় এর চেয়ে ম’রে যাওয়া ভালো।তার দমবন্ধ হয়ে আসে।সে শ্বাস নিতে পারে না।এক মাস হয়ে গেছে ,অথচ নবনীতার জীবনে কিচ্ছুটি পরিবর্তন হয়নি।সেই যে নবনীতার আত্মিক মৃ’ত্যু হয়েছে,আর সে কোনোভাবে জীবনের পথে ফিরে আসতে পারছে না।তার মনে হয় সে একটু পরেই ছটফট করতে করতে ম’রে যাবে।অথচ আশ্চর্যের বিষয় সে ম’রছে না।
আজ সে হাসপাতালে এসেছে র’ক্ত নিতে।রিমি আর ওয়াজিদ জোর করে তাকে নিয়ে এসেছে।তার শরীর বরাবরের মতোই খারাপ।আজ রাতটা তাকে কেবিনেই থাকতে হবে।
সে রক্তিম চোখে কেবিনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল।এমন সময় শুভ্রা আরশাদকে কোলে নিয়ে কেবিনে এলো।নিচু গলায় ডাকলো,’আপাই!’
নবনীতা জানালা থেকে চোখ সরাল।খিটখিটে গলায় বলল,’কি সমস্যা?’
‘আরশাদ অনেক কান্না করছে।কিছুতেই আমার কাছে রাখতে পারছি না।’
‘তো এতে আমার কি করার আছে?আরশাদ কান্না করছে,আর আমি কি এদিকে নাচছি?’
শুভ্রা হতাশ চোখে তার দিকে তাকায়।আরহাম ভাইয়ের সেই ঘটনার পর আপাই আর আপাই নেই।সে আর আগের মতো হাসে না,কথা বলে না।শুধু কথায় কথায় খ্যাট খ্যাট করে উঠে।তার মেজাজ চব্বিশ ঘন্টাই খারাপ থাকে।যাকেই সামনে পায়,তার সাথেই এমন খিটখিটে আচরণ করে।আর একটু পর পর হাতে থাকা চিঠিটা পড়ে হু হু করে কেঁদে উঠে।এই চিঠিটা তাকে ওয়াজিদ ভাই দিয়েছে।হাতে পাওয়ার পর থেকে এই চিঠিটা ছাড়া সে আর কিছু বুঝে না।এই চিঠি তার প্রাণ ভোমরা।সারাক্ষণ একে নিজের পাশে পাশে রাখে।বাদ বাকি দুনিয়ার আর কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না।আচ্ছা,একটা দুর্ঘটনা কি কোনো মানুষের জীবন এমনভাবে পাল্টে দিতে পারে?
‘আপাই তুমি একটু আরশাদকে কোলে নিবে?তুমি কোলে নিলে সে থেমে যাবে মনে হচ্ছে।’
নবনীতা অগ্নিচোখে তার দিকে তাকালো।চেঁচিয়ে উঠে বলল,’যেতে বলেছি না তোকে?যা তুই।আমার মেজাজ খারাপ করিস না।পারব না আমি কাউকে কোলে নিতে।ঠেকা পড়েনি আমার।’
‘এভাবে বলছ কেন?আরশাদ তো একটা বাচ্চা ছেলে।’
‘অতো দরদ হলে তুই রাখ না।আমাকে বলছিস কেন?অসহ্য লাগে এসব আদিখ্যেতা।যা ঘর থেকে বের হ।একা থাকবো আমি।যা তো।’
শুভ্রা ভেজা চোখে ঘর ছাড়ল।উঠতে বসতে বকুনি খেতে কার ভালো লাগে?কাল তার ওরিয়েন্টেশন।আর আপাই এই মুহূর্তেও তার সাথে এমন আচরণ করছে।
সে বেরিয়ে যেতেই নবনীতা আবার অন্যমনস্ক হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।তার হাতে ক্যানুলা সেট করা।শরীর অন্যদিনের তুলনায় আরো বেশি দুর্বল মনে হচ্ছে।সে জানে সে পাগল হয়ে যাচ্ছে।এভাবে চলতে থাকলে এক পর্যায়ে সে পাগল হয়ে যাবে।কিন্তু সে নিজেকে এই মানসিক বিপর্যয় থেকে ফিরিয়ে আনতে পারছে না।প্রতিটা মুহূর্ত তার মনে হয়,তার সবচেয়ে কাছের জিনিসটা হারিয়ে গেছে।সে শূন্য,তার কাছে কিচ্ছু নেই,কিছুই না।
বুকের ব্যাথা আগের চেয়েও প্রকট হলো।নবনীতা একটা হাত বুকে চেপে সামান্য আর্তনাদ করে উঠল।এই যে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে,কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না।স্রষ্টা এভাবে ধুকে ধুকে কেন মা’রছে তাকে?
সে পুনরায় চিঠি টা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরল।টপটপ করে নোনাজল চিঠির উপর গড়িয়ে পড়ল।
“আমার পরী,
চিঠিটা যখন তুমি পড়বে,তখন আমি তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে।যেই দুরত্ব স্কেল দিয়ে মাপা সম্ভব না,ঠিক অতোখানি দূরে।কারা প্রকোষ্ঠের অন্ধকারে ডুবে ডুবে তোমাকে এই পত্রখানা লিখছি।যখন এই পত্র তোমার সম্মুখে,তখন এর প্রেরক তোমার থেকে হাজার হাজার ক্রোশ দূরে।”
চলবে-