#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৬৬)
[অনেক বড়ো পর্ব।ধীরে সুস্থে রিচেক দিবো]
নবনীতার অল্প অল্প করে গুছিয়ে উঠা জীবনটা হঠাৎই কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো তান্ডবে একেবারে লন্ডভন্ড হয়ে গেল।কি থেকে কি হলো,কোনো কিছুই সে জানে না।তার স্বামীর অনেক দোষ ত্রুটি সম্পর্কে সে অবগত।কিন্তু খু*ন?ভাবলেই সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে নবনীতার।
গতকাল রাতেই আরহামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সজীব খন্দকারকে ছু’রিকাঘাতে হ’ত্যার অভিযোগ উঠে এসেছে তার নামে।নবনীতা যখন এই কথা শুনল তখন সে পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।রাজনৈতিক রেষারেষি তে আরহাম মানুষ মা’রবে?এতো জ’ঘন্য তো সে কোনোদিন ছিলো না।এই কাজ অন্তত সে করতে পারে না।
ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ আরহামের নির্লিপ্ত মুখটা দেখে সে প্রশ্ন করেছিল,’আরহাম! আপনি এই কাজ করেছেন?আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।আপনি যদি এমনটা করেন,তবে ফাহাদ আর আপনার মাঝে পার্থক্য রইল কই?’
আরহাম নিরব,কন্ঠ দিয়ে টু শব্দ পর্যন্ত বের করল না।শুধু নির্বিকার হয়ে একবার নবনীতাকে দেখেছিল।তারপরই ম্লান হেসে বলল,’ভালো থেকে পরী।তোমাকে যা কিছু ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিলো,ফিরিয়ে দিয়েছি।এখন তুমি ভালো থাকো।’
সোবহান ততক্ষণে তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে।নবনীতার টলমল চোখ সেই হাতকড়ার দিকে।সে ছুটে গেল,জাপ্টে জড়িয়ে ধরল আরহামের শক্তপোক্ত শরীরটা।জড়ানো কন্ঠে বলল,’না না আমি এটা বিশ্বাস করি না।আমার আরহাম এই কাজ করতেই পারে না।’
আরহাম হাসল,প্রশান্তির হাসি।হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় কোনোরকমে একটা হাত তুলে নবনীতার মাথায় রাখলো।চাপা কন্ঠে বলল,’ভালো থাকো পরী।জীবনে অনেক বড় হও।তোমার সাফল্য তোমাকেই ছাড়িয়ে যাক।যদি কোনোদিন সম্ভব হয়,মনে করে আমাকে ভালোবেসো।আমাকে ভালোবাসার মতো মানুষ বরাবরই অনেক কম।’
ব্যাস,তারপরই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সোবহানের সাথে বেরিয়ে গেল।নবনীতা কেবল হতবাক চোখে সবকিছু দেখল।আনমনে একটা হাত মাথায় ছোঁয়াল।তার দম বন্ধ হয়ে আসছে,মনে হচ্ছে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমান একটুখানি কমে গেছে।হুশ আসতেই সে দিকবিদিক ভুলে বাইরের দিকে ছুটে যায়।
আরহামকে পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়েছে।নবনীতা সেই টুকু ছুটে গিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলল,’আপনি কিছু করেন নি।তাই না আরহাম?দয়া করে বলুন আপনি কিছু করেন নি।আমি জানি এগুলো মিথ্যা।তবুও আপনি বলুন একবার।প্লিজ।’
আরহাম চোখ তুলে।ম্লান হেসে বলে,’তুমি যা বিশ্বাস করো,ভেবে নিবে তাই সত্যি।আমার বলা দিয়ে কি যায় আসে?ভালো থাকো পরী।’
পুলিশ ভ্যানটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।নবনীতা অনুভূতি শূন্য চোখে একটু একটু করে ভ্যানটার হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখল।যখন সেটা একদমই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল,তখন সে ধপ করে মাটিতে বসে গেল।আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে।বৃষ্টি হবে নাকি আজ?যেমনটা হয়েছিল তার বিয়ের দিন রাতে।আজ তো তার বিবাহ বার্ষিকী।
নবনীতা চোখ মুছল।এতো খুশীর দিনে কাঁদতে আছে নাকি?
.
.
.
.
ওয়াজিদ এক প্রকার ছুটতে ছুটতে আদালত প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হলো।তার থেকে একটু দূরেই আদি,একটা পিলারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সে এগিয়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’আদি! আরহাম কে কি আদালতে এনেছে?’
সে অন্যমনস্ক হয়ে সংক্ষেপে জবাব দিলো,’নাহ।’
দুই হাতে মাথা চেপে ওয়াজিদ একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল।তার সমস্ত শরীর অস্বাভাবিক রকম কাঁপছে,গলার কাছে সবকিছু দলা পাকিয়ে আছে।শ্বাস ফেললেও মনে হচ্ছে চারপাশ ভারি হয়ে যাচ্ছে।
গতকাল বিকেলে ওয়ারীতে নিজের বাড়িতে সজীব খন্দারের ম’রদে’হ উদ্ধার করা হয়েছে।তার কেয়ার টেকার মনসুরের ভাষ্যমতে আরহাম দুপুরের একটু পরেই তার সাথে দেখা করার জন্য তার বাড়িতে গিয়েছিল এবং এসময় তাদের ভেতরে একটা ঝামেলার সূত্রপাত হয়।যার জের ধরে আরহাম এক পর্যায়ে তাকে ছু’রি মে’রে হ’ত্যা করে।তারপরই থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয় এবং রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে আরহামের এরেস্ট ওয়ারেন্ট মঞ্জুর করা হয়।এরপর কাল রাতে নারায়ণগঞ্জের কোনো একটা ছিমছাম বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আনা হয়েছে।তার চার্জশিট থানা থেকে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।আজ প্রথম ধাপে তার বিচার কার্যক্রম শুরু হবে।
ওয়াজিদের কাছে প্রথম ফোন কলটা এসেছিল রাতের মাঝামাঝি সময়ে। আনুমানিক দুইটার দিকে।খবর পাওয়ার পরে সে কয়েক মিনিট স্তব্ধ হয়ে বসেছিল।ইন্দ্রিয় গুলো কেমন অচল হয়ে যাচ্ছিল।তারপর সবার প্রথমে সে থানায় গেল।আরহামের সাথে কেবল দশ সেকেন্ডের জন্য তার দেখা হয়েছিল।ছেলেটার ঐ নির্বাক নির্লিপ্ত রূপ দেখে সে আর কিছু বলার সাহস পায়নি।সেখান থেকে বেরিয়ে সে এডভোকেট সানাউল হকের কাছে গেল।আরহামের কেসটা হ্যান্ডেল করার জন্য অভিজ্ঞ আর বড় মাপের উকিল প্রয়োজন।সানাউল হক ওকালতি তে অনেকদিন পুরোনো।একত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা,নব্বই শতাংশ কেস জেতার রেকর্ড-সবমিলিয়ে আরহামের কেস সামলানোর জন্য ওয়াজিদের তাকেই সবচেয়ে বেশি যোগ্য মনে হয়েছে।
রিমি সেই তখন থেকে একটার পর একটা ফোন দিয়ে যাচ্ছে।ওয়াজিদ শেষে ফোনটা রিসিভ করল।রিসিভ হতেই অন্যপাশ থেকে রিমির উদ্বিগ্ন কন্ঠ ভেসে এলো,’কি হয়েছে ওয়াজিদ?আরহাম ভাইয়া কোথায়?উনাকে আজ ছেড়ে দিবে তো?আপনি কেন আমায় নিলেন না?আমি সেখানে যেতে চাই।প্লিজ আমাকে নিয়ে যান।’
ওয়াজিদ মাথা নামিয়ে তার কথা শুনলো।সে থামতেই থমথমে গলায় আস্তে করে বলল,’তোমাকে এখানে আনার কিছু নেই রিমি।পরিস্থিতি এমনিতেই খারাপ।তুমি বাসায় থাকো।আমি তোমায় সব জানাবো।দোয়া করো যেন জামিন টা হয়ে যায়।যদিও প্রায় অসম্ভব,তবুও আশা তো করাই যায়।দোয়া করো রিমি।আর কিছুই বলার নেই।’
‘নবনী কি এসেছে?’
‘জানি না,এখনো আমার চোখে পড়েনি।’
রিমি আর কিছু বলল না।একহাতে ফোনটা কানে চেপে কয়েক মিনিট সেভাবেই বসে থাকলো দুই জন।ওয়াজিদ ঘন ঘন কয়েকটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,’কিছু বলবে রিমি?’
রিমি ইতস্তত করে বলল,’আপনার কি মনে হয়?ভাইয়া এমন কিছু করেছে?’
‘অসম্ভব।’ কিছুটা চেঁচিয়ে উঠল ওয়াজিদ।
‘আমার বন্ধু এই কাজ করতেই পারে না।আমি তাকে চিনি।সে কতোটুকু অন্যায় করতে পারে আমার ধারণা আছে।’
তার কন্ঠের জোর আর নিজ বন্ধুর প্রতি বিশ্বাসের পরিমান দেখে রিমি নিচু গলায় বলল,’আপনার মতো করে তো সবাই ভাবছে না ওয়াজিদ।এটাই তো সমস্যা।’
‘না ভাবুক।এটা তাদের সমস্যা।আমার না।’
সে ফোন কাটল।একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে তাকাতেই দেখল আদালতের মূল ফটকের সামনে নবনীতা এসে দাঁড়িয়েছে।তার পরনে একটা সাদামাটা সুতির শাড়ি।আঁচলের দিকটা কিছুটা কুঁচকে আছে।
সে জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।নবনীতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,’তুমি ঠিক আছো নবনীতা?বসবে কোথাও?’
নবনীতা হাত তুলে তাকে থামাল।সামনে হেঁটে যেতে যেতে ঠান্ডা গলায় বলল,’না,আমি কোথাও বসবো না।’
***
আরহামকে কোর্টে আনা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।প্রিজন ভ্যান থেকে যখন তাকে নামালো হলো,তখন চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাংবাদিকরা সব তাকে ঘিরে ধরল।চারদিক থেকে আসা ফ্ল্যাশ লাইটের আলো তে তার চোখ বুজে এলো।নিভে আসা চোখেই সে দেখল অদূরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি একটু পর পর ঘুরে ফিরে আরহামের দিকে যাচ্ছে।সে হাসল,তার অদ্ভুত রকমের প্রশান্তি হচ্ছে।এতো এতো ক্যামেরার সামনেও তার চোখ বার বার মেয়েটির সোজা সরল মুখটার কাছে গিয়ে থামছে।কতোগুলো দিন পর মেয়েটা তার দিকে সহানুভূতির চোখে তাকিয়েছে,কতোগুলো দিন পর তার হৃদয় আরহামের জন্য ব্যথা অনুভব করেছে!আরহাম তো হারে নি।সে জিতেছে।জগতের কাছে হেরে প্রিয়তমার কাছে জিতেছে,প্রভার কাছে জিতেছে,বাবার কাছে জিতেছে,শাহানার কাছেও জিতেছে।
কোর্ট রুমে আসার পর তার সাথে ওয়াজিদের একবার কথা হয়েছে,তাও এক মিনিটের জন্য।আর কথা হয়েছে সানাউল হকের সাথে।তিনি তাকে আশ্বস্ত করেছেন তার জামিন মঞ্জুর করিয়েই ছাড়বেন।তিনি আইনজীবী।এসব বলবেনই।এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই।আরহাম খুশি হচ্ছে না।সে জানে এসব মামলায় এতো সহজে জামিন পাওয়া যায় না।এসবের পেছনে যারা কলকাঠি নাড়ছে,তারা অতো কাচা খেলোয়াড় না।আরহাম বুঝে,অনেকে কিছুই বুঝে।
তার ধারনাই সত্যি হয়েছে।আদালতে কয়েকজনের সাক্ষীর ভিত্তিতে আরহাম দোষী প্রমাণিত হয়েছে এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই খু’নের আসামির জামিন অতো সহজে পাওয়া সম্ভব না।তার জামিন হয়নি।আপিল করা,এবং তারপর আপিল পরবর্তী রায় আসা পর্যন্ত অনির্দিষ্টকাল তাকে এই কারা প্রকোষ্ঠের মাঝেই কাটাতে হবে।
সেদিনের মতো কোর্টের কাজকর্মের সেখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করা হলো।আস্তে আস্তে আদালত ফাঁকা হলো।শুধু নবনীতা আর আরিশ দু’টো পাতানো বেঞ্চিতে মাথা নামিয়ে বসেছিল।
আদি আর ওয়াজিদ সানাউল হকের সাথে কথা বলছিলো।কোর্টের কাজ শেষ হওয়ার পর নিয়ম মোতাবেক আসামীকে পুলিশ সাথে সাথে পুনরায় জেলে নিয়ে যায়।তবে যেহেতু আরহাম সাধারণ মানুষ না,তাই তার বেলায় নিয়মে একটু ছাড় দেওয়ার অনুমতি আছে।
পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো।তার যখন কথা শেষ হবে,তখন সে তাকে নিয়ে যাবে।নবনীতা তখনো বেঞ্চে বসা।আরহাম তীক্ষ্ণ চোখে তাকে দেখল।নিশ্চয়ই কাল রাত থেকে কিছু খায়নি।আজ কি বার?তার না এই সপ্তাহে রক্ত নেওয়ার কথা।নিয়েছে কি?
সে একটা শুকনো ঢোক গিলল।এই ন্যায় অন্যায়ের যুদ্ধে যদি সে হেরে যায়,তবে মেয়েটার কি হবে?বাইরে থেকে সে নিজেকে খুব সাহসী আর মজবুত দেখায়।অথচ আরহাম জানে সে ভালোবাসার কাঙাল।একটু ভালোবাসাতেই গলে যায়।আরহামের যদি কিছু হয়,তবে কি মেয়েটা উঠে দাঁড়াতে পারবে?পারবে শক্ত হয়ে এই সমাজের সাথে মোকাবিলা করতে?হয়তো পারবে,হয়তো পারবে না।পৃথিবীর নিয়ম বড়ো বিচিত্র।আমাদের অনুপস্থিতিতে যারা দুই মুহূর্তও থাকতে পারবে না বলে আমাদের বিশ্বাস,দেখা যায় আমাদের মৃ’ত্যুর পর তাদের জীবনের কোনো কিছুই থেমে থাকে না।দোষটা তাদের না।দোষটা প্রকৃতির।প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না।কোনো না কোনভাবে সেই সেই শূণ্যস্থান ভরাট হয়।হতেও পারে আরহাম না থাকলে পরী খুব সুন্দর করে সব সামলে নিবে।কিন্তু আরহাম থাকতে চায়।পরীর সাথে সে শান্তিতে সংসার করেছে হাতে গোনা কয়দিন।এইবার সে একটু শান্তিতে মন ভরে সংসার করতে চায়।মেয়েটাকে একটু শান্তিতে রাখতে চায়।পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব এতো ক্ষণিকের জন্য হোক,সে সেটা চায় না।তার এখনো প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়া বাকি,পূর্ণিমা দেখা বাকি,তাসনুভার হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর মতো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা বাকি।কতো কিছুই তো বাকি।গোটা জীবনটাই তো বাকি।
***
একেবারে নিগুঢ় নিস্তব্ধতায় পাঁচ পাঁচটে দিন কেটে গেছে।আরহাম যে কারাগারে খুব বেশি খারাপ আছে এমন না।তার জন্য আলাদা সেল আছে,বিশেষ খাবার দাবারের ব্যবস্থা আছে।শুধু মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর ক্ষমতাই নেই।নয়তো সে খুব বেশি যন্ত্রণায় নেই।তবে রোজ রোজ বাড়ির মানুষের সাথে দেখা করার অনুমতি পাওয়া যায় না।এটাই সমস্যা।
তাকে আগামীকাল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হবে।নিরাপত্তা জনিত কারণ দেখিয়ে তার এই আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে।সে হিসেবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আজই তার শেষ দিন।
রাতে ওয়াজিদ এলো তার সাথে দেখা করতে।সে বসেছিল মূলাকাত কক্ষে।কক্ষের দরজায় একজন কারা প্রহরী সটান দাঁড়িয়ে তাকে পাহারা দিচ্ছিলো।সে সেদিকে তাকালো না।ওয়াজিদের পেছন পেছন যে মেয়েটি নতজানু হয়ে মুলাকাত কক্ষে এসেছে,আরহামের সমস্ত মনোযোগ তার দিকে।
নবনীতা কক্ষে এসেই তার খোঁজ করল।দু’জনের দৃষ্টি বিনিময় হতেই নবনীতা চোখ নামিয়ে নিল।ওয়াজিদ এগিয়ে এসে বলল,’কাল সকালেই নাকি কাশিমপুর কারাগারে ট্রান্সফার করা হবে তোকে?’
‘হুম।এমনই তো শুনলাম।’
‘ওহ।’
সে থামল।পেছন ফিরে একবার নবনীতাকে দেখে আবার সামনে ফিরে বলল,’তিন দিন ধরে খুব চাইছিলো তোর সাথে দেখা করতে।আজ অবশেষে ব্যবস্থা করতে পারলাম।কথা বল তুই।আমি আছি।’
সে সরে গিয়ে কারা প্রহরীর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো।বলুক,একটু কথা বলে মন হালকা করুক।মেয়েটা বড্ড ভেঙে পড়েছে এই কয়দিনে।মুখে কিছু না বললেও তার চোখ মুখ সে কথাই বলে।
‘আরহাম’
একেবারে মলিন,বিধ্বস্ত আর ভাঙা কন্ঠ।আরহাম হাত দু’টো টেবিলে রেখে জবাব দিলো,’হু?’
‘আপনি আমায় এড়িয়ে যাচ্ছেন।’
‘এমন কিছু না।’
‘তাহলে কেমন কিছু?’ অস্থির হয়ে জানতে চাইল সে।
‘আমি ছাড়া বেঁচে থাকার প্র্যাকটিস করাচ্ছি।’
নবনীতার কন্ঠ ভেঙে এলো।সে ধরা গলায় বলল,’প্লিজ আরহাম।দোহাই লাগে এসব কথা বলবেন না।’
‘কেন?অদ্ভুত তো! তুমি জানো তুমি কার সাথে কথা বলছো?খু’নের আসামি আমি।যেকোনো সময় আদালত থেকে যে কোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে।দোহাই লাগানোর কিছু নাই।মানসিকভাবে সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে পরী।’
নবনীতা মুখের উপর একটা হাত চেপে অস্পষ্ট স্বরে বলল,’আমি জানি খু’নটা আপনি করেন নি।’
আরহাম নির্বিকার হয়ে জবাব দেয়,’তোমার জানা দিয়ে আদালতের কিছু যায় আসে না।আদালতের প্রমাণ চাই।আছে কোনো প্রমাণ?’
নবনীতা আর কথা বাড়ালো না।কেবল কাঁপা হাতে আরহামের একটা হাত নিজের মুঠোয় পুরে জমে যাওয়া কন্ঠে বলল,’আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আরহাম।আমাকে একটু স্বান্তনা দিন,একটু ভালোবাসুন।’
আরহাম ফিচেল হাসল।একটা হাত নবনীতার মাথায় রেখে আদুরে গলায় বলল,’আচ্ছা যাও।তোমাকে স্বান্তনা দিচ্ছি।তোমার বরের কিচ্ছু হবে না পরী।সে ঠিকই কোনো না কোনো ভাবে এইসব জটিলতা পার করে ফেলবে।’
নবনীতা থমথমে মুখে তার দিকে তাকালো।কটমট গলায় জবাব দিলো,’এটা কোনো স্বান্তনা না,এটা সত্যি কথা।এমনটাই হবে আমার বিশ্বাস।’
‘বাপরে! তাহলে তো আর আমার কিছু বলার নেই।’
আরহাম সামান্য ঝুকলো।নবনীতার ঘোলাটে চোখ দু’টো দেখতে দেখতে বলল,’একটা প্রশ্ন করি?’
তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই জিজ্ঞেস করল,’তোমার কি একটি বারের জন্যও মনে হয়নি আমার নামে আনা অভিযোগটা সত্য হলেও হতে পারে?’
হাতের বন্ধন আরো জোরালো হলো নবনীতার।সে চোখ তুলে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিলো,’নাহ,কখনো না।একটিবারও মনে হয়নি এই কাজ আপনি করেছেন।আপনি রগচটা,তবে এতোটাও নির্বোধ না।’
আরহাম মন দিয়ে তার কথা শুনল।সে থামতেই তীব্র অনুযোগের সুরে বলল,’আমায় খাইয়ে দিবে পরী?’
নবনীতা বড় করে টেনে একটা শ্বাস নিল।জানতে চাইল,’অনুমতি আছে?’
‘অবশ্যই আছে।’
‘তবে আমার কোনো আপত্তি নেই।’
ভাত,ডিম ভুনা,সবজি আর ডাল।কারাগার হিসেবে খাবারের মেন্যু বেশ ভালো।নবনীতা প্রথম লোকমা হাতে তুলেই আরহামের দিকে দেখে বলল,’নিন হা করুন।’
আরহাম খাওয়ার মাঝেই একগাল হেসে বলল,’এই শেষ।আর কোনোদিন জ্বালাতন করব না তোমাকে।’
স্টিলের প্লেটের উপর থাকা হাতটা হঠাৎই থেমে গেল।নবনীতা চোখ তুলে করুণ সুরে ডাকল,’আরহাম!’
‘দয়া করে এসব কথা বলবেন না।’
‘আচ্ছা বলবো না।তবে কি বলব?’
‘ভালো কথা বলুন।’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।যতখানি ভালোবাসা তুমি কল্পনাও করতে পারো না,ততখানি।’
আচমকা বন্ধ ঘরটায় ফুপিয়ে উঠল নবনীতা।ওয়াজিদ আশ্চর্য হয়ে সেদিকে তাকায়।দেখে একটা পঁচিশ বছর বয়স্কা মেয়ে ভাতের থালা কোলের উপর ফেলে শব্দ করে কাঁদছে।তার সামনে একটা ছেলে বসা।যে শান্ত চোখে তাকে দেখছে।যেন এরকম ক্রন্দনরত রমণী সে এর আগে আর দেখেনি।একটা মানুষের এমন বিষন্ন রূপ এতো গভীর চোখে দেখার কি আছে?
নবনীতা বহুবার নিজেকে সংযত করার প্রতিজ্ঞা করার পরেও শেষটায় ব্যর্থ হলো।বিদায় বেলায় সে এক দৌড়ে গিয়ে আরহামকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।তার চোখের পানিতে আরহামের শার্ট ভিজলো।আরহাম অত্যাধিক কোমল হয়ে বলল,’কাঁদে না পরী।মন দিয়ে পড়াশোনা করো।সফল হও দোয়া করি।’
নবনীতা হেঁচকি টানতে টানতে মূলাকাত কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেল।এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলেই সে ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করবে।
সে চলে যেতেই আরহাম তার পকেটে থাকা চিঠিটা ওয়াজিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’নে এটা ধর।’
ওয়াজিদ চিঠিটা হাতে নিতে নিতে বলল,’এটা কি?’
‘চিঠি।পত্র।লেটার।’
‘সেটা জানি।কার জন্য চিঠি?’
‘পরীর জন্য।’
‘তুই লিখেছিস?’
‘হুম।’
‘তবে দিস নি কেন?’
‘এখন না।যখন সময় হবে তখন তুই তাকে এটা দিবি।’
ওয়াজিদ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,’আমি কিভাবে বুঝব সময় হয়েছে নাকি?’
‘বুঝবি।তুই অবশ্যই বুঝবি।এজন্যই তো তোকে দিয়েছি।তবুও একটু পরিষ্কার করি।যখন তোর মনে হবে নবনীতার খুব বেশি আমাকে দরকার,ঠিক তখনই এই চিঠিটা তুই তাকে দিবি।বুঝেছিস?’
জবাবে ওয়াজিদ কেবল মাথা নাড়ল।আরহাম উঠে দাঁড়িয়ে কারাগারের ভেতরে যেতে যেতে বলল,’ভালো থাকিস ওয়াজিদ।তাস আর আরিশের খেয়াল রাখিস।এরা তোকে খুব ভালোবাসে।’
.
.
.
.
পরদিন সকাল নয়টায় কঠোর নিরাপত্তায় আরহামকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো।সে প্রিজন ভ্যানে উঠার দুই মিনিটের মাথায় গাড়িটা হর্ণ বাজিয়ে ধুলো উড়িয়ে কারাগারের মূল ফটক ছাড়িয়ে সাঁই সাঁই করে বেরিয়ে গেল।
নবনীতা কারাগারের সামনের বিশালাকার দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।তার মাথা ঝিমঝিম করছে।এই নিয়ে সে কতোগুলো নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে তার হিসেব নেই।রোজ রাতে তার মনে হয় সে দম বন্ধ হয়ে ম’রে যাবে।এই কয়দিনে আইন আদালত সম্পর্কে সে যতটুকু জেনেছে,সেই অভিজ্ঞতা থেকে তার ধারণা হয়েছে আরহামের রায় খুব একটা ভালো কিছু হবে না।একটা দুশ্চিন্তা তাকে রোজ কুড়ে কুড়ে খায়।সে প্রতিদিন একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে।আর কতো?আর কতো এভাবে ধুকে ধুকে ম’রবে নবনীতা?
ঘন্টাখানো বাদে ওয়াজিদের নম্বরে একটা ফোনকল এলো।রিসিভ করার পর দুই মিনিট ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে হঠাৎ সে ফোনের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিল।মুহূর্তেই সেটা সশব্দে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।নবনীতা আশ্চর্য হলো।হন্তদন্ত হয়ে তার দিকে ছুটে গিয়ে অস্থির হয়ে বলল,’কি হয়েছে ভাইয়া?রিমির কিছু হয়েছে?’
‘ভাইয়া!’
‘ওয়াজিদ ভাইয়া।’
ওয়াজিদের ধ্যান ভাঙল।আঁতকে উঠে সে নবনীতার দিকে তাকালো।নবনীতা উৎকন্ঠা মেশানো কন্ঠে আবারো জানতে চায়,’কি হয়েছে ভাইয়া?বলুন প্লিজ।’
ওয়াজিদ ঢোক গিলল।একহাতে কপালের ঘাম মুছে আচমকাই ছটফটে কন্ঠে বলল,’নবনীতা! আরহামদের গাড়িটা ব্রেকফেল করেছে।তিনজন স্পট ডেড,আর তিনজন এখনো মিসিং।পুরো গাড়ি দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে গেছে।ভেতরে কেউ আটকা পড়েছে নাকি এখনো বোঝা যাচ্ছে না।’
সে থামল।টেনে টেনে দু’বার শ্বাস নিয়ে আরো কিছু বলতে উদ্যত হলো।কিন্তু তার আগেই তার সামনে দাঁড়ানো নারী কায়াটি সমস্ত ভর হারিয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো।ওয়াজিদ হকচকিয়ে গেল ভীষণ।সে নিজেও দ্রুত হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে ভীত কন্ঠে বলল,’নবনী! তুমি ঠিক আছো?প্লিজ নবনী।এখনই এতো ভেঙে পড়ো না।শিওর হতে দাও আমাকে।প্লিজ নবনী!’
নবনীতা তার কোনো কথা শুনল না।তার কানে এখনো বেজে যাচ্ছে,’তিনজন স্পট ডেড,তিনজন মিসিং।’
সে ঠোঁট কা’মড়ে দুই হাতে মাটি আঁকড়ে ধরল।তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।তার চোখ যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে।সে কোনোরকমে একটা শ্বাস টেনে বলল,’ভাইয়া আমি কি ম’রে যাচ্ছি?আমার মনে হচ্ছে আমি মরে যাচ্ছি,সত্যি সত্যি ম’রে যাচ্ছি।’
চলবে-