#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৬৫)
লা’শবাহী ফ্রিজিং কার থেকে স্ট্রেচারে করে র’ক্তমাখা নিথর শরীরটা বের করে আনতেই নিপা আক্তার এক চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন।তার সমস্ত শরীর হুট করেই জোর হারিয়ে ফেলল।তার মনে হচ্ছে তিনি একটা মৃ’ত লাশ।যার কথা বলার কিংবা কিছু করা ক্ষমতা নেই।
আবিরের লা’শ রাখা হলো বাড়ির মূল দরজার একটু সামনে।মুখের উপরে থাকা সাদা কাপড়টা তোলার পর যখন তার মুখ দৃশ্যমান হলো,তখন নিপা একহাত মুখে চেপে আর্তনাদ করে উঠলেন।এই ছেলেটা তার সন্তান,তার কলিজার টুকরা।
আবিরের আর নিপার দুরত্ব কয়েক হাতের মতো।নিষ্প্রাণ চোখে নিপা তার সমস্ত শরীর দেখে।কপালের কাছে সেই বিশাল ক্ষত দেখতেই তিনি পুনরায় হাউমাউ করে উঠলেন।বু’লেটটা মাথার একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়েছে।কতোটা কষ্ট পেয়েছে ছেলেটা!
নিপা আক্তার উঠে দাঁড়িয়ে উন্মাদের মতোন ছুটে গেলেন।আবিরের নিষ্প্রাণ বক্ষে মাথা ঠেকাতেই তিনি হু হু করে কেঁদে উঠলেন।
‘আব্বু! তুমি আমার জান।কথা বলো আব্বু।একবার আম্মুর দিকে তাকাও।’
আলাউদ্দিন আহমেদ নিরবে দু’জনকে দেখলেন।তার দুই হাত বগলদাবা করা,চোখ দু’টো আর্দ্র।ক্ষণিক বাদেই একহাতে চোখ মুছলেন তিনি।জালালুর রহমান আর শফিক সিকদারের গাড়ি এই মাত্র তার বাড়ির সামনে এসে পৌঁছেছে।
জালাল গাড়ি থেকে নেমেই শম্বুক গতিতে তার দিকে এগিয়ে গেলেন।একবার আবিরের ম’র’দে’হ দেখে পরমুহূর্তেই আবার চোখ সরিয়ে নিলেন।একটা হাত কোনোরকমে আলাউদ্দিন আহমেদের কাঁধে রেখে ইশারায় তাকে স্বান্তনা দিলেন।তবুও কি এতে সন্তান হারানোর কষ্ট লাঘব হয়?আলাউদ্দিন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।এতো কিছুর পরেও ছেলেটার শেষ রক্ষা হয়নি।
সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পরেই শফিক সিকদার আর জালালুর রহমান সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন।জালাল বেশ শান্ত,অথচ শফিককে দেখাচ্ছে ভীষণ অস্থির।চোখে মুখে সেই অস্থিরতা ধরে রেখেই তিনি জানতে চাইলেন,’ঘটনা কি বলো তো?আলাউদ্দিনের ছেলে জানার পরেও পুলিশ এমন অবলীলায় ছেলেটা কে মেরে ফেলল কি করে?পুলিশকে তো আলাউদ্দিন আগেই বলেছিল তাকে যেন কিছু না করে।’
জালালুর রহমান ব্যাক সিটে হেলান দিলেন।তাকে কিছুটা ভাবুক মনে হচ্ছে।একহাতে মাথা চুলকে তিনি গম্ভীর মুখ করে বললেন,’সেই উত্তর তো ইয়াসিনই দিতে পারবে।কিন্তু ঘটনা গুলো যেভাবে চক্রাকারে ঘটে যাচ্ছে,আমার মনে হচ্ছে এর পেছনে প্রভাবশালী কারোরই হাত আছে।যার ক্ষমতা আলাউদ্দিনের থেকেও বেশি।’
শফিক কপাল কুঁচকান।
‘কি মনে হয়?কে হতে পারে সে?’
‘জানি না।তবে একজন কে সন্দেহ হচ্ছে।বেশ কিছুদিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছে।বাকিটা ইয়াসিনই পরিষ্কার করবে।’
‘তোমার কি মনে হয়?ইয়াসিন নিজ থেকে কিছু বলবে?’
জালালুর রহমান কুটিল হাসলেন।একহাত হাঁটুতে ভর দিয়ে সামান্য সামনে ঝুঁকে বললেন,’বলতে বাধ্য।এমন পরিস্থিতি তে তাকে রাখব যে তাকে অবশ্যই বলতে হবে এই সবকিছুর পেছনে মূল হোতা কে।’
.
.
.
.
কমিউনিস্ট পার্টি।বাম রাজনীতি।খুবই পরিচিত কিছু শব্দ।বাম রাজনীতির মূল লক্ষ্য কি?সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা,সম্পদের সুষমবন্টন নিশ্চিত করা,মজদুর আর কৃষকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা,সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা।আপাতদৃষ্টিতে শুনতে ভীষণ শ্রুতিমধুর মনে হয়।কিন্তু ভেতরে পরোখ করলে আদতেও বাম রাজনীতি অতোটা স্বচ্ছ,সরল বলে মনে হবে না।
বাম রাজনীতির একটা লক্ষ্য সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।অর্থাৎ রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থায় স্রেফ সংসদীয় রীতিনীতি থাকবে,কিন্তু কোনো ধর্মের বালাই থাকবে না।অর্থাৎ ধর্মীয় অনুশাসনের প্রভাবমুক্ত রাষ্ট্রীয় নীতিমালা বাস্তবায়নের এজেন্ডা নিয়েই বাম রাজনীতি কাজ করে।
আরহামের মনে হয় এরা আসলে সাম্য নিয়ে না,বরং নাস্তিকতা প্রমোট করা নিয়েই কাজ করে।এদের যাবতীয় সব সমস্যা এরা টেনে ধর্ম পর্যন্ত নিয়ে যায়।কথা শুনলে মনে হবে,ধর্মই জগতের সব সমস্যার মূল।একমাত্র ধর্মীর অনুশাসন থেকে মুক্তি পেলেই সমাজের তরতর করে উন্নতি হবে।অন্যথায় সমাজ রসাতলে যাবে।
সেদিন পল্টনে একটা মিটিং বসেছিল।সেখানে অন্যান্য দলের সাথে কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বাররাও ছিলো।কথায় কথায় তাদের একজনের সাথে তর্ক বেঁধে গেল আরহামের।তার নাম সজীব খন্দকার।তর্কের এক পর্যায়ে আরহাম মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে গেল।এসব নাস্তিকদের ভংচং কথা তার অসহ্য লাগে।ঘুরে ফিরে এরা সব দোষ ধর্মকে দিতে পারলেই যেন বাঁচে।এসব সুশীল দের সাথে তার আবার যায় না খুব একটা।
সজীবের সাথে পরে আরেক মিটিংয়েও তার দেখা হয়েছিল।বরাবরের মতো সেদিনও দু’জনের কথা কাটাকাটি হলো।রাগের এক পর্যায়ে আরহাম ফুসঁতে ফুঁসতে বলল,’এই নাস্তিক গুলো কে দেশে রাখাই উচিত না।পুরো দেশটা কে ধ্বংস করছে এরা।যতোসব ফালতু!’
আরহাম রাজনৈতিক ভাবে দূরদর্শী না।সেদিন সে আরো একবার প্রমাণ করলো রাজনীতিতে সে খুব বেশি অজ্ঞ।যদি পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝতো,তবে কখনোই সে মিডিয়ার সামনে এমন কথা বলতো না।
সে বিরক্ত হয়ে মিটিং ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই জালালুর রহমান একপেশে হাসলেন।বেচারা কোনো কিছু বোঝার আগেই ফেঁসে গেল।এই এক কথা তাকে কতদূর নিয়ে যাবে,আরহাম টেরও পাবে না।তিনি আয়েশ করে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।আরেকটা ঝামেলা বাঁধানোর সময় এসে গেছে।আরহাম কে নিয়ে তার আর কোনো প্রত্যাশা নেই।যেই আশায় তিনি এতোদিন আরহামকে সাহায্য করছিলেন,সেই আশায় ঐ ছেলে জল ঢেলে দিয়েছে।আজকাল সে জালালের মতামতের তোয়াক্কা করে না।সে চলে নিজের খেয়ালখুশি মতো।নূর আহমেদের সম্পদ দখলদারির যেই মামলা আদালতে করা হয়েছিল,সেটাও সেই করেছে।দেরিতে হলেও জালাল এই খবর জানতে পেরেছে।আবিরকে মা’রার পেছনেও কোনো না কোনো ভাবে আরহামের হাত আছে।এটাও তিনি নিশ্চিত।
নাহ,তাকে আর ভরসা করা যাচ্ছে না।এভাবে চুপ করে বসে থাকলে এক সময় সে জালালের উপর থাবা বসাবে।ক্ষমতায় সে জালালের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে আছে।তাকে ক্ষমতাচ্যুত করাই এই মুহুর্তে জালালুর রহমানের মূল লক্ষ্য।তার হাতে ক্ষমতা আর যাই হোক,জালালের জন্য সুখকর কিছু না।জালাল আড়চোখে সজীব খন্দকারের নিরুদ্বেগ মুখখানা দেখেন।ব’লির পাঠা সে পেয়ে গেছে।এবার শুধু সময় মতো জ*বা*ই করার পালা।
.
.
.
.
ক্লাসিকাল ইলেক্ট্রো-ডায়নামিকস বাই গ্রিফিথস।নবনীতা গত মাস থেকে রোজ একটু একটু পড়তে শুরু করেছে বইটা।অর্ধেক সে বুঝতে পারে,বাকি অর্ধেক মাথার উপর দিয়ে যায়।তবুও কিছুটা আয়ত্ত হয়েছে এতোদিনে।
তার ব্যবসার অবস্থা ভালোই।উন্নতি হয়েছে,তবে খুব বেশি না।চাকরির বেতন এক হাজার টাকা বেড়েছে,এটা খুবই খুশীর সংবাদ।আরো একটা খুশীর সংবাদ চিত্রা আজ ক্লাস টেস্টে দশে দশ পেয়েছে।নবনীতার জন্য এটা কোনো চাট্টিখানি কথা না।তার ছোট্ট বোনটা পড়াশোনা করছে,ক্লাসের পরীক্ষায় ফুল নম্বর পাচ্ছে,এটা তার জন্য গর্বের বিষয়।সে আজ ভীষণ খুশি।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হচ্ছে।নবনীতা মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুজে বইয়ের দিকে ঝুঁকে থেকে শুভ্রাকে ডাকল,’শুভিইই! দরজা টা খোল।দেখ কে এসেছে।নাম জিজ্ঞেস করে তারপর খুলবি।’
সে পুনরায় পড়ায় মন দিলো।দরজার খোলার শব্দ কানে এসেছে মিনিট পাঁচেক আগে।এখন আবার সব নিরব।নবনীতার খটকা লাগল।বইয়ের পাতায় চোখ এটেই সে জানতে চাইল,’কে এসেছে রে শুভি?’
দরজায় কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে।নবনীতা না দেখেই ব্যাপারটা টের পেয়েছে।টের পেতেই সে সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে দরজার দিকে তাকালো।দরজায় দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখতেই চোখ জোড়া আপনা আপনি বড়ো হলো তার।
সহসা হাতে থাকা বইটা সশব্দে বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো সে।বিস্ময় জড়ানো কন্ঠে প্রশ্ন করল,’আপনি?’
আরহাম নিঃশব্দে ঘরের ভেতর এসে দাঁড়ালো।নবনীতা একবার তাকে দেখল,একবার তার কোলে থাকা বাচ্চাটাকে দেখল।তার মন চাইছে ছুটে গিয়ে তাকে কোলে নিতে।অথচ সে তার জায়গা থেকে একটু নড়ল পর্যন্ত না।দুই হাতে শাড়ির দুই পাশ খামচে ধরে সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো।চোখ ভরে দেখলো তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন মানুষ কে।
দুরত্বটা প্রথমে আরহামই কমালো।কয়েক কদম এগিয়ে এসে স্মিত হেসে বলল,’কেমন আছো পরী?’
বহুদিনের বিরহ।সম্পর্ক এখন এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যেখান থেকে দু’জনকে তাদের কথপোকথন শুরু করতে হয় কুশলাদি বিনিময় করার মাধ্যমে।অথচ একটা সময় তো তারা দু’জন নিজেদের চোখ দেখেই সব বুঝে যেত।
নবনীতা মলিন মুখে সামান্য হাসি ফোটালো।মাথা নামিয়ে বলল,’জ্বী ভালো আছি।’
আরহাম গভীর চোখে তাকে আগাগোড়া পরোখ করল।শেষে তার একেবারে কাছাকাছি এসে বলল,’তোমার ছেলেকে নিয়ে এসেছি সাথে।কোলে নিবে না?’
আরো বেশি মেঝের দিকে মাথা ঝুকালো নবনীতা।একেবারে ক্ষীন গলায় জবাব দিলো,’যদি আপনি দেন,তবে অবশ্যই নিব।’
‘এই নাও,দিলাম।’
সে চোখ তুলে।নিমিষেই ছোঁ মেরে একটানে তাকে নিজের কাছে আনে।গোল গাল ফর্সা মুখটাতে অজস্র চুমু খেয়ে জড়ানো কন্ঠে বলে,’কেমন আছো বাবা?মায়ের কথা মনে পড়েছে তোমার?’
আরশাদ তাকে কয়েক পল দেখল।তারপরই আবার পেছন ঘুরে আরহামের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে নবনীতার কোল থেকে তার কোলে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,’বাবার কাছে যাবো।’
নবনীতা আশ্চর্য হলো।যতখানি আশ্চর্য হলে মানুষের মুখ হা হয়ে যায়,ঠিক ততখানি আশ্চর্য।সে বোকা বোকা হয়ে বলল,’আপনার কাছে যেতে চাইছে! এতো ভালোবাসে আপনাকে?’
আরহাম মুচকি হাসল।আরশাদকে নিজের কোলে নিয়ে মাথা চুলকে বলল,’,বাসে বোধ হয়।কেন তুমি কি এটা দেখে কষ্ট পাচ্ছো?’
নবনীতা দুই হাত বগলদাবা করল।মুখ ফুলিয়ে অন্য পাশ ফিরে বলল,’জ্বী অবশ্যই কষ্ট পাচ্ছি।তাকে আমি কতো আদর করে,বুকে চেপে ঘুম পাড়িয়েছি।সে এখন বাবা বাবা করছে।আমার কষ্ট হচ্ছে।কেউ আমাকে ভালোবাসে না।’
শেষ বাক্য কি এমন ছিলো আরহাম জানে না,শুনতেই সে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো।তার মুখের হাসি আচমকাই আরো চওড়া হয়েছে।শেষ কথাটা কি পরী তাকে ঠেস দিয়ে বলল?এই ঠেস আরহামের পছন্দ হয়েছে।দুই চোখ সরু করে সে জানতে চায়,’তবে কি তুমি চাও তোমাকে আমরা ভালোবাসি?’
নবনীতা থতমত খেয়ে বলল,’জ্বী না।এমন কিছু চাই না।’
সে গিয়ে খাটে বসল।আরহাম আরশাদকে কোল থেকে নামাতেই সে বসার ঘরের দিকে ছুটে গেল।নবনীতা চোখ নামিয়ে নিজের পা দেখতে দেখতে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’কেন এসেছেন আপনি?কি চাই আবার?’
‘তোমাকে চাই।’ অকপটে জবাব দিলো আরহাম।
নবনীতা মাথা তুলল না।কেবল দুই হাতে চাদরটা মুঠ করে ধরল।সেই প্রথম প্রথম ভালো লাগার যেই অনুভূতি,আজ অনেকগুলো দিন পর তার সেই একই অনুভূতি হচ্ছে।সে ঠোঁট চেপে উত্তর দিলো,’আমাকে চাওয়ার কিছু নাই।’
আরহাম হাসি মুখে এগিয়ে গেল।নবনীতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একবার মুখটা দেখার চেষ্টা করল।নবনীতার মনে হলো লজ্জায়,সংকোচে তার সমস্ত শরীর ভেঙে আসছে।তার হাঁটুর উপর থাকা হাত দুইটা চেপে ধরেই আরহাম নিচু স্বরে বলল,’শুভ বিবাহ বার্ষিকী পরী।তোমার জন্য বিবাহিত জীবন কেমন ছিলো জানি না,তবে আমার জন্য এই একটা বছর ভীষণ সুন্দর আর দামি ছিলো।তোমাকে ধন্যবাদ এতো এতো সুপুরুষের ভীড়ে আমার মতো অধম কে বেছে নেওয়ার জন্য।এই অধম তার পরীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।’
নবনীতা চোখ তুলল।যেই চোখে অশ্রু এসে ভীড় জমিয়েছে।আরহাম বিচলিত হয়ে বলল,’সেকি! আজ এতো চিন্তা করে এসেছি সব গুছিয়ে বলব,কোনো উল্টাপাল্টা বলব না।সেই তুমি আবার কাঁদছো! আমি কি করলে তুমি কান্না বন্ধ করবে একটু বলবে?’
নবনীতা থামল না।উল্টা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গাল মুছতে মুছতে বলল,’এতো দিনে আসার কথা মনে হয়েছে!’
‘অদ্ভুত! তুমি সময় চেয়েছিলে।’
‘তো কি হয়েছে?আপনি সেজন্য আসা বন্ধ করে দিবেন?সময় চেয়েছি,মুক্তি চাইনি।’
আরহাম আহাম্মক হয়ে তার কথা শুনলো।সে থামতেই ফিক করে হেসে উঠে বলল,’আন বিলিভেবল।তোমরা মেয়েরা এমন কমপ্লিকেটেড কেনো?মুখে বললেই তো পারো কি চাও।’
‘আমরা কমপ্লিকেটেড না,আপনারা গর্দভ।দোষ আপনাদের,আমাদের না।’
‘আচ্ছা মানলাম।এবার বলো বিবাহ বার্ষিকী তে কি চাও?’
আগের চেয়েও ক্ষীণ স্বরে সে উত্তর দেয়,’কিছুই চাই না আমার।পরে আপনি সেগুলোর খোঁটা দিবেন।’
আরহামের মনে হলো তার সামনে বসে থাকা মেয়েটার বয়স পঁচিশ না,বরং ষোলো কিংবা বড়ো জোড় সতেরো।তার কথায় বাচ্চামো ভাব স্পষ্ট,অভিমানটাও কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের মতো।’
সে উঠে গিয়ে তার পাশে বসল।এক হাত থুতনিতে রেখে তার মুখটা উঁচিয়ে ধরে বলল,’চুমু দিতে চাই।সেটার খোঁটা কি কখনো দিয়েছি আজ পর্যন্ত?’
নবনীতা দ্রুত তার হাত সরিয়ে নিল।আরহাম আর দ্বিতীয় বার তার গালে হাত রাখল না।কেবল সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে তার আরক্ত গালে আলতো করে চুমু খেল।এতো বেশি আলতো যে নবনীতার মনে হলো সে কোনো কাঁচা মাটির পুতুল।হালকা জোর খাটালেই গলে যাবে।তার চোখ ভিজে উঠল।আরহাম পর পর অসংখ্য চুমু খেল তার গালে,তার কপালে,তার চোখের পাতায়।তার ভাষায় বলতে গেলে নবনীতার এতোদিনের জমে থাকা দুঃখ গুলো সে অল্প অল্প করে শুষে নিল।
সে একবার টেনে শ্বাস নিল।তারপরই গম্ভীর গলায় জানতে চাইল,’তুমি কি আমায় একটি বার জড়িয়ে ধরবে পরী?বিবাহ বার্ষিকীতে তোমার কাছে এইটুকুই চাই আমার।’
সহজ,সরল আর নিঃসংকোচ আবেদন।নবনীতা চোখ মুখ খিঁচে ধরল।এক,দুই ,তিন,,গুনে গুনে তিন সেকেন্ডের মাথায় সে দুই হাতে শক্ত করে আরহামকে জড়িয়ে ধরল।ঠোঁট ভেঙে বলল,’আমি সেদিন অনেক কষ্ট পেয়েছি আপনার আচরণে।আপনি বলেছেন আমি নাকি পায়ে থাকার জিনিস।আমি এ কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না।’
আরহাম জবাব দিলো না।কেবল একটা হাত তার পিঠে রেখে চুপচাপ তার কথা শুনলো।নিজের ভেতর যেই ঝড় উঠেছে,সেই ঝড়ে বিলীন হতে আর বেশিক্ষণ সময় নেই।তাই বলে নিজেদের শেষ মুহূর্ত গুলো খারাপ করবে কেন?এই মুহুর্ত গুলো এমনই থাকুক।পরী যখন এগুলো ভাববে তখন এখনের মতোই তার চোখ পানিতে ভেসে যাবে।
নিজের নতুন ব্যবসা থেকে শুরু করে নতুন চাকরি,পড়াশোনা,এমনকি আদালতের নোটিশ পর্যন্ত সবকিছু নবনীতা একে একে আরহামকে খুলে বলল।বাড়ির কথা বলতে গিয়েই সে খুশিতে খিলখিল করে উঠে বলল,’জানেন আমি এখনো জানি না আমি কিভাবে সবকিছু ফিরে পেলাম।আমি তো,,’
সে কথা শেষ করার আগেই আরহাম তাকে থামিয়ে দিয়ে খানিকটা অস্থির হয়ে বলল,’আচ্ছা পরী! কখনো যদি শুনো আমি কাউকে খু’ন করেছি,তবে তুমি কি করবে পরী?’
নবনীতা ভড়কে গিয়ে বলল,’কি?কি করবেন?’
আরহাম শীতল চোখে তার দিকে তাকায়।হাতের বন্ধন অনেক আগেই ছুটে গেছে তার।আচমকা নিচ থেকে পুলিশ গাড়ির সাইরেনের শব্দ ভেসে এলো।শব্দ শুনেই নবনীতা বুঝলো শুধু একটা না,কয়েকটা গাড়ি এসে থেমেছে বাড়ির নিচে।সে আঁতকে উঠে বলল,’পুলিশ ভ্যান!’
আরহাম ক্লান্ত চোখে তার দিকে তাকায়।নবনীতা একহাত মুখে চেপে থমকে যাওয়া কন্ঠে বলল,’বাড়ির নিচে পুলিশ ভ্যান কেন এসেছে আরহাম?কি হয়েছে?’
ততক্ষণে বাড়ির দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শুরু হয়েছে।দরজার অন্যপাশে দাঁড়িয়ে আছেন ইন্সপেক্টর সোবহান রহমান।যার কাছে শাহরিয়ার আরহামের নামে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে।যার বিরুদ্ধে সজীব খন্দকারকে ছুরি’কাঘাতে কুপিয়ে হ’ত্যার অভিযোগ উঠে এসেছে।
চলবে-