কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৬৪

0
20

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৬৪)

সাল দুই হাজার ষোলো।চট্টগ্রামে নিজের বাসভবনে কু’পিয়ে হ’ত্যা করা হয় সেসময়ের নামকরা ব্যবসায়ী নূর আহমেদ কে।নূর আহমেদ কে মা’রার পর তার স্ত্রীকেও নির্মমভাবে খু’ন করে দুর্বৃত্তরা।তারপর কেটে গেছে সাত সাতটি বছর।নূর আহমেদ হত্যার কোনো বিচার হয়নি।আদালতে এই নিয়ে কোনো মামলা পর্যন্ত দায়ের করা হয়নি।

ঘটনা এখানেই শেষ না।তার মৃ’ত্যুর পর তার বিপুল পরিমান জায়গা সম্পদ অন্যায় ভাবে হাতিয়ে নেওয়া হলো,দখল করা হলো তার বাড়ি ঘর সবকিছু,ঘরছাড়া হলো নূর আহমেদের তিন মেয়ে।একজনের বয়স তখন আঠারো,অন্যজনের বারো,আর সবচেয়ে ছোট যে ছিলো তার বয়স ছিলো মাত্র ছয়মাস।এতো বড়ো হত্যা কান্ডের পরেও প্রায় সাত বছর যাবত এ নিয়ে কেউ কোনো কথা তুলেনি,তোলার প্রয়োজন বোধ করে নি।কিন্তু হঠাৎই সাত বছর পরে থানায় একটা মামলা দায়ের করা হলো।জালালুর রহমান,শফিক সিকদার,আহসান আহমেদ সহ আরো ছয়জনের বিরুদ্ধে একটি দখলদারি আর সম্পদ আত্মসাৎের মামলা দায়ের করা হয়েছে।যে ব্যক্তি দায়ের করেছে,তিনি তার পরিচয় অজ্ঞাতই রেখেছে।

জালালুর রহমানের কাছে এটার ওয়ার্নিং নোটিশ আসতেই তিনি নড়ে চড়ে বসেন।নোটিশে তাকে অতিসত্বর আদালতে যেতে বলা হয়েছে।সাত বছর পর আবারো বিষয়টা আলোচনায় আসবে জালালুর রহমান সেটা কল্পনাও করেননি।তিনি আদালতে না গিয়ে সোজা মতিঝিলে মহানগর কার্যালয়ে গেলেন।

আরহাম তখন চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছিলো।জালাল তার মুখোমুখি চেয়ারে বসেই গলা খাকারি দিলেন।আরহাম মাথা তুলল।হাই তুলতে তুলতে সামনে দেখে বলল,’কি আঙ্কেল?কিছু বলবেন?’
জালালুর রহমান ভড়কে গেলেন।তিনি সামনে বসা স্বত্তেও আরহাম তার সাথে এমন খাপছাড়া আচরন করছে।অথচ অন্যসময় তিনি সামনে এলেই আরহাম তাকে সম্মান দেখিয়ে উঠে দাঁড়াতো।আশ্চর্য! সে হঠাৎ এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন?

তিনি সেসব নিয়ে ভ্রক্ষেপ করলেন না।দু’হাত কচলে বললেন,’তোমার বউ আবার আগের বিষয় গুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করেছে।সে আমার নামে সম্পদ আত্মসাৎ করার মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে।’

আরহাম রুবিস কিউব মেলাতে মেলাতে ভাবলেশহীন হয়ে বলল,’তাতে সমস্যা কি?আপনি তো নির্দোষ।মামলা দায়ের করলেও বা কি?দিনশেষে তো এটাই প্রমান হবে যে আপনার কোনো দোষ নেই।পরী যদি নিজের আত্ম তুষ্টির জন্য মামলা করেও থাকে ,তবে এতে সমস্যা কি?’

জালালুর রহমান বোকা বনে গেলেন।গোল গোল অবিশ্বাস্য চোখে সামনে দেখে আমতা আমতা করে বললেন,’না মানে এখন এসবের কি দরকার?কতো বছর আগের ঘটনা।নবনীতা ভাবছে আমি তাদের সম্পদ দখল করেছি।এমন কিছুই না।তার বাবাই ব্যবসায় লস খেয়ে আমার কাছে এগুলো বেঁচে দিয়েছিল।’

তার জবাব শুনেই আরহাম খানিকটা শব্দ করে হাসল।ঠান্ডা গলায় বলল,’কোনো সমস্যা নেই।আপনার কাছে তাহলে জমি জমার কাগজ আছে নিশ্চয়ই।রেজিস্ট্রি পেপার আছে।আপনি আদালতে গিয়ে সেসব দেখান।তাহলেই তো হলো।পরীর ভুল সেখানেই ভেঙে যাবে।’

জালাল আবারো একটু নড়েচড়ে বসলেন।তাকে অস্থির দেখাচ্ছে ভীষণ।তিনি আনমনে একটা ঢোক গিললেন।গলার কাছাকাছি পাঞ্জাবির বোতামটা খুলে একটু শান্তিতে নিশ্বাস নিয়ে বললেন,’নূর সাহেবের সাথে আমার সেরকম কাগজ পত্রের সম্পর্ক ছিলো না।আমরা যথেষ্ট আন্তরিক ছিলাম।জায়গা কেনার পরেও সেরকম ভাবে কাগজপত্র করা হয় নি।’

তিনি থামলেন।আড়চোখে আরহামের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করলেন।আরহাম হঠাৎই শব্দ করে হেসে ফেলল।মাথার নিচে একটা হাত রেখে কিছুটা বিদ্রুপ করে বলল,’আপনি এতোখানি জায়গা কিনেছেন,অথচ দলিল করেন নি।এতো বিশ্বাস তো আজকাল আপন ভাইদের মধ্যেও দেখা যায় না।আপনি দলিল ছাড়াই এতো কিছু কিনিছেন?দুঃখিত! এই কথা বিশ্বাস করতে পারছি না আমি।’

জালাল হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকালো।তার মাথায় বাজ পড়ার মতো শব্দ হচ্ছে।মনে হচ্ছে বিরাট বড়ো আকাশের একটা টুকরো তার মাথায় এসে আঁছড়ে পড়েছে।আরহাম তাকে এমন স্পষ্ট ভাবে অপমান করছে?এমন ছেলে তো সে ছিল না আগে।সে তো কখনোই জালালের সাথে এমন আচরণ করতো না।আজকাল সে বড্ড খেয়াল খুশি করছে।তার যা ভালো লাগছে,তাই করছে।প্রভাবশালী,বিত্তবান লোকেরা তার কাছে নানান সমস্যা নিয়ে আসলেও সে তাদের তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।অথচ খেটে খাওয়া,কুলি মুজুর শ্রেণীর লোকেরা ইদানিং তার কাছে বড্ড পাত্তা পাচ্ছে। সে তাদের সমস্যা শুনছে,বোঝার চেষ্টা করছে।আরো অবাক করা বিষয়,সেই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছে।জালালুর রহমান তার এই ইতিবাচক পরিবর্তন দেখলেই চোখ কচলান।বাবার প্রেতাত্মা ভর করেছি নাকি এই ছেলের কাঁধে?

তিনি সহসা উঠে দাঁড়ালেন।থমথমে অন্ধকার মুখে বললেন,’আমি আজ আসি।পরে কোনোদিন আবার আসবো।’

যতটা শান্তশিষ্ট ভাবে তিনি ভেতরে এসেছিলেন,কথাটা বলার পর তার চেয়ে দ্বিগুন গতিতে তিনি বেরিয়ে গেলেন।আরহাম তীর্যক চোখে তার প্রস্থান দেখল।তিনি যেতেই দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’শালা চোর! বাটপার! অন্যের জায়গা মে’রে খাস।আবার নিজের বাটপারির সাফাই দিস।যা সর!’
.
.
.
.
আদালত থেকে একটা রায় বেরিয়েছে।যেখানে নূর আহমেদের সমস্ত সম্পত্তি নিয়ে একটা লিখিত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে।যেখানে বলা হয়েছে এতোদিন যাবত তার সমস্ত সম্পত্তি অবৈধ দখলদারিতে ছিলো।সেই সম্পদের আইনত মালিক নূর আহমেদ নিজে।তার মৃত্যুর পর আপনাআপনি সেই সম্পদ তার উত্তরাধিকারি’রা পাবে।

সেই বিবৃতি নোটিশ আকারে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছালো আরো দুই দিন পরে।সবার আগে সেটা হাতে পেয়েছে নূর আহমেদের জ্যেষ্ঠ কন্যা নবনীতা নূর।দরজা খুলে একটা মাঝবয়সী লোককে সামনে দেখতেই সে সামান্য বিচলিত হলো।নমনীয় হয়ে জানতে চাইল,’আপনার কি কিছু চাই?’

লোকটা ব্যস্ত হয়ে জবাব দেয়,’কোর্ট থেকে নোটিশ এসেছে।সামনের সপ্তাহে একবার আদালত যেতে হবে আপনাকে।গিয়ে কিছু কাগজে সই করতে হবে।’

সে চমকায়।আশ্চর্য হয়ে বলে,’কোর্ট নোটিশ?আমাকে নিয়ে?আমি আবার কি করলাম?’

‘অতো কিছু জানি না।পড়লেই বুঝবেন।’

লোকটা আর অপেক্ষা করল না।তার থেকে একটা সই নিয়ে মিনিটের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।নবনীতা তখনো বিস্ময়ে চারপাশ দেখে যাচ্ছিল।তাকে কেনো কোর্ট থেকে নোটিস পাঠাবে?সে এমন কি করেছে?কিছুই তো করেনি সে।

দরজা বন্ধ করে বসার ঘর পর্যন্ত আসতে আসতে পুরোটা সময় সে শুধু ভেবে গেল কি এমন থাকতে পারে এই নোটিশে?আবার কোন ঝড় চলে এসেছে তার জীবন তোলপাড় করে দিতে?

সে ভয়ে ভয়ে খাম থেকে নোটিশ টা বের করল।কাগজটা খুলে কয়েক লাইন পড়তেই আচমকা তার চোখ স্থির হলো,শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শান্ত ধারা নেমে এলো,মনে হলো সে পুরোপুরি জমে গেছে,নড়ার শক্তিটুকুও তার মাঝে অবশিষ্ট নেই।সে দুই হাতে নোটিশটা চেপে ধরল।বড় বড় অবিশ্বাস্য চোখে খুটিয়ে খুটিয়ে সেটা পড়ল।একবার,দুইবার,তিনবার,,অগনিতবার।তার হাত অল্প কাঁপছে,গলার কাছে সবকিছু দলা পাকাচ্ছে।চোখ দু’টো পানিতে টইটম্বুর।মন চাইছে চিৎকার করতে,অথচ গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।

সে নিজেকে সামলায়।বড় বড় শ্বাস টেনে সোফায় গিয়ে বসে।একটু পরেই গলা ছেড়ে চিৎকার করে,’শুভি! মামি! তোমরা কোথায়?তাড়াতাড়ি এখানে এসো।’

মিসেস রোকেয়া হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে বের হলেন।শুভ্রা বারান্দা থেকে দৌড়ে বসার ঘরে এলো।আপাইয়ের মুখ দেখে সে ভড়কে গেল।ঠোঁটে হাসি,অথচ চোখে অশ্রু।এটা আবার কেমন অনুভূতি?সে ঘরে আসতেই নবনীতা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।কান্নার মাঝেই কোনোরকমে নাক টেনে বলল,’শুভি! আমরা আমাদের বাড়ি ফিরে পেয়েছি শুভি।’

সে তাকে ছাড়ল।হাতে থাকা কাগজটা শুভ্রার সম্মুখে মেলে ধরে বলল,’এই দেখ! কোর্ট থেকে নোটিশ এসেছে।আগামী মাসেই চাইলে আমরা সব ঝামেলা মিটিয়ে আমাদের বাড়িতে যেতে পারব।আমার বিশ্বাস হচ্ছে না শুভি,সব কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে।এতো বছর পর আমরা এসব পেলাম কি করে?আমি তো কোনো মামলাও করিনি।’

শুভ্রা আহাম্মকের মতো তার কথা শুনে।আপাইয়ের উন্মাদনা দেখে তার নিজের আর কোনো প্রতিক্রিয়া আসছে না।আপাইয়ের চোখ দু’টো পানিতে চিকচিক করছে।সে খুশী,ভীষণ খুশি।কোর্ট নোটিশটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেই সে আরেক দফা হাসল।হাসতে হাসতেই বলল,’বাবা আমরা আমাদের ঘর ফিরে পেয়েছি।আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না।’
.
.
.
.
‘আমি শেখ আজিজ হোসেন।মহানগর ০৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য।আমি রাজনীতি বুঝি না।ব্যবসার অঙ্গন থেকে আমি রাজনীতিতে এসেছি শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের ভালোবাসার জোরে।আমি ক্ষমতায় থাকার চেয়েও মানুষের মনে থাকতে বেশি পছন্দ করি।জনগণ আমার প্রাণ।জনগণ আছে বলেই শেখ আজিজ আছে।আমি যতদিন থাকবো,ততদিন আমার আসনের কেউ না খেয়ে থাকবে না।তার জন্য যদি আমার নিজের পকেট থেকে টাকা খরচা করতে হয়,তবে তাই হবে।আমি মানুষকে ভালোবাসি।রমনার ফাঁকা বেঞ্চিতে যেই বাচ্চাটা ঘুমায়,আমি তাকে ভালোবাসি।মা বাবাহীন যেই এতিম বাচ্চাটার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই,আমি তাকে ভালোবাসি।আমি কোনো নেতা নই,আমি সবার বন্ধু।আমি আপনাদের ভালোবাসি।’

মুঠোফোনের স্ক্রীনে ভিডিও ক্লিপটি হাই ভলিউমে চলছে।একবার,দুইবার না,অসংখ্যবার।অনেকবছর আগে মূলধারার কোনো একটা সংবাদ মাধ্যমে এমনই একটা সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিলো।সাথে যুক্ত করা হয়েছিল একটা সুন্দর ভিডিও ক্লিপ।ছেলেটা ভেজা চোখে বারবার ভিডিওটা দেখে।কখনো বা কম্পিত হাতে স্ক্রীনে ভাসতে থাকা মুখটা ছুঁয়ে দেয়।এই স্নিগ্ধ চেহারার লোকটা তার বাবা।যাকে সে খুব বেশি ভালোবাসে।বাবা বেঁচে নেই।কিন্তু তার স্মৃতি গুলো তো তার সাথেই আছে।

আরহাম ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ে।সে কি পারবে বাবার মতো ভালো নেতা হতে?সাধারণ মানুষদের কষ্টে যেই গুটিকয়েক মানুষের ভেতরে যন্ত্রণা অনুভব হয়,সে কি তাদের মধ্যে একজন হয়ে উঠতে পারবে?সে কি পারবে তার বাবার আদর্শ কে ধারণ করতে?পরীর প্রিয়তম হয়ে পরীর মতো স্বচ্ছ হৃদয়ের অধিকারী হওয়া কি তার পক্ষে সম্ভব?সে বুক ভরে নিশ্বাস নিল।নিজ থেকেই জবাব দিলো সে পারবে,তাকে পারতেই হবে।পুরো সিস্টেম,পুরো প্রটোকলের বিরোধিতা করে সে বাবার পদচিহ্ন অনুসরণ করবে।শাহানা সেদিন যেমন করে তাকে ভালো বলেছিল,একসময় গোটা আসনের মানুষ তাকে ভালো বলবে।

তার মুঠোফোনে একটা ফোন এলো।দুইবার রিং হতেই সে ব্যস্ত হাতে সেটা রিসিভ করল।ইন্সপেক্টর ইয়াসিন হড়বড় করে বললেন,’স্যার আবির আর দ্বীপ তো বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।’

সে শুনলো।শুনেই শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো।আলমারির দিকে দেখতে দেখতে গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো,’শহরের মেইন পয়েন্ট গুলোতে চেকপোস্ট বসাও।বেশি দূর যায়নি এখনো।ইমিডিয়েটলি চেক পোস্ট বসানোর ব্যবস্থা করো।’

ফোন রেখেই সে আলমারির দিকে এগিয়ে যায়।আলমারির দরজা খুলতেই ভেতরের সবগুলো তাক দৃশ্যমান হলো।সে হাত বাড়িয়ে রিভলবার টা হাতে নেয়।স্থির চোখে কয়েক পল সেটা দেখে।ম্যাগাজিনে ছয়টা বুলেট আছে।আরহাম বড় করে একটা শ্বাস টেনে আলমারির দরজা বন্ধ করে।অতি সাবধানতার সাথে পিস্তলটা কোমরের দিকে গুজে নেয়।এই ম্যাগাজিন আজ সে খালি করবে।

****

নিলয়ের মৃ’ত্যুর মতোন ভয়াবহ বিষয়টির পরেও আবির কিংবা দ্বীপ কেউই দমলো না।তাদের কোনো শাস্তি হয়নি,কোনো বিচার হয়নি।আরহাম ভাই বলেছেন এটা স্বাভাবিক মৃ’ত্যু।কেউ কোনো রকম তদন্ত পর্যন্ত করেনি।সবকিছু এতো সহজে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে যে আবির শাস্তি ভোগ করার মতো কিংবা নিজের অপরাধ উপলব্ধি করার মতো সময় টুকুও পেল না।

নিলয়ের মৃ’ত্যুর পরেও সে তার উচ্ছৃঙ্খল আচরণ থেকে সরে আসেনি।উল্টো লাই পেয়ে যা খুশি তাই করে যাচ্ছে।তার নামে অসংখ্য অভিযোগ।সে নেশা করে,মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করে,ভার্সিটির জুনিয়রদের কোনো কারণ ছাড়াই মারধর করে।এমনকি তার বিরুদ্ধে খু’নের অভিযোগ পর্যন্ত উঠে এসেছে।এতো কিছুর পরেও আবিরের নামে কোনো মামলা করা সম্ভব হয়নি।তার বাবা প্রভাবশালী মানুষ।আগে থেকেই টাকা খাইয়ে সবাইকে শান্ত করে রেখেছেন।তবে শেষ পর্যন্ত টাকার গরম দেখিয়ে আলাউদ্দিন সাহেব টিকতে পারেন নি।আবির আর তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু দ্বীপের নামে থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং সেই সাথে আদালত থেকে তাদের এরেস্ট ওয়ারেন্ট তথা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারী করা হয়েছে।

খবর কানে যেতেই আবির আর দ্বীপ বাড়ি ছাড়া হলো।আপাতত কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে বাঁচতে পারলেই হলো,তারপর বাকিটা তার বাবা সামলে নিবে।শহর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতেই দু’জন টের পেল শহরের পয়েন্টে পয়েন্টে চেক পোস্ট বসানো।এই মুহুর্তে শহর ছাড়া অসম্ভব।

মুখ দিয়ে একটা অশ্রাব্য গালি বের করে আবির গাড়ি ঘোরায়।সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাইওয়ে দিয়ে না গিয়ে অন্য কোনো গ্রামের রাস্তা দিয়ে শহর ছাড়বে।তাদের গাড়িটা হাইওয়ে থেকে একটু দূরে সরতেই আচমকা সাইরেনের শব্দে দু’জন আঁতকে উঠল।রিয়ার ভিউ মিররে একনজর দেখেই আবির শক্ত করে স্টিয়ারিং চেপে ধরল।পুলিশ টের পেয়ে গেছে।তাদের গাড়ি ঘোরাতে হবে।

আবির গাড়ি ঘোরানোর পরেই বুঝে গেল তার পক্ষে আদৌ পালানো সম্ভব না।পুলিশের গাড়ি সবদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলেছে।সে কপালের ঘাম মুছে আলাউদ্দিন সাহেবকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করল।সম্ভব না,সে আপাতত নেটওয়ার্কের বাইরে।সামনে পুলিশের গাড়ি থেকে একে একে সব পুলিশ অফিসার নেমে তার গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে।

আর কোনো উপায়ান্তর না দেখে দু’জন দ্রুত গাড়ি থেকে বের হলো।হাতের রিভলভারটা পুলিশের দিকে তাক করেই আবির অস্পষ্ট গলায় বলল,’কতো টাকা লাগবে তোমার?বাবা কে বলো।বাবা দিয়ে দিবে।তবুও এসব বন্ধ করো।’

ইয়াসিন নিজেও বন্দুক তাক করল আবিরের কপাল বরাবর।গম্ভীর হয়ে বলল,’তোমার বাবা কে বলবে যা বলার আদালতে বলতে।এখন কিছুই করার নেই।এরেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে তোমার নামে।তুমি কোনোভাবেই নিজের গ্রেপ্তার হওয়া এড়াতে পারবে না।’

আবিরের ধৈর্য চ্যুতি ঘটল।দাঁতে দাঁত চেপে সে গালি দিলো,’কু’ত্তার বাচ্চা সব! টাকা আরো বেশি লাগবে সেটা সহজ করে বল না।এতো ঘুরাচ্ছিস কেন?’

দ্বীপ ধীর পায়ে তার কাছটায় এগিয়ে যায়।কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলে,’আবির! আই গেস আমাদের পালিয়ে যাওয়াই বেটার অপশন।এরা আমাদের ছেড়ে দিবে বলে মনে হচ্ছে না।’

আবির তীর্যক চোখে এপাশ ঐপাশ দেখে।এখন শুধু ডানদিকের ঐ বড়ো জঙ্গলের মতো জায়গাটা ছাড়া তার পালানোর আর কোনো জায়গা নেই।তার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো।একেবারে সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা হাবিলদারের পায়ে পর পর দু’টো গু’লি করে সে জঙ্গলের দিকে ছুট লাগালো।তার পিছু পিছু ছুটে গেল দ্বীপও।

ইয়াসিন তব্দা খেল।আশ্চর্য হয়ে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করল।হাবিলদার ছেলেটা ইতোমধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।তার পা থেকে অনবরত র’ক্ত বের হচ্ছে।কয়েকজন তার পাশে বসে তার পা বেঁধে র’ক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা করছে।

ইয়াসিন আর সেদিকে তাকালো না।হাতে থাকা বন্দুকটা একনজর দেখেই সে জঙ্গলের দিকে দৌড়ে গেল।আবিরের বাবার চেয়েও প্রভাবশালী মানুষ তার বিরুদ্ধে কেস করেছে।ইয়াসিন অবশ্যই তার কথা শুনবে,শুনতে বাধ্য।সে নিজেও অনুভব করে যে আবিরের একটা শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।

তারা দু’জন গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ছুটছিলো।পেছন থেকে ইয়াসিন তাদের সতর্ক করল,’থামো তোমরা।নয়তো আমি তোমাদের শ্যুট করব।’

তার কথা শেষ না হতেই হঠাৎ ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাখি শিকার করার মতো ব’ন্দুক চালানোর বিকট শব্দ হলো।একবার,দুইবার না,পর পর ছয়বার।

ইয়াসিন থেমে গেলো।তার পা দু’টো যেন মাটির সাথে গেঁথে গেল পুরোপুরি।সে দেখল আবির আর দ্বীপ দু’জনই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।একাধিক গু’লিতে তাদের শরীরের জায়গায় জায়গায় গভীর ক্ষ’ত সৃষ্টি হয়েছে।সেখান থেকে ঝরঝর করে র’ক্ত গড়িয়ে পড়ছে।একটা গু’লি আবিরের কপালে লেগেছে।সেখান থেকে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত ছুটছে।মুখটা অল্প হা হয়ে আছে,চোখ দু’টো খোলা।

ইয়াসিন আর সেদিকে তাকালো না।বোঝাই যাচ্ছে স্পষ্ট ডেড।আর দেখে লাভ নেই।দ্বীপ তখনও ছটফট করছিলো।একটা গু’লি তার কাঁধে লেগেছে,একটা পেটে,আর একটা হাঁটুতে।ইয়াসিন কম্পিত পায়ে তার দিকে এগিয়ে যায়।তার তড়পাতে থাকা শরীরটা দেখে ইয়াসিনের মনে হলো এমনভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে এক্ষুনি মরে যাওয়া ভালো।সেই হিসেবে আবির ভাগ্যবান।

ইয়াসিন বড় বড় শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করল।ডান হাতে চেপে রাখা রিভলভারটা সামনে তুলে ঠান্ডা হাতে সেটার ম্যাগাজিন বের করল।

সে যা ভেবেছিল তাই।ম্যাগাজিন একদম ফুল।একটা গু’লিও এখান থেকে বের হয়নি।চকিতে পেছন ঘুরে সে।দেখার চেষ্টা করে এই জঙ্গলের ভেতর এমন সাঁই সাঁই গু’লি চালালো কে?

চারদিক একদম ফাঁকা।সুনশান নিরবতায় ঢাকা পড়েছে গোটা জঙ্গল।কেবল ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।মহুয়া গাছের মাঝামাঝি ডালে একটা পেঁচা বসে আছে।এছাড়া ইয়াসিন ব্যতীত আরো কোনো জনমানবের অস্তিত্ব নেই এখানে।

অদূরেই একটা অশ্বত্থ গাছ।বয়স একশো বছরেরও বেশি।কার্যসিদ্ধির পরেই কালো কাপড় মুখে প্যাচানো যুবকটি একেবারে নিঃশব্দে গাছটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।হাতে থাকা কালো রঙের পিস্তলে বর্তমানে কোনো বু’লেট অবশিষ্ট নেই।সে হাসল,অকারণেই হাসল।দেশের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে তার ভালোই জ্ঞান আছে।একটা কেস আদালতে উঠবে।তারপর মাসের পর মাস রায়ের ডেট পেছানো হবে।এভাবেই সবকিছু বছরের পর বছর চলতে থাকবে।এতো ধৈর্য তার নেই।যে অপরাধ করেছে,সে সাথে সাথে শাস্তি পাবে।বছরের পর বছর আদালতে কেস ঝুলিয়ে রেখে একটা সময় পর অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার মতোন ঘটনা যে দেশে অহরহ ঘটছে,সে দেশে অন্তত আদালতের বিচারের অপেক্ষায় এমন খু’নিদের মুক্ত বাতাসে ছেড়ে রাখার কোনো মানেই হয় না।তারা বিষাক্ত,বিষের চেয়েও বিষাক্ত।এরা ভয়ংকর,বন্য ক্ষুদার্ত পশুদের চেয়েও ভয়ংকর।

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে