#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৬৩)
(রিচেক ছাড়া দিচ্ছি।আপাতত পড়ে নিন)
বৃষ্টি থেমেছে কিছুক্ষণ আগে।বাগানের গাছগুলো ভীষণ সতেজ দেখাচ্ছে,পাতাগুলো এখনো পানিতে ভেজা।তাসনুভা বিমুগ্ধ চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে।কদম গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুল দেখা যাচ্ছে।তার মুখে আপনাআপনি হাসি ফুটল।কি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে সবকিছু!
হঠাৎই পেছন থেকে কেউ তাকে জাপ্টে ধরল।সে হকচকিয়ে উঠে পেছন ফিরে।সাথে সাথে তার মুখে হাসি ফুটল।উচ্ছ্বসিত কিশোরীদের ন্যায় সে চেঁচিয়ে উঠল,’ইজমা আপু!এসেছো তুমি?’
ইজমা মিষ্টি করে হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’তোমার সাথে দেখা না হলে মন খচখচ করে বাচ্চা।তাই চলে এলাম।’
তাসনুভা লাজুক হাসে।
‘আদি ভাইয়ার মতো তুমিও আমায় বাচ্চা ডাকছো?’
‘তো তুমি তো বাচ্চাই।’
‘হেই বাচ্চা! কেমন আছো?’
তাসনুভা ইজমার থেকে চোখ সরিয়ে তার পেছন দিকে উঁকি দেয়।পকেটে একটা হাত গুজে আদি বড় বড় পা ফেলে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।ইজমার মতো আন্তরিক হেসে বলল,’কি অবস্থা তোমাদের?বড় ভাইয়ের উপর থেকে রাগ কমেছে তোমাদের দুই ভাই-বোনের?’
মাথা নাড়ল তাসনুভা।খানিকটা চঞ্চল হয়ে বলল,’ভাইয়া ইদানিং অনেক নরম হয়ে গেছে জানো?’
‘বাপরে! সাংঘাতিক বিষয়! তো কোন কোন লক্ষণ দেখে বুঝলে যে সে নরম হয়েছে?’
‘অনেক কিছু ।তুমি জানো,ভাইয়া গতকাল রাস্তার সামনের কুকুরদের বন পাউরুটি খাইয়েছে।’
আদি নাক ছিটকায়।
‘তো এতে এতো খুশি হওয়ার কি আছে?এরা তো তার কর্মী।কর্মীদের ভালো মন্দ খাওয়াবে না?’
তাসনুভা মুখভার করল।গোমড়া হয়ে বলল,’এভাবে বলো না।ভাইয়া অনেক ভালো আচরণ করে এখন।রোজ সন্ধ্যায় আরশাদকে নিয়ে বাগানে হাঁটে।আরশাদও তো ইদানিং বাবার ভক্ত হয়েছে।দু’জনের সেকি ভাব!আরো মজার কথা জানো?’
আদি কপাল কুঁচকায়।ইশারায় বোঝায় সে জানে না।তাসনুভা মুচকি হেসে বলল,’ভাবি তো দুই মাস হয়েছে হ্যান্ড ক্রাফ্টের বিজনেস শুরু করেছে।ভাইয়া কি করেছে জানো?ভাইয়া তোফায়েল ভাইয়ার এড্রেস থেকে হাবিজাবি কিসব অর্ডার দিয়েছে।তার বউয়ের ব্যবসার প্রথম খরিদদার নাকি সে হবে।এজন্য এমন অন্য এড্রেস থেকে অর্ডার দিয়েছে।’
আদি কপাল চাপড়ায়।আশ্চর্য হয়ে বলে,’দেখেছো কান্ড! শালা তো পুরাই বউ বলতে অজ্ঞান।’
ইজমা গালের নিচে হাত রেখে বলল,’ইশশি রে! দে আর সো কিউট।আমার এতো মিষ্টি লাগে দু’জনকে! দেখবে খুব জলদিই সব ঠিক হয়ে যাবে তাদের।’
সে কথা শেষ করেই তাসনুভা কে দেখে।চোখ পাকিয়ে বলে,’আমি কিন্তু শুধু আড্ডা দেওয়ার জন্য আসিনি তাসনুভা।’
তাসনুভা কপাল কুঁচকে বলল,’তাহলে কেন এসেছো?’
‘তোমাকে হাঁটাতে এসেছি।তুমি নাকি চাইলেই দাঁড়াতে পারো?আলসেমি করে চেষ্টা করো না।’
তাসনুভা দ্রুত দুই হাত সামনে নাড়ে।জোর গলায় বলে,’না না মিথ্যা কথা।ভাবি সবাইকে এই মিথ্যা কথা বলেছে।আমি একদমই দাঁড়াতে পারি না।দুই সেকেন্ডেই পড়ে যাই।তারা জোর করে আমায় দাঁড় করাতে চায়।এসব মিথ্যা।আমি দাঁড়াতে পারি না।’
ইজমা জেদ ধরল।চোখ রাঙিয়ে বলল,’অবশ্যই পারো।আজ আমরা আবার চেষ্টা করব।চেষ্টা করতে করতেই একসময় পারবে।’
বলেই সে তাসনুভার একটা হাত টেনে ধরল।তাসনুভা সত্যি সত্যি বাচ্চাদের মতো কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’না আপু।আমি পারব না।আমার পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব না।’
‘অবশ্যই পারবে।নিজেকে এতো আন্ডারেস্টিমেট করছো কেন?মানুষ চাইলে কি না পারে?আমার বিশ্বাস চেষ্টা করলেই তুমি পারবে।’
ইজমা আশা ছাড়ল না।তার একরোখা জেদের কাছে পরাস্ত হয়ে তাসনুভা হতাশ ভঙ্গিতে কয়েকবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল।পাঁচবারের বারের চেষ্টায় চারবারই সে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।শেষবারে দুই সেকেন্ডের জন্য দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল।তাল হারিয়ে পড়ে যেতে নিলেই আদি খপ করে তার বাম হাতের কবজি চেপে ধরল।তার পা জোড়া দেখতে দেখতে ব্যস্ত হয়ে বলল,’হচ্ছে হচ্ছে।একটু কষ্ট করে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করো।এই দেখো আমি ধরেছি তোমায়।তোমার কিচ্ছু হবে না।পড়বে না তুমি।’
ইজমা ধীরে ধীরে নিজের হাতটা ছেড়ে দিলো।এখন তাসনুভার দু’টোর হাতই আদির হাতের মুঠোয়।তাসনুভার মনোযোগ নিজের ভারসাম্যের দিকে,আদির মনোযোগ তার পায়ের দিকে,আর ইজমার মনোযোগ তাদের দু’জনের দিকে।কি মিষ্টি দেখাচ্ছে দু’জন কে!
সদ্য যৌবনে পা রাখা ফুলের কুড়ির মতো নিষ্পাপ মেয়েটিকে দেখামাত্র ইজমার প্রশান্তি অনুভব হয়।আচ্ছা,আদি কি মূর্খ?মাথায় কি কোনো বুদ্ধি নেই তার?যেই স্বচ্ছ চোখের ভাষা ইজমা এক সপ্তাহে বুঝে গেছে,ঐ ভাষা কি ছাগলটা এতোদিনেও বুঝতে পারেনি?সে আদির দিকে দেখে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে,’আস্ত ছাগল একটা!’
সে সরে গেল আরো দুই কদম।থাকুক।তারা সেভাবেই থাকুক।তার বিশ্বাস,তার হাতের চেয়ে তাসনুভা ঐ দু’টো হাতেই বেশি নিরাপদ।
.
.
.
.
আজকে মোট ছয়টা অর্ডারের পার্সেল ডেলিভারি করতে হবে।তিনটা যাবে ঢাকায়,একটা শেরপুরে,একটা চট্টগ্রামে,আর আরেকটা কুমিল্লাতে।
নবনীতা স্কচটেপ দিয়ে বেশ মজবুত ভাবে প্যাকেট গুলোর মুখ বন্ধ করল।প্রথা একটা শিটে হিসেবের বিষয় গুলো টুকে নিচ্ছে।শুভ্রা রান্নাঘরে,মামিকে টুকটাক কাজে সাহায্য করছে।আর চিত্রা পুরো বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে।আজ ছুটির দিন,কারো বাইরে যাওয়ার তাড়া নেই।আবহাওয়াও বেশ ঠান্ডা।মামি কুমড়োর পাতা বেসনে চুবিয়ে ভাজছে।নবনীতা প্যাকিং করতে করতেই নাক টেনে ঘ্রাণ নেয়।গলা উঁচু করে বলে,’অনেক সুন্দর ঘ্রাণ আসছে মামি।’
বলা শেষ করেই সে আবার নিজের কাজে মন দেয়।সে ভাবছে ব্যবসায় ইনভেস্টমেন্ট আরেকটু বাড়াবে।তাহলে কষ্ট একটু কম হবে।রোজ রোজ জিনিস কেনা একটা ঝামেলা।এর চেয়ে অনেক কিছু একেবারে কিনে ফেললে তার জন্য সুবিধা।এমন করলে যাতায়াত খরচও কমবে,সাথে লাভের পরিমানও বাড়বে।সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এরপর থেকে সে এমন একসাথে অনেক কিছু কিনে নিবে।
কাজ অনেকটা গোছানো হয়ে গেছে।টেবিলে গরম গরম খাবার সব একে একে রাখা হয়েছে।এমনই সময় মূল দরজায় কড়া নাড়ল।নবনীতা সন্দিহান চোখে সামনে এগোতে এগোতে জানতে চাইল,’কে?’
দরজা খুলতেই তার চক্ষু চড়াকগাছ।রিমি আর ওয়াজিদ এসেছে।রিমির গায়ে একটা নীল শাড়ি।আর ওয়াজিদ পরেছে কালো পাঞ্জাবি।নবনীতা স্তব্ধ হয়ে তাকে দেখলো।হুশ ফিরতেই ছুটে গিয়ে রিমিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।সে নতুন নতুন শহরে আসার পর রিমি দুইবার এসেছিল।তারপর অনেকদিন সে আর আসেনি।যোগাযোগ যা হতো সব ফোনেই সীমাবদ্ধ।
নবনীতা রিমির এক হাত ধরে তাকে ভেতরে নিতে নিতে বলল,’আয় না রিমি।বোস বোস।সোফায় বোস।’
রিমি তার পাগলামি দেখে শব্দ করে হেসে ফেলল।তার পায়ের সাথে পা মেলাতে মেলাতে বলল,’আরে আরে,পড়ে যাবো তো।আস্তে হাঁট।’
সে কোনোরকমে একটা সোফায় গিয়ে বসল।নবনীতা দুই দিকে দেখে খানিকটা লজ্জা পেয়ে বলল,’আসলে এই ঘরে কোনো সিলিং ফ্যান নেই।চার্জিং ফ্যান আছে।সিলিংটা সামনের মাসে কিনবো।তোর কোনো সমস্যা হবে না তো?’
রিমি একহাত মাথায় রেখে চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,’আল্লাহ! এতো কথা কেমন করে বলিস তুই?আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।এবার একটু চুপচাপ আমার পাশে এসে বয়।’
সে স্মিত হেসে তার পাশটায় গিয়ে বসল।ওয়াজিদ বসল অন্যপাশের সোফাতে।তার মনোযোগ ফোনের স্ক্রিনে।মেয়েদের আলাপে থেকে সে করবে টা কি?এর চেয়ে নিউজফিড স্ক্রল করা ভালো।
নবনীতা তার পাশে বসেই চঞ্চল হয়ে জানতে চাইল,’তো এবার বল,তুই কেমন আছিস?তোর বাবু কেমন আছে?’
রিমি সদ্য বিবাহিতা রমণীদের মতো লজ্জায় ঈষৎ রক্তিম হলো।মাথা নামিয়ে বলল,’আছে।ভালোই আছে।’
‘খাওয়া দাওয়া করিস ঠিক মতো?এই অবস্থায় কিন্তু ভালো মন্দ খেতে হয়।’
রিমি জবাব দেওয়ার আগেই ওয়াজিদ আগ বাড়িয়ে জবাব দিলো,’কচু করে।একদমই নিয়মিত খায় না তোমার বান্ধবী।খাবার দাবারে ভীষণ অনিয়ম তার।না বললে খেতেই চায় না।’
রিমি কটমট করে তার দিকে তাকায়।বিরক্ত হয়ে বলে,’বাজে বকবেন না তো।আজ সকালেও আমি খেয়েছি।’
‘ওহ তাই?তা কয়েকবার জোরাজুরি করার পর খেয়েছো শুনি?কাজ কর্ম সব ফেলে তোমার খাবার নিয়ে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে আমার।’
‘এতো সমস্যা হলে খাওয়াতে আসেন কেন?’
‘তো আসবো না?না খেয়ে খেয়ে আমার বাচ্চাকে কষ্ট দিবে নাকি তুমি?’
নবনীতা গালের নিচে হাত রেখে একবার রিমিকে,একবার ওয়াজিদকে দেখল।ব্যাস,এদের আবার ঝগড়া বেঁধে গেছে।বিয়ের পর এমন মিষ্টি ঝগড়া কে না চায়?কতো সুন্দর তাদের বিবাহিত জীবন!
রিমি কনসিভ করেছে।তার এখন দুই মাস চলছে।রিপোর্ট হাতে পাওয়ার সাথে সাথে সে নবনীতাকে ফোন দিয়েছে।এ কারনেই মূলত সে আর ঘনঘন যাতায়াত করে না।রিমির এখন ভালোবাসাময় যন্ত্রনার অধ্যায় চলছে।সবাই তাকে ভালোবেসে,আদর করে চেপে চেপে যা পারছে তাই খাওয়াচ্ছে।এই দুই মাসেই তার ওজন সাড়ে তিন কেজি বেড়েছে।ওজন বাড়া নিয়ে তার ভীষণ চিন্তা।বর যদি পরে আর তাকে ভালো না বাসে?নবনীতা তাকে বুঝিয়েছে আর যাই হোক ওয়াজিদ এই কাজ করবে না।
সে মন ভরে রিমি আর তার স্বামীর খুনশুটি দেখে।টের পায় এতো শত চেষ্টার পরেও কোনো একটা জায়গায় সে ভীষণ অসহায়।ভেতরটা এখনো কেমন ছটফট করে,সবকিছু খাঁ খাঁ করে।আনমনে তার একটা হাত পেটে গিয়ে ঠেকল।মনে হলো কোনোকিছু তার চেয়ে অনেক অনেক দূর চলে যাচ্ছে।মা,,এই চমৎকার শব্দটা সে অর্জন করতে পারেনি।এই ডাক সে অর্জন করেনি।সংসার,,এই শব্দের সাথেও তার আর যোগাযোগ নেই।নবনীতা শূন্য।দিনশেষে সে একটা শূন্য,ছন্নছাড়া জীব।
আপনাআপনি বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।যাকগে,সেসব চিন্তা করে লাভ কি?সবার সংসার কি সুখের হয়?সবার সমাপ্তিতেই কি প্রাপ্তি থাকে?নবনীতার সমাপ্তিতে প্রাপ্তি না থাকুক,আত্মসম্মানটা অন্তত থাকুক।কেউ আদর করে,ভালোবেসে দিনশেষে তাকে এ কথা না বলুক-‘কি যোগ্যতা আছে তোমার আমার বউ হওয়ার?’
ভালোবাসার মোহে জড়িয়ে কেউ না বলুক,তোমার জায়গা তো আমার পায়ের কাছে।কেউ না,কোনোদিনও না।
রিমি তার অবস্থা বুঝলো কিছুটা।পরিস্থিতি অন্যদিকে নেওয়ার জন্য বলল,’দাঁড়া! তোর সাথে তাসনুভার কথা বলাই।মেয়েটা তোকে অনেক মিস করে।’
নবনীতা ম্লান হাসল।বলল,’গত পরশুও কথা হয়েছে আমাদের।’
‘তো কি হয়েছে?আজ আবার বলবি।’
রিমি ভিডিও কল দিলো তাসনুভার নম্বরে।তাসনুভা ফোন ধরেই স্ক্রিন না দেখে বলল,’হ্যাঁ রিমি আপু,বলো।’
যখন স্ক্রিন দেখল তখন আচমকাই চেঁচিয়ে উঠে বলল,’ভাবিইই! তুমি?’
তার বাচ্চা বাচ্চা মুখটা দেখেই নবনীতা হেসে ফেলল।এই দুই ভাই বোনের কথা তার ভীষণ মনে পড়ে।কি আদুরে এরা! কতোদিন এদের সাথে তার দেখা হয় না।রিমির কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে সে জানতে চাইল,’শরীর কেমন তোমার?দাঁড়ানোর প্র্যাকটিস করছো তো?’
‘আর বলো না।আদি ভাইয়া আর ইজমা আপু রোজ এসব নিয়ে জ্বালাতন করে।তোমাদের যন্ত্রণায় হাত পা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে আমার।’
‘বেশ করেছে।তুমি বড্ড অলস।তোমাকে একটু খাটুনির মাঝে রাখাই ভালো।’
হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটল।আরহাম কিছু বলার জন্য তাসনুভার কাছে এসেছিলো।সামনে আসতেই তার অবয়ব স্ক্রিনে ভেসে উঠল।নবনীতা তাকে দেখতেই অপ্রস্তুত হয়ে নড়েচড়ে উঠল।
আরহাম থামলো।গভীর মনোযোগ দিয়ে তাসনুভার হাতে থাকা ফোনটার দিকে দেখে বুঝল ফোনের অপরপাশের মেয়েটা তার স্ত্রী।যার মুখের হাসি আরহাম সামনে আসা মাত্রই মিলিয়ে গেছে।
সে নিজেও অপ্রস্তুত হলো খানিকটা।অদ্ভুত বিষয়! এতোটা সময় একই ছাদের নিচে থাকার পর হঠাৎই দু’জন দু’জনের থেকে এতোবেশি দূরে সরে এলো যে স্ক্রিনে একজনের মুখ দেখাও অন্যজনের কাছে অস্বস্তির মতো?
অস্বস্তিটুকু একপাশে সরিয়ে আরহাম নিজে থেকেই প্রথম মুখ খুলল।
‘কেমন আছো পরী?’
নবনীতা চোখ নামিয়ে ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলো,’আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনি?’
‘আমিও ভালো।’
‘আর আরশাদ?সে কেমন আছে?’ এবার কিছুটা অস্থির শোনাল তার কন্ঠ।মনে হলো আরহামের ভালো থাকার চেয়েও তার কাছে আরশাদের ভালো থাকাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সে সংক্ষেপে জবাব দিলো,’ভালো আছে।’
তারপরই আর এক মুহুর্ত দেরি না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।পরীর সাথে তার মূলাকাত হবে,অবশ্যই মূলাকাত হবে।তাদের আবার সংসার হবে।কিন্তু এখন না।আগে আরহাম কিছু অসমাপ্ত কাজ শেষ করবে।কিছু প্রায়শ্চিত্ত তার এখনও করা বাকি।উনিশ বছর বয়সের মিষ্টি মুখের মেয়েটি যেই আকুল আবেদন নিয়ে তার কাছে এসেছিল,ঐ মেয়েটির আস্থার জায়গাটা এখনো অর্জন করা হয়নি।শীতের রাতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে জমে যাওয়া ছেলেটাকে ইনসাফ দেওয়া বাকি।বাবার বিজনেস পার্টনার কতৃক বিশ্বাসঘাতকতায় সর্বশূন্য হয়ে যাওয়া তিনটা কোমল প্রাণকে সবকিছু ফিরিয়ে দেওয়া বাকি।কেরানীগঞ্জে কোনো এক নেতার ছেলের বেপোরোয়া হয়ে চালানো গাড়ির নিচে পড়ে পিষ্টন হওয়া দরিদ্র বাবার ইনসাফ পাওয়া বাকি।নোংরা রাজনীতির জঞ্জালে জড়িয়ে থাকা ছেলেটার ভালো নেতা হয়ে উঠা বাকি,বাবার পথ ধরে অনেকটা পথ হাঁটা বাকি।কতো কিছুই তো বাকি।আগে সমস্ত হিসেব মিটমাট হোক।তারপর না হয় তাদের সংসার হবে।
সে বেরিয়ে গেল বাড়ির মূল ফটক ছাড়িয়ে।আকাশে মেঘ ডাকছে ঘন ঘন।চারদিক থেকে সবকিছু ঘোলাটে দেখাচ্ছে।দূর আকাশে কালো মেঘ জমেছে।সেই কালো ছড়িয়ে পড়েছে ধরণীজুড়ে।গম গম মেঘের আওয়াজ,হঠাৎই শব্দ তুলে বজ্রপাত।
“অন্ধকারের গহীন ডাক,শোনায় শঙ্কার সুর,
পায়ের নিচের মাটি যেন হারায় গভীর গুড়।”
চলবে-