#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৬২)
সময় এগিয়েছে।ডেস্ক ক্যালেন্ডার থেকে চারটে মাস গায়েব।বসন্ত শেষ হয়ে বর্ষার মাঝামাঝি চলছে।আজ সকালেও আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি হয়েছে।এখন আবহাওয়া একদম গুমোট।আকাশের রং কালো।দেখে মনে হচ্ছে আর দশ মিনিট পরেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামবে।
নবনীতা পর্দা সরিয়ে জানালা খুলল।বৃষ্টি থামার পর মাটির একটা ভেজা ঘ্রাণ নাকে লাগে।এই ঘ্রাণটা তার ভীষণ ভালো লাগে।চিত্রা একটু পরেই স্কুল থেকে আসবে।শুভ্রা গিয়েছে তাকে আনতে।রান্নাঘর থেকে মাছ ভাজার সুন্দর ঘ্রাণ আসছে।বৃষ্টির দিনে গরম গরম ভাত আর মাছ ভাজা।দারুন একটা ব্যাপার!
সে গালের নিচে হাত রেখে জানালা গলিয়ে বাইরে দেখে।সামনের বিশালাকার গাছের মগডালে দু’টো শালিক বসা।নবনীতা তাদের দেখে মুচকি হাসল।নিজ থেকেই বলল,’তোদেরই ভালো।কথা বলতে পারিস না,ভেজালেও পড়িস না।আমাদের মানুষদেরই যতো জ্বালা।কথার আঘাতে অন্যজনকে জর্জরিত করি।পরে আর শত চেষ্টাতেও কোনো কিছু স্বাভাবিক হয় না।’
কলিংবেল বাজছে।নবনীতা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল।দুই বোনকে দেখতেই তার মুখের হাসি চওড়া হলো।সে চিত্রার কাঁধ থেকে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে যেতে যেতে বলল,’এক্ষুণি গোসলে যা চিত্রা।এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।’
ঘরে এসে ক্লাচারের সাহায্য আনাড়ি হাতে কোনোরকমে চুলগুলোকে খোঁপা বাঁধে সে।এটা তার নতুন একটা জীবন।খুবই আলাদা একটা জীবন।সাত বছর আগের জীবনটা থেকে একদমই আলাদা।সাত বছর আগে মামি তাকে এতো স্নেহ করতো না,এখন করে।সাত বছর আগে প্রথার সাথে তার সম্পর্ক এতোটা প্রাণবন্ত ছিলো না।এখন প্রথা রোজ রোজ তার ঘরে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে।
প্রথার সাথে তার এই সুন্দর সম্পর্কের একটা দুর্দান্ত পটভূমি আছে।এক বিকেলে প্রথা গালভর্তি হাসি নিয়ে তার ঘরে এলো।এসেই বলল,’আপু থ্যাঙ্ক ইউ।’
নবনীতা তখন কাপড় ভাঁজ করছিলো।কাজ করতে করতেই সে আড়চোখে তাকে দেখে বলল,’কেন?আমি আবার কি করেছি?’
প্রথা উৎফুল্ল হয়ে খাটে বসল।বলল,’সেদিন আব্বুর সাথে ঝগড়া করছিলাম না টাকা দেওয়ার জন্য?ব্যবসা করব বলে।পরে তো তুমি টাকা দিতে দাওনি।ব্যবসাটাও আর করতে পারিনি।আমার বাকি ফ্রেন্ডরা ব্যবসা করেছে।আর জানো,তারা লস খেয়েছ ,তাও আবার মোটা অঙ্কের টাকা।আমি তো টাকা দেই নি।তাই আমি বেঁচে গেছি।’
বলেই সে ফিক করে হেসে দিলো।তার হাসি দেখে নবনীতার আপনাআপনি হাসি চলে এলো।আসলে হাতে গোনা কিছু মানুষ ব্যতীত সব মানুষই বোধহয় একরকমই হয়।এই যে প্রথাকে সে ভীষণ দাম্ভিক ভাবতো,বিষয়টা কিন্তু তেমন না।একটু মনোযোগ দিলে দেখা যায় প্রথাও আসলে খুব মিষ্টি একটা মেয়ে।শুধু চরিত্রের রুক্ষ ভাবটা সরিয়ে নিলে তবেই হলো।
নবনীতা হুট করেই তার কাছে জানতে চেয়েছিলো,’এই প্রথা! ব্যবসা করবি?তুই আর আমি মিলে?’
প্রথা অবাক হয়ে বলল,’সেকি! কিসের ব্যবসা করব আমরা?এতো টাকা কোথায় পাবো?’
সেই থেকে শুরু।তারপর তারা দু’জন সত্যিকার অর্থেই ক্ষুদ্র পরিসরে একটা ব্যবসা শুরু করেছিল।হ্যান্ড ক্রাফটের ব্যবসা।নবনীতাই অনেক চিন্তা করে এটাকে ব্যবসা হিসেবে বেছে নিয়েছে।এটাতে খরচ কম।অর্ডার আসলে তবেই বানানোর কাজ শুরু করা যায়।পাশাপাশি মামিও এসবে পারদর্শী।তিনজন একসাথে মিলে সময় দিলে নবনীতার উপর চাপও কমবে।বেশ দ্বিধাদ্বন্দে থাকার পর অবশেষে সে বিসমিল্লাহ বলে ব্যবসার অঙ্গনে নেমেছিলো।দেখা গেল দুই মাসে সে মোটামুটি ভালোই অর্ডার পেল।প্রথম মাসে তার লাভ হয়েছিলো তিন হাজার টাকা।গত মাসে লাভ হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা।এই মাসের অর্ডার দেখে মনে হচ্ছে এই মাসে আরো বেশি লাভ হবে।তার অবশ্য এখনই ব্যবসা রমরমা করার কোনো তাড়া নেই।চাকরি তো আছেই,পাশাপাশি ব্যবসা থেকে যা লাভ হচ্ছে সেটাই অনেক।
প্রথার লাস্ট সেমিস্টার চলছে।বেচারির যাতায়াতে সমস্যা হয় খুব,তবুও মানিয়ে নিচ্ছে।দিনভর পড়াশোনাতে ব্যস্ত,আর রাতে ব্যবসার কাজ।এই ব্যবসা শুরু করার পর থেকেই নবনীতার সাথে তার সখ্যতা বেড়েছে।একটু অবসর হলেই সে তার ঘরে চলে আসে।তারপর চা খেতে খেতে দু’জন দীর্ঘসময় আড্ডা দেয়।
জীবনের এই নতুন মোড় নবনীতার মাঝে মিশ্র অনুভূতির সঞ্চার করে।যেই অধ্যায় সে পেছনে রেখে এসেছে,সেই অমীমাংসিত অধ্যায় মাঝে মাঝেই তাকে শেকড়ের মতো আঁকড়ে ধরে।তাসনুভা,আরিশ এদের কথা ভীষণ মনে পড়ে।আর আরশাদ?তার কথা তো নবনীতা ভাবতেই পারে না।ভাবলেই তার চোখে পানি এসে যায়।বাচ্চাটা নিশ্চয়ই এই কয়দিনে কিছুটা বড়ো হয়েছে।সে কি আর কোনোদিনই তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারবে না?
এই তিনমাসে সবচেয়ে চমৎকার যেই ব্যাপারটি ঘটেছে তা হলো শুভ্রানীর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে।নবনীতা ভেবেছিল সে খুব বেশি ভালো করতে পারবে না পরীক্ষায়।যেহেতু তার এডমিশন ফেজ টা পুরাই একটা টানা হ্যাঁচড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে।কিন্তু নবনীতাকে আশ্চর্য করে দিয়ে শুভ্রা ময়মনসিংহ মেডিকেলে চান্স পেল।রেজাল্ট দেখার পর নবনীতা হা হয়ে কতোক্ষণ রেজাল্টশীট টা দেখল।কি হচ্ছে এসব?আল্লাহ তাকে সবদিক থেকে এতো কিছু দিচ্ছে কেন?
শুভ্রার ক্লাস শুরু হতে এখনো অনেকদিন বাকি।নবনীতা তাকে এখন খুব একটা কাজ করতে দেয় না।জীবনের এই সময়টা একবারই আসে।তারপর যে শুভ্রা ব্যস্ততায় ঢুকবে,সেই ব্যস্ততা থেকে আর মুক্তি নেই।শুভ্রা অবশ্য নিজ থেকেই টুকটাক কাজ করে।সে খুব ভালো অরনামেন্টস বানাতে জানে।সন্ধ্যের দিকে আপাই আর প্রথা আপু যখন সেগুলো নিয়ে বসে,তখন সেও টুকটাক সাহায্য করে।তার ভীষণ মজা লাগে এই কাজ করতে।
এই হলো নবনীতা নূরের সংক্ষিপ্ত জীবন।কিছুটা ছন্নছাড়া,কিন্তু তবুও আগের তুলনায় যথেষ্ট গোছানো।নিজের টাকায় চলছে,সংসার চালাচ্ছে,বোনদের ছোটখাটো চাহিদা পূরণ করছে।এতে মন্দ কি?বেশ ভালোই আছে সে।
আরহাম সেদিন যাওয়ার পর আর আসেনি।মাঝে একবার ফোন দিয়েছিল অবশ্য।নবনীতার কাছে জানতে চেয়েছিল ভালো মানুষ হওয়ার জন্য কি করতে হয়?সে কাটকাট জবাব দিয়েছে ‘রাজনীতি ছাড়তে হয়।’
আরহাম তারপর আর যোগাযোগ করেনি।খুব সম্ভবত সেদিনই সে ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছে রাজনীতি ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব না।এরপর শেষ।নবনীতার সাথে তার আর কোনো কথা হয়নি।ভবিষ্যতে কবে হবে কিংবা আদৌ হবে নাকি নবনীতা জানে না।জানার ইচ্ছেও করে না।সে বেশ আছে তার জীবনে।আর যাই হোক,প্রতি মুহূর্তে মু’ত্যু ভয় নিয়ে তো আর ঘুরতে হয় না।নবনীতার জন্য এই জীবনই ঠিক আছে।ওসব ভিআইপি,চব্বিশ ঘন্টা গার্ড নিয়ে ঘুরা বড়লোকি জীবন তাকে টানে না,একটুও টানে না।
.
.
.
.
‘তুই কি জানিস আমি যে তোকে ভালোবাসি না?’ বেঞ্চে বসে পা দোলাতে দোলাতে প্রশ্ন করল ইজমা।
আদি তীর্যক চোখে তাকে দেখল।রুক্ষ স্বরে বলল,’তো আমি কি তোকে ভালোবেসে মরে যাচ্ছি?ফালতু কোথাকার!’
‘না সেটা না।তোর আর আমার একটা পার্থক্য আছে।’
আদি চোখ পাকায়।
‘সেটা কি?’
‘সেটা হলো আমি একজনকে ভালোবাসি।’
একেবারে ঠান্ডা উত্তর।অথচ আদি এমনভাবে চমকালো যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।বড় বড় চোখে পাশ ফিরে বলল,’সত্যি?নাকি মজা করছিস?’
‘সত্যি।’ ভীষণ কটকটে জবাব।
আদি ঝুকলো।চোখ সরু করে বলল,’কাকে পছন্দ করিস তুই?বাড়িতে কি জবাব দিবি?’
‘বাড়িতে কি জবাব দিব মানে?তুই সব সামলে নিবি।’
আদি খেঁকিয়ে উঠল,’থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দিব বেয়াদব।পরকীয়া করছিস,আবার বলিস তুই সামলে নিবি।’
ইজমা তার মাথায় একটা গাট্টা মেরে কটমট চোখে বলল,’পরকীয়া মানে?তোর সাথে বিয়ে হয়েছে আমার?ঐসব হাসবেন্ড হাসবেন্ড ভাইবস আমি তোর থেকে পাই না।’
আদির গায়ে লাগল কথাটা।সে ইজমার চেয়েও দ্বিগুন জোর দিয়ে বলল,’আর তোর থেকে তো আমি কোনো মেয়ে মেয়ে ভাইবসই পাই না।তুই একটা বেডা।’
সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর ফিসফিস করে বলল,’ছেলেটা কে?’
ইজমা মাথা নামায়।লাজুক হেসে বলে,’ইফাজ।’
‘ইফাজটা আবার কে?’ আদি কপাল কুঁচকে জানতে চাইল।
আবারো নিচু স্বরে সে জবাব দিলো,’ঐ যে আমার ডাক্তারটা।’
আদি চোখ বড় বড় করে তাকে দেখল।তারপরই আচমকা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।ইজমা ভড়কে গিয়ে বলল,’কি?এভাবে হাসছিস কেন?’
‘সিরিয়াসলি ইজমা! তোর চয়েজ এতো ক্ষেত? এতো সুন্দর সুন্দর ছেলে ফেলে তুই ঐ ডাক্তার আতেলটার প্রেমে পড়েছিস?ঐটাকে দেখতে আমার নবিতার মতো লাগে।’
কথা শেষ করেই সে আরো একদফা হেসে কুটি কুটি হয়।ইজমা রাগী রাগী মুখে তাকে দেখে।শেষে ভেঙচি কেটে বলল,’তো কি হয়েছে?সে যদি নবিতা হয়,আমি তবে সিজুকা হবো।তোর কোনো সমস্যা?’
আদি খিলখিল করতে করতে জবাব দিলো,’না,আমার কোনো সমস্যা নাই।’
তার হাসি থামে না।ইজমার বিরক্তি বাড়ে।সে অধৈর্য হয়ে বলে,’এমন ষাঁড়ের মতো হাসছিস কেন?থামবি তুই?রাগ হচ্ছে আমার।’
.
.
.
.
মেয়েটির নাম শাহানা।বয়স বারো।শাহবাগে ফুল বিক্রি করে।গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা।দুই দিকে দুই বেণী করে ফেলে রাখা।বেণীতে আবার লাল ফিতা বাঁধা।গোল গোল মুখটা অদ্ভুত রকমের মায়ায় ভরা।শাহানার বাড়ি নেত্রকোনা।গত বছর সে বাবার হাত ধরে ঢাকায় এসেছে জীবিকার তাগিদে।বাবা একটা ইটের ভাটায় চাকরি করে।আর সে শাহবাগে ফুল বিক্রি করে।
গত দুইদিন যাবত শাহানার মন খারাপ।এখানে কয়েকটা কলেজ পড়ুয়া ছেলে প্রায়ই এসে আড্ডা জমায়।মেয়েদের দেখলেই তারা অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে।শাহানাও বাদ যায়নি এসবের থেকে।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য মেয়েদের তারা কেবল মুখেই বাজে ইশারা করে।তবে শাহানাকে প্রায়শই ফুল কেনার নামে বাজে ভাবে স্পর্শ করে।তার মাঝে মাঝে বুক ফেটে কান্না আসে।তারা গরীব হতে পারে।তাই বলে যখন তখন তাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করার অধিকার কারো নেই।সে আর বাচ্চা না।সে কিশোরী।আদর আর অসভ্যতার মাঝের পার্থক্য টুকু শাহানা বুঝে।
সেদিন সে রোজকার মতোন ফুল বিক্রি করছিল।হঠাৎই দু’টো ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।শাহানা প্রথম দেখাতেই বুঝল এরা কেউ ফুল কিনবে না।সে তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে চাইল।একটা ছেলে আচমকা তার হাত চেপে ধরে বলল,’দাম কতো?’
শাহানা চমকায়।আমতা আমতা করে বলে,’গ গোলাপ?একটা বিশ টাকা।’
‘গোলাপ না।তোর দাম কতো?’
শাহানা স্তব্ধ হয়ে তার কথা শুনে।তার দাম মানে?মানুষের আবার কোনো দাম হয় নাকি?ছেলে দু’টোর চাহনি অদ্ভুত।এই চাহনি দেখলেই তার সমস্ত শরীর ঘিন ঘিন করে।সে হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল,এতেই বোধহয় হাতের বন্ধন আরো জোরাল হলো।
পাশ দিয়ে একটা ভিআইপি গাড়ি যেতে যেতেই তাদের দেখল।দেখামাত্রই ভেতরে থাকা মানুষটা ড্রাইভারকে ডাকল,’মোতাহের! গাড়ি থামাও।’
সে দ্রুত গাড়ি থেকে বের হয়।গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে ধমকে উঠে,’এ্যাই ছেলে! সমস্যা কি?হাত কেন ধরছিস?’
শাহানা পেছন ফিরে।দেখে তাদের চেয়ে কয়েক হাত দূরে ধূসর রঙের পাঞ্জাবি গায়ে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখতেই শাহানার দুই চোখে বিস্ময় খেলে।এটা তো একটা নেতা।দুই দিন পর পর সমাবেশে বক্তৃতা দেয়।
আরহাম আরো দুই কদম এগিয়ে আসলো।ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে শাহানার হাত ছেড়ে দিলো।সে তখনো তব্দা খেয়ে আছে।আরহাম সামনে এসেই কটমট করে বলল,’থাপ্পড় চিনিস?বাচ্চা একটা মেয়ে ফুল বিক্রি করছে।অসভ্যতা করছিস কেন?’
ছেলে দু’টো শুকনো ঢোক গিলল।তৎক্ষনাৎ শাহানার কাছে ক্ষমা চেয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ল।শাহানার চোখে মুখে তখনো রাজ্যের বিস্ময়।আরহাম চোখ সরু করে বলল,’নাম কি তোমার?’
সে তড়িঘড়ি করে উত্তর দেয়,’শাহানা।শাহানা খাতুন।’
‘ওহহ।ছেলেরা কি রোজ রোজ এমন করে?’
‘হু’
‘এরপর থেকে এমন করলে আমার অফিসে গিয়ে বিচার দিবে।ঠিক আছে?’
বলেই সে ঘুরে দাঁড়ালো।আজকে দুপুরে একটা মিটিং আছে।একটু পরেই মিটিং শুরু হয়ে যাবে।শাহানা তাকে পিছু ডাকলো,’ভাইয়া।’
সে পেছন ফিরে।জিজ্ঞাসু হয়ে শাহানার দিকে তাকায়।সে এগিয়ে এসে প্রশস্ত হেসে বলল,’আপনে অনেক ভালো ভাইয়া।আপনের মতো ভালো নেতা আমি আগে দেখি নাই।আল্লাহ আপনাকে অনেকদিন বাঁচাবে।’
আরহাম ভড়কে গিয়ে বলল,’আমাকে বলছ?আমি কি করলাম?’
‘এই যে আপনে আমাকে দেখে গাড়ি থামালেন।আমাদের জন্য এতো কিছু কেউ ভাবে না ভাইয়া।আপনে খুব ভালো।’
মুহূর্তেই তার মুখে হাসি ফুটল।সে বরাবরই প্রশংসায় গলে যায়।এই প্রশংসাটাও তার মনে ধরেছে।সে শাহানার হাতে থাকা ফুল গুলো দেখে চওড়া হেসে বলল,’এই মেয়ে! তোমার এই ফুল গুলোর দাম কতো?’
‘সবগুলো?’
হ্যাঁ সবগুলো।
‘দুই হাজার টাকা।’
আরহাম মানিব্যাগ বের করল।গুনে গুনে পাঁচটা হাজার টাকার নোট তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’এই নাও।দুই হাজার ফুলের।আর তিন হাজার আমার পক্ষ থেকে সালামি।’
শাহানার চোয়াল ঝুলে গেল।সে বিস্মিত হয়ে বলল,’এতো টাকা বকশিস?কেন?’
আরহাম ঠোঁট চেপে হাসল।মনে মনে উত্তর দিলো,’আমার প্রশংসা করার জন্য।’
অথচ মুখে বলল,’এমনিতেই।তোমাকে দেখে আমার ছোট বোনের কথা মনে পড়েছে তাই।’
শাহানা কাঁপা হাতে টাকাটা নিল।তার দুই চোখ কৃতজ্ঞতায় ভরা।এতোকিছুর মাঝেও সে মনে করে আবার বলল,’আপনে অনেক ভালো ভাইয়া।’
আরো একটা প্রশস্ত,মুখ ভর্তি হাসি।আরহাম প্রচন্ড ফুরফুরা মেজাজে গাড়িতে গিয়ে বসল।এইটুকু?ব্যাস এইটুকু কনসার্ন দেখানো তে মেয়েটা তাকে এতো ভালো বলল?এই সামান্য একটা আচরণে মেয়েটা এতো খুশি হলো?সাধারণ মানুষরা এতো সরল হয় কেন?এতো অল্পতেই নেতাদের প্রতি তারা তুষ্ট হয়ে যায়!
সে হাসি হাসি মুখ করে ব্যাক সিটে গা এলিয়ে দিলো।আচমকা তার ভেতর ভূত চেপেছে।ভালো নেতা হওয়ার ভূত।এর আগে তার সাথে যারা ভালো আচরণ করেছে,তারা সবাই তার ক্ষমতার দাপটে বাধ্য হয়ে ভালো আচরণ করেছে।তাকে শ্রদ্ধা করে,ভালোবেসে এতো সুন্দর আচরণ কেউ করেনি।শাহানার এই সামান্য কৃতজ্ঞতা তার ভেতরে একটা মিষ্টি পরিবর্তন এনে দিলো।
সে সিদ্ধান্ত নিল সে ভালো নেতা হবে।জনমানুষের নেতা।সে পার্টির পোষা কুকুর হবে না।সে হবে জনগণের ভরসার নেতা।ঠিক তার বাবার মতো।লোকে তখন বলবে আজিজ হোসেনের ছেলে ঠিক তার মতোই হয়েছে।আরহাম সামনে দেখতে দেখতে প্রশ্ন ছুড়ে,’মোতাহের! সত্যি করে বলো তো আমাকে তোমার কেমন লাগে?’
মোতাহের থতমত খায়।কোনোরকমে বলে,’ভালোই লাগে স্যার।’
‘তোমার কি মনে হয়,আমি যদি ভালো মানুষ হয়ে যাই,তবে কি তোমার ম্যাডাম আবার আমার কাছে ফিরে আসবে?’
মোতাহের কি জবাব দিবে?সে কেমন করে জানবে ম্যাডাম আসবে নাকি?তবুও সে স্যারকে খুশি করার জন্য বলল,’অবশ্যই আসবে।ম্যাডাম খুব নরম মনের মানুষ।’
আরহাম জবাবে কেবল হাসল।ফোন বের করে নবনীতার হাসি হাসি মুখটা দেখল।এই ছবিটা তার নিজের হাতে তোলা।নবনীতা যখন খালি মুখে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়,তখন আরহামের মনে হয় তার মতো সুন্দর মেয়ে এই পৃথিবীতে দু’টো নেই।সে এই অবস্থায় তার অগণিত ছবি তুলেছে।পুরোনো সেই ছবি গুলো সে মাঝে মাঝেই দেখে।ছবিটা দেখার পরেই সে মুচকি হেসে একহাতে সেটা স্পর্শ করল।অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে বলল,’জানো মোতাহের।তোমার ম্যাডাম তো ব্যবসা করছে।তোমার যদি ঘর সাজানোর জিনিস লাগে তবে তোমার ম্যাডামের কাছ থেকেই নিবে বুঝেছ?’
চলবে-